পক্ষিবিদ: সেলিম আলি। ডান দিকে, প্রিয় মোটরসাইকেলে চেপে বিদেশের মাটিতে। টু-হুইলার ছিল সব জায়গায় তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
তিনি সেলিম আলি। ভারতের বার্ডম্যান। কিন্তু তাঁর মোটরসাইকেল-প্রেমও সে তুলনায় কিছু কম ছিল না। পাখি-বিষয়ক পত্রপত্রিকার পাশেই থাকত মোটরসাইকেলের দেশি-বিদেশি জার্নাল। সুইডেনে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রিয় বাহন সানবিম। বহু মারাত্মক দুর্ঘটনাতেও ভালবাসা কমেনি মোটরসাইকেলের প্রতি। আজ তাঁর ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
সালটা ১৯৫০। দুপুর একটা নাগাদ সুইৎজ়ারল্যান্ডের পক্ষিবিদ ডক্টর লুক হফম্যানের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন রাখতে যাওয়ার কথা আর এক পক্ষিবিশারদের। তিনি ভারতের ‘বার্ডম্যান’ সেলিম আলি! সুইডেনের উপসালায় সেলিম যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে লুকের বাড়ি ছিল কমবেশি একশো কিলোমিটার দূরে। তাই সকাল-সকাল ধোপদুরস্ত হয়ে নিজের মোটরসাইকেলটি চালিয়ে ফুরফুরে মেজাজে সেলিম যাচ্ছিলেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। হঠাৎ ছন্দপতন! উল্টো দিক থেকে আসা একটি মালবোঝাই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। সেলিম মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়লেন একেবারে মাঝরাস্তায়। অন্য দিক থেকে কোনও গাড়ি না আসায় কপালজোরে তিনি বেঁচে গেলেন বটে, কিন্তু হাত-পা ছড়ে একাকার। আহতকে দেখে ট্রাকচালক অবশ্য থামেননি, তার বদলে গাড়ির জানলা থেকে সেলিমকে দু’-চারটে ফরাসি গালমন্দ ছুড়ে দিতে দিতে বিদায় নিয়েছিলেন। বার্ডম্যানকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন পিছনের গাড়ির যাত্রী। তিনি নিজের গাড়ি করে সেলিমকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে মাথায়, হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বার্ডম্যান ট্যাক্সি করে তৎক্ষণাৎ ছুটলেন। না, লুক হফম্যানের বাড়ির নেমন্তন্ন রাখতে নয়, রাস্তায় চোট খেয়ে পড়ে থাকা তাঁর প্রিয় ‘সানবিম’-এর কাছে। ১৯৬৪ মডেলের শ্যাফ্ট-চালিত, ৫০০ সিসি-র জোড়া সিলিন্ডারের তোবড়ানো মোটরসাইকেল সানবিমকে রীতিমতো ধাক্কাটাক্কা মেরে সোজা করে তাতে চড়েই বিকেল চারটের সময় তিনি পৌঁছলেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে! অনেকেই জানেন না, বার্ডম্যানের মোটরসাইকেল-প্রীতি পক্ষিপ্রেমের চেয়ে কিছু কম ছিল না।
১৯৫০-এ সুইডেনের উপসালায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক (অরনিথোলজিক্যাল) কংগ্রেস-এ একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে যাওয়ার সময় জাহাজে সঙ্গে করে নিয়েছিলেন তাঁর এই আদরের যানটিকে! উদ্দেশ্য ছিল মোটরসাইকেল করে গোটা ইউরোপ ঘুরে বেড়ানো!
মায়ানমারের তাভোইতে পারিবারিক ব্যবসা জে এল আলি ব্রাদার্স-এ যোগ দেওয়ার জন্য যখন সেলিমের ডাক পড়ল, তখন তিনি নিতান্তই যুবক। সেখানেই তাঁর প্রথম বন্ধুর মোটরসাইকেল চড়া। প্রথম আরোহণেই চিরস্থায়ী প্রেম। সৌভাগ্যবশত এর কয়েক দিন পরেই হাতে আসে তাঁর জীবনের প্রথম মোটরসাইকেল, ৩.৫ অশ্বশক্তির জোড়া সিলিন্ডারের ‘জ়েনিথ’। চালক হলেও জ়েনিথের প্রকৃত মালিক সেলিম ছিলেন না, ওটা ছিল আলি ব্রাদার্স-এর। খাতায়-কলমে কোম্পানির সম্পত্তি হলেও ‘জ়েনিথ’-এর উপর একচেটিয়া মালিকানা তৈরি করে ফেলেছিলেন সেলিম। সময় পেলেই পাখি আর মোটরসাইকেল-চর্চা। অবসরে পড়তেন মোটরসাইকেল সংক্রান্ত দেশ-বিদেশের জার্নাল আর পাখি বিষয়ের নানা বই ও পত্রপত্রিকা। ছুটির দিনে নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। ইঞ্জিন খুলে, ভিতরের কলকব্জা নেড়ে গায়ে-হাতে-মুখে তেলকালি মেখে বাহনের পরিচর্যা করে অসীম আনন্দ পেতেন। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে তিনি লিখেছেন, ‘ছুটির দিনে প্রায়ই আগাপাশতলা খুলে ফেলে নতুন করে আবার সব জোড়া লাগাতে বসতাম। এই করতে গিয়ে সর্বাঙ্গে তেলময়লা আর কালিঝুলি মেখে একসা হতাম। এ সব হয়ে যাওয়ার পর হাতে থেকে যেত বাড়তি একমুঠো বল্টু আর ইস্কুরুপ আর গুঁজি আর ওয়াশার। সেইসব দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম— এ সব যদি কাজে নাই লাগবে, তা হলে কোম্পানি অত বদান্যতা করে আদৌ কেন এগুলো লাগাতে গেল!’ বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরসাইকেল সংক্রান্ত বিভিন্ন পত্রিকা আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। বিদেশে গিয়ে মোটরসাইকেল প্রদর্শনীর খোঁজ পেয়েছেন অথচ সে প্রদর্শনীতে তিনি যাননি এমন হয়নি! ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’, ‘মেক’, সানবিম... বিশ্বের নামীদামি কোম্পানির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল জীবনে বিএমডব্লু-র মোটরসাইকেল চালানোর সুযোগ পাননি বলে!
উপসালায় আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেসে যাওয়ার সময়ই তিনি ঠিক করে ফেলেন, প্রকৃতিদর্শনের পাশাপাশি ইংল্যান্ড ও ইউরোপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবেন। এত ঘোরাঘুরির জন্য নিজস্ব একটা বাহন না হলেই নয়। এ দিকে ইউরোপের অধিকাংশ দেশে তখন পরিবহণের অবস্থা বেশ নড়বড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও দগদগে। হাতে গোনা যে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ সে সময় যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল, তার মধ্যে অন্যতম সুইডেন। তাই সম্মেলনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল সুইডেনের উপসালা। কোনও মতে গাড়ির বন্দোবস্ত হলেও তার জন্য যে বিরাট অঙ্ক খসাতে হবে, তা সেলিম হিসেব করে ফেলেছিলেন। সানবিম-কে সঙ্গে নেওয়ায় খরচ অনেকটাই কম পড়েছিল। মোটরসাইকেল নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়িয়ে তাঁর বিস্তর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়, সে সব তিনি পরবর্তী কালে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন। বন্ধুদের টানে সেলিম যেমন এই অভিনব কাণ্ড করেছিলেন, তেমনই ভারত থেকে মোটরসাইকেল বগলদাবা করে আসা এই বন্ধুটিকে নিয়ে তাঁর বন্ধুদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের শেষ ছিল না।
ইউরোপের সফর করতে গিয়ে সেলিম সমস্যায় পড়তেন বাইকের পিছনে তাঁর দুটো ঢাউস ব্যাগ নিয়ে, যার মধ্যে তাঁর যাবতীয় পোশাক, এমনকি একটা-দুটো কালো শেরওয়ানিও থাকত। প্রায়ই ইউরোপের গ্রামের খোয়া-ছড়ানো ভাঙাচোরা রাস্তায় মস্ত দুটো ব্যাগ নিয়ে টাল সামলানো সমস্যার হত। অনেক বারই ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে পড়েছেন রাস্তায়, আহতও হয়ছেন। তবে তাতে তিনি মোটেই দমে যাননি, যত বার পড়েছেন, তত বার ধুলো ঝেড়ে মোটরসাইকেল ঠেলে আবার যাত্রা শুরু করেছেন। বহু বছর পরে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘পরে বুঝেছিলাম যে, অতসব হাবিজাবি সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও দরকারই ছিল না।’
লন্ডন, ডার্বি, সুইডেন... ইউরোপের বিভিন্ন মুলুকে সেলিম পথে পথে মোটরবাইক চেপে ঘুরেছেন, আর ঝুলিতে ভরেছেন বিস্তর অভিজ্ঞতা। লন্ডনে পক্ষীবিদ মেইনের্ৎস্হাগেনের বাড়ির লাইব্রেরিতে অগণিত পাখি, প্রকৃতিবিজ্ঞান আর জানোয়ার শিকারের বইয়ের সংগ্রহ দেখে বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রহে ছিল বহু বইয়ের প্রথম সংস্করণ, সেলিমের মতে পুরনো বই সংগ্রাহকেরা সেগুলো পেলে লুফে নেবেন। তবে সেলিমকে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল চামড়ায় বাঁধানো মেইনের্ৎস্হাগেনের ডায়েরিগুলি। যেখানে তিনি আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে কাজ করার সময়কার নানা অভিজ্ঞতা আর বিচিত্র ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সুইডেনের ল্যাপল্যান্ডে আবিস্কো আর সুইডেন-নরওয়ের সীমান্তে রিক্স্গ্রুনসেন যাওয়ার পথে তুষারাবৃত পর্বতশিখর, খরস্রোতা নদী আর প্রচুর পাখি দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি এক রূপকথার জগতে চলে এসেছেন। যদিও ইউরোপ ভ্রমণের সব অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না। সেলিম বেজায় চটে ছিলেন ফরাসি গাড়িচালকদের প্রতি। রাস্তাঘাটে এঁদের নিয়ে তাঁর পদে পদে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার একটা নজির লুক হফম্যানের বাড়ি যাওয়ার পথের ঘটনা। ডার্বির অস্বাস্থ্যকর পাবলিক টয়লেট দেখে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল সেলিম আলির। ভারতীয়দের ‘নেটিভ’ বলা নাকউঁচু সাহেবরা কী ভাবে ওই নোংরা শৌচালয় অবলীলায় ব্যবহার করে, তাঁর উত্তর তিনি আমৃত্যু খুঁজে পাননি!
বিদেশ হোক বা স্বদেশ, মোটরসাইকেল নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি বার বার। বহু বার দুর্ঘটনায় পড়ে মরতে মরতে বেঁচে ফিরে আসা অকুতোভয় সেলিম শেষমেষ পরিবার ও আত্মীয়দের বকুনির কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৬৪ সালে ৬৮ বছর বয়সে চিরতরে মোটরসাইকেল চালানোয় ইতি টানেন। তবে চালকের আসনে না বসলেও এই দু’চাকার যানের প্রতি তাঁর প্রেম অটুট ছিল আমৃত্যু।
ঋণ: ‘চড়াই উতরাই’ (‘ফল অব আ স্প্যারো’-র বাংলা অনুবাদ)
অনুবাদ: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy