Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২

মায়া প্রপঞ্চময়

কুঁড়েগুলো থেকে ঢাল বরাবর কয়েক মিটার এগোলেই বেশ কয়েকটা চারকোল ভাটি। এগুলোয় গাছের মোটা ডালপালা আর গুঁড়ি পুড়িয়ে কাঠকয়লা তৈরি হত এক সময়।

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ

কানাইলাল ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৫
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: সলিলসখার বারমুখো স্বভাব বদলানোর জন্য কিষণকে সলিলসখার জন্য একজন সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ব্যবস্থা করতে বলেন অনিকেত। একটি হারানো কালনাগিনীকে খুঁজে পাওয়ার সূত্রে অনিকেতের মনে পড়ে যায় চিড়িয়াখানায় সিসি টিভি ইনস্টল করার ঘটনা। পরিচয় গুপ্ত নামের এক সুযোগসন্ধানীর ব্ল্যাকমেল করা আটকাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ও দিকে পুরুলিয়া থেকে বাড়ি ফিরে বেন্দা শোনে, তার বাড়িতে সাপ দেখা গিয়েছে...

বেন্দারও নতুন সাহেবের কাছে বাহাদুরি করার ঝোঁক চাপল। বলে বসল, “নাই জানি আঁজ্ঞা, ইদিকবাগে খুব বেশি ত আনাগুনা নাই হামাদের। হামিও আজই ইখানে পেরথম আলি, একবার যায়েঁ দেখ্যে আইসব্য না কি?”

বোসস্যর বললেন, “নাঃ, তুমি একা যাবে কেন? আমারও তো এলাকার হালহকিকত, বিশেষ করে সীমানার কাছাকাছি কী হচ্ছে না হচ্ছে জানা দরকার। চলো, পাহাড় বেয়ে ওই জায়গাটা পর্যন্ত দেখে আসি।”

নদীতে অল্পই জল, ও পারে গিয়ে পা শুকিয়ে নিয়ে জুতো পরে দু’জনে পাহাড় বাইতে শুরু করে। রাস্তা বলে কিছু নেই পাহাড়ের এই ঢালে, কখনও ছোট গাছ, কখনও লতা-গুল্ম ধরে ধরে চড়াই বেয়ে উঠতে থাকে দু’জনে। প্রায় আধ ঘণ্টা লাগে গন্তব্যে পৌঁছতে। ততক্ষণে দু’জনেরই খাকি পোশাক ঘামে বেশ ভিজে গিয়েছে। প্রকৃতির খেয়ালে খানিকটা জায়গা সমতল, বাকিটা মানুষের হাতের কাজ। কয়েকটা কুঁড়ে, যেমন-তেমন ভাবে তৈরি। স্রেফ মাথা গোঁজার জন্যই করা। চাতাল মতো জায়গাটার শেষে সামান্য ঢালু জমি ক্রমশ অনেক দূরে চাষবাসের সমতলে গিয়ে মিশেছে। অনুমান করা যায়, ওদিকটা বিহার। আসলে সাতগুড়ং নদীটাই বাংলা-বিহার সীমান্তরেখা।

কুঁড়েগুলো থেকে ঢাল বরাবর কয়েক মিটার এগোলেই বেশ কয়েকটা চারকোল ভাটি। এগুলোয় গাছের মোটা ডালপালা আর গুঁড়ি পুড়িয়ে কাঠকয়লা তৈরি হত এক সময়। আশপাশে বনের অনেকটা নিয়ে শুধু গাছের কাটা গুঁড়ি মাটিতে মাথা উঁচিয়ে আছে। এখানে বন ধ্বংস করে কাঠকয়লা তৈরির কটেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছিল। পরে ব্যবহারযোগ্য গাছ শেষ হয়ে যাওয়ায় কারিগররা এখান থেকে সরে গিয়েছে। পড়ে আছে কয়েকটা কুঁড়েঘর।

ওদের সরেজমিন তদন্ত শেষ, এ বার ফিরতে হবে। তার আগে একটু রেস্ট নেওয়ার জন্যে বেন্দা টুলের শেপের গোটাতিনেক গাছের কাটা গুঁড়ি দেখে বসার লোভ সামলাতে পারল না। আবার সেই খাড়া উতরাই বেয়ে নীচে নদীর ধারে নামতে হবে, তাই এ দিক-ও দিক দেখে বোসস্যরও ওর একটু তফাতে আর-একটা ওই রকম টুলে বসলেন। বেন্দা যেখানে বসেছে, তার ফুটদেড়েক পিছনে ছুটকো-ছাটকা সরু ডালপালা আর শুকনো পাতার একটা স্তূপ, বেন্দার কাঁধ ছুঁই-ছুঁই।

বোসস্যর পকেট থেকে একটা তোয়ালে-রুমাল বার করে ডান হাতে কপাল আর মুখের ঘাম মুছে সবে হাতটা গলার কাছে নামিয়েছেন, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে দৃষ্টিটা মাথার পিছনে স্থির হয়ে গেল। সাহেবের মুখের ভাব পরিবর্তন লক্ষ করে একটু ভয় পেয়েই গেল বেন্দা। মাথার পিছনে একটা খসখস শব্দ হলেও তাতে পাত্তা না দিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল ওর ভুলটা হল কোনখানে, যে স্যর হঠাৎই এত রেগে গেলেন!

মুহূর্তের মধ্যে বোসস্যর ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন যেন বাঘের মতো, বাঁ হাতে ওর জামার কলার ধরে এক হ্যাঁচকায় ওকে মাটিতে ফেলে দিলেন। একই সঙ্গে ওঁর ডান হাতটা ওর মাথার পিছনে শুকনো পাতার স্তূপে যেন সাপের মতো ছোবল মারল। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে ওরও মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল, পুরুল্যার ছেল্যা বলে কথা! সাধে তো আর লোকে ওদের ‘রঢ়’ বা রগচটা বলে না! ও সামনের একটা মোটা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে রণহুঙ্কার দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, “তব্যে র‌্যা, আজ সাহেবের গুষ্টির তুষ্টি...’’ কিন্তু ওর মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। সাহেবের ডান হাতের শক্ত মুঠোয় রুমাল আর শুকনো পাতার মোড়কে একটা সাপের মাথা আটকানো। তিন হাতের বেশি লম্বা নয়, মেটে-মেটে রং আর তাতে কালো রঙের গোল চাকা-চাকা দাগ।

গলার কাছে চাপ পড়ায় মুখটা অনেকখানি হাঁ হয়ে গিয়েছে, মুখগহ্বরের রং বাসি মাংসের মতো ফ্যাকাশে লাল। উপরের মাড়ির দু’পাশে সামান্য বাঁকানো দুটো বিষ-দাঁত। চকচকে, লম্বা, যেন স্টিলের তৈরি। দাঁতদুটো দেখে ওর গা শিরশির করে ওঠে। স্যর না থাকলে ওই দাঁতদুটো এতক্ষণে ওর পিঠে বা ঘাড়ে ঢুকে যেত— এটা ভাবতেই মাথা ঘুরে যায় ক্ষণিকের জন্য। শূন্যদৃষ্টিতে বেন্দা চেয়ে থাকে স্যরের হাতে ঝুলন্ত সাপটার মোচড় খেতে থাকা শরীরের দিকে, গলার পর থেকে দেহটা বেশ মোটা হয়ে সরু লেজে গিয়ে শেষ হয়েছে। ও দেখে, সাপটা লেজের দিকটা ঝাঁকিয়ে তুলে স্যরের ডান হাতটা পেঁচিয়ে ধরছে ক্রমশ। স্যর ওকে ধমক দেন, “হাঁ করে তাকিয়ে দেখছ কী? এটাকে ছাড়াতে হবে, একটু হেল্প করো।”

নিজে হাঁটু মুড়ে বসে বাঁ হাতটা মাটিতে ঘষে নিয়ে লেজের দিকটা ধরে প্যাঁচ খোলার চেষ্টা করতে থাকেন, কিন্তু একটু আলগা করতে না-করতেই সাপটা আবার ছিটকে গিয়ে পরের পাকটা লাগায়। এ বার বেন্দার চৈতন্য ফেরে, স্যরকে সাহায্য করা দরকার বুঝে দু’হাত মাটিতে ঘষে খসখসে করে নিয়ে সাপটার প্যাঁচ ছাড়াতে সচেষ্ট হয়। দু’জনের খানিকক্ষণের চেষ্টায় সব প্যাঁচ খুলে ওটাকে লম্বা করে টেনে ধরা সম্ভব হয়। স্যর বলেন, ‘‘ভাল করে চেহারাটা দেখে রাখো, বৃন্দাবন। এটা মারাত্মক বিষাক্ত। চন্দ্রবোড়া। দু’দিক সরু, মাঝখানটা খুব মোটা আর গায়ে চাঁদের মতো চাকা আঁকা। কত বড় বিষদাঁত দেখেছ! বিষের থলিও বোধহয় চেহারার মতোই বিরাট। এর একটা ছোবল খেলে এখান থেকে পুরুলিয়া বা নিদেনপক্ষে কাছের বলরামপুর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েও চিকিৎসা করার সময় মিলবে না। মুখ-নাক-চোখ দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করবে। কারণ এর বিষে রক্তকণিকা নষ্ট হয় খুব তাড়াতাড়ি। চলো, একটু ঢালের ধারটায় গিয়ে দু’জনে একসঙ্গে এটাকে ছুড়ে দেব, যাতে এক্ষুনি উঠে আসতে না পারে। আমরাও সেই ফাঁকে ফেরার রাস্তা ধরব। খুব বাঁচা বেঁচে গেলে আজ!”

রুমালসুদ্ধ সাপটাকে ঢালের মুখে নিয়ে দু’জনে এক সঙ্গে কয়েকবার দুলিয়ে ছুড়ে ফেলে ওরা, তার পর ফেরার পথ ধরে উতরাই বেয়ে। নদীতে নেমে ভাল করে হাত ধুতে-ধুতে বেন্দা বলে, “মাফ করে দ্যান আঁজ্ঞা, হামার ত্যাখন রাগে মাথার ঠিক ছিল্য নাই। আপনি হামাকে বাঁচানোর জন্যে যমের মুখ্যে হাত দিলেন আর হামি কি ন্য...’’

বোসস্যর ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “চোখের সামনে শুকনো ডাল-পাতার মধ্যে থেকে তিনকোনা মাথাটা বেরিয়ে আসতে দেখে বেশি কিছু ভাবার সময় পাইনি। আমি জানি, অ্যাটাক করবে মনে করলে চন্দ্রবোড়া এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে চার-পাঁচ ফুট দূরের শিকারকে ছোবল মারতে পারে। তোমার মাথা আর ঘাড় ওর লক্ষ্য ছিল, আমি একটু সময় নিলে সাপটার ছোবল তোমার এমন জায়গায় পড়ত যেখানে কোনও বাঁধনও দেওয়া যেত না। আমি তোমাকে এই ডুংরি থেকে নামিয়ে বাইকে করে বান্দোয়ান বা আরও দূরের কোনও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই তুমি এলিয়ে পড়তে। আমার হাতে ছোবল পড়লে কয়েকটা বাঁধন দিয়ে অন্তত সেই চেষ্টা করা যেত, কিন্তু তোমার বাইক চালানোর অভ্যেস নেই। যত ক্ষণ ধরে এ সব তোমাকে বললাম, ভেবেছি তার চেয়ে অনেক কম সময়ে। বিপদে পড়লে আমার মাথা বেশি স্পিডে কাজ করে।”

সে ব্যাপারে বেন্দার কোনও দ্বিমত নেই। ঘটনা ঘটে যাওয়ার আধ ঘণ্টা পরও ওর মাথা ঝিমঝিম করছে। ও শুধু ভাবছিল, সায়েবের কোনও আত্মীয় বা বন্ধু নয় ও, একজন সাধারণ কর্মচারী মাত্র। তা ছাড়া সাপটা কামড়ালে ওঁরও যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল বাঁচা-মরা নিয়ে। হয়তো ওর মনের ভাব বুঝেই স্যর বললেন, “কে কত দিন বাঁচবে তার কোনও স্থিরতা নেই। আমি তো অনেক দিন ধরেই মরতে চাই, কিন্তু মৃত্যুটা যেন স্বাভাবিক দেখতে লাগে। আমি চাই না কেউ জানুক যে, আমি কারও ছলনার আঘাতে আত্মহত্যা করেছি। হয়তো সেই কারণেই আমি চট করে মারা যাব না, আমার নিয়তি আমাকে বাঁচিয়ে দেবে ঠিক!”

কানের কাছে চড়া একটা খনখনে আওয়াজে বেন্দা বাস্তবে ফিরে আসে, “কী গ্য বড়কুটুম, কতা কান্যে যায় না যে? হামার মেয়্যার জন্যি পেরানে বেঁচ্যে গ্যালে ই যাত্রা, সি খিয়াল রাখ্যো ইখন থেক্যা! ইয়ারা ত্যো বুলচ্যে সাপটো চাঁদবুড়োই বঠ্যে, ইয়ার কামড়ে ন কি হাঁথিও বাঁচ্যে না! আমাবস্যা-পুল্লিমায় ন কি বিষটো বাড়্যে ইয়াদের, আজ আবার পুল্লিমা তিথ্যি চইলছ্যে। ইট্যা তুমাক্যে ছুবলাইল্যে ফটোক হইয়্যে যাঁত্যে গ!”

গলাটা সৈরভীর মায়ের। এখন বেশ কিছু দিন এই গলার দাপট চলবে, সেটা ও ভালই বুঝতে পারছে। ঘাড় নেড়ে সায় দেয়, “হঁ, বেয়ান, ঠিক্যেই বুল্যেছ তুমি, তুমার মেয়্যার লজরের জোর আছে, মাইনত্যে হব্যে সিট্যা। তব্যে কথাটো হল্য, সাপটো তো আর হিসাব কষ্যে ছুবলাইত্য নাই, যাকে সামনে দেইখত্য তাক্যেই দিত অ্যাক ছোব্যল— সে আমিই কী আর তুমিই কী! বেশি ঘুরঘুর তুমিই কর‌্য কি না...’’

দুই বেয়াই-বেয়ানের সংলাপে দর্শকেরা মজা পায়। ও দিকে ফরেস্টের থেকে আনা বাক্সে না ঢুকিয়ে সাপটাকে একটা মাটির হাঁড়ি চেয়ে নিয়ে তাতেই ভরে নিয়ে নেয় সাপুড়েরা। মুখে বলে, দূরের জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দেবে, তবে বেন্দা জানে ওরা সাপ আর বিষ, দু’টোরই ব্যবসা করে। ও মনে মনে ভাবে, দুচ্ছাই, যা করে করুক ওরা... হামি তো আর সরকারি নোকর লয়, হামার কিসের মাথাবেথ্যা!

রাতে শুতে গিয়ে এক উৎপাত। আলো জ্বেলে বেন্দা ঘুমোতে পারে না, এ দিকে আলো বন্ধ করলেই অন্ধকার ঘরে খসখস সড়সড় করে শব্দ শুরু হয়। এ সব শব্দ হয়তো অন্য দিনও একটু-আধটু হয়ে থাকে, বেন্দা পাত্তা দেয়নি সে ভাবে। অথচ আজ নিজের চোখে যমদূতকে দেখার পর আর অত বছর আগে মরণের খুব কাছ থেকে ফিরে আসার ঘটনাটা সদ্য মনে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে শরীরে কাঁটা দেয়। হঠাৎই প্রথম দিন বান্দোয়ানে আসার পর বোসস্যরের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সন্ধের আগে রেস্ট শেড থেকে বেরনোর সময় বেন্দাকে দেখতে পেয়ে উনি বলেছিলেন, ‘‘দেখো তো বৃন্দাবন, তুমি আমার মশারিটা টাঙানোর ব্যবস্থা করতে পারো কি না। আমি সুটকেস থেকে বার করে বিছানায় রেখেছি, কিন্তু দড়ি মাপে ছোট হচ্ছে।” দড়ি জোগাড় করে মশারি খাটানো পর্যন্ত উনি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, ঠিকমতো খাটানো হয়ে গেলে ওকে চারদিক ভাল করে তোষকে গুঁজে দিতে হয় ওঁর নির্দেশ মতো। কাজ হয়ে গেলে দরজায় তালা লাগিয়ে ওকে বলেন, “টানা দু’বছর ট্রেনিং এই সার্ভিসে, তার মধ্যে ক্যাম্প করে অনেক দিন বনে-জঙ্গলে কাটিয়েছি তো, অভ্যেস হয়ে গিয়েছে মশারির ভিতর শোয়া। পোকামাকড়, মশা, বিছে, মাকড়সা, এমনকি সাপের হাত থেকেও বাঁচা যায় এতে।”

তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে ও আলো জ্বেলে ট্রাঙ্ক থেকে মশারিটা বার করে টাঙিয়ে নেয়, তার পর চার দিক ভাল করে গুঁজে আলো নিভিয়ে মশারির ঘেরাটোপে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু আধ ঘণ্টা উসখুস করার পরও দু’চোখের পাতা এক হচ্ছে না বেন্দার। বোসস্যরের কথাই মনে আসছে বারবার।

বোসস্যর বান্দোয়ানে কাজে জয়েন করার প্রথম দিন থেকে নিজের অজান্তেই তাঁর চার পাশে বেশ কিছু শত্রুর সৃষ্টি করে ফেললেন। উনি যখনই অফিস থেকে সরে যেতেন, তখনই বিটবাবুরা আর কয়েক জন সিনিয়র গার্ডবাবু মিলে গুজগুজ ফুসফুস শুরু হয়ে যেত। ওঁর কোনও বদভ্যাস আছে কি না, উনি কী কী পছন্দ বা অপছন্দ করেন, সে সব খতিয়ান জোগাড় শুরু হল। এই সব আলোচনায় মধুময় মানে মধুদাকে আর দু’-তিনজন পেটোয়া টিম্বার মার্চেন্টকে ওরা সামিল করেছিল, বেন্দাকে কিন্তু নেয়নি।

পোড়-খাওয়া ফরেস্টার দুয়ারিবাবু বলেছিলেন, “ওটা সদ্য কাজে ঢুকেছে ট্রেনিং শেষ করে, বোধবুদ্ধি পাকেনি। তার উপর আবার অফিসারের পাইলট হয়ে সর্বদা ঘুরবে, গুহ্যকথা ওর পেটে থাকবে না। কিন্তু মধুরে বলা আছে, অফিসারের খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, যে-কোনও রকম কাজে সাহায্য করা চলবে না! এমনকি ওঁর হ্যাজাক-ডেলাইটটাও যেন না জ্বালানো হয়। নয়াসাহেব তো এক বচ্ছরও থাকবে না, কিন্তু আমরা সবাই থাকব বরাবর, আমাদের চটালে তোর পরকাল ঝরঝরে করে দেব!” কিছু কিছু কথা মধুদাই চাপতে না পেরে ওঁর কাছে বলে ফেলত, আবার কাউকে বলতে বারণ করত বার বার করে।

প্রথম গন্ডগোলটা বাধল দিনদশেকের মধ্যেই, তখনও স্যর রেস্ট শেডেই থাকছেন আর আগের বড়বাবু কোয়ার্টারে। পরিবারের অন্যরা চলে গিয়েছে নতুন জায়গায়, নিজস্ব মালপত্রও গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে উনিও চলে যাবেন। সবে ছট পুজোর মাতামাতি শেষ হয়েছে, খোয়ারি তখনও কাটেনি। তাই সে দিন বিকেলবেলার আড্ডায় ঠিক হল যে, বিদায়ী বড়বাবুকে বেশ ঘটা করে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হবে। কাষ্ঠব্যবসায়ী সমিতির নেতা সন্দীপ শেঠের দিনের বেলাতেই একটু চড়ে গিয়েছিল, সে চেঁচিয়ে উঠল, “অ্যাই ত অ্যাকটো বাহানা পাওয়া গ্যাছে নতুন সায়েবকেও পটানোর, আজই তাইলে রাতেরবেল্যা ফ্যারওলটো হইয়েঁ যাক! পিকনিকের খর্চা আমার, অ্যাখন তাইলে অ্যাকটো ভিডিয়ো লাগায়েঁ দিই বরং। ইখানে ভাল মালের বড্ড কেরাইসিস, ভালো বেরান্ডের অ্যাকলম্বরি ফুল বোতল দুইট্যা আইনত্যে লাইগব্যেক। আমার ভাইটো এসপার্ট আছে, বেন্দাকে পায়লট পেলে ঢাই ঘণ্টায় ঘুরে আসবেক মাল লিয়ে।”

যথারীতি আধ ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার হতে না-হতেই রেঞ্জ অফিস চত্বরে ভিডিয়ো এনে একটা ঝিনচ্যাক বাংলা ফিলিম চালু হয়ে গেল। স্টাফদের ছেলে-মেয়ে আর ঘোমটা-টানা বৌ-বিটিরাও সব বসে পড়ল। স্যর বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, ফেরার পথে তাঁকেও ধরে একটা উঁচু চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হল। ফেয়ারওয়েলের সঙ্গে পিকনিক হবে শুনে উনি একটু হেসে রাজি হয়ে গেলেন। গোল পাকাল আকাট মুখ্যু কাঠব্যাপারি শেঠের পো। নতুন অফিসার পিকনিকে থাকতে রাজি হয়েছে শুনে ভাবল, যুদ্ধজয়টা বোধহয় হয়েই গেল। স্যর শুনতে পাবেন সেই রকম হাই ভল্যুমে বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করল, “তাইলে আপনার আর নতুন সাহেবের বেরান্ডটো কী হবে, আঁজ্ঞা?”

(ক্রমশ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maya Prapanchomoy Kanailal Ghosh Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE