ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল সীতাপতিদা। সীতাপতি বেহড়া। বাড়ি ওড়িশার বারিপদা জেলায়। এ বাড়িতে মেয়েদের রান্নার কাজ করে। বহু পুরনো লোক। ঊর্মিলার খুব বিশ্বস্ত। তিনটে কারণে ওকে পছন্দ করে ঊর্মিলা। এক, সীতাপতির রান্নার হাত দুর্দান্ত। দুই, খুব প্রয়োজনীয় কাজের কথা ছাড়া বেকার বকবক করে না। তিন, যে কোনও কথা, তা যত গোপনই হোক না কেন, ওর সঙ্গে আলোচনা করা যায়, নিশ্চিন্ত থাকা যায় যে সেটা কখনওই পাঁচকান হবে না।
“একটা কথা ছিল দিদি,” মৃদু গলায় বলল সীতাপতি।
“বলো,” বিমর্ষ গলা ঊর্মিলার। পাশে রাখা একটা মোড়ায় বসল সীতাপতি। তার পর ভুরু কুঁচকে তাকাল ঊর্মিলার দিকে।
“ক’দিন ধরে তোমাকে খুব আনমনা দেখছি। কী হয়েছে? আমাকে বলা যায়?” বলে সীতাপতি।
“আর বোলো মত দাদা, রুদ্রসাহাব একটা জরুরি খবর চাইছেন আমার থেকে, সেটাই দিতে পারছি না...” সীতাপতিকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলল ঊর্মিলা।
“হলদিয়ায় খোঁজ নিয়েছে ওরা? ওখানকার হোটেলগুলোয় তো নেপালি মেয়েতে গিজগিজ করছে,” জানাল সীতাপতি।
শোনামাত্র ঊর্মিলার মাথায় বিজলি চিকুর হানল যেন! আরে, এ দিকটা তো ভেবেই দেখা হয়নি। আজ থেকে বারো-পনেরো বছর আগেও বাংলায় নেপালি মেয়েদের সবচেয়ে বড় ঠিকানা ছিল খিদিরপুরের দুটো লাইনপাড়া, ওয়াটগঞ্জ আর মুন্সিগঞ্জ। কারণ লাগোয়া খিদিরপুর ডক। বন্দরে ভেড়া বিদেশি জাহাজের ফরেনার সিম্যানগুলোর খুব পছন্দ ছিল গোরি গোরি চামড়ার নেপালি মেয়েরা। তার পর এক দিন গঙ্গায় চড়া পড়ে পানি গেল কমে। বড় জাহাজ আসা বন্ধই হয়ে গেল একদম। সব গিয়ে ভিড়তে লাগল নয়া হলদিয়া ডকে। নেপালি মেয়েরাও দলে দলে বোরিয়াবিস্তারা বেঁধে পা বাড়াল হলদিয়ার দিকে। সে ভাবে বলতে গেলে প্রায় ফাঁকাই হয়ে গেল খিদিরপুরের দুটো জমজমাট লাইনপাড়া। এ দিক-ও দিক থেকে ঊর্মিলা শুনেছে ওখানকার ওই সব হোটেলগুলোয় মেয়েগুলোকে নাকি সারা দিন মদ আর নানা কিসিমের ড্রাগ খাইয়ে বসিয়ে রাখা হয়, সেই সঙ্গে জানোয়ারের মতো খাটানো হয় কাস্টমারদের কাছে। আরও অনেক ধরনের দু’নম্বরি কামকাজও নাকি হয় ওখানে, খবর আছে ঊর্মিলার কাছে। এ রকম একটা জায়গার কথা মনেও আসেনি ওর। অওর ক্যা তাজ্জব কি বাত! রুদ্রসাহাব, মজিদসাহাব ওরা ভি কিছু শোচেনি ব্যাপারটা নিয়ে। নইলে সে দিন প্রতাপের হোটেলে কখনও না কখনও আলোচনার মধ্যে এক বার কথাটা উঠতই। নিজের গালে নিজেই টেনে একটা চড় কষাতে ইচ্ছে করছিল ঊর্মিলার। ইচ্ছেটা সামলে দু’চোখে চকচকে হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল সীতাপতির দিকে।
“বহোত বহোত শুক্রিয়া দাদা, তুমি না বললে কথাটা মনেই আসত না আমার,” বলে ঊর্মিলা।
“তুমি ভাবো ব্যাপারটা নিয়ে। আমি আসি। দুনিয়ার কাজ পড়ে রয়েছে।” মুচকি হেসে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সীতাপতি বেহড়া। ওর চলে যাওয়ার দিকে একটুক্ষণ কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইল ঊর্মিলা। তার পর মোবাইলটা তুলে নিয়ে ডায়াল করল রুদ্রর নম্বর।
সন্ধে ছ’টা। শীতের হিমসন্ধে ভাল রকম জাঁকিয়ে বসেছে চার পাশে। ঘন কুয়াশায় ঝাপসা নিয়নের আলো। হলদিয়া গ্রিন ভ্যালি হোটেল। রিসেপশন ডেস্কের পিছনে কি-বোর্ডের পাশে টাঙানো গাদাখানেক ঠাকুরদেবতার ছবিতে ধূপ দেখাচ্ছিল নিতাই ঘোড়ুই। বয়েস পঞ্চাশ-বাহান্ন মতো। হোটেলের ম্যানেজার কাম রিসেপশনিস্ট। বেঁটেখাটো চিমড়েপানা চেহারা। গোটা মুখ জুড়ে শেয়ালে-ধূর্ততার ছাপ স্পষ্ট। সবে সন্ধে নেমেছে। একটু বাদে খদ্দেররা আসতে শুরু করবে। এক-দু’ঘণ্টার, কেউ কেউ আবার নাইট স্টে। একটু আগে নাইটে ফ্লোর ডিউটির ছোঁড়াটাকে পাঠিয়েছে তিনতলায়, মাগিগুলোকে তাড়া লাগানোর জন্য। শীতের সময় বাজার এমনিই একটু বেশি রকম চাঙ্গা থাকে— মদ আর মাগি, দুটোরই। ঝটপট সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া দরকার তার আগেই। এই সব পাঁচপ্যাঁচালি ভাবনার মাঝখানেই সুইং ডোর খোলার হাল্কা কিঁইচ আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নিতাই। একটা লোক। বছর চল্লিশেক। রোগাপাতলা ফিচেল ফিচেল চেহারা। নীল ডোরাকাটা হাফশার্ট আর ক্রিম কালারের প্যান্ট। হাল্কা চালে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। মুখভর্তি গুটখার রসে জড়ানো কথা, “একটা ঘর পাওয়া যাবে?”
“সিঙ্গল না ডবল?” চোখ সরু করে প্রশ্ন করল নিতাই।
“ডবল,” অম্লানবদনে উত্তর দিল লোকটা।
“সঙ্গে কেউ আছে?” ফের প্রশ্ন নিতাইয়ের।
জবাবে ফিচেল হাসল লোকটা, “নেই, কিন্তু চাই। একটা নয়, দুটো। পাওয়া যাবে?”
পা থেকে মাথা অবধি আগাপাছতলা এক বার লোকটাকে মাপল নিতাই ঘোড়ুই। চাপা মশকরা চোখের কোণে, “দু’-দুটো হেভি ডিউটি মেশিন এক সঙ্গে, এই চেহারায় চালাতে পারবেন?”
উত্তরে ফের এক বার সেই ফিচেল হাসি হাসল লোকটা, “নাঃ, তা হয়তো পারব না, তবে ও পারবে।”
দরজার দিকে আঙুল দেখাল তারক। দরজা ঠেলে ঢুকল সুনীল।
হাঁ করে সুনীলের দিকে তাকিয়ে ছিল নিতাই। তীব্র ত্রাস আর বিস্ময় মিলেমিশে একাকার দু’চোখে! এটা মানুষ না দানো? পুরাকালে এদেরই বোধহয় রাক্ষস বলা হত। আর কিছু ভেবে ওঠার
আগেই সুনীলের গুহার মতো দুই পাঞ্জার মুঠোয় হ্যাঁচকা টানে চড়াইছানার মতো উড়ে এসে ডেস্কের বাইরে পড়ল নিতাই। সামনে এগিয়ে এল তারক, ডেস্কের পাশে রাখা ওয়েস্ট পেপার বক্সটায় লম্বা ‘পুউউচ’ শব্দ করে পিক ফেলল অনেকটা। কথা একদম স্পষ্ট এখন।
“এর নাম সুনীল যাদব। কলকাতা হেডকোয়ার্টারে সেন্ট্রাল লক-আপ নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে তোমার মতো হারামি বেদোর ব্যাটাদের একটু-আধটু সাইজপত্তর করে ও। তবে এতেই সব কিছু শেষ হল বলে মোট্টে ভেবো না। এর পর আমাদের দু’জনের বাপরা আসবে। তারা যা কিছু প্রশ্নটশ্ন করবে, ঠিকঠাক জবাবটবাব দিয়ো, নইলে সেন্ট্রাল লক-আপের কাজটা এখানেই শুরু করে দেবে সুনীল।”
“না-আ-আ!” আর্তস্বরে ককিয়ে উঠল নিতাই। আর্তনাদ থামার আগেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ডিডি আর অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং সেলের জয়েন্ট স্কোয়াড। সংখ্যায় কমপক্ষে দশ থেকে বারো জন। সবার শেষে রুদ্র আর মজিদ আলি। এগিয়ে গিয়ে সপাটে নিতাইয়ের গালে বিরাশি সিক্কার একটা চড় কষালেন মজিদসাহেব। “শুয়োরের বাচ্চা! মেয়েগুলো কোথায়?”
মার খেয়ে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল নিতাই, “মারবেন না স্যর! সবাই তিনতলায় আছে।”
শোনামাত্র হুড়মুড়িয়ে ওপরে উঠে গেল পুরো টিম।
রিসেপশন ডেস্কে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রুদ্র। দলে দলে নেপালি মেয়েদের এনে বসানো হচ্ছে নীচে একতলার একটা বড় ঘরে। সন্তোষী আর অ্যান্টি ট্র্যাফিকিং সেলের লোকজনেরা রিপোর্ট তৈরি করছে। টুকটাক প্রশ্ন করছে মেয়েদের। হোটেল কর্মচারী আর কাস্টমারও অ্যারেস্ট হয়েছে দু’-চার জন। সবাইকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এক কোণে। হিমচোখে নিতাইয়ের দিকে তাকালেন মজিদসাহেব। “ভালই তো বন্দোবস্ত করেছ দেখছি নুড়কুৎ! এ বার চলো কলকাতা, তোমার বন্দোবস্ত কী ভাবে করতে হয়, সেটা দেখছি আমি।”
“আঃ মজিদসাহেব!” মৃদু তিরস্কারের সুর রুদ্রর গলায়, “এ ভাবে ধমকাবেন না ওকে। এমনিতেই তো কাপড়েচোপড়ে হয়ে গেছে,” বলতে বলতে নিতাইয়ের দিকে তাকাল রুদ্র, “শুনুন, কলকাতা নিয়ে গিয়ে যা যা প্রশ্ন করব, সব ক’টার ঠিকঠাক জবাব দেবেন। তাতে আপনার কেসটাও কিছুটা হালকা হবে, তা না করলে আপনার কপালে কিন্তু এই মজিদসাহেব আর সুনীল।”
কথাটা শেষ হবার আগেই ফের ককিয়ে উঠল নিতাই ঘোড়ুই, “না, না, স্যর! আপনি যা জিজ্ঞেস করবেন, হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট অ্যানসার দেব। দয়া করে পেটাবেন না প্লিজ়!”
করুণ আকুতি নিতাইয়ের গলায়। এ সবের মধ্যেও রুদ্রর মনে একটা খটকা কোথাও। বিকেল থেকে তিন-তিনটে হোটেলে রেড করা হয়ে গেল, বার বার কেন জানি না মনে হচ্ছে, কোনও কিছুই ঠিক পথে এগোচ্ছে না। বর্ডার পেরিয়ে এ পারে আসা মেয়েরা এখানকার রেড লাইট এরিয়াগুলোয় গিয়ে উঠবে, অথবা তাদের এখানকার মধুচক্রগুলোয় পাওয়া যাবে, এ তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু এর সঙ্গে রুদ্র যাদের খুঁজছে, সেই সব নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েগুলোর সম্পর্ক কী? এ তো আর দশটা রুটিন রেডের মতোই হয়ে যাচ্ছে যা পুলিশ হামেশাই করে থাকে। এই সব সাতপাঁচ ভাবনার মাঝখানেই হঠাৎ প্যাসেজের এক কোণের ঘরটা থেকে ভেসে আসে ক্ষীণ এক কিশোরীর কণ্ঠস্বর, ভাঙা ভাঙা হিন্দি... “হামকো বচাও! বহোত বিমার হুঁ ম্যায়।”
আওয়াজটাকে অনুসরণ করে তিরগতিতে সে দিকে ছুটে গেল রুদ্র। পিছনে পিছনে মজিদসাহেব।
খুপরিমতো একটা ছোট ঘর। নোংরা, অন্ধকার। আলু, সব্জির বস্তা আর এটা-ওটা দশ রকম জিনিসপত্তরে ঠাসা। আরশোলার ছোটাছুটি আর ইঁদুরের খুটখাট। এক পাশে একটা শতছিন্ন মাদুর। তার ওপর শুয়ে থাকা একটা মেয়ে। প্রেতমূর্তির মতো শীর্ণ, ফ্যাকাশে! হাড় ক’খানার ওপর চামড়াটা জড়ানো রয়েছে কোনও মতে। বন্ধ চোখজোড়া কাঁপছে থিরথির করে। ঠোঁটের কষে গ্যাঁজলা উঠছে। কথা বলার শক্তি নিঃশেষিত। ওই এক বার চিৎকার করে ওঠাতেই যেন খরচ হয়ে গেছে সবটা। কোন কারণ নেই সে রকম, তবু কেন যেন রুদ্রর মনে হচ্ছিল, অনেক সব বেজায় ধোঁয়াশারকম প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই মেয়েটার মধ্যে।
“মেয়েটা কে?” নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন মজিদ।
“ও সব পরে হবে মজিদসাহেব। অনেক সময় পড়ে রয়েছে তার জন্য।” কথার মাঝখানে মজিদকে থামাল রুদ্র, “আপনি তারককে বলুন ইমিডিয়েটলি মেয়েটাকে নিয়ে কলকাতা চলে যেতে। সঙ্গে সন্তোষী যাক। মেডিক্যাল কলেজে আমাদের এমারজেন্সি কোটায় একটা কেবিন। কলকাতা পৌঁছনোর আগেই যেন ব্যবস্থা হয়ে যায়। আপনি এক্ষুনি বড়সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিন।”
দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার সামনে ঝুঁকে পড়ল রুদ্র। নিঃশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। মনে হয় জ্ঞান হারিয়েছে মেয়েটা।
ভরদুপুর। সূর্য একেবারে মাথার ওপর। মেঙ্গালুরু-মুম্বইয়ের সীমান্তঘেঁষা জনমানবশূন্য সমুদ্রের ধারে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েছিল উসমান কালিয়ার দুধসাদা জাগুয়ার গাড়িটা। সাধারণ সি-বিচ বলতে যা বোঝায়, জায়গাটা সে রকম নয়। অসমান বালিয়াড়ি। চার দিকে ছড়ানো অমসৃণ বড় বড় পাথরের বোল্ডার। শোঁ শোঁ হাওয়া বইছে। বাতাসে নোনা মেছো গন্ধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy