Advertisement
০৭ জানুয়ারি ২০২৫

ধর্মচ্যুত হননি কেরি সাহেবের মুনশি

তিনি সাহেবকে বাংলা শেখান, দোভাষীর কাজ করেন। খ্রিস্টগীতি লিখে মনিবকে তুষ্টও রাখেন। তাঁকে ছাড়া বাইবেল অনুবাদ হয় না। বাঙালির প্রতিভা ও পেশাদারিত্বের আর এক নাম রামরাম বসু। প্রমথনাথ বিশীর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’র শুরুটা এ রকমই।

অতীত: শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরির সমাধিক্ষেত্র। তাঁরই মুনশি রামরাম বসু প্রায় বিস্মৃত

অতীত: শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরির সমাধিক্ষেত্র। তাঁরই মুনশি রামরাম বসু প্রায় বিস্মৃত

পৃথা কুণ্ডু
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সালটা ১৭৯৩। সদ্য কলকাতায় পা রেখেছেন এক ইংরেজ পাদ্রি। উদ্দেশ্য, বাংলায় খ্রিস্টধর্মের প্রচার। কিন্তু তার জন্য এ দেশের ভাষা শেখা চাই, মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করা চাই। তাঁর আগেই এ দেশে আসা আর এক মিশনারি জাহাজঘাটে এই সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন চালাক-চতুর এক স্থানীয় সহকারীর। নাম বসুজা, সাহেবকে তিনি বাংলা শেখাবেন। সে কালে এই ধরনের সহকারীদের বলা হত ‘মুন্সী’ (মুনশি), ফারসিতে যার অর্থ ‘পণ্ডিত’। মানুষটির কথাবার্তায় প্রথম দিনেই সাহেব মুগ্ধ। তখনই তাঁকে নিজের ‘মুন্সী’ পদে বহাল করে নিলেন। মাসমাইনে কুড়ি টাকা।

প্রমথনাথ বিশীর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’র শুরুটা এ রকমই। তবে বাস্তব ঘটনাও বোধহয় খুব একটা আলাদা ছিল না। জাহাজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই রামরাম বসু উইলিয়াম কেরির সঙ্গী হয়েছিলেন কি না, সে কালের কলকাতার হাড়গিলে-অধ্যুষিত পথঘাট তাঁকে চেনাতে চেনাতে নিয়ে আসছিলেন কি না তা জানা নেই। তবে ইতিহাস বলে, ব্যাপটিস্ট পাদ্রি জন টমাস ১৭৮৩ সালে এ দেশে আসেন। উইলিয়াম চেম্বার্স-এর সুপারিশে তাঁর ফারসি জানা দোভাষী রামরাম বসুকে তিনি নিজের কাজে নিয়োগ করেন ১৭৮৭ সালের ৮ মার্চ। রামরাম টমাসকে বাংলা শেখাতেন, সেই সঙ্গে খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে আগ্রহের ভাব দেখিয়ে মনিবকে খুশি রাখতেন। টমাসের অনুরোধেই কেরি এ দেশে আসতে রাজি হন, আর টমাসই কেরির পরিচয় করিয়ে দেন রামরাম বসুর সঙ্গে।

রামরাম বসুর জন্মতারিখ নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না। তবে টমাস সাহেব ১৭৯২ সালে লিখে গিয়েছেন, রামরামের বয়স তখন প্রায় ৩৫। সে হিসাবেই ধরা হয় তাঁর জন্ম ১৭৫৭ সালে, সম্ভবত চুঁচুড়ায়। তাঁর বাল্যজীবন, শিক্ষা বা পারিবারিক বৃত্তান্ত সম্পর্কে তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। তবে বাংলা আর সংস্কৃতের পাশাপাশি কাজ চালানোর মতো ইংরেজি আর ফারসি তিনি রপ্ত করেছিলেন। উইলিয়াম চেম্বার্স-এর ফারসি দোভাষী হিসেবেই সম্ভবত তাঁর জীবিকার শুরু।

শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরির সমাধিফলক। ছবি: মোহিত রণদীপ

কাজ করতে করতেই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন সাহেবসুবো মনিবদের সন্তুষ্ট রাখার কৌশল। জিশুর নামে স্তব, গান লিখে মিশনারিদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। কেমন ছিল রামরাম বসুর লেখা খ্রিস্টবন্দনা? ‘কে আর তরিতে পারে/ লর্ড জিজছ ক্রাইস্ট বিনা গো’— এই জাতীয় রচনাকে খুব উচ্চস্তরের খ্রিস্টীয় দর্শন বা ভক্তিমূলক কবিতা হয়তো বলা যায় না, তবে তাঁর মিশনারি প্রভুদের মুগ্ধ করার পক্ষে তা ছিল যথেষ্ট।

এর পাশাপাশি রামরাম সম্পাদনা করেন বাইবেল-অনুসারী ‘গসপেল মেসেঞ্জার’-এর বাংলা সংস্করণ— ‘হরকরা’ নামে একটি বই। এ ছাড়াও হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে মিশনারিদের জন্য প্রচারপুস্তিকা তৈরি করে দেন। মনিবদের কাজে সহায়তার জন্যই হয়তো খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয়েছিল তাঁকে। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি উদার ছিল নিশ্চয়ই, তবে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তিনি যে মনেপ্রাণে অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন, তা কিন্তু মনে হয় না। তাঁর মিশনারি প্রভুরা খুব আশা করেছিলেন যে রামরাম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবেন, কিন্তু তাঁদের আশা পূর্ণ হয়নি। রামরাম চাকরি রক্ষার কৌশল আর ব্যক্তিগত ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেননি। ঔপনিবেশিক ধর্মপ্রচারে সাহায্য আর মিশনারি মনিবদের সন্তুষ্ট করেছেন এ কথা যেমন ঠিক, তেমনই ব্যবহারিক জীবনে কী ভাবে চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব আর খোলা মন নিয়ে চলতে হয়, সে বিষয়েও তিনি সে কালের বাঙালিদের মধ্যে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন।

সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হলেও রামরাম বসুর আত্মসম্মানের অভাব ছিল না, এ কথা কেরি সাহেব নিজেই লিখে গেছেন। এমনিতে ‘সরল’ ও ‘মধুর’ প্রকৃতির মানুষ হলেও, কেউ দুর্ব্যবহার করলে তিনি তা মেনে নিতেন না। কেরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও একরঙা ছিল না। তাঁর সহায়তায় ভরসা করেই বাইবেলের বাংলা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন কেরি। আবার, এক বিধবা মহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে এক সময় রামরামের উপর বিরক্ত হয়ে তাঁকে মুনশির কাজ থেকে বরখাস্তও করেছিলেন তিনি। এই সম্ভাবনার আলোতেই বোধহয় প্রমথনাথ তাঁর উপন্যাসে ‘টুশকি’ চরিত্রটির পরিকল্পনা করেছিলেন। সংসারে অশান্তির জ্বালায় বিরক্ত বসুজা টুশকির কাছে মানসিক শান্তি খোঁজেন, তার ঘরে বসেই লেখালেখি করেন।

রামরামের সঙ্গে সাময়িক তিক্ততা সত্ত্বেও, এ দেশে কাজ করতে গেলে এই মানুষটিকে ছাড়া যে তাঁর চলবে না, এ কথা কেরি সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন। ১৮০০ সালে উইলিয়াম ওয়ার্ড আর জোশুয়া মার্শম্যানকে নিয়ে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস গড়ে তোলেন কেরি। ফের ডাক পড়ে রামরাম বসুর। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কেরির অধীনে বাংলা বিভাগ চালু হলে রামরাম বসুকে সহকারী মুনশি ও বাংলার দ্বিতীয় পণ্ডিত নিযুক্ত করা হয় মাসিক ৪০ টাকা বেতনে। ফোর্ট উইলিয়াম-এর লেখকগোষ্ঠীর হাত ধরেই গোড়াপত্তন হয় আধুনিক বাংলা গদ্যের। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, গোলকনাথ শর্মা, চণ্ডীচরণ মুন্সী, রামরাম বসু প্রমুখ এই কলেজের ছাত্রদের জন্য বাংলা পাঠ্যপুস্তক লেখার কাজে নিযুক্ত হলেন। রামরাম লিখলেন প্রাচীন বাংলার ‘বারো ভুঁইয়া’দের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে একটি জীবনীমূলক গ্রন্থ। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ নামে এই বইটি শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হল ১৮০১ সালে; আর সেই সঙ্গে ইতিহাসেও জায়গা করে নিল। এর জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাউন্সিল থেকে তাঁকে পুরস্কৃত করাও হয়েছিল। বাংলা ভাষায় বাঙালির লেখা প্রথম গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয় রামরাম বসুর এই বইকে। সমকালীন অন্যান্য পণ্ডিত যেখানে মূলত সংস্কৃতগন্ধী ভাষার পক্ষপাতী, রামরাম বসুর ভাষা সেখানে ফারসি-প্রভাবিত। সে কালের ব্যবহারিক বাংলা কেমন ছিল, আন্দাজ পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। তাঁর বিষয়ও ছিল মৌলিক— ‘হিতোপদেশ’, ‘পঞ্চতন্ত্র’ অনুবাদের পথে হাঁটেননি তিনি।

১৮০২ সালে ‘লিপিমালা’ নামে বিভিন্ন কাজের সহায়ক একটি চিঠিপত্রের সঙ্কলন প্রস্তুত করেন রামরাম বসু। মিশন প্রেস থেকে ছাপা হয় এটিও। জীবিকার তাগিদে খ্রিস্টসঙ্গীত, খ্রিস্টীয় সাহিত্যের অনুবাদ ইত্যাদি রচনা করলেও ‘লিপিমালা’র সূচনায় পরম ব্রহ্মের প্রতি প্রণাম জানিয়েছেন রামরাম। তা হলে কি ব্রাহ্ম ধর্মের অনুভূতি-বীজ কোনও ভাবে তাঁর মধ্যে দেখা দিয়েছিল? তাঁর উপর রাজা রামমোহন রায়ের প্রভাব কতখানি ছিল, সে বিষয়েও নানা জনের নানা মত। অনেকে বলেন, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তিনি রামমোহনকে দিয়ে সংশোধন করিয়ে নিয়েছিলেন। আবার রামমোহনের জন্যই নাকি তিনি শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান হননি, এমন মতও প্রচলিত। এ সব কিছুর অনেকটাই হয়তো কিংবদন্তি। রামরাম কোনও বড় মাপের সংস্কারক ছিলেন না, তাঁর কাজের পরিধিও সীমিত। তবে আধুনিক বাংলার প্রথম যুগের লেখক হিসেবে এক সংস্কারমুক্ত মননের শরিক ছিলেন তিনি, সে কথা বলাই যায়।

রামরাম বসু সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তাতে মনে হয়, কোম্পানি আমলের বাংলায় যে পরিবর্তন, যে আত্মপরিচয়ের সমস্যা-সঙ্কট দিয়ে বাঙালির আধুনিকতার সূচনা— তার প্রতিফলন তাঁর জীবনে পুরো মাত্রায় ঘটেছিল। তাই আজকের বাঙালি তাঁকে মিশনারিদের এক সাধারণ বেতনভুক মুনশি হিসেবে মনে রাখবে, না কি এক উদারপন্থী মানুষ, বাংলা গদ্যের ভিত গড়ার অন্যতম কারিগর হিসেবে মনে রাখবে, এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া সহজ নয়। ‘রামরাম বসুকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম শুকতারা বলা যেতে পারে,’ লিখেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, তাঁর ‘রামমোহন রায় ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য’ বইয়ে।

১৮১৩ সালের ৭ অগস্ট প্রয়াত হন রামরাম বসু। এ বছর তাঁর মৃত্যুদিনেও হয়তো আকাশ থাকবে একই রকম নীল, বাতাস বইবে রোজকার মতো, কেউ কিছুই মনে রাখবে না— ঠিক যেমনটি কল্পনা করেছিলেন প্রমথনাথ বিশী, তাঁর উপন্যাসের শেষ অংশে। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা চরিত্র হয়েই রয়ে যাবেন ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’।

অন্য বিষয়গুলি:

William Carey Carey Saheber Munshi Literature History Ramram Basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy