রচনাগৃহ: শিলংয়ের রিল বং অঞ্চলের সেই বাড়ি ‘জিৎভূমি’। কবির ‘রক্তকরবীর’ জন্মস্থান।
তারিখটি ছিল ১৯২৩ সালের ২৬ এপ্রিল। রবীন্দ্রনাথ বোলপুর ছাড়লেন প্রিয় শৈলশহর শিলঙের উদ্দেশে। ঠিক এর আগে চলেছে বারাণসী, লখনউ, বোম্বাই, পোরবন্দর, করাচি, ইত্যাদি স্থানে চল্লিশ দিনের টানা সফর। শিলঙে পৌঁছে শোভনা দেবী ও নলিনী দেবীকে লিখলেন নব্বই পঙ্ক্তির পত্র-কবিতা ‘শিলঙের চিঠি’— “গর্মি যখন ছুটল না আর পাখার হাওয়ায় শরবতে,/ ঠাণ্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলঙ-নামক পর্বতে।/ মেঘ-বিছানো শৈলমালা গহন-ছায়া অরণ্যে।/ ক্লান্তজনে ডাক দিয়ে কয়, ‘কোলে আমার শরণ নে।...’”
কবি এসে উঠলেন শিলঙের রিল বং অঞ্চলে। বাড়ির নাম ‘জিৎভূমি’। মালিক ছিলেন ডা. দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ইনি রবীন্দ্রনাথের সুকণ্ঠী ভাইঝি অভিজ্ঞা দেবীর স্বামী। লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার ভায়রাভাই। যক্ষ্মারোগে অভিজ্ঞার অকালমৃত্যুর পর মনীষা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। অভিজ্ঞা, মনীষা দুজনেই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা, যথাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম সন্তান।
শিলঙে কবির সঙ্গী কন্যা মীরা দেবী, নাতনি বুড়ি (নন্দিতা), রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর ‘গৃহীতা’ পুপে, কবি যার নাম রেখেছিলেন নন্দিনী। সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারীর কন্যা প্রিয় রাণু এবং আমেরিকার সমাজসেবিকা গ্রেটেন গ্রিন। শিলং আসার দিনকয়েক পরে ১১ মে রবীন্দ্রনাথ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে ‘নাটক গোচের একটা কিছু’ লিখবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। এক মাস পর ‘শিলঙের চিঠি’তে লিখছেন— “জানলা দিয়ে বৃষ্টিতে গা ভেজে যদি ভিজুক তো, / ভুলেই গেলাম লিখতে নাটক আছি আমি নিযুক্ত।”
‘নাটক গোচের একটা কিছু’ থেকে ‘লিখতে নাটক আছি আমি নিযুক্ত’ এই দুই পরিস্থিতির মাঝখানে আছে এক সোনালি পর্ব, কবির দুঃখ-সুখের অনিরুদ্ধ উৎসার।
প্রেক্ষাপট
এই উৎসরণ সহজ নয়, জটিল। আধুনিক কালের স্বদেশ ও বিদেশ থেকে উৎপন্ন রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ মনোব্যথার শিল্পরূপ। সুকুমার সেন বলেছেন, নাটকটি ‘রবীন্দ্রনাথের কঠিনতম ভাবনাট্য’। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের আলাপচারিতা সূত্রে জানা যায়, ১৯২৩-এ রবীন্দ্রনাথ যখন শিলঙে ছিলেনতখন রাধাকমলও ছিলেন শিলঙে। কবির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হত প্রায়ই। প্রভাতকুমারেরকথায়, “রাধাকমল অল্পকাল পূর্বে বোম্বাইয়ের শিল্পকেন্দ্রের শ্রমিকদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছিলেন— সেই সব কথা তিনি কবির কাছে গল্পচ্ছলে বলেন।... কবি খুব মনোযোগ দিয়া তাঁহার কথাগুলি শুনিতেন।” রাধাকমল কথিত শ্রমিকদের দুর্দশার কথা রবীন্দ্রচিত্তকে স্পর্শ করেছিল। প্রভাতকুমারের উক্তি, “যান্ত্রিকতা মানুষের সহজ শক্তি-সৌন্দর্যকে নষ্ট করিয়া স্তূপীকৃত বস্তুপিণ্ডের উপর তাহার সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে প্রবৃত্ত; সেই বেদনা রূপকে রূপ লইয়াছে ‘যক্ষপুরী’ তথা ‘রক্তকরবী’ নাটকে।”
‘মুক্তধারা’ নাটকের আড়ালেও মানুষের সমাজকে যন্ত্রে বা পুতুলে পরিণত করার প্রক্রিয়ার বাস্তব ছবি রয়েছে, রয়েছে বন্দিত্বের শিকল ভাঙার কথাও। ‘রক্তকরবী’-তে হাত দেওয়ার এক দশকেরও আগে থেকেই বিদেশে ও দেশে যন্ত্রদানব ও মানুষ বা শ্রমিকদের নানা সংঘাতচিত্র কবির মনকে আঘাত দিয়ে আসছিল। ১৯১৭-তে আমদাবাদে শ্রমিক জাগরণ, ১৯২১-এ ট্রেড ইউনিয়ন সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা, তার উপর রাশিয়ার বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ— কোনও ঘটনাই অজানা ছিল না কবির।
বিশ্বজোড়া যন্ত্রের প্রসার, পশ্চিমের দেশে পুঁজিবাদী কাণ্ডকারখানা সংবেদনশীল কবিচিত্তে সমানে আঘাত করে চলেছিল, রুদ্ধ বেদনার গণ্ডি থেকে কবিও মুক্তি পেতে চাইছিলেন তাঁর কলমের সহায়তায়। রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’কাব্যের দ্বিতীয় কবিতাটির নাম ‘বিজয়ী’। সেখানেকবি কী লিখেছেন?—
“...চমকে উঠেই হঠাৎ দেখে অন্ধ ছিল তন্দ্রামাঝে।/ আপনাকে হায় দেখছিল কোন স্বপ্নাবেশে/ যক্ষপুরীর সিংহাসনে লক্ষমণির রাজার বেশে/ মহেশ্বরের বিশ্ব যেন লুঠ করেছে অট্ট হেসে।...” ‘বিজয়ী’ ১৩২৪ বঙ্গাব্দে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। অর্থাৎ একটা ছক তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই।
‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি’-তে কবি জানিয়েছেন, বয়স ‘ষাটের আরম্ভে একবার আমেরিকা গিয়েছিলুম।’ ইতিহাস বলছে, সময়টা ১৯২০-র অক্টোবর থেকে ১৯২১-এর মধ্য-মার্চ। কবি তখনই আমেরিকাতে যক্ষপুরীর বহিরঙ্গ-অন্তরঙ্গ সব ছবিই চোখে দেখেছেন। লিখেছেন, “যেদিন ভাবুকতার ঔদার্য থেকে রিক্ত আমেরিকাকে দেখলুম সেদিন দেখি সে ভয়ংকর ধনী, ভয়ংকর কেজো, সিদ্ধির নেশায় তার দুই চক্ষু রক্তবর্ণ।”
কবি যখন শিলং এসেছেন, তখন তিনি অভিজ্ঞতা ও বেদনার জলভরা মেঘ, ‘নাটক গোচের’ সৃষ্টিপথে তাঁর বর্ষণ। বারিধারায় ধন্য হল শিলং, ধন্য জিৎভূমি। কবির জীবনে শিলঙের এক বিশেষ মানে আছে। বহুদিনের রুদ্ধ বেদনা প্রকাশ পেয়েছে নাটকের আঙ্গিকে তাঁর প্রিয় ‘শিলং নামক পর্বতে’।
খসড়া, নামপ্রসঙ্গ এবং...
সৃষ্টি এবং সংস্কারের সূত্রপাত শিলং পাহাড়ে। ষোলো মাস পর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তার প্রথম মুদ্রিত রূপ। কবির ইচ্ছে-অনুযায়ীই প্রকাশে বিলম্ব ঘটল, নয়তো ১৯২৩-এর পূজা সংখ্যাতেই দেখা দিত ‘রক্তকরবী’। যত দিন না প্রকাশ পেয়েছে, তত দিনই কবি সংস্কার করেছেন বার বার। ১৯২৬-এর ডিসেম্বরে নাটকের গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগেও কবির ইচ্ছে ছিল ছোটখাটো কিছু পরিবর্তনের।
‘রক্তকরবী’-র মোট দশটি খসড়া বা পাণ্ডুলিপির মধ্যে ন’টি আছে বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবনে। একটি পাণ্ডুলিপি-নির্ভর মুদ্রিত রূপ পাওয়া যায় ‘বহুরূপী’ পত্রিকার মে ১৯৮৬ সংখ্যায়। ‘রক্তকরবী’ সংক্রান্ত আরও দুটি খসড়া ও ‘রক্তকরবী’র ইংরেজিঅনুবাদ ‘রেড ওলিয়েন্ডার্স’-এর পাণ্ডুলিপিও রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত।
কবিকণ্ঠে নাটক পাঠ-অনুষ্ঠান হয়েছিল শিলঙে। সভায় উপস্থিত শিলঙের সাহিত্যপ্রেমী হেম চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪১ সালে লেখা স্মৃতিকথায় মুদ্রিত নাটকের নামই দিয়েছেন। মাসখানেক পরের কথা। সীতা দেবীর কলমে, “শুনিলাম নূতন একখানি নাটক লিখিয়া আনিয়াছেন, সকলকে শুনিবারজন্য ডাকিয়া পাঠাইলেন। নাটকটির প্রথম নামকরণ হয় ‘যক্ষপুরী’, পরে বদলাইয়া ‘রক্তকরবী’নাম দেন।”
কবি শিলং থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে বেশ অল্প সময়ের মধ্যে তিন বার নাটকটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। এক বার উপস্থিত ছিলেন মেধাবী আশ্রমিক সৈয়দ মুজতবা আলী। মুজতবা বন্ধু সয়ফ্-উল আলম খানকে লিখছেন, “রবিবাবু একটা নূতন ড্রামা লিখেছেন, সেটার নাম বোধ হয় যক্ষপুরী। সেদিন সেটা পড়লেন। খুব ভালোই লাগল। তবে বড্ড complicatedবলে মনে হয়। দেখা যাক, বেরুলে লোকে কি বলে। তবে কেউ কেউ বলে মুক্তধারার চাইতে নাকিসহজ হয়েছে।”
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী-তে বলা হয়েছে, “শান্তিনিকেতন পূজাবকাশের জন্য বন্ধ হইল ২৫ আশ্বিন ১৩৩০, ১২ অক্টোবর ১৯২৩। কবি আশ্রমেই থাকিলেন; বিজয়াদশমীর দিন তিনি ‘যক্ষপুরী’ নাটক পড়িয়া শুনাইলেন; কিন্তুএখনও মনের মতো হইতেছে না; তাই প্রকাশের তাড়া নেই।”
এ বার নাটকের নামপ্রসঙ্গটি কবির দিক থেকে দেখা যাক। ১১ মে ১৯২৩ শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে জানাচ্ছেন, একখানা নাটক লেখায় ও আর একখানা নাটকের [বিসর্জন] অভিনয়-ব্যাপারে তিনি ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। অন্য চিঠিতে জানালেন, নতুন নাটক পড়া হয়ে গেছে। কোথাও কিন্তু নামের উল্লেখ করছেন না কবি।
৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৩-এ ‘প্রবাসী’-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে ‘যক্ষপুরী’ নামের উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন তাঁর একটি মনোবাসনার কথাও— “যক্ষপুরী নাটকটি প্রবাসীর পূজার সংখ্যায় (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯২৩) প্রকাশ না করিয়া ফাল্গুন বা চৈত্র মাসে প্রকাশের ব্যবস্থা যদি করেন তবে ভালো হয়। অভিনয়ের পূর্ব্বে আমি উহার বাহির করিতে ইচ্ছা করি না।” রামানন্দ রবীন্দ্রনাথের অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে পরের বছর, অর্থাৎ রচনার ষোলো মাস পরে, পূজা-সংখ্যায় (১৯২৪) ‘রক্তকরবী’ প্রকাশ করেন। ‘রক্তকরবী’-র কোনও অভিনয় হল না।
১৯২৩-এর ৬ সেপ্টেম্বর ও ১২ সেপ্টেম্বর রাণু অধিকারীকে (পরে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়) লেখা কবির দু’টি চিঠিতে নাটকটি যথাক্রমে ‘নন্দিনী’ ও ‘যক্ষপুরী’ নামে পাওয়া যায়। অর্থাৎ তখনও কবি নাটকটির নাম স্থির করতে পারেননি। মনে কি দুটো নামই পাশাপাশি দোল খাচ্ছিল? ১১ অক্টোবর তারিখে অমিয় চক্রবর্তীকে জানাচ্ছেন, “নন্দিনী নাটকটার উপর ক্ষণে ক্ষণে প্রায়ই তুলি বুলচ্চি— তাতে তার রং ফুটছে বলে বোধ হচ্ছে।” পরের দিন অর্থাৎ বারো তারিখের সন্ধেবেলা, শান্তিনিকেতনে ‘নন্দিনী’ নাটকটি আবার পাঠ করবেন, এমন বার্তাও আসছে সে চিঠিতে। কিন্তু পরের দিন অর্থাৎ তেরো তারিখে রাণুকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন হয়ে যাওয়া পাঠ-অনুষ্ঠানের কথা, সঙ্গে এ-ও জানাচ্ছেন, “জান বোধহয় এখন তার নাম হয়েছে রক্তকরবী।”
আমরা এত ক্ষণ ১৯২৩-এর জুলাই থেকে অক্টোবর অবধি নাটকের নাম নিয়ে টানাপড়েনের কথা বলেছি। শিলঙে প্রস্তুত প্রথম খসড়ায় রচনার কোনও নাম নেই, এই নামহীনতা চতুর্থ খসড়া পর্যন্ত। প্রথমে নাটকের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্রটির নাম খঞ্জনী, সবাই ডাকে খঞ্জন বলে। খঞ্জনী নামটি বাদ পড়ল, স্বল্প সময়ের জন্য সুনন্দা এসেই খারিজ হয়ে গেল, হল নতুন নাম নন্দিনী। প্রথমটায় নেই, দ্বিতীয় খসড়ার শুরুতে আছে ‘নাট্যপরিচয়’। রচনায় বার বার পরিমার্জন— শব্দে, বাক্যে, চরিত্রনামে; একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কিশোর— সে এসে ঢুকেছে দশম খসড়ায়। ১৯২২-এ প্রতিমাদেবীর ‘গৃহীতা’ শিশুকন্যার নাম রেখেছেন কবি নন্দিনী। চতুর্থ খসড়া দুটো খাতায় বিন্যস্ত— নন্দিনী ১, নন্দিনী ২। নাটকের উপমন্যু চরিত্র, প্রথম খসড়ায় তার নাম সুরূপ। প্রথম থেকে তৃতীয় খসড়া পর্যন্ত গাঁয়ের নাম নিশানী। চতুর্থ, থেকে হল ঈশানী। চতুর্থ খসড়া নেই রবীন্দ্রভবনে, সেটিই ব্যবহৃত হয়েছে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায়। চতুর্থ ও পঞ্চম খসড়ার পাঠ এক।
নাটকটি যে নামে এত বিখ্যাত, সেই নামটি কিন্তু প্রথম খসড়ায় নেই। দ্বিতীয় খসড়ার আদি ও অন্তে দু’বার রক্তকরবী ফুল-নামের ব্যবহার পাই। অষ্টমে ফুল-প্রসঙ্গ বেড়ে গেছে, নবমে আরও।
স্রষ্টা যেখানে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ভাবনার আকাশে আরও তারা থাকতে পারে, নীহারিকার অস্তিত্বকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নন্দিনী-প্রতিমা হয়তো বীজাকারে আছে কবির কোল-আলো-করা (শিলং থেকে নীতুকে লেখা কবিকন্যা মীরাদেবীর চিঠির কথা মনে পড়ে) গৃহীতা বা পালিতা ছোট্ট নাতনি পুপের মধ্যেও। এক গুজরাতি পরিবারের রুগ্ণা মায়ের থেকে কয়েক মাসের শিশুকন্যা এসে নিঃসন্তান প্রতিমাদেবীর কোল আলো করেছিল। কবি তাকে নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দিনী’, ১৯২২ সালে। নন্দিনী মানে ‘আনন্দয়িত্রী’। কবির ‘তিন বছরের প্রিয়া’, যে ‘কাছের থেকে দেয় না ধরা দূরের থেকে ডাকে, সেই পরম আদরের পুপু, পুপে, পুপমি, রূপসী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা, মাদাম পাভলোভা দ্য সেকেন্ড (নন্দিনীর নানা নাম), কবির সঙ্গে যাঁর নিবিড় বন্ধন— তাকে ভুলি কী করে?
আবার বলি, ‘রক্তকরবী’র প্রাণশিখা নন্দিনীও ‘আনন্দয়িত্রী’। অধ্যাপককে সে বলে, “তোমাদের ঐ সুড়ঙ্গের অন্ধকার ডালাটা খুলে ফেলে তার মধ্যে আলো ঢেলে দিতে ইচ্ছে করে।” নন্দিনী রাজাকে বলে, “তাই ত বলছি আলোতে বেরিয়ে এসো, মাটির উপর পা দাও, পৃথিবী খুশি হয়ে উঠুক!”
যা-ই হোক, নাটকের ইতিহাসকার অজিতকুমার ঘোষের মুখে শুনেছি, কবি শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে অনুরোধ করেছিলেন ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়নের জন্য। শিশিরকুমার রবীন্দ্রনাথের সাতটি নাটকের মঞ্চায়ন ও অভিনয়ে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু ‘রক্তকরবী’ তাঁর দ্বারা সম্ভব হল না। জানি না, নন্দিনীর উপযুক্ত অভিনেত্রী তাঁর হাতে ছিলেন কি না।
শিশিরকুমার ছাড়া আরও দুই অভিনেত্রী নৃত্যাঙ্গনার সঙ্গে ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কবি যোগাযোগ করেছিলেন, সে কথা বলব, তবে তার আগে অন্যদের প্রযোজনার কথা বলে নিই।
১৯৩৪-এর ১৫ জানুয়ারি বিহার প্রদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়। ‘ইউনাইটেড প্রেস’ মারফত বিধ্বস্ত বিহারের জন্য কবি দেশবাসীর কাছে শুধু আবেদনই প্রচার করেননি, নিজেও এগিয়ে আসেন বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে জরুরি কর্তব্য-পালনে। ভূমিকম্পে দুর্গতদের সাহায্যের জন্য নাট্য-নিকেতনে প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকুর, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অদিতি দেবী, অপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে ‘দ্য টেগোর ড্রামাটিক গ্রুপ’ রক্তকরবীর অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। অভিনয়ের সমস্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করেন প্রবোধেন্দুনাথের পিতা প্রফুল্লনাথ ঠাকুর। অভিনয় থেকে অর্থাগম হয় দু’হাজার তিনশো একচল্লিশ টাকা। উদ্যোক্তারা সম্পূর্ণ অর্থ তুলে দেন মজফফরপুরের কল্যাণব্রত সঙ্ঘের সভানেত্রী অনুরূপা দেবীর হাতে। অভিনয়ে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, ডা. বি এ দে, শুভ্রজা বন্দ্যোপাধ্যায়, করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে।
ভারতে ট্রেড ইউনিয়ন সঙ্ঘ গঠিত হয় ১৯২১ সালে। তার পর থেকে সারা ভারতের শ্রমিকদের স্বার্থে দেশের বিভিন্ন স্থানে সঙ্ঘের অধিবেশন হতে থাকে। মিল মালিকদের বেশির ভাগ ইংরেজ। শ্রমিক জাগরণের ফলে মিল মালিকরা বিষম অস্বস্তিতে পড়ে। ১৯২৮ সালে মুম্বইয়ের বয়ন শিল্পাঞ্চলগুলিতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রতিবাদ ও জয়লাভ মালিক ও ব্রিটিশ সরকারকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। মীরাট মামলা শক্তিশালী শ্রমিক সঙ্ঘের প্রতিবাদকে দুর্বল বা নিঃশেষ করার জন্য ছিল এক বিশেষ আয়োজন। ১৯২৯ সালে কোথায় কোন ভাষায় কোন মঞ্চে এ অভিনয় হয়েছিল, এ সম্পর্কে আর কিছু জানা যাচ্ছে না। তবে এমন পটভূমিতে ‘রক্তকরবী’র নাট্যবার্তা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাই বটে।
১৯৪৯ সালে দেবব্রত বিশ্বাস শ্রীরঙ্গমে (পরবর্তী কালে যার নাম হয় বিশ্বরূপা) ‘রক্তকরবী’র অভিনয়ের আয়োজন করেছিলেন। অভিনয়ে রাজা - শম্ভু মিত্র, নন্দিনী - কণিকা মজুমদার, চন্দ্রা - তৃপ্তি মিত্র, সর্দার - কালী ব্যানার্জি, গোঁসাই - সজল রায়চৌধুরী প্রমুখ। পরিচালক ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস।
ঘটনাটি কবিপ্রয়াণের আট বছর পর। যাঁরা এই নাটকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট, স্বনামধন্য। কিন্তু তাঁদের মঞ্চায়ন দর্শকমনে তেমন রেখাপাত করতে পারেনি।
পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
অমিতা ঠাকুর কবির নাটকে অভিনয় করে ও নৃত্য পরিবেশনে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনিও একটি চিঠিতে (২০.৬.৭৮) প্রণয়কুমার কুণ্ডুকে জানিয়েছেন: “...আমার তপতী অভিনয় ওঁর [কবির] ভালো লাগে ও তপতী অভিনয় [২৬, ২৮, ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ ও ১ অক্টোবর] অনুষ্ঠিত হবার পর আমায় বারবার বলতে থাকেন ‘নন্দিনী’ করার জন্য। আমার কেমন মনে হয়েছিল ওটা আমি পারব না। উনি অনেক করে বলেন কিন্তু আমি রাজি না হওয়ায় করালেন না।... আমি যে কতো বড়ো অন্যায় করেছি তা এখন বুঝতে পেরে মর্মে মর্মে দুঃখ অনুভব করি। উনি বলেন, ‘আমি তোকে শেখাবো তুই ঠিকই পারবি!’ নন্দিনীর একটা ছবি তাঁর মনের মধ্যে ছিল যার সঙ্গে আমার কিছু মিল পেয়ে থাকবেন।”
অমিতাকে নিয়ে নন্দিনী চরিত্রাভিনয়ের ভাবনা খুবই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। শিল্পীর আফসোসটা খুবই স্বাভাবিক। রাণু ও অমিতার মাঝখানে আর এক জন নারীর কথা উল্লেখ করতে চাই। এই নারীর নাম রেবা রায়। শ্রীহট্ট জলসুকার বিখ্যাত রমাকান্ত রায়, সতীশচন্দ্র রায়, রাধামাধব রায়দের বংশজা এই রেবা। শান্তিদেব ঘোষের কলমে প্রেক্ষাপটটা পাই। তাঁর কথাটা এ রকম— কবি প্রথম ভেবেছিলেন কলিকাতায় ‘রক্তকরবী’ নাটকটি মঞ্চস্থ করাবেন। তিনি নিজে রাজার ভূমিকায় এবং দিনেন্দ্রনাথ বিশুর চরিত্রে অভিনয় করবেন বলে স্থির করেছিলেন। অন্যান্য চরিত্রের নির্বাচনও প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আটকাল নন্দিনী চরিত্র নিয়ে। মনের মতো কাউকে পেলেন না। রেবা রায় তখন নৃত্যে কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে সুপরিচিত। ১৯২৭-এর অগস্ট মাসে দিনেন্দ্রনাথ ও সরলাদেবীর পরিচালনায় যখন রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য ‘মায়ার খেলা’র অভিনয় হয় এম্পায়ার থিয়েটারে, তখন নৃত্যাভিনয়ে রেবা দর্শকদের খুবই প্রশংসা অর্জন করেন। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী চরিত্রের নির্বাচন নিয়ে কবি যখন চিন্তিত, তখন রেবা রায়ের নাম কবির কাছে সুপারিশ করা হয়।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘যাত্রী’ গ্রন্থে (পরিবর্ধিত সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৭৫) লিখেছেন, “প্রকাশ্যে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশে রেবার আগে কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে নৃত্য করেনি। রবীন্দ্রনাথও তখন প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে মেয়েদের দিয়ে নৃত্য অনুষ্ঠান করাননি। এর প্রায় একবছর বাদে নটীর পূজায় রবীন্দ্রনাথ নৃত্যের অবতারণা করেন। এ বিষয়ে রেবা পথকারিণী। সে-ই সর্বপ্রথম পথ দেখিয়েছে। এর জন্যে তাকে কম বিদ্রূপ ও অপমান সহ্য করতে হয়নি। অনুষ্ঠানের পরেই ‘সঞ্জীবনী’ থেকে শুরু করে সব সংবাদপত্রগুলি আমার ও রেবার বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করে দিল।” (পৃ. ৯১)
সৌম্যেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন নৃত্যপটীয়সী রেবা রায়ের কথা। ‘গণবাণী’র আয়োজিত অনু্ষ্ঠান হচ্ছে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। হলের উপর থেকে নীচ ভরে গেল লোকে। উদার ও নির্ভীক বাবার (রাধামাধব রায়, ইংল্যান্ডের কুপার্স হিলের ইঞ্জিনিয়ার) অনুমতি নিয়ে রেবা নাচতে এল। ‘যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে’ গানের সঙ্গে উল্কার মতো দল থেকে বেরিয়ে এসে স্টেজের মাঝখানে নাচতে লাগল। কবি নন্দিনী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় এই রেবার কথাই তাঁর মনে পড়েছে। রেবাকে তিনি আগে থেকেই জানতেন, শান্তিনিকেতনে পড়েছেন রেবা, এক সময়ে থাকতেন বোলপুরে ভাড়াবাড়িতে। ৮ নভেম্বর ১৯২৭ কবি শান্তিনিকেতন থেকে লিখছেন রেবাকে— “এবার রক্তকরবী অভিনয় করা স্থির। নন্দিনীর ভূমিকায় নেওয়ার উপযুক্ত আমি কাউকে দেখচি নে। তুমি যদি এই দায় নিতে রাজি হও তা হলে অভিনয় সম্ভব হবে, নইলে হয় কি না সন্দেহ। আমাকে রাজা ও দিনুকে বিশু সাজতে হবে। আর সমস্ত পাত্র একরকম জুটিয়ে নিয়েছি। তুমি কি যোগ দিতে পারবে না? যদি নিতান্ত অসম্ভব না হয় তাহলে এখানে এসে তোমাকে কিছুদিন থাকতে হবে।”
২৮ কার্তিক ১৩৩৪, অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর ১৯২৭-এর রেবার অসুস্থতার খবর পেয়ে কবি আবার লিখেছেন— “অসুস্থ শরীরকে ক্লিষ্ট করে তুমি অভিনয় করবে এমন কথা আমি কল্পনাও করিনি। তোমার রোগশয্যার মেয়াদ ফুরিয়ে যাক তারপর ডিসেম্বর থেকেই রিহার্সাল শুরু করা যাবে। জানুয়ারির মধ্যে অভিনয় হতে পারলেই চলবে। যদি রক্তকরবী লোকের অভাবে অভিনয় করা অসম্ভব হয় তবে ‘রাজা’ করব তাতে তোমাকে সুদর্শনা সাজতে হবে। এই বেলা যদি একটু ভালো করে দেখে রাখো তো সুবিধা হয়। তোমার শরীর সেরে উঠলে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে এসে থাকতে তো কোনো বাধা হবে না?”
চিঠির ভাষা থেকে রেবার গুরুত্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। লক্ষণীয়, অমিতা ঠাকুরের ‘তপতী’ নাটকে অভিনয়ের দু’বছর আগে কবি রেবাকে আহ্বান করেছিলেন। যে ঠিকানায় কবি দু’খানি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের ফাইলে সেই ঠিকানাটিও পেলাম— ‘কল্যাণীয়া শ্রীমতী রেবা দেবী, C/o C. C. Das, Bar at Law, Patnagaya Road, Patna’।
১৯২৩-এর ১২ সেপ্টেম্বর রাণুকে লেখা চিঠি— “আমার ইচ্ছে সেই যক্ষপুরীর অভিনয়টা করে’ অভিনয়ের আর এক রকম ধারা দেখিয়ে দিই। তার উপযুক্ত দেশকালপাত্র কবে জুটবে জানি নে।” এ থেকে কবির মনের তীব্র ইচ্ছেটি প্রকট হয়ে উঠেছে। অথচ মনের আশা ফলছে না। তেইশ গেছে, চব্বিশ গেছে, পঁচিশ, ছাব্বিশ গেছে, সাতাশের ডিসেম্বরে রেবা রায়কে লেখা চিঠিতে কবির অসহায়তা ফুটে উঠেছে। ডিসেম্বরে রিহার্সাল হোক, ১৯২৮-এর জানুয়ারিতে না-হয় অভিনয় হবে! রেবাকে লেখা চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, কবি হবেন রাজা, দিনেন্দ্রনাথ বিশু, আর সমস্ত পাত্র এক রকম জুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি থাকছে এক নন্দিনী। কবির ‘দেশকালপাত্র’-র মধ্যে অসুবিধের জায়গা ওই একটুখানি। নন্দিনীর জন্যই এ ভাবে বছরের পর বছর কবির প্রতীক্ষা। ১৯২৯-এর শেষে অমিতা ঠাকুরকেও ডাকলেন! কিছুতেই হল না সে অভিনয়। বিশাল মেঘখণ্ড, তার থেকে রবিপ্রকাশ ঘটল না কোনও দিনও।
‘রক্তকরবী’ যে কাছে-দূরের মানুষকে প্রভাবিত করেছিল, এ কথা বোঝা যায় আরও একটি সূত্র থেকে। ২৩ এপ্রিল ১৯২৫, পশ্চিম অসমের গৌরীপুর থেকে কবি অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন, “আপনি শুনলে আনন্দিত হবেন এই সুদূর আসাম-পল্লী পর্য্যন্ত সাহিত্যের আনন্দ হিল্লোল এসে পৌঁচেছে, এখানকার মাস্টার, ছাত্রেরা মিলে একটি বড় রকমের সাহিত্যসভা করে, আপনার ‘রক্তকরবী’ নিয়ে আলোচনা করলেন ... আমি সেদিন ‘বহুদিন মনে ছিল আশা’ এই কবিতাটি পড়ে শোনালাম— সভাসুদ্ধ ছোটবড় সকলকে সম্পূর্ণ তন্ময় হয়ে যেতে [আগে] কখনও দেখিনি। এ রকম সব হলে ভারি উৎসাহ বোধ হয়, সব আশা ফিরে আসে।”
১৯২৯, ১৯৩৪, ১৯৪৯-এর তিনটি প্রযোজনার উল্লেখ করা হয়েছে, চতুর্থটি ১৯৫৪ সনের। তৃতীয়টিতে শম্ভু মিত্র রাজার ভূমিকায় ছিলেন অন্যের পরিচালনায়, এ বারও তিনি রাজা, ‘বহুরূপী’-র হয়ে। মহলা চলত তাঁর বাইরের ঘরে দিনের পর দিন। তখন ‘বহুরূপী’র নিজস্ব মহলাঘর ছিল না। মঞ্চায়ন ঘটল ১০ মে ১৯৫৪— শিয়ালদহের রেলওয়ে ম্যানসন্স ইনস্টিটিউশনের হলে। এ এক ঐতিহাসিক ক্ষণ। ‘বহুরূপী’র হাত ধরে রবীন্দ্র-নাটক রক্তকরবী পেল এক অসাধারণ নাট্যরূপ। চিত্তরঞ্জন ঘোষের লেখা থেকে জানতে পারি, ১৯৫৪-র ২২ থেকে ২৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নাট্য-উৎসব। পনেরোটি ভাষায় বাইশটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল; আধুনিক বিভাগে পুরস্কৃত হয় রক্তকরবী।
‘বহুরূপী’র উক্ত দু’টি মঞ্চাভিনয়ের মাঝখানে ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর (১৯৫৪) অসমের (বর্তমান মেঘালয়ের) রাজধানী, ‘রক্তকরবী’র জন্মভূমি শিলঙে অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রহ্মপুত্র-লাঞ্ছিত বন্যার্তদের সাহায্যার্থে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চাভিনীত হয়েছিল।
শম্ভু মিত্র লিখেছেন ‘রক্তকরবী’ নাটক থেকে নাট্যে রূপান্তরের সময়কার নানা অভিজ্ঞতার কথা, ‘নাটক রক্তকরবী’ বইতে (১৯৯২)। যুগপৎ রসিক পাঠক ও নাট্যপরিচালকের দৃষ্টিকোণজাত এ এক চমৎকার পুনঃসৃষ্টিদর্পণ। ‘প্রস্তাবনা’য় লেখক জানিয়েছেন, “বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের কর্তারা আমাদের অভিনয় বন্ধ করে দেবেন ব’লে ধমক দিয়েছেন (কারণ আমরা নাকি রবীন্দ্রনাথের নাটকের অপব্যাখ্যা করেছি।) তার আগে বোধহয় দু’একটা বড় কাগজে বেশ নিন্দে বেরিয়েছে রক্তকরবী নাট্যের। আবার শ্রীপ্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ-আদি কিছু রবীন্দ্রানুরাগী বিখ্যাত ব্যক্তি খুব প্রশংসা করেছেন ঐ নাট্যরূপেরই।” সেই বইয়ের অন্তিম কথা— “আমাদের কাছে রক্তকরবীর পুরো কাহিনীটাই বড় সত্যমূলক এবং আধুনিক জীবন সম্পর্কিত। এবং এটি একটি নাটক। অভিনেতাদের বা নির্দেশকদের লুব্ধ করার মতো একটি ‘নাটক’।” কোনও আবছা কথা নয়, প্রবল প্রত্যয়গর্ভ এ উচ্চারণ।
নাট্যাচার্যের আক্ষেপ আমাদেরও ব্যথিত করে, অন্তিম কথা আলো দেখায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy