Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

প্রথমে সানো জিন্নোসু, পরে শিনজো তাকাগাকি। দুজনেই এসেছিলেন জাপান থেকে। শান্তিনিকেতনের পড়ুয়া ও শিক্ষকেরা তাঁদের কাছে জুজুৎসু শিখতেন। মেয়েদের শেখানোর সময় প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং কবি। স্বপনকুমার ঘোষ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে ওকাকুরা-ই জাপানের বিশিষ্ট জুজুৎসুবিদ সানো জিন্নোসুকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ভাবধারার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জুজুৎসু শেখানোর জন্য কবি ‘সানো সান’কে নিয়োগ করলেন। এই জুজুৎসু চর্চাকে কেন্দ্র করে ভারত ও জাপান দুই দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল। 

কসরত: তাকাগাকি-র প্রশিক্ষণে শান্তিনিকেতনে জুজুৎসুর ক্লাস।

কসরত: তাকাগাকি-র প্রশিক্ষণে শান্তিনিকেতনে জুজুৎসুর ক্লাস।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৪২
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বহুমুখী শিক্ষার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের শিল্প-সংস্কৃতির আদান-প্রদান। চিন ও জাপান, এই দুটি দেশের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। এই সূত্রেই আশ্রমে শুরু হয় জাপানি কলা এবং জুজুৎসু চর্চা। নিরাপত্তার কারণেই, বিশেষ করে মেয়েদের স্বনির্ভর আত্মরক্ষার বিকল্প হিসেবে জুজুৎসুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, এটা মনেপ্রাণে অনুভব করেছিলেন তিনি।

জুজুৎসু কথার আক্ষরিক অর্থ, ‘দ্য সফট অ্যান্ড জেনারেল আর্ট’ বা ‘মৃদু মার্জিত শিল্প’। এটাই পরে হয়ে যায় ‘জুডো’।
জুজুৎসুর প্রধান উদ্দেশ্য কেবল শারীরিক সক্ষমতা প্রদর্শন নয়। এই চর্চার মধ্যে দিয়ে, নারী-পুরুষ যে কেউই নিজেদের দেহ ও মনের গঠনকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারেন। তাই সে কালে পরাধীন দেশে নিরস্ত্র মানুষের ব্যায়াম ও আত্মরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে জুজুৎসু চর্চার প্রয়োজনীয়তাকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন ক্রীড়ারসিক রবীন্দ্রনাথ।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমে তখন নিদারুণ অর্থকষ্ট। কিন্তু এ সবের মধ্যেই শান্তিনিকেতনে চালু হল জুজুৎসু। জাপানে কাকুজো ওকাকুরার কাছে সুপ্রাচীন আত্মরক্ষার কৌশল জুজুৎসুর বিষয়ে শুনে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগে ওকাকুরা-ই জাপানের বিশিষ্ট জুজুৎসুবিদ সানো জিন্নোসুকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ভাবধারার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জুজুৎসু শেখানোর জন্য কবি ‘সানো সান’কে নিয়োগ করলেন। এই জুজুৎসু চর্চাকে কেন্দ্র করে ভারত ও জাপান দুই দেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল।

জুজুৎসু শেখার জন্য ছাত্রদের মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিল। আর শিক্ষক সানো বেশ যত্ন নিয়ে আন্তরিক ভাবে তাঁদের জুজুৎসু শেখাতেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন সানো। কিছু দিনের মধ্যেই শিক্ষক ও ছাত্রদের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠল। সানোর জুজুৎসু শেখানোর কায়দা দেখে কবি অভিভূত হয়েছিলেন। প্রায় বছরখানেক সানো শান্তিনিকেতনে ছিলেন।

ছাত্রদের সঙ্গে সানো জিন্নোসু।

সানো দক্ষ কারুশিল্পীও ছিলেন। তিনি ছেলেদের নিয়মিত কাঠের কাজের ক্লাস নিতেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের আশ্রম ও বিদ্যালয়ের খরচ চলছে মূলত স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর গয়না বিক্রি করে। আর্থিক সঙ্কটের জন্যই সম্ভবত সানোকে আর বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কাজে রাখা যায়নি। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সানো বাংলা শিখেছিলেন। জাপানে ফিরে গিয়েও তিনি বাংলা ভুলে যাননি। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন দ্বিতীয় বার জাপানে যান, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করে, অনুমতি নিয়ে সানো ‘গোরা’র অনুবাদ করেছিলেন।

জুজুৎসু শেখানোর কলাকৌশল কবির মনকে স্পর্শ করেছিল। সে কারণেই তিনি আর্থিক অসুবিধা ও নানা বাধাকে উপেক্ষা করে, আবার শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৯২৯ সালে কানাডা থেকে দেশে ফিরবার পথে তিনি কিছু দিন জাপানে ছিলেন। টোকিয়োতে থাকাকালীন সেখানে আবার জুজুৎসু ও জুডো ব্যায়ামের কলাকৌশল দেখে তিনি মুগ্ধ হন। এর পরই তিনি জাপানের প্রাচ্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রবক্তা কুনিহিকো ওকুরাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এক জন জুজুৎসু শিক্ষককে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতনে পাঠানোর জন্য। তাঁরই উদ্যোগেই রবীন্দ্রনাথ শিনজো তাকাগাকিকে শান্তিনিকেতনে আসবার আমন্ত্রণ জানান। তাকাগাকি ১৯২৯ সালের নভেম্বরে শান্তিনিকেতনে এসে বিশ্বভারতীর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কবি চেয়েছিলেন কেবলমাত্র আশ্রমের ছেলেমেয়েরা নয়, সারা বাংলার মেয়েরা এই আত্মরক্ষার বিদ্যাটি আয়ত্ত করুক।

সিংহ সদনে জুজুৎসু প্রশিক্ষণ শুরু হল। বিদ্যালয়ে ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের জন্য জুজুৎসু শিক্ষা আবশ্যিক ছিল। তাকাগাকি জাপান থেকে এক ধরনের মোটা ছিট কাপড় আনিয়েছিলেন জুজুৎসুর পোশাক তৈরির জন্য। ক্যানভাস জাতীয় এই কাপড়কে জাপানি কায়দায় সেলাই করে জুজুৎসুর পোশাক তৈরি হত।

ছাত্ররা ছাড়াও কর্মী ও শিক্ষকদের মধ্যে মনোমোহন দে, প্রফুল্লকুমার দাশগুপ্ত, নৃপেন্দ্রনাথ দত্ত, অনুপানন্দ ভট্টাচার্য, সত্যেন বিশী, প্রশান্ত ভট্টাচার্য, গোরা বসু প্রমুখ জুজুৎসু শিখতেন। অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে ছাত্রীদের মধ্যে সাত-আট জন খুবই আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা হলেন অমিতা সেন, নিবেদিতা ঘোষ, যমুনা সেন, গীতা রায়, উমা দত্ত, সাবিত্রী কৃষ্ণণ, কুসুমিকা পাল, নীহারিকা পাল, জ্যোৎস্না বসু। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন গায়িকা অমিতা সেনও (খুকু)।

এক সময়ে সিংহ সদনের জানালা দরজা বন্ধ করে মেয়েদের জুজুৎসুর কলাকৌশল শেখানো শুরু হয়। মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে সিংহ সদনের সব বন্ধ দুয়ার ও জানালা খুলে গেল। ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু ও তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষ তাঁদের মেয়েদের প্রথম থেকেই জুজুৎসু শেখার অনুমতি দিয়েছিলেন।

সিংহ সদনের সামনের মাঠে ছেলেমেয়েদের ড্রিল বা কুচকাওয়াজ হত, আর ঘরের মধ্যে ব্যায়াম। পরে জাপান থেকে তৈরি হয়ে এসেছিল জুজুৎসুর পোশাক। মেয়েদের পরতে হত সাদা কিমোনো ধরনের পোশাক। এর কাপড় খদ্দরের চেয়ে মোটা। বিশেষ করে জুজুৎসু শেখানো হয়েছিল দুটি জুটিকে। প্রথম জুটি হলেন অমিতা দেবী ও নিবেদিতা দেবী, আর দ্বিতীয় জুটি যমুনা দেবী ও গীতা দেবী। জুজুৎসু শেখানোর সময় রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন। এতে যে শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হতেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

তাকাগাকির আন্তরিক উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু চর্চা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় পঞ্চাশ থেকে বেড়ে চারশো জন হয়! সিংহসদনে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে গেলে, কখনও গৌরপ্রাঙ্গণেও জুজুৎসু শেখানো হয়েছে। জুজুৎসু চর্চার খবর পেয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেরল থেকে মেনন ভ্রাতৃদ্বয়, কলকাতা থেকে নির্মলকুমার বসু, কুমার সিংহ নাহার, সন্তোষ দত্ত প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

তাকাগাকি শান্তিনিকেতনে প্রায় দু’বছর ছিলেন। তাঁর বেতন ও যাতায়াত ইত্যাদি বাবদ খরচ হয়েছিল প্রায় চোদ্দো হাজার টাকা।

ছবি সৌজন্য: বিশ্বভারতী রবীন্দ্র ভবন

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Shantiniketan Jujutsu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy