অপরূপ: লা গোমেরা দ্বীপ। শিস-ভাষায় যোগাযোগ করেন এখানকার মানুষ
স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ বিখ্যাত তার বিপুল সামুদ্রিক জীববৈচিত্র, কার্নিভাল আর পর্যটনের জন্য। আর একটা বিশেষ কারণও আছে, তা হল ‘গোমেরার শিস’— ‘এল সিলবো গোমেরো’। অতলান্তিক মহাসাগরে আফ্রিকার উপকূলের কাছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে নির্গত লাভায় সৃষ্টি হওয়া ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জেরই একটি ছোট্ট দ্বীপ ‘লা গোমেরা’। ফার্ন আর মসে ঢাকা বড় বড় গাছের ঘন জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা এই সবুজ দ্বীপের অনন্য বৈশিষ্ট্য এখানকার সুরেলা ভাষা, এল সিলবো গোমেরো। বহু যুগ ধরেই এ ভাষা চলে এসেছে ইউরোপের এই দ্বীপাঞ্চলের নানা দ্বীপে। তবে বর্তমানে একে বাঁচিয়ে রেখেছে একমাত্র গোমেরা।
গোমেরার অধিবাসীরা সুরে সুরে কথা বলেন। কোনও শব্দের উচ্চারণ নেই, কথা বলা হয় তীক্ষ্ণ শিসের মাধ্যমে সুর ওঠানামা করিয়ে। সেই শিস শোনা যায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেও। খাড়া পাহাড়, গভীর গিরিখাদে ভরা অতীতের গোমেরায় গ্রাম থেকে গ্রামে দ্রুত গতিতে খবর পৌঁছনোর সহজ রাস্তা ছিল এটাই। শিস দিতে জানাটা একান্ত জরুরি ছিল জনসংযোগের জন্যই।
ইতিহাস বলছে, শিস দিয়ে যোগাযোগের প্রথার শুরু সেই রোমান যুগ থেকে। গোমেরা ছাড়াও পৃথিবীর আরও কিছু জায়গায় এখনও এ ভাবে কথা বলা হয়। তা হলে গোমেরা আলাদা কিসে? গোমেরার শিস-ভাষা স্বতন্ত্র, কারণ তার একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা কাঠামো আছে, তার ‘ফোনেটিক ট্রান্সক্রিপশন’ আছে, এবং এই ধরনের ভাষাগুলির মধ্যে এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সর্বাধিক। প্রায় ২২ হাজার মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এই অতুলনীয় ভাষাকে তাই ইউনেস্কো ২০০৯ সালে ‘মাস্টারপিস অব দি ওরাল অ্যান্ড ইনট্যাঞ্জিব্ল ওয়র্ল্ড হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’-র সম্মান দিয়েছে।
এই ভাষার উৎপত্তি নিয়ে মতভেদ বিস্তর। স্পেনীয়রা পঞ্চদশ শতকে এই অঞ্চল দখল করে। তখন এখানকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী ‘গুয়ান্চে’-র মানুষেরা এই ভাষাতেই কথা বলতেন। অনেকের মতে এই জনগোষ্ঠী আসলে উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত জনজাতি, যেখানে এই ভাবে শিস দিয়ে কথা বলা প্রচলিত ছিল। এঁরাই ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের আদি বাসিন্দা। ১৯৪০-৫০ অবধি গোমেরায় বহুল প্রচলিত ছিল এ ভাষা। ১৯৫০-এর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মানুষ দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দেওয়ায় এই ভাষায় কথা বলার লোকসংখ্যা কমতে থাকে। টেলিফোনের ব্যবহার, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রচলনও এই ভাষার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়। গোমেরার ফসল চাষের খেত পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে উঠে যেত প্রায় পাহাড়ের চূড়া অবধি। দূরের ফসলখেতের চাষিরা একে অন্যের সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন এই শিসের সাহায্যেই। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০-র দশকে এখানকার মানুষ অন্য জীবিকায় সরে যেতে থাকেন। আরও কমে যায় এই ভাষার ব্যবহার।
অনেকেই ভাবতেন, এ চাষাভুষোর ভাষা। তথাকথিত আধুনিক ও সচ্ছল মানুষেরা নিজেদের সন্তানদের এই ভাষা শেখাতে চাইতেন না, পাছে লোকে তাঁদের ‘গ্রাম্য’ বলে। ষাটের দশকে এই ভাষা প্রায় হারিয়ে যেতে বসে। ভাষাতাত্ত্বিক রামোন ত্রুখিইয়ো কাররেন্যিয়ো-র বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই মনোভাবের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ১৯৭৮ সালে তাঁর বই ‘এল সিলবো গোমেরো’ প্রকাশিত হওয়ার পর জনমানসে এই ভাষার মর্যাদা ফিরে আসে। ১৯৯০-এ ভাষার পুনর্নবীকরণ প্রকল্প শুরু হওয়ায় অবলুপ্তি থেকে একে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে সরকারের উদ্যোগে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই ভাষা, ফিরে পেয়েছে হারানো সম্মান। এখন শিশুরাও পরিবারে বা স্কুলে এই ভাষা শিখছে। এই ভাষার বিশেষজ্ঞরা সরকারি কেন্দ্রে গিয়ে বিনা পয়সায় এই ভাষা শেখাচ্ছেন। ভাল সাড়া মিলেছে। ১৯৯৭ সালে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের সরকার এই ভাষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে পাঠ্য তালিকাভুক্ত করেন। প্রাথমিক ও তার পরবর্তী শিক্ষাক্রমে এই ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯৯৯ সালে একে ‘এথনোগ্রাফিক হেরিটেজ’ বলে ঘোষণা করা হয়। উচ্চ শিক্ষা স্তরে যে সব ছাত্রছাত্রী এই ভাষা শেখাতে ইচ্ছুক, তারা পেশাদার হয়ে এই কাজ করতে পারে। এমনকি দ্বীপে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও এই ভাষা শিখতে পারেন। সরকারি তরফে ডিপ্লোমা কোর্সের ট্রেনিংও হয়।
লা গোমেরা দ্বীপের প্রাচীন এই ভাষা এখন সেখানকার অতীত ও ভবিষ্যতের সেতু। এ ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্র নিয়ে গবেষণাও চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাষাতাত্ত্বিকরা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যৌথ ভাবে কাজ করছেন। সংখ্যালঘু জনজাতি সম্প্রদায়ের এই বাচিক ঐতিহ্যকে অবলুপ্তি থেকে বাঁচানো, এই ভাষার নথিভুক্তকরণ ও সম্প্রসারণ, বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণই গবেষকদের লক্ষ্য। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, গোমেরার ভাষায় আছে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণও। মাত্র দুটি স্বরবর্ণ, চারটি ব্যঞ্জনবর্ণ। এই ছোট্ট বর্ণমালা দিয়েই এখানে স্প্যানিশ ভাষা অনূদিত হচ্ছে সুরেলা ভাষায়। যে কোনও ভাষারই অনুবাদ সম্ভব।
এই ভাষায় স্বরতন্ত্র বা ভোকাল কর্ডের ভূমিকা নেই, যেহেতু ঠোঁট, জিভ ব্যবহার করে অথবা একটি বা দু’টি আঙুল মুখে পুরে শিস দেওয়া হয়। বিশেষ ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশ যে এই ভাষার প্রসারের কারণ, তা তো বলা হয়েছে আগেই। দুর্গম বিচ্ছিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে এক দিকে যেমন
এই ধরনের ভাষা ব্যবহারকারীদের শ্রবণ-দক্ষতা অভিযোজিত হয়েছে, তেমনই অভিযোজন ঘটেছে ধ্বনি তৈরির সামগ্রিক ব্যবস্থাটিরও। এই সব বৈশিষ্ট্যই ভাষা বিবর্তনের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবে গোমেরা-র ভাষা কী ভাবে গোষ্ঠীর সবাইকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে রাখে, তার উদাহরণ এখানকার একটি প্রাচীন প্রথা— ‘ডেথ হুইস্ল’। সাধারণত পাহাড়ের উঁচুতে যাঁরা থাকেন তাঁদের মধ্যে এক জন এই শিস দেওয়া শুরু করেন, যাতে সেটা দূর থেকেও সহজেই শোনা যায়। সব দলেই এক জন করে মুখ্য ব্যক্তি থাকেন, এঁদের বলে ‘লিংক’। এক দল থেকে আর এক দলে শিস দিয়ে সংযোগ রাখেন এই ‘লিংক’-রা। সারা দিন কাজ শেষে সবার ঘরে ফেরার সময় পাহাড়ের উপর থেকে আসা শিসের উত্তরে শিস দেওয়া শুরু করেন ‘লিংক’ মানুষটি। যদি সে দিন কারও মৃত্যু হয়ে থাকে, তাঁর নাম উচ্চারিত হয় শিসের সুরে। সেই নাম ধ্বনিত হতে থাকে এক গ্রাম
থেকে অন্য গ্রামে, পুরো দ্বীপবাসীই তা জানতে পারেন। মৃত মানুষটিকে এ ভাবেই স্মরণ করেন সবাই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই অনন্য লোকসংস্কৃতির ধারা বজায় রেখে চলেছেন দ্বীপের অধিবাসীরা।
লা গোমেরা-র সুরেলা শিস ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রকার ও আলোকচিত্রী ফ্রান্সিসকা ফিলিপস-এর ২০০৯ সালের তথ্যচিত্র ‘রিট্ন ইন দি উইন্ড’ চিন-এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব পর্বত তথ্যচিত্র উৎসবে ২০১০ সালের শ্রেষ্ঠ
পুরস্কার জিতে নিয়েছে। প্রাক-ঔপনিবেশিক এই সুরেলা ভাষার ‘বাচিক ঐতিহ্য’ হয়ে উঠেছে লা গোমেরার বাসিন্দাদের পরিচয়পত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy