Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১৯
Novel Series

হাওয়ার আড়ালে

মিশুকের ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কস্তুরী। সত্যি তো। সব্যসাচী ছেলেটা অনেক ক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলছে। ওর কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতে সব্যসাচী এসে হাজির।

অজিতেশ নাগ
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ ০৭:০৭
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: লিখতে লিখতে মেয়ের কথা মনে পড়ায় মেহুলিকে ফোন করেন স্বর্ণেন্দু। মেহুলিও মনে রেখেছে পৌষালীর কথা। সে বুঝতে পারে মেয়েকে মিস করছেন স্বর্ণেন্দু। অন্য দিকে কস্তুরীও ফোন পায় মিশুকের। মিশুক তাকে সে দিন প্রিন্সেপ ঘাটে দেখা করতে আসতে বলে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়ে কস্তুরী। কস্তুরী পৌঁছনোর একটু পরেই সব্যসাচীকে নিয়ে সেখানে আসে মিশুক। কস্তুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সব্যর। সব্য বিস্ময় প্রকাশ করে, কী করে কস্তুরী এত তাড়াতাড়ি আপন করে নিলেন মিশুকের মতো অন্তর্মুখী একটি মেয়েকে।

সন্ধে নেমে আসছিল প্রিন্সেপ ঘাটের মাথার উপর। চার দিকের ভিড় কমে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। এই ভাবে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে চার পাশটা কমলা থেকে কালো হতে কত দিন দেখেনি সে। সামান্য পরেই অবশ্য কস্তুরীর হাসি পেল। এত ক্ষণ কী ভাবছিল সে। নিজের মেয়ে! ইস, মিশুকের নিজের বাবা-মা আছে। বোন আছে। এই দিন কুড়ি-একুশে তাদের ব্যাপারে সব বলেছে মিশুক। এমনকি ছোট্ট পোষ্য মাফিনেরও পরিচয় দিতে ছাড়েনি। মোবাইলে ছবি দেখিয়েছে।

মিশুক প্রায় ফিসফিস করে বলল, “তুমি খুব ভাল গো, ভীষণ ভাল।” বলেই প্রায় লাফিয়ে উঠল, “বিবি! ইয়েস, বিবি!”

কস্তুরী অবাক হয়ে বলল, “বিবি মানে?”

মিশুক বলল, “আজ থেকে আমি তোমাকে বিবি বলে ডাকব। বুঝলে তো? বিবি মানে ভীষণ ভাল। শর্ট ফর্ম। চলবে?”

“তাই বলিস। আর তোকে?”

“তোমার যা ইচ্ছে।”

বেশ খানিকক্ষণ ভেবে কস্তুরী বলল, “তুই আমার তিতি।”

“তিতি? ও মা, কোত্থেকে পেলে এই নাম?”

“তা হলে বলি, আমি তো হিস্ট্রির স্টুডেন্ট। ইজিপ্ট আমার চিরকালের ইন্টারেস্ট। ইজিপ্টের এক রানি নেফারতিতি। আচমকাই মনে এল। নেফারতিতি বলে তো ডাকা যায় না। তাই তিতি। চলবে?”

“খু-উ-ব। কিন্তু মালটা গেল কোথায়?উপস, স্যরি!”

মিশুকের ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কস্তুরী। সত্যি তো। সব্যসাচী ছেলেটা অনেক ক্ষণ ধরে ফোনে কথা বলছে। ওর কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতে সব্যসাচী এসে হাজির। এসেই হাসতে হাসতে ঘাসের উপর প্রায় লুটিয়ে পড়বার দশা। মিশুক বলল, “হেসে মরছিস কেন?”

কোনও মতে হাসি থামিয়ে সব্য বলল, “চন্দন ফোন করেছিল।”

মিশুক বলল, “তোর সেই পটলডাঙার ফ্রেন্ড?”

“হ্যাঁ। শোনই না। ওর মালিকের ছেলে ড্রাগ-অ্যাডিক্ট, বলেছিলাম তোকে। ধরাও পড়েছে। যে কোনও সময় বিহাইন্ড দ্য বার হতে পারে। ছেলেকে বাঁচাতে কাল একটা কাণ্ড করেছে ওর মালিক।”

“কী?”

“মাড়োয়ারিরা নাকি বিশ্বাস করে জেলের ভাত এক বার খেলে তার আর জেল হয় না। ওর মালিক ছেলেকে নিয়ে জেলে গিয়ে জেলের কয়েদিদের জন্য তৈরি খিচুড়ি বাইরে আনিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। ভাব এক বার!”

“ধ্যাত। গুল মেরেছে। ওই খিচুড়ি তো প্রিজ়নারদের জন্য। বাইরের লোক পাবে কী করে?”

“চন্দনের মালিকের তো হেবি কন্ট্যাক্টস। কোনও এক পুলিশের উঁচু লোককে ধরে-করে অনেক দাম দিয়ে সেই খিচুড়ি খানিকটা বাইরে আনিয়ে ছেলেকে খাইয়েছে। চন্দন সঙ্গে গিয়েছিল। বাধ্য ছেলের মতো মালিকের ছেলেও নাকি ওই ট্যালটেলে খেয়ে নিয়েছে সাপটে।”

“ব্ল্যাকে খিচুড়ি! হি-হি-হি-হি!”

হাসতে হাসতে মিশুক কস্তুরীর গায়ে হেলে পড়ল। মজা লাগছিল কস্তুরীরও। তবে ওদের দেখে ভারী ভাল লাগছিল। সব্যসাচী নিশ্চয়ই বেকার নয়, ভাল চাকরি-বাকরি করে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা শুধুমাত্র লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটে বিশ্বাস করে না। মিশুক কি সব্যসাচীকে বিয়ে করবে? করলে দু’টিতে বেশ মানাবে। অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা কিছু বলা যায় না। হয়তো ভাল বন্ধু। হয়তো লিভ-ইন করবে। কিংবা করে।আচমকা মিশুক বলল, “এই রে, ভুলেই গেছিলাম আজ আমার মাচা আছে। আর আমি এ দিকেদাঁত দেখাচ্ছি।”

কস্তুরী বলল, “মাচা কী?”

“ওই স্টেজ বানিয়ে ফাংশন আর কী। একটু সাবার্বান এলাকায়। কলকাতাতেও হয়, তবে জেলায় বেশি। আজ পাঁশকুড়ায় আছে।”

কস্তুরী বলে, “আমি কোনও দিন দেখিনি। কী করিস সেখানে গিয়ে?”

“কিছু না। স্টেজে উঠে গেলে আমি তখন রিখি সেন। কিংবা যে সিরিয়াল করি, তার ক্যারেক্টার। দর্শকদের সঙ্গে কথা বলি, হাঁটি, চেনা ডায়লগ থ্রো করি... এই সব আর কী। এক দিন নিয়ে যাব তোমায়। ফিরতে ফিরতে কিন্তু ভোর হয়ে যাবে। বাড়িতে বলে রেখো।”

কস্তুরী ভাবল, বাড়িতে আর কী-ই বা বলার আছে। যার পারমিশন নেওয়ার কথা, সে তো নিজেই মত্ত। একমাত্র মেয়েটাও সেই পথেই।

ভাবনায় বাধা পড়ল। কস্তুরী টের পেল তার ফোনটা বাজছে ব্যাগের ভিতর। বার করে স্ক্রিনে দেখল, ট্রু-কলারে ‘তুলিকা পাল’। নাম্বার সেভড নয়। কী মনে করে রিসিভ করল সে, আর করতেই কেতকীবালার কণ্ঠস্বর তার কানে মধু ঢেলে দিল, “কত ক্ষণ থেকে ফোন করছি। কোথায় পড়ে থাকো কে জানে।”

“এটা কার নাম্বার, মা?”

“সেটা জেনে তুমি কী করবে? কত দিন বলেছি বাড়িতে একটা ফোন লাগিয়ে দাও, সে কথা তোমার কানে যায়?”

এটা সত্যি কথা। নীচের ফ্লোরে একটা ফোন থাকা জরুরি। কেতকীবালা অনেকদিন বলেছেন আকিঞ্চনকে। দিচ্ছি-দেব করে আকিঞ্চন গা করেনি। মোবাইল বেটার অপশন। কিন্তু কেতকীবালা মোবাইল চালাতে জানেন না। মেহুলি তিন-চার বার শেখানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

কস্তুরী বলল, “কী হয়েছে সেটা বলবে? ফোন করলে কেন?”

কেতকীবালা ঝনঝন করে উঠলেন, “খোকার এক জন ক্লায়েন্ট এসে বসে আছে সেই কখন থেকে। আমি বললাম বাড়িতে কেউ নেই, পরে আসুন। সে মেয়ে কথা শুনছে না। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। বাধ্য হয়ে চন্দনকে পাহারায় রেখে তুলিকার বাড়ি গিয়ে ওর ফোন থেকে ফোন করছি। তুমি এসো বাপু। আর পারি না।”

কস্তুরী অবাক হল, “আকিঞ্চনের ক্লায়েন্ট তো আমার সঙ্গে কী? ওকে ফোন করো।”

“তাকে খবরটা দেব কী করে বলতে পারো, যদি সে ফোন না ধরে?”

কেতকীবালাকে থামিয়ে দিয়ে কস্তুরী বলল, “আমি ওকে ফোন করে দেখি। ও চলে আসবে।”

“আরে, সে মেয়েছেলে খোকার সঙ্গে দেখা করতে চায় না। তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে বসে আছে। সেই কোন বিকেলে এসেছে। এখনও যাওয়ার নাম নেই।”ফোন কেটে দিল কেতকীবালা। কস্তুরী চিন্তায় পড়ল। আকিঞ্চনের ক্লায়েন্ট, তিনি মহিলা হোন বা পুরুষ, তার সঙ্গে কী দরকার থাকতে পারে রে বাবা!

কস্তুরী উঠে পড়ল। মিশুক মুখ দেখে কিছু বুঝে প্রশ্ন করল, “এনিথিং সিরিয়াস, বিবি?”

“সেটা বাড়ি না গেলে বুঝতে পারছি না। আমি এগোচ্ছি। তোরা সাবধানে যাস।”

“ডোন্ট ওরি। সব্য আজ গাড়ি এনেছে। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”

মিশুকের গাল টিপে দিল কস্তুরী, বলল, “তার কোনও দরকার নেই। কোথায় পাটুলি আর কোথায় যোধপুর পার্ক!”

“এটা কোন ডিসট্যান্স হল? কোনও প্রবলেম হবে না, তুমি দেখে নিয়ো।”

“দরকার নেই রে। তা ছাড়া তোর প্রোগ্রাম আছে। আজ যা, পরে তোকে নিয়ে আমার বাড়ি যাব এক দিন।”

একটা অ্যাপ-ক্যাব ডেকে বাড়ি পৌঁছতে ঠিক এক ঘণ্টা লাগল ঘড়ি ধরে। সে এমনিতেই টেনশনে ছিল, চন্দন দরজা খুলে দিতে ভিতরে ঢুকে যাকে দেখল, অবাক হয়ে গেল কস্তুরী। মধ্যবয়সি যে ভদ্রমহিলা সোফায় বসে আছেন তার শাশুড়িকে সামনে রেখে, তাকে কস্মিনকালেও দেখেনি কস্তুরী। ভদ্রমহিলা তাকে দেখেই বোধহয় আন্দাজ করে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করল, “আপনি মিসেস রায়?”

“হ্যাঁ। কিন্তু...”

“নমস্কার। আমাকে চিনবেন না। আমি রাধিয়া শ্রীবাস্তব। আমরা কি আলাদা করে কথা বলতে পারি?”কস্তুরী না দেখেও বুঝল কেতকীবালা তাকে খরচোখে দেখছেন। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে দোতলায় উঠে গেল।

পরের আধঘণ্টায় যেন শ্রবণশক্তির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল কস্তুরীর। কী যে শুনল, কেন যে শুনল কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। শুধু তা-ই নয়, কথা বলার ক্ষমতাটুকুও যেন সে হারিয়ে ফেলছিল একটু একটু করে। সে শুধু উচ্চারণ করতে পারল, “আমার কাছে এসেছেন কেন আপনি?”

ভদ্রমহিলাকে কার্যত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। আঁচল সামলে নিয়ে বললেন, “আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই মিসেস রায়। আকিঞ্চনকে চিনতে এত ভুল করেছিলাম! পুরুষদের ব্যাপারে আমার ধারণা পাল্টাতে দিল না আকিঞ্চনও। ভাবতেই পারছি না, যে আকিঞ্চন আমাকে এত দিন ধরে লড়ার মানসিকতা জুগিয়ে এসেছে, সেও শেষ অবধি আদিনাথের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমার এমন সর্বনাশ করতে পারল? ভাবতে পারেন? সবই তো আপনাকে বললাম। আপনি তো এক জন মেয়ে...”

ভদ্রমহিলাকে এখন অসহ্য লাগছে কস্তুরীর। কার্যত এই মহিলা তার স্বামীর রক্ষিতা! আকিঞ্চনকে সে এত দিন রগচটা, নিজের ইচ্ছেয় চলা এক জন মানুষ হিসাবেই দেখে এসেছে। মেয়েকে অসম্ভব ভালবাসে। নামী অ্যাডভোকেট। কত সম্মান করে তাকে পাড়ার লোক। স্বামীকে তেমন গভীর ভাবে ভালবাসতে না পারলেও অসম্মানের চোখে কোনও দিন দেখেনি কস্তুরী। বরং স্বামীকে নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্বই ছিল তার। কত দিন অদ্রিজার কাছে গল্প করেছে, বাবার টাকায় নয়, নিজের ক্ষমতায় এত দূর এগিয়ে এসেছে আকিঞ্চন। সেই আকিঞ্চনের কি না একটা পোষা...! আর সেখানেও তো স্পষ্ট নয় সে। সম্পত্তি বাগানোর জন্য একটা অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করেছে। দিনের পর দিন। কস্তুরীর সঙ্গে শারীরিক রিলেশন নেই অনেক দিন। হতেই পারে। তাই বলে এত দিন এই ভাবে খিদে মিটিয়েআসত আকিঞ্চন?

কস্তুরী স্খলিত গলায় বলল, “আপনি আমাদের ঠিকানা পেলেন কোথা থেকে?”

রাধিয়া কান্নাভেজা গলায় বলল, “আকিঞ্চনের কার্ড ছিল আমার কাছে। অনেক দিন আগে দিয়েছিল। কাল খুঁজে পেয়েছি। কার্ডের পিছনে বাড়ির ঠিকানা ছিল। অনেক কষ্ট হয়েছে এখানে আসতে। আসলে আমি তো রাস্তাঘাট তেমন...”

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy