ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।
বিছানা ছেড়ে উঠে এসে বিশাল সোফাটায় শুয়ে পড়ল রিচা। মাত্র মিনিট তিন-চারেকের ব্যাপার। সেটাকেই মনে হচ্ছিল তিন-চার যুগ অনন্ত নরকে কাটানোর মতো। নাঃ, আর নয়! ওই শালা না-মরদ বুঢ্ঢা জানোয়ারটার সঙ্গে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেছে রিচা। বছরছয়েক হল মালটার সঙ্গে। যা গোছানোর গুছিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে। এ দিকে নিজের বয়েসও বাড়ছে। ওই শালার দেওয়া বাংলোটা ছাড়াও আরো দুটো বিশাল ফ্ল্যাট, এক-একটা আড়াই হাজার স্কোয়ার ফিটের, মেরিন লাইনস আর নিউ ভাসিতে। তিনটে লাক্সারি কার। মার্সিডিজ়, বি এম ডব্লু, পোরশে। দেশবিদেশ মিলিয়ে মোটা অঙ্কের অ্যাকাউন্ট অন্তত এক ডজন ব্যাঙ্কে। কমপক্ষে দেড়শো ভরির জুয়েলারি। উইথ সাম এক্সক্লুসিভ পিসেস অব ডায়মন্ডস। বাকি জিন্দেগি হেসেখেলে চলে যাবে। আর এ দিকে রিকি তো আছেই। পুরো নাম রিকি হেন্ডারসন। আলাপ হয়েছিল সিডনির একটা শোয়ে, বছরখানেক আগে। অস্ট্রেলিয়ায় একটা ভীষণ পপুলার ব্যান্ডের লিড সিঙ্গার। দুনিয়াজোড়া নাম। ফ্যান বেস দুর্দান্ত! রিচার চেয়ে বয়সে বছরকয়েকের ছোটই হবে। এর মধ্যেই বারতিনেক মলদ্বীপ আর ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডের রিসর্টগুলোয় বেশ কয়েকটা উদ্দাম রাত কাটিয়েছে ওরা দু’জনে, খুব গোপনে। দুরন্ত হ্যান্ডসাম রিকি, একই সঙ্গে দুর্দান্ত বিছানাতেও। সে সব কথা ভাবতেই এসির ঠান্ডাতেও দু’কানে আগুনের হল্কা যেন। স্কিন গ্রাফটিং-এর কাজটা দুর্দান্ত করেছে ডক্টর সমর্থ। এ বার ঢলতি বয়সের চটকটুকু থাকতে থাকতে রিকিকে গেঁথে ফেলা দরকার। তার পর উড় যা চিড়িয়া। আলবিদা ইন্ডিয়া! সন্দেহ নেই মনু পাওয়ারফুল, কিন্তু রকস্টার রিকি হেন্ডারসনের স্ত্রীকে ঘাঁটাতে দশ বার ভাববে শালা। নিজের সারা শরীরে এক বার হাত বোলাল রিচা। জানোয়ারটার ঘাঁটাঘাঁটিতে একটা ঘিনঘিনে ভাব গোটা গা জুড়ে। এক্ষুনি একটা হট শাওয়ার নেয়া দরকার। কার্পেট মাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল রিচা।
রাত বারোটা বাজতে পাঁচ। ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে হেডকোয়ার্টারের সেন্ট্রাল লক-আপ। সিলিং থেকে একটা খুব কম পাওয়ারের বাল্ব ঝুলছে। ঢিমে আলোর নীচে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো জনা দশ-বারো হোটেল মালিক আর কর্মচারী। সেই রেডের রাতেই হলদিয়া থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে সবাইকে। সামনে খাঁচা-খোলা বাঘের মতো পায়চারি করছিলেন মজিদসাহেব। চোখে হাড়হিম করা দৃষ্টি।
“এই শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি সবাইকে,” গরগর করে উঠলেন মজিদ, “কে বা কারা পৌঁছে দিত মেয়েগুলোকে, তোমাদের হোটেলে? সাপ্লায়ার কারা? যা কিছু জানো উগরে ফেলো এক্ষুনি।”
মজিদের সামনে দাঁড়ানো পরেশ গিরি, গ্রিন ভ্যালি হোটেলের মালিক। ভয়ে কাঁপছে থরথর করে। ককিয়ে উঠল ধমক খেয়ে, “বিশ্বাস করুন স্যর, আমরা মেয়ে কেনাবেচার কারবার করি না। মা কালীর দিব্যি। মেয়েগুলো নিজেরাই আসে কখনও দল বেঁধে, কখনও একা, আবার কখনও বাড়িওয়ালিদের সঙ্গে। কলকাতার লাইন পাড়াগুলোয়, বিশেষ করে খিদিরপুরে ফরেনার সি-ম্যানদের আসা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের ওখানে নেপালি মেয়েদের আসা বাড়ে হুড়হুড় করে। মিথ্যে বলব না স্যর, আমাদের মতো কিছু হোটেল মালিক দুটো এক্সট্রা পয়সা কামানোর লোভে এই ধান্দার নেশায় পড়ে গেছি। স্রেফ কমিশনের ওপর বেস করে কারবারটা চলে। দিনের শেষে দু’তরফই নিজের পারসেন্টেজ বুঝে নিত। তবে জোর করে কাউকে লাইনে নামানো, জবরদস্তি ধান্দায় খাটানো, অত্যাচার করা, এ সব কখনও করি না আমরা। আর ওই যে অসুস্থ মেয়েটা, যাকে আপনারা নিয়ে এসেছেন, ওকে কেউ আনেনি, মাত্তর ক’দিন আগে এসে হোটেলের সামনে বসে ছিল। ওখানকার মেয়েরাই ওকে তুলে নিয়ে আসে। তখনই খুব অসুস্থ ছিল। কথা বলার অবস্থায় ছিল না প্রায়। ও একা একাই নাকি মুম্বই থেকে চলে এসেছিল এখানে। কার কাছে নাকি শুনেছিল, এখানে ওর জাতের মেয়েরা সব থাকে। হোটেলের মেয়েরাই ওকে খেতে দিত। ধান্দার ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু পারত সেবাযত্ন করত। দিনে দিনে অবস্থা খারাপ হচ্ছিল মেয়েটার। আমরাই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিলাম। তার মধ্যেই তো স্যর আপনারা… তবে মেয়েটার ওপর কোনও অত্যাচার করিনি আমরা। বাকি মেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন...” বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মাঝবয়সি হোটেল মালিক। পরমুহূর্তেই লকআপের মেঝেয় ছড়ছড় শব্দ। সে দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাতের তেল খাওয়ানো রুলটা আলতো করে লোকটার গালে বোলালেন মজিদ, “এখনও আঙুলটুকুও ছোঁয়াইনি, তাতেই মেঝে ভিজিয়ে ফেললে বাওয়া। এ তো সবে কলির সন্ধে। এখনও অনেক কচলাকচলি চলবে। সে শালা যত্ত বড় সেয়ানাই হোক না কেন, মায়ের গব্বে গিয়ে ঢুকলেও ঠিক টেনে বের করব সব ক’টাকে। তখন যদি কথার কোনও গরমিল পাই, এমন ডোজ় দেব…” দাঁতে দাঁত ঘষলেন মজিদ। তার পর চোখ নাচালেন পাশে দাঁড়ানো সুনীলের দিকে চেয়ে, “জমাদার ডাক সুনীল। এর মধ্যেই যা গন্ধ ছাড়তে শুরু করে দিয়েছে...” গজগজ করতে করতে বিরক্তমুখে লকআপ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন মজিদ আলি।
সকাল দশটা চল্লিশ। বেডের সামনে ঝুঁকে পড়ে আশার সঙ্গে কথা বলছিল সন্তোষী। খুব ক্ষীণ গলায় উত্তর দিচ্ছিল মেয়েটা। এক-একটা শব্দ উচ্চারণ করতে যেন প্রাণান্তকর পরিশ্রম হচ্ছিল মেয়েটার। শীর্ণ বুকের খাঁচাটা ওঠানামা করছিল হাপরের মতো। সন্তোষীর পাশে বসা কৌস্তুভ। কথা বলতে বলতে বার বার ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে আশার বয়ানের তর্জমা করে দিচ্ছে সন্তোষী। কৌস্তুভের হাতে স্কেচ পেন্সিল। ড্রয়িং পেপারে হাত চলছে দ্রুত। একটু দূরে দেয়ালের এক কোণে দাঁড়ানো রুদ্র আর ডক্টর চিন্ময় পত্রনবীশ। কথা হচ্ছে নিচু গলায়।
“জানোয়ারের মতো অত্যাচার হয়েছে মেয়েটার ওপর,” বিষণ্ণ শোনাচ্ছিল ডাক্তারের গলা, “ভ্যাজাইনাল হোল সাংঘাতিক ভাবে জখম। রিপোর্ট বলছে স্কিন লিফট করা হয়েছে। সেটা সেভারাল টাইমস হলেও হতে পারে। মনে হয় সেই সব ইনজুরির ফলে এইচ আই ভি ভাইরাস খুব সহজেই ইনফেক্ট করতে পেরেছে শরীরকে। এতটুকু একটা মেয়ে…” গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তারবাবু। “আমার মনে হয় মেয়েটাকে এখন ছেড়ে দেওয়া উচিত আপনাদের। অলরেডি শি হ্যাজ অ্যাবসরবড এনাফ।”
কথার মাঝখানেই বেডের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল সন্তোষী, “স্টেটমেন্ট মোটামুটি কমপ্লিট স্যর। কৌস্তুভ রাফ একটা স্কেচ করে নিয়েছে।”
ডক্টর পত্রনবীশের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল রুদ্র, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। আপনি যা করলেন তার তুলনা নেই। আমার পুরো টিম গ্রেটফুল আপনার কাছে।” জবাবে ফের এক বার সেই বিষণ্ণ হাসি হাসলেন ডাক্তার, “না, না, এটা কিছু নয়। আয়াম শিওর, ইউ অ্যান্ড ইয়োর টিম উইল বি এবল টু পানিশ দোজ় বাস্টার্ডস, দোজ় হু হ্যাভ কমিটেড দিস ব্রুটলাইক ক্রাইম। আর সে দিন আপনারা নয়, আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের কাছে। নাউ দিস পুওর গার্ল।”
বেডে শোওয়া আশার দিকে তাকালেন চিন্ময়, “যত দিন ও সারভাইভ করতে পারবে, সেই সময়টুকুকে ওর জন্য কতখানি লেস পেনফুল করে তোলা যায় সেই চেষ্টাই করতে হবে আমাদের।”
কেবিনের বাইরে লম্বা কাঠের বেঞ্চিটায় বসে ছিলেন মজিদসাহেব। পাশে দাঁড়ানো সুনীল। রুদ্রকে বেরোতে দেখেই শশব্যস্তে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে এগিয়ে এলেন সামনে, “মজিদসাহেব, ইমিডিয়েটলি এক বার প্রতাপের হোটেলে যেতে হবে আমাদের। রফিকমিয়াঁ আর ঊর্মিলা বাড়িওয়ালিকেও ফোন করুন এক্ষুনি! মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে চলে আসে ওখানে।” উত্তেজিত শোনাচ্ছিল রুদ্রর গলা।
“ইয়েস স্যর!” ঝটিতি পকেট থেকে ফোনটা বার করে আনলেন মজিদ আলি।
প্রতাপের হোটেল। সাউন্ডপ্রুফ কেবিনটার মধ্যে বড় টেবিলটাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘিরে বসা সবাই। রুদ্রর চোখের ইশারায় রোল-করা ড্রয়িং পেপারটাকে রফিক আর ঊর্মিলার সামনে খুলে ধরল সন্তোষী। একদৃষ্টে অনেক ক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল ঊর্মিলা সিং। তার পর চোখ তুলে তাকাল রুদ্রর দিকে। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি, “রুদ্রসাহাব, আগর আপনার জায়গায় আপনাদের ডিপার্টমেন্টের দুসরা কোই হতো, আমি তাদের কিচ্ছু বলতাম না। কারণ এটা আমাদের কওমের, আমাদের বেরাদরির বেপার আছে। লেকিন আপকা বাত আলগ হ্যায়। আপনি আমার জান কা টুকরা বান্টিকে, আমার একলওতা ভাতিজাকে বাঁচিয়েছিলেন। এক নয়ি জ়িন্দেগি দিয়ে থে উসকো। তাই আপনাকে বলছি, তসবির দেখে যত দূর মনে হচ্ছে, এটা সদানন্দ দালাল।”
“কাদের হয়ে কাজ করে মালটা?” তীক্ষ্ণ চোখে ঊর্মিলার দিকে তাকালেন মজিদসাহেব। জবাবে মজিদসাহেবের দিকে ঘুরে তাকাল ঊর্মিলা সিং, “আপনি তো জানেন স্যর, এলাকার দালালরা খাস কারও জন্য কাজ করে না। যার কাছে কমিশন পায় তাকেই সাপ্লাই এনে দেয়। ইস লিয়ে আলগ সে কিসি কা নাম বতা নহী সকতে। তবে সদানন্দ সাপ্লাইয়ের কাজে মাঝে মাঝেই নেপাল, ইউ পি যায়। ইয়ে বাত জানতে হ্যায় হাম।”
“স্যর, আপনি জাস্ট এক বার অর্ডার করুন, এক্ষুনি গিয়ে হারামিটাকে তুলে নিয়ে আসছি!” ভয়ঙ্কর উত্তেজিত গলায় বলে উঠল সন্তোষী।
শান্ত চোখে সন্তোষীর দিকে তাকাল ঊর্মিলা সিং, বলল, “এক মিনিট, মেহেরবানি করকে মেরা এক বাত শুনিয়ে ম্যাডামজি। এলাকার মধ্যে থেকে অচানক সদানন্দকে তুলতে গেলে গন্ডগোল হতে পারে। ইলাকার পলিটিক্সওয়ালা বাবুদের অনেকের সঙ্গে ওদের বেশ ভাল জানপহেচান ভি আছে। তারা ভি এসে মামলায় দখলান্দাজি শুরু করে দেবে। ইস কাম মে অওর ভি এক প্রবলেম হ্যায়। ইলাকায় যাদের এই কামের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারা ভি সবাই সাবধান হয়ে যাবে। ম্যায়নে চেতাবনি দে দিয়া। আভি আপলোগোঁকি মর্জি।”
“তা হলে ওকে কী করে তোলা যাবে?” গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল রুদ্র।
“সদানন্দ মহল্লায় বেলাকের ঠেকগুলো থেকে মদ খায় না। হররোজ সন্ধে সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ কোম্পানি বাগানের কাছে একটা সরকারি আংরেজি দারুর দুকান থেকে মাল কিনতে যায়। আব হামকো ইজ়াজ়ত দিজিয়ে সাহাব, ধান্দা কা টাইম হ্যায়...” মুচকি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঊর্মিলা সিং আগ্রাওয়ালি।
সন্ধে পৌনে সাতটা নাগাদ নীলমণি মিত্র স্ট্রিট লাগোয়া গলিটা দিয়ে বেরিয়ে বিডন স্ট্রিটের বড় রাস্তায় পড়ল সদানন্দ। সাতটা প্রায় বাজতে চলল, এখনই মালটা স্টকে রেখে দেওয়া দরকার। তায় আজ আবার শনিবার। একটু বাদেই খদ্দেররা সব ঢুকতে শুরু করবে পিলপিল করে। দু’-একটা মালদার কাস্টমার ঠিকঠাক কোনও মাগির ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই আজকের মতো জাব-রোটির চোখা বন্দোবস্ত একদম পাক্কা। তার মধ্যে যদি হোল নাইটের কাস্টমার জুটে যায় এক-আধটা, তা হলে তো একদম পাঁচ উংলি ঘি মে! ফুটপাতের ধারে রাস্তার ওপর একটা শিবমন্দির। দাঁড়িয়ে পড়ে হাত কপালে তুলে পরম ভক্তিভরে একটা নমস্কার ঠুকল সদানন্দ দালাল। তার পর একটা দশ টাকার কয়েন ছুড়ে দিল বড় পেতলের থালাটার ওপর। “হে ভোলেনাথ, হে বাবা জটাধারী। এক-দুটো ভাল দেখে পার্টি জুটিয়ে দাও বাবা।” তার পর ফের ফুটপাত ধরে হনহন করে এগিয়ে চলল নতুন বাজারের দিকে। পাঁইটটা কিনেই ফিরতে হবে জলদি। মহল্লার আলিজালি বেলাকের দোকানের মাল খায় না সদানন্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy