ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।
দু’বছর ধরে দাপানো ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ এসেছিল মোটে ১০৩ বছর আগে। তারও ১০০ বছর আগে কুখ্যাত ‘বর্ধমান ফিভার’ দেখেছিলাম আমরা, যার পরমায়ু ছিল কয়েক দশক। ১৮২৪-এ যশোরে শুরু, যা নিয়ে গোপালচন্দ্র রায় ১৮৭৫-৭৬ সালে লিখেছিলেন, আনন্দমুখর সেই সব গ্রামে আর শিশুর হাসির রোল নয়— ‘নাউ রিসাউন্ড উইথ লাউড ওয়েলিংস অ্যান্ড ল্যামেন্টেশন্স’। লালবিহারী দে-ও বর্ধমান প্রসঙ্গেই লিখেছিলেন, ‘পুকুরধারের চিতা আর নিভতে চায় না, প্রতিদিনই শোনা যায় কেবল হরিবোল।’
আসলে ‘মহা’ হোক বা ‘অতি’, মারি-রা কি সহজে কোনও কালে বিদেয় হয়েছে? ওলাওঠা, ম্যালেরিয়া আমাদের গাঁ-কে গাঁ নির্বংশ করেনি? আজকের মতো সে দিনও তো করোনার মতো সংক্রামক ব্যাধিতে মৃত মানুষকে তার নিকটাত্মীয়রা ত্যাগই দিতেন। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ১২৯৯ বঙ্গাব্দের দোলপূর্ণিমায় তাঁর পিতাঠাকুর কলেরায় দেহ রাখলে ‘গ্রামের জনপ্রাণী কেহ তাঁহাকে দেখিতে আসে নাই। এবং সৎকারের ব্যবস্থাও করে নাই।’ ১৮৬৯-এ ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’-এ প্রকাশিত এক খবর পড়লে তো শিউরে উঠতে হয়। শ্রীক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে নদিয়ার কোনও গ্রামের ১৬ বছরের এক কিশোরী কলেরায় আক্রান্ত হলে তার ‘পাষাণ জননী’ নিজেরও বিপদ হবে জ্ঞান করে তাকে ফেলে আসেন। কাগজ বলছে, ‘বলিতে হৃদয় দীর্ণ হইয়া যায় কন্যাটী যখন দেখিল জননী পরিত্যাগ করিয়া দেশাভিমুখে গমন করিতেছে, দুর্ভাগিনীর বাকশক্তি ছিল না এ কারণ কথার দ্বারা জননীকে কিছু বলিতে না পারিয়া কেবল নয়নজলে বক্ষস্থল প্লাবিত করিয়াছিল।’ চিকিৎসাবিজ্ঞান যখন অত আধুনিক হয়নি, তখনও মানুষ এই সব উপদ্রবকে সঙ্গী করেই চলেছিলেন। তা হলে আজ আর কোভিডের ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ আসিয়াছে’ ভেবে ‘দুবেলা মরার আগে’ মরি কেন বলতে পারেন?
‘এক্ষেণ তক বসন্তর ব্যাম ক্ষেন্ত হন নাই’— পুরনো চিঠিতে প্রায়শই এ ধরনের উল্লেখ থাকত। এদের দাপট চলত অবিরাম। একটা সামান্য কমলেই আর একটা গা ঝাড়া দিত। আসলে খবরের কাগজ আসার আগে এত সব তো আমরা জানতেই পারিনি। খবরের কাগজ লিখতও বেশ চমৎকার— ‘অশান্ত বসন্ত রোগের আগমন হওয়াতে রোগাধিপ ওলাউঠা তাঁহার চরিত্র দেখিয়া গাত্রোত্থান করিয়াছেন।’ আবার কখনও কলেরা গেলে আসত জ্বরের প্রকোপ। তখন ‘সমাচার দর্পণ’-এর মতো কাগজ আবার লিখেছে— ‘ওলাউঠার রাজ্য শাসনকালে জ্বরাদি রোগ মহাশয়েরা কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহার কিঞ্চিৎ আলস্য দেখাতে ঐ জ্বরাদি রাজ্য করিতে গাত্রোত্থান করিতেছেন।’ ১৮৩৫-এ ভগবানগোলা অঞ্চলে জ্বর-মহামারি এত ব্যাপক আকার নেয় যে ‘রোদনবিলাপাদি ব্যতীত অন্য শব্দ কোন স্থলে শোনাই যেত না।’ রোগ তমলুকের ছোট রানির প্রাণপক্ষীকে পর্যন্ত ‘দেহ পিঞ্জর হইতে বাহির করিয়া লইয়াছে।’ যশোর প্রদেশে তার পরাক্রম নাকি ‘অতিশয়।’ এ সবই ১৮২৫ থেকে ১৮৩৫-এর মধ্যেকার কথা।
এর পরেও ছিল ম্যালেরিয়া। সহজ কথায় রেল তৈরির জন্য উঁচু বাঁধ দেওয়া হলে গ্রামবাংলার নিকাশির পথ বন্ধ হয়, আর সেই জমা জলে জন্মায় ম্যালেরিয়ার মশা। ‘সাধারণী’ ১৮৮৩-তে লিখেছিল, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার এত দৌরাত্ম্যের প্রধান কারণ হল এখানে বিস্তর রেলপথ নির্মাণ। এই জ্বরও বাংলাকে ছারখার করে দিয়েছিল। সে কালের বিশিষ্ট সাংবাদিক ক্ষেত্রমোহন সেনগুপ্ত ১৯০৭-এ ‘উপাসনা’ পত্রিকায় লিখছেন— ‘উৎসব নাই, আনন্দ নাই,...স্বাস্থ্য নাই, সুখ নাই... আছে কেবল ম্যালেরিয়া, আছে প্রকাণ্ড প্লীহা ও বৃহৎ যকৃৎ, আর আছে মহামারী।’ তা হলে করোনা কেন সহজে হাল ছাড়বে? দেশসেবকদের আহ্বানে জমায়েত, কুম্ভমেলায় ভিড়। রাস্তাঘাটে মাস্ক না ব্যবহার-সহ ন্যূনতম নিয়মকানুন পালনেও আমরা কিঞ্চিৎ আলস্য দেখাতে তিনিও আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন।
তবে সে কালে হিটলিস্টে সবার আগে ছিল কলেরা। গ্রামকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে, এক ১৮২৫-এর অগস্টেই ৮০০, সেপ্টেম্বরে ৭০০ লোকের প্রাণ কেড়ে নেয় এই ওলাওঠা, ঢাকায়। কাঠের অভাবে দাহ পর্যন্ত হচ্ছে না, লোক পালিয়ে যাচ্ছে। নবদ্বীপে এক দিনে ৩৬টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সে, ১৮২৪-এ। ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে— ‘প্রতিদিন ক্রন্দন ধবনিতে’ সুস্থ লোকও ভয় পেয়ে যাচ্ছে। ১৮৩৭-এ বর্ধমানে দিনে ৩০-৪০ জন কলেরার গ্রাসে মারা যেতেন। ইংরেজরা এ দেশে তীর্থযাত্রীদের দল বেঁধে যাওয়ার যে পদ্ধতি, তাকে কলেরা ছড়ানোর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে করত। তাই তীর্থস্থান আর তীর্থে যাওয়ার পথঘাটগুলো টার্গেট হয়। ‘শ্রীক্ষেত্রের যাত্রিদের ও মহাবারুণীযোগে গঙ্গাস্নান করিয়া যাহারা ফিরিয়া যাইতেছিল তাহাদের এত লোক মারা পড়িয়াছে যে মড়ার গন্ধেতে পথে চলা অতি কঠিন হইয়া পড়িয়াছে’— ‘সমাচার দর্পণ’ এ রকমই লিখেছিল ১৮২৪-এ। আবার কখনও লিখেছে: ‘গত বৎসর অসংখ্যক যাত্রী চাঁদ মুখ দেখিবার নিমিত্ত নীলাচলে গমন করিয়াছিল, তীর্থ দর্শনের ফল হাতে
হাতে বিলক্ষণ ফলিয়াছিল। গমনকালীন অসংখ্যক যাত্রী বিসূচিকা রোগাক্রান্ত হইয়া শমনভবন গমন করিয়াছিল।’ ঠিক আজকের কুম্ভমেলা থেকে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ যে ভাবে দেশ জুড়ে ছড়িয়েছে, তার অতীতদর্পণ।
পুরীতে কর্মসূত্রে গিয়ে কলেরায় নিজের ছোট ভাইকে হারিয়েছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। সারা জীবনেও সে ব্যথা ভোলেননি। তাই তো পরবর্তী কালে নদিয়ায় চাকরি করতে এসে সেই কলেরার স্মৃতি আবার বোধহয় মনে পড়েছিল। শান্তিপুরের রাস সম্পর্কে লিখছেন— ‘তৃতীয় দিবস ঐ নগর পরিভ্রমণ বা ভাঙ্গা রাস দেখিতে বহু দূর হইতে লক্ষ দর্শকের সমাগম হইয়া থাকে, এবং এ সময়ে ওলাদেবীর যে রাস হয়, তাহা সমস্ত বঙ্গদেশে ছড়াইয়া পড়ে। অতএব বহু দর্শক এ দেশের রাসের রস ভোগ করিয়া যমালয়ের রসভোগ করিতে
যাত্রা করেন।’
ভোট-রাজনীতির তাগিদে জনপ্রিয়তা কুড়োতে মহামারির মধ্যেও কুম্ভমেলায় সম্প্রতি বিপুল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেখে শিউরে উঠতে হল। ঔপনিবেশিক সরকার কিন্তু তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি। কুম্ভমেলার মতো বড় বড় জায়গায় কী হারে কলেরা হচ্ছে, তার জন্য সরকার কাজে লাগাত নিচুতলার পুলিশদের, তাই এদেরকে এ কালে অনেকে ‘সিকনেস ডিটেকটিভ’ বলছেন। ১৮৯২-তে মহাবারুণী মেলায় হরিদ্বারে কলেরা লাগলে লোককে ফিরতে বলা হলে তাঁরা শিবালিকের পাহাড়-জঙ্গলে গিয়ে লুকোন। স্নানের দিন ৫০,০০০ লোক এসে পুলিশের দিকে লাঠি তুলে হুমকি দেন, ‘বেহতর হ্যয় মরনা এঁহি, হাম নহি যাতে ঘর বিনা নাহাকে।’ ১৮৭৯ সালে আরও ভয়াবহ ঘটনা। কলেরা লাগল পাহাড়বাসী যাত্রীদের মধ্যে। মহামারি রুখতে নাজিবাবাদ, নাগিনা হয়ে তাঁদের চেনা পথে ফিরতে দেওয়া হল না। ‘আলমোড়া আখবার’ লিখেছিল, রোগ ছড়ানোর ভয়ে বিজনোর জেলার লোকালয়গুলো সিল করে দেওয়া হয়। ফলে অচেনা পথে মানুষগুলো খেতে পেলেন না, জলও জোটেনি। নদী দূষিত হবে বলে তাঁদের পেরোতেও দেওয়া হয়নি। ফলে তাঁরা ধরলেন জঙ্গলের পথ, সঠিক পদ্ধতিতে এঁদেরকে এক জায়গায় আবদ্ধ না করার ফলে অনেকেই মারা গেলেন বেঘোরে।
কুম্ভ হয়নি, এমন সময়েও ইলাহাবাদে এক সপ্তাহে কলেরায় ১০০-র মতো মানুষের মারা যাওয়ার কথা লিখেছেন ফ্যানি পার্কস। আতঙ্কে লোক পাগলের মতো শহর ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। ঠিক যেমন পালাচ্ছিলেন ঢাকায়, ১৮৮১-তে। দীনেশচন্দ্র সেন স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘তাঁতী বাজারের পথে যাইতে হরিবোল শব্দে বহু মৃত ব্যক্তিকে লইয়া যাইতে দেখিতাম,... স্কুলে যাইয়া দেখিতাম ক্রমশঃ ছেলে কমিয়া যাইতেছে, তাহারা ভয়ে ঢাকা ছাড়িয়া যাইতেছে।’ পাশের মেসে থাকা উমাপ্রসন্ন নামের ছেলেটির মৃত্যুতে ভীত দীনেশচন্দ্র লিখছেন, দাহ করে ফেরার পর প্রত্যেকের মনে হইতেছিল, ‘আমার কলেরা হইল।’ নদীর ঘাটে গিয়ে দেখলেন, ভীত সন্ত্রস্ত শহরবাসী ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন। দোকানপাট, স্কুল সব বন্ধ, পথে কেবল ‘হরিবোল, কান্নার রোল, অনাথ ছেলে-মেয়েদের চিৎকার।’ তন্দ্রার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন সেই উমাপ্রসন্ন এসে বলছেন, ‘দীনেশ, চল্ আমার
সঙ্গে যাবি?’
সম্প্রতি শুনলাম, ব্যথা আছে কিনা পরখ করতে গিয়ে সম্প্রতি ঢোঁক গিলতে গিলতে আমার এক বন্ধুর গলাই ব্যথা হয়ে গেল। দীনেশচন্দ্র সেনের আমলে যা ছিল, আজও যেন তা-ই। মৃত্যুর চেয়েও মৃত্যুভয়ে সমাজ অনেক বেশি আচ্ছন্ন।
তবে প্লেগ নিয়ে বোধহয় রোগের চেয়েও রোগ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত সরকারি নীতির সম্পর্কে ছিল যত আপত্তি আর ভয়। প্লেগ-আক্রান্ত অঞ্চল থেকে এলে ডাক্তারি পরীক্ষা (বিশেষত মেয়েদের), বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী খোঁজা, স্টেশনে জীবাণুনাশক দিয়ে স্নান— এ সবের বিরুদ্ধে হরিদ্বার বা কানপুরে ১৮৯৮ থেকে ১৯০০-র মধ্যে বার বার দাঙ্গা লাগে। বম্বের কথা ছেড়েই দিলাম। দশ-বারো বছর কাঁপানো প্লেগ কলকাতাতেও তো হাড়-হিম-করা আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। কোয়রান্টিন নিচুতলার মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করছিল বলে বন্দর থেকে পাটকল সর্বত্র শুরু হয়েছিল শ্রমিকদের হিংসাত্মক আন্দোলন। মানুষ ট্র্যাফিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেছে, ট্রামলাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে। আজ তো লকডাউনের বলি হওয়া গরিব মানুষরাও প্রশংসনীয় সংযম দেখিয়েছেন।
টিকা দেওয়ার ব্যাপারটাও অত সহজ ছিল না সে দিন। আজ ভ্যাকসিনের আকাল। সে দিন এই টিকার সঙ্গে বিষাক্ত সুচ ফোটানো হয়— এমন গুজব ছড়িয়েছিল। টিকা দেওয়ার লোক সন্দেহে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ মারধর অবধি করেছে। কাঁধে একটি ব্যাগ থাকায় এক অস্ট্রীয় যুবককে টিকা দেওয়ার লোক ভেবে পিটিয়ে মেরেই ফেলেছিল কলকাতার মানুষ। জেলাগুলোতেও একই অবস্থা ছিল। তার চেয়েও বেশি ছিল মানুষের ‘পলায়ন’। একটা সরকারি প্রতিবেদনের সুন্দর অনুবাদ তুলে ধরেছেন এ কালের এক ইতিহাসবিদ— ‘সকলেই রোগাক্রমণের বিশেষত আব্রুহানির ভয়ে শশব্যস্ত হইল এবং অনেকেই শহর ছাড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করিল। তাহাদের তখন মনে হইল যেন পশ্চাতে প্লেগ রোগ দীর্ঘ বাহু প্রসারণ করিয়া আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইতেছে, সম্মুখে দারুণ ‘কোয়ারেন্টাইন’ গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং দুই পার্শ্ব হইতে প্লেগ কর্মচারীরা ভয়ঙ্কর যমকিংকরের ন্যায় নাগপাশ হস্তে বন্ধন করিতে আসিতেছে।’ উনিশ শতকের কলকাতার প্লেগ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক ক্রেক সাহেব লিখেছিলেন— ‘অ্যাট লিস্ট ওয়ান-ফোর্থ অব দ্য পপুলেশন অব ক্যালকাটা ফ্লিয়িং... (দ্য সিটি) ইন আ স্টেট অব ওয়াইল্ড প্যানিক।’
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ১৮৯৮ সালে ‘কলকাতায় প্লেগের মড়ক দেখা দিলে, প্রাণের ভয়ে আমরা আমার পিতামহের তৈরি ৬৪ নং সুকিয়াস স্ট্রীটের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শিবপুরে আমার দিদিমা আর মামাদের আশ্রয়ে গিয়ে এক বছর কাটাই।’ ত্রৈলোক্যনাথের ‘ভয়ানক আংটি’ উপন্যাসে (‘স্বপ্নদৃষ্ট বালিকা’/ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) হারাধন তো নাহয় প্লেগের ভয়ে লোক যখন কলকাতা থেকে পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর জনকয়েক আত্মীয়কে প্রবল ভিড়ের মধ্যেও কোনও রকমে ট্রেনে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রশ্ন, আমরা কোথায় পালাব? কেন পালাব, প্রতিষেধক যখন এসেছে? ক’দিন আগে স্নায়ুরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বন্ধু জয়ন্ত রায়ের শেয়ার করা একটা পোস্ট দেখলাম— এক জন টিকা নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করছেন, এর পর তিনি ১০০ ভাগ সুরক্ষিত কি না। উত্তর পেলেন— বিয়ের সময় সকলেই সুখী দাম্পত্য জীবনের শুভেচ্ছা জানায়— এটাও তেমনই। কর্কটরোগ-সহ যে সমস্ত রোগ বহু পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়, তার তো কোনও প্রতিষেধকই বেরোয়নি।
একটু ভেবে দেখুন, আজ যে সব মানুষ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার ফলে বলতে পারেন ‘ঘরে থাকলে না খেয়েই মরব, করোনায় আর মরতে হবে না’, তাঁরা কিন্তু উনিশ শতকের শেষ, বিশ শতকের গোড়ায় বম্বে-কলকাতার প্লেগ দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী গরিবগুর্বোদের সংযমী উত্তরসূরি। নিঃশব্দে কত মানুষ কর্মহীন হয়ে অনেক অসম্মানে ভিন্ন পেশা নিতে বাধ্য হয়েছেন, টোটো চালানো ছেড়ে আলু ফেরি করছেন। মৃত মানুষের পরিসংখ্যানের মতোই তাঁদের বা করোনাজয়ীদের পরিসংখ্যানটাও জানা আবশ্যক। দীর্ঘকালের পরিচিত এক ডাবওয়ালা সে দিন কানের কাছে মুখ এনে শুধোলেন— ‘বাবু ছোড মেইয়েডার বে দোব, শুনছি আবার নাকি টানা নকডাউন হবে। কী হবে বাবু!’ ওঁর চোখের দিকে তাকাতে পারিনি।
পরিস্থিতি নিশ্চিত বিপজ্জনক। বুঝি, ভাইরাসকে বাগে আনা শক্ত। কিন্তু দিনে দিনে তো আরও রোগব্যাধি আসবে। নদিয়ারাজের দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র যেমন করে বলেছিলেন ‘একালে ওলাওঠা উদরাময় প্রভৃতি পীড়ার যেরূপ প্রাবল্য হইয়াছে, সেরূপ সেকালে ছিল না।’ আমরাও না-হয় আগামী দিনে এ ভাবেই ‘সেকালের’ করোনার স্মৃতিচারণ করব। বেপরোয়া না হয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো আবশ্যিক নিয়মকানুনগুলো পালন করে জীবনযাপনের পদ্ধতিটা ঠিক ভাবে যদি মানি, তা হলে তো অনেকটা নিরাপদ। শুধু শুধু অ-সুরক্ষিত মানুষগুলোকে কেন আর ভয় দেখানো? বাড়িতে অবরুদ্ধ থেকে সকাল-সন্ধ্যা বাহারি খানার ছবি, সুসজ্জিত বাসস্থানে গপ্পগাছা করার ছবি পোস্ট করার কপাল নিয়ে তো ওঁরা জন্মাননি। সিঁদুরে মেঘ দেখে তাঁরা এমনিতেই ডরান। ডাবওয়ালাদের জীবনে লকডাউন তো অবকাশ হয়ে আসে না। তার চেয়ে বরং আসুন, ভরসা দিই, আর আশায় বাঁচি। আলব্যের কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের শেষ অঙ্কের মতো— এক দিন শহরের সব ক’টা প্রবেশদ্বার পাকাপাকি ভাবে আবার খুলে যাবে, রাম্বার্টের মতো কোনও মানুষ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ফিরে যাবেন তাঁর স্ত্রীর কাছে, আসবে প্লেগ (পড়ুন করোনা) মুক্ত এক নতুন ভোর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy