Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

বাইশে শ্রাবণেই চলে গিয়েছিল নীতু

রবীন্দ্রনাথের মেয়ে মীরার পুত্র নীতীন্দ্রনাথ। ভাল গান গাইতেন, দাদুর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন নাটকেও। মাত্র একুশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। সে দিনটাও ছিল বাইশে শ্রাবণ। পীতম সেনগুপ্তইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথের সেজ ছেলে নীতীন্দ্রনাথকে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী ছেলের মতো স্নেহ করতেন।

দৌহিত্র: নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য: গৌতম ঘোষ

দৌহিত্র: নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য: গৌতম ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাবেন। হঠাৎ খবর এল, যে জাহাজে যাওয়ার কথা সেটি বোম্বে বন্দরে বিগড়েছে। শেষে যাত্রাই ভেস্তে গেল। এরই মধ্যে সুসংবাদ। ছোট মেয়ে অতসীলতা, যিনি মীরা নামে বেশি পরিচিত, তাঁর ছেলে হয়েছে। কবি নাম দিলেন নীতীন্দ্রনাথ।

ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথের সেজ ছেলে নীতীন্দ্রনাথকে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী ছেলের মতো স্নেহ করতেন। যদিও বয়সে তিনি মৃণালিনীর চেয়ে একটু বড়। রবীন্দ্রনাথের পুত্রকন্যা, বিশেষত রেণুকা বা রাণী তাঁর খুব নেওটা ছিলেন। অসুখে ভুগে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান নীতীন্দ্রনাথ। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন, ‘মীরার একমাত্র ছেলের নাম যে নীতীন্দ্র রাখা হয়েছিল সে তাঁকেই স্মরণ করে।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯১৩-র ২৬ জানুয়ারি নাতির অন্নপ্রাশনে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছানুযায়ী ‘নীতীন্দ্রনাথ’ নাম রাখা নিয়ে ঠাকুর পরিবারে আপত্তি ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তখন কেমব্রিজে। তিনি চিঠিতে মীরার স্বামী নগেন্দ্রনাথকে লেখেন, ‘মীরা লিখেছে তোমার ছেলের নাম নীতু রাখলে কেউ কেউ তার নাম উচ্চারণ করতে পারবে না। একথার কোনো মূল্য নেই।’ কেন, সেই যুক্তিও দিয়েছেন। পরে নীতীন্দ্রনাথ নামটিই থেকে যায়।

যত দিন যায়, মীরার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্কে চিড় ধরে। অশান্তি অবশ্য বিয়ের দিন থেকেই। মীরার বিয়েটা সাদামাটা ভাবে শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে হয়েছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম মেনে নগেন্দ্রনাথ বিয়েতে রাজি হলেও বিয়ের আসরে কবির স্বহস্তদত্ত উপবীত গ্রহণে বেঁকে বসেন, পরিয়ে দেওয়ার পরেও খুলে ফেলেন। গায়ে হলুদ, মালাবদল, শুভদৃষ্টির সময় খারাপ আচরণ করেন। কবির বড় মেয়ে মাধুরীলতার কথায়, ‘বরের অসভ্যতায় আমাদের পর্যন্ত লজ্জাবোধ হয়েছিল।’ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে কবি বলেছিলেন, “ওর (মীরার) জীবনের প্রথম দণ্ড তো আমিই ওঁকে দিয়েছি। ভাল করে না ভেবে না বুঝে আমিই ওর বিয়ে দিয়েছি।”

এই কারণেই হয়তো নাতির উপর কবির দুর্বলতাও ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯১৩ সালে কবি তখন লন্ডনে, নাতির জন্য প্রবাসে বসেও তাঁর মন উতলা। নীতীন্দ্রের ছবিও নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে। খবর পেলেন, নাতি এগজিমায় আক্রান্ত হয়েছিল। মীরাকে হোমিয়োপ্যাথির পরামর্শ দেন তিনি। শান্তিনিকেতনে আশ্রমে নীতীন্দ্রকে ভর্তি করা হয়। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ চান ছেলেকে কাছে রেখে পড়াতে। ফের শুরু টানাপড়েন। কবি চিঠিতে লিখেছিলেন, খোকার ইশকুলের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি চিন্তিত।

১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে ‘শারদোৎসব’ নাটক কলকাতায় দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়। কবির সঙ্গে অভিনয় করেন নীতীন্দ্রনাথ। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘সকলের চেয়ে আমাদের ভাল লাগিল উপানন্দের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রের অভিনয়।’ নীতীন্দ্রনাথ শুধু ভাল অভিনয়ই করতেন না, গানও গাইতেন ভাল। নেদারল্যান্ডস থেকে মেরি ভ্যান ইঘেন ১৯২২-এ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন আশ্রমের ছেলেমেয়েদের পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখাতে। পিয়ারসনের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিলভাঁ লেভি ও তাঁর স্ত্রী, পদ্মজা নায়ডু, এল্‌মহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এল্‌মহার্স্টের ডায়েরি থেকে জানা যায়, সে দিন বারো বছরের নীতীন্দ্র গান গেয়েছিলেন। প্রশংসাও পেয়েছিলেন।

পরের বছর নগেন্দ্রনাথ স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বিদেশে চলে যান। কবির আপত্তি ছিল, তা সত্ত্বেও মেয়ের সংসারের শান্তির কথা ভেবে বিদেশে থাকার খরচের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। স্কুলের পড়া শেষে নীতীন্দ্র দেশে ফেরেন ১৯৩০ সালে। ফিরে ছাপাখানা ও প্রকাশনার ব্যবসার পাঠ নিতে গেলেন বম্বেতে। ব্যাপারটা কবির পছন্দ হয়নি। নাতির জন্য তিনি জার্মানিতে কাজের খোঁজ করতে থাকেন।

১৯৩১-এ নীতুকে জার্মানি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। বছর কাটলেও সুস্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে মীরা গেলেন জার্মানি। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা গেলেন নীতীন্দ্রনাথ। দিনটা ছিল ১৯৩২-এর ৭ অগস্ট, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। কলকাতায় বসে শোকাতুর কবি চিঠিতে মেয়েকে লিখেছিলেন, ‘নীতুকে খুব ভালোবাসতুম...আমার শোকের দায় আমিই নেব— বাইরের লোকে কি বুঝবে তার ঠিক মানেটা।’ এর ন’বছর বাদে প্রয়াত হন কবি। আর এক বাইশে শ্রাবণে।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Nitindranath Tagore Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy