দশ বছর বয়সে আমার অগাধ সম্পত্তি ছিল। সাতটা নতুন পুজোর জামা, তিনটে স্কুল-ড্রেস। চাচা চৌধরীর কমিকস, বুরাতিনো পুতুল। ঘরের দেওয়ালে ছবি আঁকা ছিল সবুজ সায়রের ওপর হলদে নৌকোয় বসে নীলকেশী কন্যে আনমনে ভাবছে, আর তার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে কাঠঠোকরা। ঘর থেকে বেরলে চওড়া সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়িরই তিন নম্বর ধাপে গামবুটটা জিরোত। আমার বাবার ঠাকুরদার কেনা। বাড়িতে তাঁর নিশানা রয়ে গেছে বাঘমুখো লাঠি, খানকয় তেলের ছবি, আর এই একখানা বিদেশি গামবুট। সব ক’টার বয়স একশোর কাছে। লাঠিটা ক্ষয়ে গেছে, ছবিগুলো চটে গেছে। কিন্তু, বুটটার স্বাস্থ্য টসকায়নি। বৃষ্টি নামলেই সে জেনারেশনের পর জেনারেশন আমাদের বংশের পদসেবা করেছে। প্রপিতামহের পর ঠাকুরদা পরেছেন। জ্যাঠামশাই পরে জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছেন। বাবা পরে ঝমাঝম বৃষ্টিতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আদা দিয়ে চা খেয়েছে। ফলে আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। এক দিন ঠিক বাবার মতো বড় হয়ে হ্যাটকোট চাপিয়ে আপিস যাব, ফেরার পথে তেড়ে বৃষ্টি হবে, হাতে ঝুলবে চকচকা ইলিশ আর পায়ে ওই জুতোজোড়া।
কিন্তু ইতিমধ্যে একটা ভয়ানক ছন্দপতন ঘটে গেল। আমি ক্লাস ফাইভে উঠলাম এবং বাড়িতে আমার জন্য অঙ্ক মাস্টার এলেন। কান মলতেন না বটে, কিন্তু উঠতে-বসতে তাঁর বিদ্যেবতী কন্যের গল্প হজম করতে হত। সে ক্লাস থ্রি থেকেই কেমন ঝাঁ-ঝাঁ অ্যালজেব্রা কষত, কবে রামানুজন মেডেল পেল, অঙ্কের অলিম্পিকে কী করে চ্যাম্পিয়ন, এখন ম্যাথস-এ পিএইচডিইএফজি না কী যেন করে। ধুস।
জুলাই আসতেই মাস্টার আমাকে নিয়ে আদাজল খেয়ে লাগলেন। হাফিয়ার্লি নকিং অ্যাট দ্য ডোর। একটা রোববারও হাজির হলেন। সে সন্ধেয় উনি পড়াতে বসতেই শোঁশোঁ করে সাইক্লোন উপস্থিত হল। গাছ-টাছ ছিঁড়ে শুরু হল মুষলধারায়। চটপট জল জমে গেল। মাস্টার সেই সুযোগে আরও জাঁকিয়ে বসলেন। বিদঘুটেতম সরল, বাঁশের ওপর ওরাংওটাং, চৌবাচ্চার হিসেবনিকেশ। একটাও তো পারছি না। কারণ, আমি তো মনে তার চেয়েও শক্ত পাটিগণিত সল্ভ করছি। ঘণ্টায় সত্তর মিলিমিটার হিসাবে, কুড়ি মিনিট নাগাড়ে বৃষ্টি হলে একটা পাড়ায় জল জমে যায়। সেই জল প্রতিটা নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। পাড়ায় নর্দমা আছে, উম্ম্ম্, এগারোটা। তা হলে আকাশ আর নর্দমা সবক’টার পাইপ এক সঙ্গে খোলা থাকলে জমা জল সরে যেতে কত ক্ষণ সময় নেবে অ্যাঁ? মাস্টার কি আজই সারা রাত দুলে দুলে কেসিনাগ শেষ করাবে?
এই সময় ‘গেল রে, কী আক্কুটে কুকুর গো!’ চিৎকারে বই উলটে টেবিল ছিটকে বেরিয়ে দেখি, আমার তকাইসোনা মাস্টারের জুতোর এক পাটি ফালা ফালা করে ন্যাজ নাড়ছে। (ভাবখানা, দ্যাখো দিদি, শোধ নিইছি)। মাস্টারও নড়ে গেলেন। ‘এহে, জল তো নামবে না। বাড়ি যাই কী করে বলো দেখি!’ বাবা বলল, আমাদের গামবুটখানা নিয়ে যান। ও এক আশ্চর্য জুতো। সব্বার পায়ে ফিট করে। পায়ে পরলে গায়েও জল পড়তে পায় না।
গামবুট মাস্টারের পায়ের সঙ্গে থফথফ করতে করতে চলে গেল। কিন্তু কেউ আর ফিরল না। গামবুটও এল না। মাস্টারও না। টানা তিন দিন অ্যাবসেন্ট থাকার পর তাঁর নম্বরে ফোন গেল। বাজখাঁই নারী-কণ্ঠ জানালেন, ‘গ্রামের বাড়িতে দিদির বাড়াবাড়ি। এক কাপড়ে দৌড়েছেন। ফিরলে খবর পাবেন।’ তার পর দুম। মাস্টারমশাই বুটসহ চিরতরে গুম!
গুড়ুম করে গুলি চালিয়ে কে যেন আমার বুকের ঠিক মধ্যিখানটা ফুটো করে দিল। অত কষ্ট দেখে সে বার বরুণঠাকুর আলাদা করে প্ল্যান ভাঁজলেন। বেছে বেছে স্কুলে যাওয়া-আসার টাইমে বালতি বালতি ঢালতে লাগলেন। সঙ্গে সারা দিন কী স্যাঁদা বাতাস বইল! স্কুলের কেড্স তো মিইয়েই রইল। ক্লাসে নোটিস এল, বর্ষার সময়টা ইশকুলের বজ্রাইন শিথিল হবে, তোমরা সব বৃষ্টির জুতো পরে এসো। সকলে কান এঁটো করে হাসল।
পর দিনই প্রেয়ারের লাইনে ছোট অনন্যাদির প্রচণ্ড চেঁচামেচি— ‘এইগুলি তোমাদের বর্ষার জুতা?!’ ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’র হিলহিলে লাল হিল, কুছ কুছ হোতা হ্যায়-এর গ্লাস ওয়েজি, প্রীতি জিন্টা-র ফুলেল স্লিপারস! সব্বাই নিষ্পাপ মুখে সমবেত মিনমিনে জানালাম, ‘দিদি, পাড়ার দোকানে এ রকমই পাওয়া যায়।’ বলেই সবাই মানে-মানে সটকে পড়ছি, অনন্যাদি তুরুপের তাসটা খেললেন, ‘অ্যাই শোনো। বৃষ্টি হলে, হাতে একটা পলিথিনের প্যাকেট নেবে। তাতে স্কুলের কেড্স ঢোকাবে। তার পর তোমাদের এই কিম্ভূত জুতো পরে স্কুল পর্যন্ত আসবে। এর পর, স্কুলের গেটের সামনে এসে প্লাস্টিক থেকে বের করে কেড্স পরবে, বৃষ্টির জুতো প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে তবে স্কুলে ঢুকবে। বেরবার সময় কেড্সই পরে বেরবে। স্কুলের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেড্স খুলে হাতে নিয়ে নিজেদের অসভ্য জুতো পরে যাবে।’
তবে বেশি দিন এ ব্যবস্থা চলল না। কারণ, পর দিন থেকে স্কুল শুরু আর ছুটির সময়ে স্কুলের গলিতে সাংঘাতিক জ্যাম হতে লাগল।
কলেজে উঠে নিজগুণে শপিং করা শিখলাম। নব্য গজিয়ে ওঠা সিটি সেন্টার, ফোরাম, ইমামি মার্কেটের দরজা-জানলায় আমি খ্যাপার মতো খুঁজে খুঁজে ফিরি পরশপাথর। ‘ও কাকু, রেনি শু আছে?’ ‘আঁক— কীঃ?’ ‘ওয়াটারপ্রুফ জুতো?’— পিনড্রপ সাইলেন্স! ‘মনসুন স্লিপার্স বললাম তো, কী দেখাচ্চেন? এ তো জলে নষ্ট হয়ে যাবে।’ ‘নিয়ে যান না দিদি, এক বছর পেস্টিং গ্যারান্টিড।’ ‘আরে ধুর। জলে আঠা খুলে গেলে কি বৃষ্টি মাথায় ট্যাক্সি ধরে আপনার কাছে আসব?’
ওই ঘোর বর্ষাতেই আমার এক প্রাণের বন্ধুর বিয়ে লাগল। আমি তো কার্ড পেয়ে এক গঙ্গা জলে। কোথায় পাই বৃষ্টির জুতো কাম বিয়েবাড়ির স্যান্ডাল কাম লেহেঙ্গার পার্টনার? নেমন্তন্ন করলেই হল? বৃষ্টির মরশুমে বিয়ে করছে কেন? শেষে কি হাওয়াই চটি পরে যাব? বন্ধুটি বলল, তোর চিন্তা কী রে? পাড়াতেই তো বিয়েবাড়ি, তোর বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটে। রিকশা ধরবি, উঠবি, নামবি।
এমনি একটা চকোমকো জুতো পরেই গেলাম। কিন্তু, বর আসতে যেই না তাকে দেখব আর বাকিদের গোলাপ দেব বলে বাইরের রাস্তায় বেরিয়েছি, কৌতূহলের আতিশয্যে একটা জল-কাদা ভর্তি খন্দে পা দিয়ে বসলাম। আর যায় কোথা! ফচাৎ করে কাদা উঠে শাড়িতে নতুন ডিজাইন। কিন্তু আরও ভয়ংকর কথাটা হল, মটাৎ করে আমার এক পায়ের হিল মুটকে খট করে বেরিয়ে এল। ফলে, আমার অবস্থা কর্ণের মতো। রথের চাকা, মানে জুতোর হিল বসে গিয়েছে। সেই বিশ্বাসঘাতক হিলের ভাঙা টুকরো হাতে আবার একটা রিকশা ডেকে চেনা মুচির কাছে ছুটলাম। কিন্তু জুতোর হিল প্লাস্টিক সার্জারি করে সে যে কথাটা বলল, আমার প্রাণ আবার উড়ে গেল। ‘এ যুতো গিয়েছে গো দিদি, বেশি ক্ষণ চলবেনি। তুবু আমি সিলাই করে দিছি। তুমি বেশি নোড়োচোড়োনি যেন। নড়লি পরেই আবার ভেঙি যাবে।’
বিয়েবাড়িতে ফিরে একটা চেয়ার পাকড়ে তাতে সেই যে বসলাম, আর উঠলামই না। বন্ধু কনের সিংহাসন থেকে মেহেন্দি-পরা হাতে কত ডাকল, শেষে হাত উঁচু করে মারও দেখাল। আমি ওখানেই বসে বসে মাথা দোলালাম। তার অর্থ কী আমি নিজেও জানি না। একজন মুখচেনাকে বলেকয়ে খাবারের প্লেটও ওই চেয়ারেই আনিয়ে নিলাম। ফোন করতে, বাবা রিকশা করে এসে বাড়ি নিয়ে গেল। ফিরে, বন্ধুকে লম্বা এসএমএস করলাম, বিয়েবাড়িতে পরার মতো বৃষ্টির জুতো নেই বলে আজ খুব অসুবিধা হয়েছে। জুতো না কিনলে তোর কনেযাত্রীও যাওয়া হবে না রে। স্যরি রে। সে কী বুঝল কে জানে, আমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি করে দিল!
তার পর আমার সিভিতে ঢুকল চাকরি, পার্সে এটিএম, চুলে হাইলাইট। ঠিক এই সময়েই ঋতু পরিবর্তনের চেনা চাকাটা কে যেন শনশন করে আবোলতাবোল ঘুরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ল। শীত থাকে জানুয়ারির তিন দিন, গোটা বছরটাই গ্রীষ্ম। হেমন্ত-বসন্ত লাপাত্তা। বর্ষা আসে নিম্নচাপের ঘোড়ায় চেপে, প্যান্ডেল হওয়া, কেনাকাটা আর পুজো দেখতে। তবে, কলকাতায় এখন শপিং মল দেবতার কৃপায় টি-রেক্সের দুধও মেলে। এক বিরাট নামী ব্র্যান্ডের দোকানে উঁকি দিতে, বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠল। ব্যানার টাঙিয়েছে ‘হ্যাপি রেনি ডে’। তার নীচে রামধনু। না না। এক রাশ রঙিন ফ্লোটারস-স্কিমারস। তাদের রূপের ছটায় চোখ যেন অন্ধ হয়ে গেল। রাজহাঁসের মতো দেখতে একটাকে হাতে তুলতেই সারা শরীরে যেন টুংটাং। রেওয়াজ করা সেল্স-কণ্ঠ বেজে উঠল ঠিক আমার পিছনে— ‘আপনার পায়ের মাপে দেখাই ম্যাডাম? এগুলো আজই ব্রাজিল থেকে এসেছে। আমাজন-অববাহিকার জুতো। সেখানে যে গুল্ম জলে ভেসে থাকে তার...’ আরও কী কী বলে চলল সে, আমি যেন শুনলাম বলছে, কুমিরের আঁশ, বাঁদরের রস! কোনও রকমে বলতে পারলাম, ‘জলে কিচ্ছু হবে না বলছেন?’ ‘পরে সোজা সাগরে নেমে যান ম্যাডাম।’
আমি যখন সে জুতো পায়ে ফিরছি, ধোঁয়া-ধোঁয়া বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। পিছল রাস্তায় কুৎসিত জ্যাম, জলে ডোবা নিয়ন আলো, বেসময়ের বৃষ্টিতে বাড়ি ফিরতে নাকাল হওয়া শয়ে-শয়ে মানুষ। আমি সবাইকে কাটিয়ে চলতে লাগলাম। মনে হল, হাঁটছি কোথায়? জল কেটে সাঁতরে চলেছি।
সে বার অক্টোবরে বন্যা এল, পুজো সপ্তমী থেকে ভাসল। বাবুবাগানের জলে-কাদায় যখন আমি হিমশিম, আমার জুতো আমাজনের ট্রেনিং প্রাণপণ মুখস্থ আওড়াবার চেষ্টা করল, কিন্তু খাবি খেয়ে তুতলে একশা! আর এক বার বিদ্যুৎ চমকাতেই মুহূর্তে ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। জুতো খুলে হাতে করে বুকে তুলে ছাতা দিয়ে প্রাণপণ আড়াল করলাম তাকে। খালি পায়ে কলকাতার রাস্তার কামড় খেতে খেতে এগিয়ে চললাম বীরদর্পে। আমার চাইতে এ জুতোর দাম অনেক বেশি।
তখনই ঠিক করলাম, ভারী জলঝড়ের জন্যে একটা কাঠখোট্টা জুতো কিনতে হবে। পেয়েও গেলাম। দোকানের শো-রুমেই দেখে মনে হল, আরে! এ তো আমার সেই গ্রিনহ্যাম সায়েবের জুতোই, শুধু নতুন জন্ম নিয়েছে বলে আর একটু বেশি কদাকার আর দামি! দু’সপ্তাহ মতো সেই জুতো পরে দাপিয়ে বেড়ালাম অফিসে, আইনক্সে, নাইটক্লাবে, লং ড্রাইভে। তার পর বর্ষার তেজ বাড়ল। আমি তো ডগোমগো। সব ঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে। এক দিন বৃষ্টি আসতে যখন সবাই হুড়মুড় করে শেড খুঁজছে, আমি ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি ভাব নিয়ে ছাতা খুলে জাহাজ-জুতো পায়ে দিয়ে এমনি এমনি একটু হেঁটে আসতে গেলাম। মনে মনে গাইছি, বৃষ্টি আমার পুত, জল আমার ঝি। গ্রিনহ্যাম বাবু সঙ্গে আছেন ভয়টা আমার কী?
ধড়াম। শিস দিতে দিতে সামনে মাঠের জলে ভেজা সবুজ ঘাস দেখছিলাম, হঠাৎ দেখলাম নাকের ডগায় এবড়োখেবড়ো নুড়ি পাথর। চার পাশের লোকজন কী হল কী হল বলে উঠল। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠতে বুঝলাম বাঁ হাটুর ভেতর দিয়ে দু’পাশে কী সব যেন ভূমিকম্পের রাস্তাঘাটের মতো ধুপধাপ বসে গেল। ডাক্তার বললেন, তিন হপ্তা বেডরেস্ট উইথ মিনিমাম মুভমেন্ট। ও দিকে এখনই রোজ লাগ-ঝমাঝম। চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে, জানলা দিয়ে শ্রাবণ দেখি আর কান্না গিলি। টিভিতে শ্রদ্ধা কপূর আর টাইগার শ্রফ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেও কঠিনস্য কঠিন স্টেপে দুদ্দাড়িয়ে নাচে। এত তাড়াতাড়ি পা চালায়, কী জুতো পরেছে ঠিক ঠাহর হয় না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy