Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Novel

বৃশ্চিকবৃত্ত

ঘুরন্ত পেপারওয়েটটাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলে রুদ্রর দিকে তাকালেন মিস্টার রাহা

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।

ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।

সুপ্রিয় চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২১ ০৭:০৮
Share: Save:

লোহার হাতলে শ্মশান-ডোমের হাতের হ্যাঁচকা টান। আওয়াজ হল ‘ঘটাং’। ইলেকট্রিক চুল্লির লাল গনগনে সুড়ঙ্গের মতো ফার্নেসের মধ্যে ঢুকে গেল আশার শরীরটা। হাসপাতালের করিডরে ডক্টর পত্রনবীশের কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল রুদ্রর, “খুব চেষ্টা করেছিলাম রুদ্রবাবু। বাট আয়্যাম হেল্পলেস! এইচআইভি ইরাডিকেট করার মেডিসিন এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি মেডিক্যাল সায়েন্স।”

“স্যর,” ভাবনার চটকা ভেঙে গেল পাশে দাঁড়ানো মজিদসাহেবের ডাকে। মজিদসাহেবের দুটো চোখ রক্তলাল। গরগর করে উঠলেন চাপা গলায়, “মুসলমান শব্দের অর্থ মুসল্লে ইমান। মানে, ইমান যার মধ্যে পুরো মাত্রায় মজুদ। সেই ইমানের এক বিন্দুও যদি আমার মধ্যে বেঁচে থাকে, তা হলে যারা মেয়েটার এই অবস্থার জন্য দায়ী তাদের প্রত্যেকটাকে হাবিয়া দোজখে (অনন্ত নরকে) পাঠিয়ে ছাড়ব আমি। ওয়াদা রইল আপনার কাছে।”

“দ্যাটস দ্য স্পিরিট, মজিদসায়েব!” মৃদু হেসে মজিদের পিঠে একটা চাপড় মারল রুদ্র, “কিন্তু তার আগে আমাদের সবাইকে মুম্বই পৌঁছতে হবে। আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি।”

ডি সি সাহেবের আঙুলের মোচড়ে বিশাল টেবিলে কাচের কভারটার ওপর ঘুরছিল পেপারওয়েটটা। থামার সঙ্গে সঙ্গে ফের সেটাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন ডি সি মিস্টার রাহা। বহু দিনের অভিজ্ঞতা থেকে রুদ্র জানে, এ রকম করা মানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চলেছেন বড়সাহেব।

ঘুরন্ত পেপারওয়েটটাকে হাতের মুঠোয় ধরে ফেলে রুদ্রর দিকে তাকালেন মিস্টার রাহা, “প্রথমেই আমি কনগ্র্যাচুলেট করতে চাই তোমাকে। হোয়েন দেয়ার ওয়াজ় নো হোপ, বলতে গেলে প্রায় একটা ডেড এন্ডে চলে গেছিল কেসটা, এমনকি ফাইলটা বন্ধ করে দেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করে দেওয়া হয়েছিল, তখন যে ভাবে তুমি এখানকার পুরো র‌্যাকেট ক্র্যাক করলে, তাতে কোনও প্রশংসাই তোমার জন্য যথেষ্ট নয়। বাট লিসন রুদ্র,” কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ডি সি সাহেব। তার পর ফের যখন শুরু করলেন তখন গলার আওয়াজ খাদে নেমে গেছে একদম, “বাট নাও ইট ইজ় অ্যাবসলিউটলি অ্যান অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড কেস। সে ক্ষেত্রে আমাদের কেস ইনভেস্টিগেশন রিপোর্টগুলো মুম্বই পুলিশের হাতে তুলে দিলে ওরাই বাকিটা হ্যান্ডেল করে নিতে পারবে...” বলতে বলতে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন রাহাসাহেব, “দ্যাখো রুদ্র, ওয়ান্স আ কপ, অলওয়েজ় আ কপ, আমরা দু’জনেই বিশ্বাস করি কথাটা। কিন্তু দেখো,” একটা চোরা অস্বস্তি ডি সি সাহেবের গলায়, “আফটার অল তুমি তো অফিশিয়ালি ফোর্স থেকে রিটায়ার করে ফেলেছ বেশ কিছু দিন, আর ফিরেও এসেছ মেনলি আমার আর মজিদের সঙ্গে তোমার রিলেশনের জন্য। আর তুমি তো জানোই, মুম্বইয়ের ক্রাইম গ্যাংগুলো এখানকার তুলনায় কতটা বেশি ডেঞ্জারাস। সে ক্ষেত্রে একটা কিছু ঘটে গেলে কথা উঠবে, তুমি ফোর্স ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও তোমাকে ডেকে এনে কেন বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম আমরা। সে ক্ষেত্রে সবার, বিশেষ করে তোমার বেটার হাফের কাছে মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না আমাদের।”

জবাবে বড়কর্তার দিকে চেয়ে ম্লান হাসল রুদ্র, “দেখুন স্যর, আপনি আর মজিদসায়েবের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অবশ্যই গুরুত্ব পেয়েছে আমার ফিরে আসার কারণ হিসেবে। বাট সরি টু সে, দিস ওয়াজ় নট দ্য মেন রিজ়ন। আসলে ফুলের মতো নিষ্পাপ, নিরপরাধ কতগুলো বাচ্চা মেয়ে...” গলা কাঁপছিল রুদ্রর, “স্রেফ লোপাট হয়ে গেল আমাদের চার পাশ থেকে! যারা ওদের এই অবস্থার জন্য দায়ী, তাদের সবাইকে গরাদের পেছনে দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই আমার। তাই আমার জন্য একদম চিন্তা করবেন না স্যর। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় এখানে এসেছি আমি, আর সে ক্ষেত্রে যদি ভালমন্দ কিছু ঘটে, তার জন্য একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। সেটা আমার ডেস্কটপে লিখেও রেখে যাব আমি, মেল কপি পাঠিয়ে দেব আপনাকে...” গলার কাঁপুনিটা বাড়ছিল রুদ্রর, “আপনি আমার স্ত্রীর কথা ভেবে জেনুইনলি ওয়রিড অ্যান্ড টেন্সড। বাট বিলিভ মি, পর্ণা খুব ভাল করে চেনে আমাকে। ও জানে, এই মিশনের শেষটা না দেখে যেতে পারলে ভেতরে ভেতরে মরে যাব আমি। এখনও অবধি আশার বয়ান আর অন্যান্য সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স খতিয়ে দেখে ব্যাপারটাকে স্কিন ট্র্যাফিকিং-এর কেস বলেই মনে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরা কেউই এ ব্যাপারে অ্যাবসলিউটলি শিয়োর নই। এর সোর্সে পৌঁছতে গেলে আমাদের টিমের মুম্বই যাওয়াটা মাস্ট। ওরা সবাই অমানুষিক পরিশ্রম করেছে কেসটার পিছনে, টানা এত দিন ধরে। তাই ওদের সবাইকে দু’দিন ছুটি দিয়েছি আমি, যাতে ওখানে গিয়ে নতুন উদ্যমে ফের কাজ শুরু করতে পারে। ইন দিস সিচুয়েশন, উই ওয়ান্ট টু স্টার্ট ডে আফটার টুমরো। আর আমার বিশ্বাস, আমার ওপর ভরসা থাকলে আপনি আমাদের মুম্বই যাওয়ার পারমিশন দেবেন!” কথা শেষ করে উত্তেজনায় থরথর কাঁপছিল রুদ্র।

“কুল ডাউন রুদ্র, কুল ডাউন মাই বয়!” টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতলটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ওর কাঁধে হাত রাখলেন ডি সি সাহেব, “এত শর্ট পিরিয়ডের নোটিসে অনেক কিছু অ্যারেঞ্জ করতে হবে আমাকে। দেখছি কী করা যায়।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যর,” টানটান উঠে দাঁড়িয়ে নিজের সুপিরিয়রকে স্যালুট করল রুদ্র। তার পর দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

হেডকোয়ার্টারের বিশাল লনের এক পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা টিমের সুমো। তারককে ফোন করতে গিয়ে মনে মনে হেসে ফেলল রুদ্র। ওদের সবাইকে তো ছুটি দিয়েছে আজ। ব্যাকপকেট হাতড়ে গাড়ির চাবিটা বের করল রুদ্র। দরজা খুলে ইঞ্জিন স্টার্ট করতেই গোঁ-ও-ও শব্দে গুঙিয়ে উঠল সুমো। ফরেনসিক অফিসে ডক্টর চট্টরাজের ওখানে যাওয়া দরকার। পরে মুম্বই যাওয়ার তাড়াহুড়োয় আর সময় পাওয়া যাবে না। গতি বাড়িয়ে হেডকোয়ার্টারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সুমো।

“আয়্যাম সো হ্যাপি মাই বয় দ্যাট ইউ হ্যাভ ডিসাইডেড টু গো টু মুম্বই,” খুশিতে চকচক করছিল ডক্টর চট্টরাজের মুখখানা। “আর এই খবরটা সেলিব্রেট করার জন্য ইমিডিয়েটলি দু’কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি দরকার। দাঁড়াও,” বলে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এক কোণে কফি তৈরির সরঞ্জাম রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন চট্টরাজ। মিনিটপাঁচেক বাদে ফিরে এলেন দু’হাতে দুটো গরম কফির মাগ নিয়ে, “গিন্নির ধমকে সিগারেট ছেড়েছি, সে তো তুমি জানোই। তাও মাঝে মাঝে এক-আধটা খাই লুকিয়েচুরিয়ে। আছে না কি তোমার কাছে? থাকলে দাও একটা।”

“শিয়োর স্যর,” সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ডক্টর চট্টরাজের দিকে এগিয়ে দিল রুদ্র। লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিয়ে নিজেও ধরাল একটা। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে রুদ্রর দিকে তাকালেন চট্টরাজ। জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কবে রওনা দিচ্ছ?”

“সব ঠিকঠাক থাকলে পরশু,” জবাব দিল রুদ্র।

“ওকে,” কফির মাগে ছোট একটা চুমুক দিলেন চট্টরাজ। “এর মধ্যে আমি মুম্বইয়ে কনট্যাক্ট করছি। ডি ডি, ক্রাইম ব্রাঞ্চ, এস টি এফ সব জায়গাতেই কিছু চেনাশোনা আছে আমার। সাম ভেরি রিলায়েবল পার্সনস। তারা রেসপেক্ট করে আমাকে, ভালওবাসে খুব। দে উইল হেল্প ইউ।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যর!” কফিমাগে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র।

“আর একটা কথা,” এগনোর মুখে রুদ্রকে থামালেন ডক্টর চট্টরাজ, “মুম্বই ইজ় দ্য বিজ়নেস ক্যাপিটাল অব ইন্ডিয়া। কলকাতার তুলনায় টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যাপারটা বহুগুণ বেশি। একই কথা ওখানকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্ষেত্রেও সত্যি। ওখানকার ক্রাইম গ্যাংগুলো, দে আর ফার মোর ডেঞ্জারাস অ্যান্ড ফিয়ারসাম দ্যান দ্য ক্রিমিনালস অব কলকাতা। আমাদের এখানে একটা নাইন এমএম পিস্তল যখন অনেক বড় ব্যাপার, তখন মুম্বইয়ের গ্যাংস্টারদের হাতে এ কে ফর্টি সেভেন, এ কে ফিফটি সিক্স, কালাশনিকভের মতো মোস্ট সফিস্টিকেটেড ওয়েপন্‌স দেখা যায় হরবখত। তাই বলছি, বি ভেরি কেয়ারফুল। তোমার একটা জিনিসকেই ভয় আমার, তোমার লাগামছাড়া দুঃসাহস। ওটা বশে রাখবে সব সময়। মনে রাখবে, সুন্দরবনের ওই রিমোট ভিলেজে, সামওয়ান ইজ় ওয়েটিং ফর ইউ। কোনও স্টেপ নেওয়ার আগে তার মুখটা যেন সবার আগে ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। অনেক কষ্টে জোড়া লেগেছে তোমাদের সম্পর্কটা। সেটায় যেন ফের কোনও আঘাত না নেমে আসে। অলওয়েজ় কিপ ইট ইন মাইন্ড। বেস্ট অব লাক মাই বয়!” উদ্বেগের সুর ধরা পড়ল চট্টরাজের গলায়।

জবাবে মৃদু হাসল রুদ্র, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যর। আপনার অ্যাডভাইস আমার মনে থাকবে। আপনিও নিজের কেয়ার নেবেন। আমি আসছি।”

ফুটপাতে নেমে ঘড়ি দেখল রুদ্র। একটা বেজে কুড়ি। পর্ণা যতই আসতে বারণ করুক, কলকাতা ছাড়ার আগে ওর সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা কিছুতেই সম্ভব নয় রুদ্রর পক্ষে। ঠিকঠাক ড্রাইভ করলে সদর পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে চারটে বড় জোর। সদর থানায় গাড়িটা রেখে পর্ণার ওখানে যেতে বড় জোর সাড়ে ছটা। কাল ভোর-ভোর উঠে ফেরার জন্য রওনা দিলেই হবে। তবে তার আগে দুটো ফোন করা দরকার। একটা ডি সি সাহেবকে। প্রায়র ইন্টিমেশন দিয়ে রাখা দরকার। দ্বিতীয়টা পর্ণাকে। মাঝিচাচাকে যেন নৌকো নিয়ে সদরঘাটে চলে আসতে বলে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বর ডায়াল করতে করতে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল রুদ্র।

আধভেজানো জানলার ফাঁক দিয়ে কুয়াশামাখা সরু এক ফালি ঝাপসা চাঁদের আলো এসে পড়ছে বিছানায়। বহু অভিযানের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ অভিযাত্রীরা যে ভাবে মাটিতে উপুড় হয়ে কান লাগিয়ে মরুভূমি অথবা বিপদসঙ্কুল অরণ্যে জলের শব্দ খোঁজে, ঠিক সেই ভাবে শ্রীপর্ণার পেটে কান রেখে প্রাণের স্পন্দন খুঁজছিল রুদ্র। যদি এতটুকু ক্ষীণ শব্দও শোনা যায় কোথাও! বিছানায় শোওয়া শ্রীপর্ণা। মুখে অলৌকিক একটা হাসি।

“এত তাড়াতাড়ি কিছু শোনা যায় না। আরও ক’টা মাস যাক। তবে আমি টের পাই। শরীরটা ভারী ভারী ঠেকে আজকাল। বমি হয় মাঝে মাঝেই। এ রকমই হবে এখন। চিন্তা কোরো না একদম। দুষ্টুটা নড়াচড়া শুরু করলে আমিই তোমাকে জানিয়ে দেব,” রুদ্রর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব আদুরে গলায় বলল শ্রীপর্ণা, “এখন উঠে একটু জানলাটা বন্ধ করে দাও না প্লিজ়। বেশ ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে।”

শ্রীপর্ণার কথায় দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিল রুদ্র। ঘর জুড়ে মায়াবী নীল নাইটল্যাম্পের আলো। বিছানায় শোওয়া এক অলৌকিক রমণী! মিলনের তীব্র ইচ্ছা অনুভূত হল শরীরে। পরমুহূর্তেই নিজের মধ্যে অদৃশ্য এক কশাঘাতে সংযত করল নিজেকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নিদান অনুযায়ী একদম প্রাইমারি স্টেজ এটা। সামান্য অসাবধানতা বা ভুল পদক্ষেপে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। বিছানায় ফিরে এসে আলতো করে শ্রীপর্ণার হাতের ওপর একটা হাত রেখে চোখ বুজল রুদ্র।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy