স্মৃতিবিজড়িত: শান্তিনিকেতনের এই প্রাঙ্গণে খেলাধুলো-শরীরচর্চা করতেন কবির স্নেহধন্য গৌরগোপাল। ছবি: অরিন্দম বিশ্বাস।
চন্দননগরের সঙ্গে কবির সম্পর্ক আত্মিক। এই গঙ্গাতীরেই কবির জীবনের ‘সত্য ও সহজ’ উদ্বোধন হয়েছিল। এই জন্যই কবি নিজেকে ‘গাঙ্গেয়’ বলে মনে করতেন। সেই যে রিভারভিউ-মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে জ্যোতিদাদা-নতুন বৌঠানের হাত ধরে চন্দননগরের সঙ্গে কবির পরিচয়পর্বের সূচনা, তার সমাপ্তি হয়েছিল একেবারে প্রৌঢ় বয়সে। বয়সকালে যত বারই কবি এখানে পদার্পণ করেছেন, ক্রমশ স্মৃতিভারে ন্যুব্জ হয়েছেন, বিহ্বল হয়েছেন। অনেক বারই কবি এই শহরে এসেছেন। স্বভাবতই কবির সঙ্গে বহু বিশিষ্ট মানুষের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। এই ভাবেই তেলেনিপাড়ার জমিদার বংশের সত্যবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবির পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। এই শহরের হরিহর শেঠ, ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, সঙ্ঘগুরু মতিলাল রায়, কবি নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, চন্দননগরের তৎকালীন মেয়র নারায়ণচন্দ্র দে, চিকিৎসক যোগেশ্বর শ্রীমানী প্রমুখ বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে কবির যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবেশী ছিলেন চন্দননগরের আর এক বিশিষ্ট চিকিৎসক দয়ালচন্দ্র ঘোষ। প্রতিবেশীর কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে দয়ালচন্দ্র ঘোষ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গৌরগোপাল ঘোষকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন।
আনুমানিক ১৮৯৪ সালে চন্দননগরে গৌরগোপাল জন্মগ্রহণ করেন। রানী চন্দ জানাচ্ছেন, “সাত বছরের ছেলে এসেছিলেন পড়তে আশ্রমে।” ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষক অজিতকুমার চক্রবর্তী ১৩০৮-১৩১৮ সালের ছাত্রদের যে তালিকা দেন, তাতে গৌরগোপাল ঘোষ আছেন। ১৩০৮ সালের ৭ পৌষ যে পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের সূচনা হয় তারা হলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীরচন্দ্র নান, প্রেমকুমার গুপ্ত, গৌরগোবিন্দ গুপ্ত ও অশোককুমার গুপ্ত। কাজেই বলা যায় যে, ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একেবারে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে না হলেও, তার কিছু পর থেকেই গৌরগোপাল এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সাত বছরের গৌরগোপালের ফুটফুটে রং দেখে কবি তাঁকে আদর করে ‘গোরা’ বলে ডাকতেন। সেই থেকে শান্তিনিকেতনে সবাই তাঁকে ‘গোরা’ বলতেন।
শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা এবং শারীরিক কসরতের বিষয়ে প্রথম থেকেই জোর দেওয়া হত। কবির জীবনের আদর্শ ‘শিক্ষার মধ্যে ক্রীড়ার স্থান বড়’ রূপায়ণে কবি প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হাডুডুর পাশাপাশি কুস্তি, জুজুৎসু, জিমন্যাস্টিক্স, লাঠি খেলা, সাঁতার, ড্রিল, ব্যায়াম এবং পরবর্তী সময়ে বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস, বিদেশি খেলা ক্রোকে ইত্যাদির প্রচলন হয়। মরাঠি যুবক দত্তাত্রেয় বালসুব্রহ্মণ্যম কালেলকরের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনের পরিচয় ঘটে ক্রিকেটের সঙ্গে। ব্রতীবালক ও ব্রতীবালিকা বিভাগও তৈরি হয়। আশ্রমে নিয়মিত বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হত। ১৯০৫ সালে জাপান থেকে প্রশিক্ষক সানোসান জুজুৎসু শেখাতে আসেন। অন্য সমস্ত ছাত্রদের সঙ্গে অত্যুৎসাহী গৌরগোপালও তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নেন এবং বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ফুটবলেও গোরা তাঁর অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন।
১৯১০ সালে শান্তিনিকেতন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাস করে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতার কলেজে ভর্তি হন। কবি এই প্রাণবন্ত ছাত্রটির অভাব খুব অনুভব করতেন। ছোট ছেলে শমী কয়েক বছর আগেই প্রয়াত। ব্যথিত কবিহৃদয় গোরাকে যেন পুত্রস্নেহেই আগলে রাখত। গোরার শান্তিনিকেতন ত্যাগের সময় কবি সম্ভবত জোড়াসাঁকোয় রথীন্দ্রনাথের বিয়ে (২৭ জানুয়ারি ১৯১০) নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কবি তাঁকে চিঠিতে লিখছেন, “গৌর, আমার বড় ইচ্ছা ছিল তোমরা আশ্রম হইতে বিদায় লইবার সময় আমি উপস্থিত থাকিয়া তোমাদিগকে আশীর্বাদ করিব। তাহার ব্যাঘাত ঘটিল। এতদিন পরে আজ তোমরা আশ্রম হইতে রিক্ত হস্তে ফিরিতেছ একথা আমি কিছুতেই মনে করিতে পারি না। বিদ্যালয়ের সঙ্গে তোমাদের যে যথার্থ সম্বন্ধ সেইটিই তোমাদের চিত্তে শক্তিদান করবে ও তোমাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করিয়া দিবে। অতএব সংসারের পথে প্রাণপণ শক্তিতে চরিত্রকে সর্বপ্রকার ভ্রষ্টতা হইতে রক্ষা করিয়া চলিবে এই দক্ষিণা আমি তোমার কাছে চাই। তোমার জীবনে আমার চেষ্টা আমার কামনা ব্যর্থ হয় নাই ইহাই তোমাকে একান্ত যত্নে প্রমাণ করিতে হইবে...” রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমার বিয়ের পর শান্তিনিকেতনে তাঁদের প্রথম পদার্পণ উপলক্ষে যে উৎসব-অনুষ্ঠান হয়, সেখানে গৌরগোপাল শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। বুকের উপর দিয়ে গরুর গাড়ির চাকা চলে যাওয়ার খেলাটিও তিনি সে দিন দেখিয়েছিলেন।
গোরার এক চিঠির প্রত্যুত্তরে এক বার কবি লেখেন, “গোরা, তোমার চিঠি পেয়েছি।... যদি কোনো বিশেষ বিঘ্ন না ঘটে তাহলে আমাদের বর্ষশেষ ও নববর্ষের উৎসবে যোগ দিতে চেষ্টা কোরো।” এই চিঠির মাত্র ন’দিনের মাথায় লেখা আর এক পত্রে পুনরায় কবিহৃদয়ের ব্যাকুলতা ধরা পড়ে, “গৌর, তুমি কেমন আছ, কি করিতেছ, আমাকে জানাইবে।... নববর্ষোৎসবের আর বিলম্ব নাই। তোমাদের সকলের নিকট আমার নিমন্ত্রণ রহিল।” কবির সঙ্গে গোরার এতটাই সখ্য গড়ে উঠেছিল যে, এই কিশোর জনৈক এক জন ছাত্রকে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য কবির কাছে সুপারিশ করেন। কবি সস্নেহে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে ফিরতি চিঠির মাধ্যমে তাকে আশ্বস্ত করেন। ৫ আষাঢ়, ১৩১৭-র সেই চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, “তুমি যে ছেলেটির কথা লিখিয়াছ তাহাকে এখানে পাঠাইয়া দিবে। মাসিক বারো টাকা লইয়াই তাহাকে এখানে রাখা স্থির হইয়াছে।”
ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে গৌরগোপাল কলকাতার কলেজে ভর্তির পরই তাঁর ফুটবল-প্রতিভা অনেকের নজরে আসে। গৌরগোপাল ১৯১০-১৪ পর্যন্ত মোহনবাগান ক্লাবে ব্যাক হিসেবে খেলে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। রানী চন্দ জানিয়েছেন, “গৌরদা এক সময়ে মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন ছিলেন।” কলকাতার ক্লাবে তখন ব্রিটিশরাই বুট পরে খেলতেন। গৌরগোপাল ফুটবল দক্ষতা, শারীরিক ক্ষমতা ও মানসিকতায় যে তাঁদের সমকক্ষ, এই পরিচয় দিতেই বুট পরে খেলা শুরু করেন। ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষা গোরাকে শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছিল। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র তারকনাথ লাহিড়ী জানাচ্ছেন, “আমাদের শান্তিনিকেতনে ফুটবল খুব ভাল খেলা হত। খেলা শেখাতেন সন্তোষদা। আমাদের ওখানকার অনেক খেলোয়াড়ই কলকাতার সব বিখ্যাত দলে খেলেছেন। গৌরদা মোহনবাগান দলে তখনকার দিনে শ্রেষ্ঠ বুট-পরা ব্যাকের খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁকে এবং সূর্যিদাকে (সূর্য চক্রবর্তী) না চেনে, ফুটবল খেলা যাঁরা ভালোবাসেন, এমন বোধহয় কেউ নেই। কলকাতা থেকে কত নামজাদা সব দল গেছেন সেখানে খেলতে, কিন্তু খুব কম দলই সেখান থেকে জিতে আসতে পেরেছেন।...”
গৌরগোপাল ফুটবল খেলার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এসসি ডিগ্রি অর্জন করে তিনি আবার ১৯১৭ সালে শান্তিনিকেতনে গণিতের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তখনও ফুটবল অনুশীলনও সমান ভাবে চলত। কলকাতা থেকে ফুটবল দল শান্তিনিকেতনে এলে গৌরগোপাল শান্তিনিকেতনের হয়ে জার্সি, বুট পরে নেমে যেতেন। যখনই কলকাতার কোনও ক্লাব বা কলেজ আমন্ত্রিত হয়ে ফুটবল খেলতে আসতেন, তখন শান্তিনিকেতনের দলের সঙ্গে গৌরগোপালকেও খেলতে হত। খেলা শুরু হওয়ার আগে গৌরগোপাল যখন গায়ে শান্তিনিকেতনের জার্সি, হাফপ্যান্ট পরে দু’পায়ে মোজা-সহ ফুটবল খেলার উপযোগী বুটজুতো পায়ে তাঁর বাসগৃহ থেকে বেরোতেন, ছেলেরা তাঁকে ঘিরে উল্লাস করত। খেলার মাঠে নেমে যখন বুট পায়ে তিনি ফুটবলটিকে আকাশে অনেকখানি তুলে বিপক্ষ সীমানায় ফেলতেন, তখন ছেলেদের চিৎকার আর উল্লাসের সীমা থাকত না। সে যুগে খেলার সুবাদে গৌরগোপাল ছিলেন সকলের ‘হিরো’।
১৯২৭-১৯৩১ সাল পর্যন্ত রথীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের সচিবের দায়িত্ব সামলানোর পরই গৌরগোপাল ঘোষ সচিব পদে নিযুক্ত হন। আর এই সময়েই গোরার ব্যক্তিগত জীবনেও আরও বড় দায়িত্ব গ্রহণের ডাক আসে। শিল্পী মুকুল দে-র বোন এবং রানী চন্দর দিদি অন্নপূর্ণা বা বুড়ির সঙ্গে তাঁর বিবাহ স্থির হয়। তবে এই নিয়ে বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটে। কানাঘুষোয় অন্নপূর্ণার কানে বিবাহের সংবাদ বা তার জন্য প্রস্তুতি নজরে এলেও দুই বোনের কাউকেই পাত্র সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। আর তাতেই অজানা ভয়ে, আশঙ্কায় অন্নপূর্ণা সব সময় কেঁদেই অস্থির। কিছুতেই সে দিন কান্না থামানো যাচ্ছে না। শেষে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু এবং শান্তিনিকেতন হাসপাতালের কম্পাউন্ডার অক্ষয়কুমার রায় কবিগুরুর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তখনই দুই বোন মিলে একেবারে সশরীরে কবিগুরুর কাছে উপস্থিত। গুরুদেবকে প্রণাম করে অন্নপূর্ণা আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ সব কথা শুনে অন্নপূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করেন “...তোকে জানানো হয় নি এ বড়ো অন্যায় মুকুলের। গোরা বড়ো ভালো ছেলে রে, তার সঙ্গে বিয়ে হলে সুখীই হবি। সে আমার খুব প্রিয়।”
গোরা-অন্নপূর্ণার এই বিয়েতে গোটা আশ্রম মেতে ওঠে। এক দিকে শ্রীনিকেতনের সচিব, অন্য দিকে শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত দে পরিবার। শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতনের সম্মিলিত এই বিবাহ যেন এক উৎসবের মাত্রা পায়। সুরেন্দ্রনাথ করের উপর মূল ব্যবস্থাপনার ভার পড়ে। সকালে গৌরগোপালদের বাড়ি থেকে তত্ত্বের মধ্যে দিয়েই সেই চমকের শুরু। তত্ত্বের থালা নিয়ে প্রবেশ করল সাঁওতাল মেয়েদের বিরাট একটা দল। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, গায়ে রুপোর গহনা। সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে কলাভবনের ছেলেরা বরের গাড়ি সাজিয়ে ফেলল। তবে যে সে গাড়ি নয়, তাকিয়া-ঝালর-সুজনি দিয়ে সাজানো হল ছাদখোলা গরুর গাড়ি। চাকায় রংবেরঙের নকশা করা হল। শ্রীনিকেতনের ডেয়ারি থেকে দুটো বাছাই করা তাগড়াই ষাঁড় নিয়ে এসে ‘মালায় রঙে কাঁচ বসানো কাঠিওয়ারি বস্ত্রে’ সাজিয়ে তোলা হল। বরের মাথায় ছাতা ধরল এক জন। সুদৃশ্য রথের দু’পাশে সাঁওতাল বালকেরা মাদল-বাঁশি-কাঁসর বাজিয়ে চলেছে। সামনে সাঁওতাল মেয়েরা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। আর বরযাত্রী দলের সঙ্গে নিশিকান্ত মজা করে গাইতে গাইতে চলেছেন—‘... কালীমায়ের পুজো দিয়ে/ আজ মুকুলদার বোনের বিয়ে/ মায়ের প্রসাদ পাবার জন্য/ আমরা সবাই হলেম আকুল-/ ঐ আমাদের দাদা মুকুল॥ / বর সেজেছেন গৌর দাদা/ তাঁর দুই পায়ে দুই পাউরুটি বাঁধা/ আনন্দে তাঁর মন মশগুল/ ঐ আমাদের দাদা মুকুল॥”
যাই হোক, সচিব হওয়ার বহু আগে থেকেই শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের বিভিন্ন কর্মোদ্যোগ ও প্রকল্প নিয়ে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গৌরগোপালের নিয়মিত আলোচনা চলত। ১৯২১-এর ২৭ নভেম্বর এলমহার্স্ট সেখানে যাওয়ার পর শ্রীনিকেতনের কাজের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি হয় এবং নিয়মিত কাজ এগোতে থাকে। গৌরগোপালও এলমহার্স্টের কর্মোদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন এবং পরে তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে শ্রীনিকেতনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। রথীন্দ্রনাথ বিদেশে গেলেও টেলিগ্রাম বা পত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়ে গোরার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথাবার্তা চলত। কাজের কথার ফাঁকে ফাঁকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতাও চলত। বিদেশ থেকেও রথীন্দ্রনাথ গৌরগোপালের পারিবারিক সুখ-দুঃখের খবর নিতেন। এটা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পরিচয়ও বহন করে।
গৌরগোপাল কবির বিদেশ সফরেও সঙ্গী ছিলেন। ১৯২৬ সালের মে মাসে কবির বহুবিতর্কিত দ্বিতীয় ইটালি-সফর তথা পঞ্চম বার ইউরোপ সফরে অন্য অনেকের সঙ্গে গৌরগোপালও ছিলেন। তাঁকে ইটালিতে পাঠানো হয়েছিল রোমের সমবায় কার্যাবলি অনুশীলনের জন্য। তবে ইতিপূর্বেও বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কবি ১৯২৩-এর পূজাবকাশের পর নভেম্বরে মুম্বই-কাথিয়াবাড়-গুজরাত যান। মুম্বই পর্যন্ত অ্যান্ড্রুজ সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু মুম্বই-পরবর্তী সফরে গৌরগোপাল সব সময় কবির সঙ্গী ছিলেন। আর ১৯২৭ সালের ৪ মে কবির চন্দননগর সফরে সারা দিনের ঠাসা কর্মসূচি চূড়ান্ত করার ভার বর্তেছিল ভূমিপুত্র গোরার উপর। কবি মজা করে বলেছিলেন, ‘বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি’। বিকেলে কবির সঙ্গে তিনি কৃষ্ণভাবিনী স্কুলেও যান। কবি ১৯৩৫ সালে পুনরায় চন্দননগরে এসে প্রায় মাস দেড়েক ছিলেন, তখন তিনি গৌরগোপালের পৈতৃক বাড়িতেও গিয়েছিলেন।
ছোট, ফুটফুটে, সদাচঞ্চল যে বালকটিকে কবি আদর করে ‘গোরা’ বলে ডাকতেন, যে পঠনপাঠন, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলো, কসরতে মাতিয়ে রাখত শান্তিনিকেতনের বৃহত্তর প্রাঙ্গণ, ফুটবল প্রাঙ্গণ যাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষী বহন করছে, লেখাপড়া শেষে যিনি পুনরায় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনকেই জীবনের কর্মপ্রাঙ্গণ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, ১৯৪০-এ সেই গোরার অকাল প্রয়াণে গভীর শোক পান কবি। শান্তিনিকেতনে তাঁর স্মৃতিকে চির অক্ষয় করে রাখতে কবি লাইব্রেরির সামনের প্রাঙ্গণের নামকরণ করেন ‘গৌরপ্রাঙ্গণ’।
১৩১৭ বঙ্গাব্দের ১৩ জ্যৈষ্ঠ কবি তিনধরিয়া, দার্জিলিং থেকে তাঁর প্রিয় গোরাকে লিখেছিলেন, “অন্তরের মধ্যে যদি সত্যকে পাইয়া থাক তবে স্পর্শমণি পাইয়াছ— তাহার স্পর্শে সকল অবস্থাতেই তোমার সকল কাজই সুন্দর ও মহামূল্য হইয়া উঠিবে। যে কোন কাজই কর না কেন, মনকে সর্বদা ভূমার সহিত যোগযুক্ত করিয়া রাখিবার সাধনা করিবে।” কবিও যেন গোরাকে কোনও ভাবেই চোখের আড়াল করতে চাননি। তাই শান্তিনিকেতনের ‘ভূমার সহিত যোগযুক্ত করিয়া’ তাঁকে চিরন্তন করেছেন। আজও ‘গৌরপ্রাঙ্গণ’ সেই স্মৃতিকে আত্মস্থ করে জেগে আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy