তিনি এত ভাল কথা বলেন কী ভাবে জানতে চাইলে যাদবচন্দ্র প্রথমেই তাঁর পাড়ার কথা বলেছিলেন। যাদবচন্দ্র বালেশ্বরে ‘নিমকি’র দারোগা। লোকে সমুদ্রের জলে কত নুন তৈরি করছে, কর দিচ্ছে কি না, আইনশৃঙ্খলা বজায় থাকছে কি না, সে সব দেখাই নিমকি বা নিমকমহলের দারোগার কাজ। চমৎকার তাঁর বাকচাতুর্য। বালেশ্বরের কালেক্টর হেনরি রিকেট এক দিন তাঁর কথা বলা, যুক্তিবিন্যাসে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আচ্ছা, তুমি কি পণ্ডিত?’’ দারোগার উত্তর, ‘‘পণ্ডিত নই, তবে পণ্ডিতসমাজে বাস করি। আমার বাসস্থান গঙ্গার ধারে, হুগলির কাছে। সেখানে অনেক পণ্ডিত ও সভ্য লোক থাকেন।’’
ভাটপাড়ার কাছে নৈহাটির বাসিন্দা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পণ্ডিত বংশেরই ছেলে। তাঁর পূর্বপুরুষ গঙ্গানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন টোলের পণ্ডিত। ভবিষ্যতে এই যাদবচন্দ্রের ছেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-ই বাংলা গদ্যসাহিত্যকে আধুনিকতার দিশা দেখাবেন। কিন্তু সে সব পরের প্রশ্ন। নৈহাটি, ভাটপাড়া নিয়ে সেখানকার মানুষ যে কী রকম গর্বিত ছিলেন, যাদবচন্দ্রের ওই উক্তিই তার প্রমাণ!
গর্বিত হবেন না-ই বা কেন? মধ্যযুগে বাঙালির বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। শ্রীচৈতন্য ছিলেন, উপরন্তু স্মার্ত রঘুনন্দন থেকে নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি, তন্ত্রবিশারদ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, সকলেই উঠে এসেছিলেন নবদ্বীপের চতুষ্পাঠী থেকে।
বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই নবদ্বীপের পরের স্টেশনই ভাটপাড়া। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের পর ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু, নদে ভেসে যায়।’ পলাশির যুদ্ধের সমসাময়িক, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজ্যে এক বিচারসভা ডেকেছিলেন। সেই বিচারসভায় সে দিন যোগ দিতে গিয়েছিলেন আশি বছর পেরোনো বৃদ্ধ বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কার।
বীরেশ্বর হলেন নারায়ণ ঠাকুর নামে বিখ্যাত এক সিদ্ধপুরুষের পৌত্র। নারায়ণ ঠাকুরের শিষ্য পরমানন্দ হালদার গঙ্গাতীরে ভাটপাড়ার জায়গাটি গুরুদেবকে দান করেন। গুরুদেব কান্যকুব্জ থেকে আসা পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি ভাটপাড়ায় চলে আসেন, অতঃপর তাঁর পুত্র চন্দ্রশেখর ন্যায়বাচস্পতি ভাটপাড়ায় প্রথম টোল খোলেন। সেই ন্যায়বাচস্পতির পুত্র বীরেশ্বর অশক্ত, বৃদ্ধ শরীরে গেলেন নবদ্বীপের বিচারসভায়। গেলেন ৩২ জনকে নিয়ে। কেউ তাঁর পৌত্র, কেউ বা ছাত্র।
বিচারসভায় জ্যোতিষ্কের ভিড়। ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, ফরিদপুরের কোটালিপাড়া থেকে এসেছেন বিখ্যাত পণ্ডিতেরা। তিন দিন ধরে চলল বাদ-বিতণ্ডা। প্রতিটি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেলেন বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কার। তাঁর সৌজন্যেই সে দিন ভাটপাড়ার নাম হল ‘নব নবদ্বীপ’।
পরাজয় কি একটা? কয়েক প্রজন্ম পরে এলেন শ্রীরাম শিরোমণি। তাঁকে ‘নবদ্বীপগৌরব’ বলা হত। ন্যায়শাস্ত্রের তর্কে তাঁকে পরাস্ত করলেন নৈহাটির পণ্ডিত নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চু— হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দাদা।
নৈহাটি নবদ্বীপকে হারালে ভাটপাড়াই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? নড়াইলের জমিদার রতন রায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মতো এক বিচারসভা ডাকলেন, সেখানে শ্রীরাম শিরোমণিকে বিতর্কে হারালেন ভাটপাড়ার হলধর তর্কচূড়ামণি। নবদ্বীপ বনাম ভাটপাড়াতেই গল্প শেষ হল না। বর্ধমান মহারাজার ডাকা এক বিচারসভায় আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতীকে সাকার-নিরাকার বিবাদে পরাস্ত করলেন তারাচাঁদ তর্করত্ন। ভাটপাড়া তখন বাংলার অক্সফোর্ড!
এই গর্বের ইতিহাসটাই আমরা ভুলে গিয়েছি। ভাটপাড়া মানে শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ বনাম ‘জয় বাংলা’ নয়। ভাটপাড়া মানে বাংলার শিক্ষা-ঐতিহ্য। উনিশ শতকের মাঝামাঝিও সেই ‘ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়’-এ ৪৮টি চতুষ্পাঠী, দেড়শোরও বেশি অধ্যাপক। ব্রিটিশ সরকার সেরা পণ্ডিতদের ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধিতে ভূষিত করতেন। তখনকার সংস্কৃতজ্ঞদের মধ্যে আজকের ‘ভারতরত্ন’র মতোই ছিল সেই সম্মান। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে গোপীনাথ কবিরাজ, তামিলনাড়ুর স্বামীনাথ আয়ার ভূষিত হয়েছেন এই সম্মানে। উনিশ শতকের শেষ ভাগে সারা ভারতে জীবিত ‘মহামহোপাধ্যায়’ ১৯ জন, পাঁচ জনই ভাটপাড়ার।
মুশকিল অন্যত্র। আধুনিক বাঙালি ভাটপাড়া বলতেই ভাবে পাঁজিপুঁথি, তিথিনক্ষত্রে বিশ্বাসী রক্ষণশীল কিছু টুলো পণ্ডিত। এই আধুনিকেরা সংস্কৃত জানেন না, নিজেদের ঐতিহ্যও জানেন না। নবদ্বীপকে তর্কে হারিয়ে ভাটপাড়ায় যিনি ন্যায়চর্চার জোয়ার নিয়ে এসেছিলেন, সেই অশীতিপর বীরেশ্বর তর্কালঙ্কারের পৌত্র ভৈরব বিদ্যাসাগর। প্রসঙ্গত, ‘বিদ্যাসাগর’ শব্দটি বুদ্ধ, মহামহোপাধ্যায়ের মতোই একটি উপাধি। বৌদ্ধ শাস্ত্র বলে, সিদ্ধার্থ গৌতম ছাড়া আরও অনেক বুদ্ধ ছিলেন। আর সংস্কৃতের ইতিহাস বলে, বীরসিংহ গ্রামের ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও এ দেশে অনেক ‘বিদ্যাসাগর’ ছিলেন।
ভৈরব বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ভাটপাড়ার অন্য পণ্ডিতদের মতবিরোধ হয়েছিল। পণ্ডিতদের তখন নিয়ম, টোলে অব্রাহ্মণ ছাত্র নেওয়া যাবে না। ভৈরব তা মানতে নারাজ। তিনি ভাটপাড়া ছেড়ে কাশীতে গিয়ে টোল খুললেন। প্রায় ৯০০ দক্ষিণ ভারতীয় ছাত্র সেই টোলে পড়ত। বিশ্বনাথ মন্দিরের শহরে ভাটপাড়ার এক প্রতিবাদী ব্রাহ্মণের ঔজ্জ্বল্য বাঙালি আজ ভুলে গিয়েছে।
ঔজ্জ্বল্যের ঝিলিক বিচিত্র জায়গায়, বিচিত্র পথে। স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিধবা মেয়ের বিয়ে, পণ্ডিতেরা ‘কদাপি নয় কদাপি নয়’ করছেন। ভাটপাড়ার পণ্ডিত শিবচন্দ্র সার্বভৌম দিলেন অনুমতি। ১৮৯২ সালে মহেন্দ্র রায় নামে স্থানীয় এক বঙ্গতনয় বিলেত যাবেন, তা নিয়ে ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজে প্রবল ঝড়। ১৮৯২-এর ২৭ জুলাই বঙ্কিমচন্দ্র ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় সমুদ্রযাত্রার পক্ষে ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের বিপক্ষে মত দিলেন। ঝড় প্রবল হল। ভাটপাড়ার তরুণ পণ্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন ‘বঙ্কিমবাবুর সমুদ্রযাত্রা’ নিবন্ধে পাল্টা উত্তর দিলেন, ‘‘আমরা পূর্ব হইতেই জানি, সমুদ্রযাত্রায় মত আর কাহারও না হউক, সুরেন্দ্রবাবু, ডব্লিউ সি ব্যানার্জি, বঙ্কিমবাবু, রমেশ দত্ত প্রমুখ কতিপয় বাবুসাহেবের মত হইবেই।’’
বিতর্কের আগুনে ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন ভাটপাড়ার বৈদিক ব্রাহ্মণদের নেতা মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্ন। সংস্কারের গণ্ডি ভেঙে বঙ্কিমকেই সমর্থন করলেন। তাঁর বয়স তখন ষাটের ওপরে। বুড়ো বয়সে কালাপানি পেরোনোকে সমর্থন করার অপরাধে ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ তাঁকে অচ্ছুৎ মনে করত, রাখালদাস হেঁটে গেলে সেই রাস্তায় গোবরজলের ছড়া দেওয়া হত। সমাজের আর পাঁচ জনের কথা না শুনে বার্ধক্যেও ন্যায়ের পক্ষে, বিচারবুদ্ধির পক্ষে স্থিত থাকার ঐতিহ্যই ভাটপাড়া!
আজকের বাংলা সাহিত্যেও কি নেই ভাটপাড়ার উজ্জ্বল অবদান? ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লেখা সমাপ্ত, বঙ্কিম শুনতে চাইছেন তাঁর এলাকার পণ্ডিতসমাজের মত। এই রোমান্স বাংলা ভাষায় আগে হয়নি, সংস্কৃতবহুল বিদ্যাসাগরি তৎসম বা হুতোমি ভাষার দেশজ স্রোত পেরিয়ে কেউ ঘোষণা করেনি ‘বন্দি আমার প্রাণেশ্বর’!
রীতিমতো টেনশন নিয়েই সে দিন উপন্যাস পড়ে শোনালেন বঙ্কিম। তার পরই ভাটপাড়ার চন্দ্রনাথ বিদ্যারত্নের বিখ্যাত উক্তি: আমি স্থানে স্থানে ব্যাকরণদোষ লক্ষ্য করিয়াছি বটে, কিন্তু সেই স্থানে ভাষা আরও সুন্দর হইয়াছে। আর এক শ্রোতা মধুসূদন স্মৃতিরত্নের বক্তব্য ছিল, ‘গল্প ও ভাষার মোহিনী শক্তিতে আমরা এতই আকৃষ্ট হইয়াছি যে সাধ্য কি অন্য দিকে মনোনিবেশ করি!’ সাহিত্যের ভাষা যে কখনও কখনও ব্যাকরণের নিগড় ভেঙে বেরোনোর ক্ষমতা রাখে, ভাটপাড়া জানত।
জানবে না-ই বা কেন? সে দিন ‘দুর্গেশনন্দিনী’র অন্যতম শ্রোতা মধুসূদন স্মৃতিরত্নের ছেলে হৃষীকেশ শাস্ত্রী। তিনি ইংরেজি পড়তে চান, কিন্তু ভাটপাড়ার রক্ষণশীল সমাজে ম্লেচ্ছভাষা শেখা তখন অসম্ভব। হৃষীকেশ গেলেন পঞ্জাব, ইংরেজি শিখে শেক্সপিয়রের নাটকে এতই পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন যে সংস্কৃতে লিখে ফেললেন ‘হ্যামলেট চরিতম্।’ আজকের ‘বহুভাষিক সংস্কৃতি’র চেতনা থেকে সম্ভবত ভাটপাড়ার স্মার্ত ব্রাহ্মণরাও বঞ্চিত ছিলেন না।
আসলে, ভাটপাড়া তো নিজেকে বদলেছে বারংবার। একদা ওই এলাকার টোলগুলিতে মুখ্যত সাংখ্যদর্শন, স্মৃতিশাস্ত্র, জ্যোতিষ ও ন্যায়চর্চা হত। ছেলেবেলার স্মৃতি ঘাঁটতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তও লিখে গিয়েছেন, এই বঙ্গে বেদচর্চা বিশেষ ছিল না। রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে ভাটপাড়ার পণ্ডিত গোবিন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। লোকনিন্দার ভয়ে তিনি প্রকাশ্যে বেদান্ত আলোচনা করতেন না। অথচ, কয়েক প্রজন্ম পরে ভাটপাড়া থেকেই উঠে আসবেন মহামহোপাধ্যায় প্রমথনাথ তর্কভূষণ। আজও তাঁর লেখা ‘মায়াবাদ’ বা গীতার শাঙ্করভাষ্যের আনন্দগিরি টীকার বঙ্গানুবাদ বাঙালির অনন্য সম্পদ। ভাটপাড়া কোনও দিনই অনড়, স্থাণু সংস্কৃতি ছিল না।
এই সংস্কৃতি আসলে এক জায়গায় অনেক পণ্ডিত বসবাস করে বিদ্যা বিস্তারের সংস্কৃতি। শ্যামলী চক্রবর্তী তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র এবং ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজ’ বইয়ে পরিষ্কার জানিয়েছেন, বাংলায় এক নয়, একাধিক ভাটপাড়া ছিল। রাজা বসন্ত রায়ের আমলে যশোহর পণ্ডিতদের বাসস্থান হিসাবে বিখ্যাত। সেখানে ভৈরব নদের তীরে ছিল একটি ভাটপাড়া। খুলনাতে সোনাই নদীর তীরে ছিল ভাটলা-ভাটপাড়া। মুখ্যত ভট্ট আচার্য অধ্যুষিত অঞ্চলই লোকের মুখে মুখে ভাটপাড়া নামে বিখ্যাত হত।
আজ নৈহাটি, কাঁকিনাড়া সংলগ্ন যে ভাটপাড়া অন্যদের হারিয়ে উঠে এল, তার উত্থান ১৬৬০-৭০ নাগাদ। পণ্ডিতরা তত দিনে সেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত। হিন্দু ঐতিহ্য বজায় রাখতে ‘জয় শ্রীরাম’ বা যাই বলুন, মুঘল শাসনকে বাদ দিয়ে ভাটপাড়ার আদিপর্ব সম্ভব নয়। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে দুর্লভানন্দ নামে এক ব্রাহ্মণকে ‘হালদার’ খেতাব-সহ ভাটপাড়া অঞ্চলে জায়গির দেওয়া হয়। দুর্লভানন্দের ছেলে পরমানন্দ হালদার যশোহরের ধূলিপুর-ধলবেড়ে গ্রামের পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠ গোত্রীয় নারায়ণ ঠাকুরের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। আজও ভাটপাড়া বিদ্যাসমাজে বেশির ভাগই যশোহর খুলনা থেকে আসা বৈদিক ব্রাহ্মণ। এঁদের কেউ কেউ কনৌজ থেকে এসে প্রথমে মেদিনীপুর অঞ্চলে থাকতেন। অতঃপর যশোহর, খুলনা, সেখান থেকে ভাটপাড়া। বাৎস্য গোত্রীয় রামভদ্র প্রথমে গোবিন্দপুর গ্রামে বাস করতেন। সেখান থেকে যশোহর হয়ে ভাটপাড়া। এখনও কুলজি গ্রন্থগুলি জানায়, ভাটপাড়ার অনেক পণ্ডিত বল্লালসেনের আমলে এই বঙ্গে এসেছিলেন। কিন্তু নীহাররঞ্জন রায় থেকে হাল আমলে রণবীর চক্রবর্তী অবধি বহু ইতিহাসবিদই কুলজি গ্রন্থকে ইতিহাসের সম্মান দিতে নারাজ। বস্তুত ভাটপাড়ায় ন্যায়, দর্শনের পাশাপাশি আয়ুর্বেদ এবং জ্যোতিষচর্চাও উল্লেখ্য ছিল। আয়ুর্বেদের শিক্ষক ও ছাত্রেরা মুসলিম নবাবদের চিকিৎসাও করতেন। গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার শুরুতে সেখানকার বিভিন্ন জ্যোতিষী উঠে এসেছিলেন ভাটপাড়া-সংস্কৃতি থেকেই।
বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাটপাড়ায় এসে পণ্ডিতদের বসতি স্থাপনা, বিদ্যাচর্চাই এই জনপদের মুখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। কালনা থেকে আসা মহামহোপাধ্যায় বীরেশ্বর তর্কতীর্থ পড়তেন ভাটপাড়ার মহামহোপাধ্যায় শিবচন্দ্র সার্বভৌমের কাছে। যশোহরের মহামহোপাধ্যায় আশুতোষ তর্কভূষণ শিক্ষালাভ করেছেন ভাটপাড়ার হরিনাথ তর্কসিদ্ধান্তের কাছে। মহামহোপাধ্যায় গুরুচরণ তর্কদর্শনতীর্থ ত্রিপুরার ছেলে, ন্যায়দর্শন শিখেছেন ভাটপাড়ার টোলে। ১৯২৩ সালের পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক তিনি। বিচিত্র জায়গা থেকে আসা বিচিত্র ছাত্রের সমাহার বুঝিয়ে দেয়, আগ্রহী শিক্ষার্থীই ছিল সব। ভাটপাড়ার পণ্ডিত সমাজে কেউ ‘বহিরাগত’ নয়।
টোল ছিল, ছিল কলেজও। সজল চৌধুরী তাঁর ‘মহামহোপাধ্যায়জ় অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে দেখিয়েছেন, পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর তখন মুলাজোড়ে একটি সংস্কৃত কলেজ তৈরি করেছিলেন। শিবচন্দ্র সার্বভৌম এবং অনেকেই সেখানে অধ্যাপনা করতেন। গোপীমোহন তখনকার হিন্দু কলেজ তৈরির জন্য মোটা অঙ্কের অর্থসাহায্য করেছিলেন, কালীঘাটে দেবীর জিভ সোনায় গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে মুলাজোড় কলেজ! ভাটপাড়া জানত, ‘টোল’ না ‘কলেজ’ এই সব নামে কিছু আসে যায় না। শিক্ষাদানই আসল!
কেমন ছিল এই শিক্ষাব্যবস্থা? টোল মানে, দূরাগত ছাত্রদের গুরুগৃহে বাস। বিদ্যাদানের জন্য গুরু বেতন নিতেন না। ভাটপাড়ার অভাবি গুরু ছাত্রদের খরচ চালাতে না পেরে পিতলের হাঁড়ি বিক্রি করে চাল, ডাল এবং রান্নার জন্য মাটির হাঁড়ি কিনে এনেছেন, এমন ঘটনাও আছে।
পড়া শুরু হত সাতসকালে। চলত দুপুর অবধি, তার পর তিন ঘণ্টা স্নান, আহ্নিক, নিদ্রার বিরতি। ফের বিকেল তিনটে থেকে সন্ধ্যা অবধি। তার পর দু’ঘণ্টার বিরতি— সন্ধ্যাহ্নিক, ভোজন ও বিশ্রাম। ফের পড়া শুরু, চলত রাত দশটা অবধি। প্রতিপদ, অষ্টমী ও ত্রয়োদশীতে স্মৃতির পাঠ নিষিদ্ধ। ছাত্রেরা তখন স্মৃতিশাস্ত্র না পড়ে কাব্য অধ্যয়ন করত।
এখনকার মতো লিখিত পরীক্ষা নয়, ভাটপাড়া, নবদ্বীপের টোলে সবই মৌখিক আলোচনা। গুরু একা তিরিশ জন ছাত্রের ওপর নজর রাখছেন এমন নয়। সিনিয়র ছাত্রেরা ছোটদের সঙ্গে আলোচনা করছে, বিতর্ক করছে, কোথাও খেই হারিয়ে গেলে গুরু ধরতাই দিচ্ছেন। তারই মধ্যে কোনও রাজা বা জমিদার বিচারসভা ডাকলে গুরু প্রিয় শিষ্যদের নিয়ে সেখানে যেতেন। গুরু বিচারসভায় আমন্ত্রিত মানে, সঙ্গে প্রিয় শিষ্যরাও রয়েছে।
কোনও প্রিয় ছাত্র যদি ভবিষ্যতে নিজের টোল খুলতে চাইত? তাকে দিতে হত শলাকাভেদ পরীক্ষা। নির্দিষ্ট বিষয়ের পুঁথিতে নির্দিষ্ট দিনে একটি সূচ বিঁধিয়ে দিতেন গুরু। সূচের ডগা যে পৃষ্ঠায় গিয়ে ঠেকত, সেখান থেকেই অধ্যাপকরা হরেক প্রশ্ন করতেন। নিজের গুরু ছাড়া, বাইরের টোল থেকে অারও পণ্ডিত প্রশ্ন করতে অাসতেন। অনেকটা আজকালকার ‘এক্সটার্নাল’ পরীক্ষকদের মতো। সোজা কথায়, শিক্ষক হতে গেলে এখনকার বি এড পরীক্ষায় তাও নির্দিষ্ট সিলেবাস থাকে, ভাটপাড়ায় সেটিও ছিল না।
কে কোন বিষয়ের অধ্যাপক, তা নিয়ে শ্রেণিবৈষম্যও ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখে গিয়েছেন, ‘ভট্টাচার্যদিগের মধ্যে কাব্য ও ব্যাকরণের পণ্ডিত হেয় ছিলেন।...অন্যপক্ষে স্মৃতির পণ্ডিতদিগের মান ব্যাকরণওয়ালাদিগের অপেক্ষা অধিক ও নৈয়ায়িকদিগের অপেক্ষা অল্প ছিল।’ সোজা কথায়, ন্যায়দর্শন না জানলে ভাটপাড়ার পণ্ডিতসমাজে তখন কল্কে পাওয়া যেত না।
যেখানে উত্থান, সেখানেই লুকিয়ে ছিল অবনতির বীজ। বাংলার অন্যান্য ‘ভাটপাড়া’কে ছাপিয়ে নৈহাটি শ্যামনগর কাঁকিনাড়া অঞ্চলের ভাটপাড়া যে প্রধান হয়ে উঠল তার অন্যতম কারণ, সে রাজধানী কলকাতার কাছে। মুদ্রণযন্ত্র, রেলগাড়ি এবং আধুনিকতার হরেক সুবিধা। আধুনিকতার বয়ানেই এই এলাকায় ঢুকে এল চটকল, বিভিন্ন কারখানা। ব্রাহ্মণসমাজ আর যজনযাজন অধ্যাপনা নিয়ে আলাদা থাকতে পারলেন না। নতুন গঞ্জ, শ্রমিক মহল্লা, ভাটিখানা, সবই ছড়িয়ে পড়ল দুর্বার গতিতে। সেই নতুন বাংলায় আর ন্যায়শাস্ত্র নেই, ফণিভূষণ তর্কবাগীশ থেকে শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ সকলে বিস্মৃত। এই ভাটপাড়া-নৈহাটি-জগদ্দল উঠে এল সমরেশ বসুর ‘বিটিরোডের ধারে’ বা ‘শ্রীমতী কাফে’র মতো উপন্যাসে।
শুধু ন্যায়শাস্ত্রের টোলগুলি হারিয়ে গেল। এ শুধু ভাটপাড়া নয়, গোটা বাংলার ট্র্যাজেডি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy