পর্ণার কথার উত্তরে রুদ্র বলল, “আজকেই ফোনটা পেলাম। ফার্স্ট কলটাই তোমাকে।”
“তাই?” উত্তরটার মধ্যে খুশি না চোরা ব্যঙ্গ, ধরতে পারল না রুদ্র। আর সেটা বোঝার আগেই শান্ত গলায় নির্দেশাবলি, “সাবধানে থেকো, বেশি সিগারেট খেয়ো না, বেশি রাত জেগো না। আগেও যেটা বলেছিলাম, আবারও বলছি এই কাজটা যেমন তোমার ভীষণ ভাল লাগার, ভালবাসার, আবার একই সঙ্গে চরম অপছন্দেরও। বেশি দিন ওখানে থাকতে পারবে না তুমি। তাই কাজটা শেষ হলেই ফিরে এসো। আমার জন্য না হোক আর একটা মিমোর জন্য ফিরে এসো।”
শেষ দিকে পর্ণার কথাগুলো কি একটু ঝাপসামতো শোনাল?
“দু’জনের জন্যই ফিরব পর্ণা!” চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল রুদ্র।
ড্রাইভারের পাশের সিটটায় বসে একটু একটু ঢুলছিল সদানন্দ। হবে না-ই বা কেন। ক’দিন ধরে যা ধকল গেল! সেই নেপাল থেকে মেয়েটাকে নিয়ে এত দূর আসা। শিলিগুড়ি পানিট্যাঙ্কির সরকারি বর্ডার দিয়ে অতটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে তো আর ঢোকা যাবে না। ওপারের মামুরা হুড়কো দেবে ঠিক। ইস লিয়ে শালা হাজারখানা পাহাড়, তরাই আর মেচ নদী পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকতে হয়েছে। কখনও বাস, কখনও বয়েল গাড়ি, কখনও স্রেফ পয়দল। যাক, শেষতক মাল কৌশল্যাভাবির ফেলাটে কিষানের জিম্মায় জমা করে দেওয়া গেছে।
সব কাম খতম করে রাজারহাট থেকে কলকাতা ফিরছে গাড়ি। ঢুলুনির মাঝে মাঝে দু’-একটা এলোমেলো চিন্তাও উঁকি মেরে যাচ্ছে সদানন্দর মনে। হঠাৎ এই একলপ্তে অনেক বেশি টাকা কবুল করে নাবালিকা মেয়ে কিনে নেওয়ার ব্যাপারটা যেন খুব বেশি রকম বেড়ে গেছে সোনাগাছিতে। খাস করে কৌশল্যাভাবির মতো বেশ কিছু আগ্রাওয়ালি মালকিনদের মধ্যে। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার হল কিনে নেওয়ার পর থেকে ছুকরিগুলোর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শালা পুরো লাপাতা হয়ে যাচ্ছে মেয়েগুলো!
সোনাগাছি পাড়াতেই জন্ম সদানন্দের। মা, নানি, নানির মা, তিন-চার পুরুষ ধরে এই চামড়ার ধান্দা। নানির কাছে শুনেছিল, শ-দেঢ়শও বরষ পহলে যখন বঙ্গালিবাবুদের খুব বোলবোলাও ছিল, তখন সোনাগাছি নয়, পাশে রামবাগান ছিল সবচেয়ে বড় লাইনপাড়া। বাবুরা তাদের রাখেল মেয়েমানুষদের সঙ্গে শুধু শরীরের ফুর্তিই করত না, রীতিমতো পণ্ডিত, ওস্তাদদের মাস্টার রেখে পেয়ারের রান্ডদের নাচাগানার তালিম ভি দিত। জমানা পাল্টাল। তওয়ায়েফ আর বাইনাচ, রান্ডিবাজি, পতঙ্গবাজি, কবুতরবাজি, ঘোড়ার রেস, বুলবুলির লড়াই, আরও শালা হাজার রকম শখের পিছে পানির মাফিক রুপিয়া ঢেলে বঙ্গালিবাবুরা তো ফতুর হয়ে গেল। তাদের জায়গায় নয়া কাপ্তেন এল মাড়ওয়ারি বানিয়ারা। ওদের এসব শওকিন বিমারি নেই। বিছানায় খাপসুরত মেয়েমানুষ পেলেই হল। সেই ওদের হাত ধরেই সদানন্দের নানিদাদিরা, মানে আগ্রাওয়ালিরা এল কলকাতায়, এই সোনাগাছি লাইনমহল্লায়। ওদের গোষ্ঠীকে ‘বেরিয়া’ বলেও ডাকা হত রাজস্থান, উত্তর প্রদেশে। এই পুরা সোনাগাছিতেও এলাকার লোক ওদের বেরিয়া নামেই বেশি চেনে। ওদের সমাজে আইনকানুন, তওর-তরিকা একদম আলাদা। বেরিয়ারা নিজের মেয়েকে ধান্দায় নামাবে, কিন্তু বেটার বহুকে হারগিস ধান্দায় নামাবে না, কারণ বংশ ঠিক রাখতে হবে। সেখানে দু’নম্বরি খুন ঢুকে গেলে চলবে না। আবার সেই বহুর লড়কি পয়দা হলে খুব কম উমর থেকেই তাকে ধান্দায় নামানোর জন্য তৈয়ার করবে। সদানন্দর মতো বেরিয়া ঘরের ছেলেরা সারা দিন বসে বসে মা, বোন, দিদিদের কামাইয়ের পয়সায় মদ-গাঁজা খাবে, সন্ধে হলে ওদের জন্যই কাস্টমার ধরবে। এ ছাড়াও পুরা দেশ ঢুঁড়ে দুনিয়ার যত খাপসুরত ছুকরি এনে একাট্টা করবে এই সোনাগাছিতে। মা, চাচি, নানি, দাদিদের কাছে মেয়ে এনে দেওয়ার কমিশন খাবে। মেয়েরা লাইনপাড়ায় কাজ শুরু করলে আবারও কমিশন কামাবে তাদের খদ্দের ধরে দিয়ে। মেয়েরাই তো এই ধান্দায় লছমি। তারাই যদি এখানে না এসে অন্য কোথাও চলে যায়, তা হলে তো শালা বহোত মুশকিলের কথা। এক থোকে এখন হয়তো অনেকটা বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু একটা মেয়ের এই মহল্লায় থেকে যাওয়া মানে হর মাহিনায় বাঁধা একটা রোজগার। মেয়েটারও, সদানন্দের মতো ভাড়ুয়া দালালদেরও। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে তো শালা ভারী মুশকিল! কিন্তু যাচ্ছে কোথায় বাচ্চা বাচ্চা ছোকরিগুলো? কিঁউ অওর কওনসা কামকে লিয়ে ইতনা জিয়াদা রুপিয়া খর্চ করকে খরিদা যা রহা উনলোগোঁকো? সবসে বড়া বাত, সির্ফ নেপালি মেয়েদেরই এ ভাবে খরিদ করা হচ্ছে কেন? কৌশল্যাভাবি আর অন্য বাড়িওয়ালিরাও কি সবটা জানে? ঠারেঠোরে দু’-এক বার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও রামধমক খেয়েছে চাচি, ভাবি, মৌসিদের কাছে, “শালা রান্ডির অউলাদ ভাড়ুয়া! আম খাচ্ছিস খা, পেড় গিননে কা ক্যা জরুরত হায়?”
এই সব চিন্তাভাবনার মাঝখানেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে এসে ব্রেক কষল গাড়িটা। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সদানন্দ। কৌশল্যাভাবির জবরদস্ত মানা আছে। এ ভাবে গাড়ি করে সোনাগাছির সামনে গিয়ে নামা যাবে না একদম। শালা উর্দিওয়ালাদের খবরিতে পুরা মহল্লা ভর্তি। সন্দেহ হয়ে যাবে কুত্তাদের। এটুকু রাস্তা পয়দলই যেতে হবে। ঘরে একটা রামের পাঁইট রাখা আছে। গিয়ে বিনা পানিতে কাচ্চা মেরে দিতে হবে তিনটে পাতিয়ালা পেগ। তবে শালা এই ক’দিনের গায়ের ব্যথা মরবে। ভাবতে ভাবতে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে পা চালাল সদানন্দ।
ঝকঝকে পরিষ্কার ডিপার্টমেন্টের ছোট ঘরটা। দু’টো মাঝারি সাইজ়ের র্যাকে সাজানো এক গাদা হার্ড-কপি ফাইল। কেস ডকুমেন্টসে ঠাসা। বড় টেবিলটার পিছনে রিভলভিং চেয়ারে বসে চার দিকে চোখ চালাচ্ছিল রুদ্র। চোখে চাপা সপ্রশংস দৃষ্টি। সত্যিই তারিফ করতে হবে সন্তোষীর। এক দিনের মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে-গাছিয়ে ফিটফাট করে ফেলেছে একদম। দু’বছর আগেও ঠিক এ রকমই ছিল মেয়েটা। সমস্ত কিছু একেবারে রেডি করে রাখত হাতের সামনে। র্যাকের কোথায় কোন ডকুমেন্ট, কম্পিউটারের কোন ফাইলে কী রাখা আছে, সব একেবারে ঠোঁটস্থ। চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে হাজির রুদ্রর টেবিলে। সেই সন্তোষী, এই মুহূর্তে একদৃষ্টে ঝুঁকে রয়েছে নিজের টেবিলে ডেস্কটপের ওপর। মঙ্গোলীয় গোলগাল ফর্সা মুখটা আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কম্পিউটার স্ক্রিনের আলোয়। ওর মতো মেয়ে যে কোনও টিমের অ্যাসেট। একাধারে অসম্ভব বুদ্ধিমতী, অসমসাহসী, মাথাটা বরফের মতো ঠান্ডা, দুর্ধর্ষ মার্শাল আর্ট যোদ্ধা, সর্বোপরি কম্পিউটারে অগাধ দক্ষতা, তেমন কোনও উঁচু স্তরের প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই। বছরদুয়েক আগে এএসআই পোস্টে জয়েন করেছিল ফোর্সে। এর মধ্যেই প্রমোশন পেয়ে এস আই হয়েছে। আরও অনেক দূর যাবে মেয়েটা। রুদ্র নিশ্চিত।
আরও আধঘণ্টা এ রকম চলার পর কম্পিউটার বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সন্তোষী।
“ইস দ্য জব ডান সন্তোষী?” প্রশ্ন করল রুদ্র।
“ইয়েস স্যর, ডেটাবেসে সব কিছু তুলে ফেলেছি মোটামুটি,” মৃদু হেসে জবাব দিল সন্তোষী।
“গুড,” বলে ঘুরে তাকাল রুদ্র। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একটা হার্ড কপি ফাইলে চোখ বোলাচ্ছেন মজিদ আলি।
“সুনীল আর তারক কোথায়, মজিদসাহেব?” জিজ্ঞেস করল রুদ্র।
“ওরা একটু বাইরে গেছে স্যর, টিফিন খেতে, সে রকমই তো বলে গেল।”
“টিফিন খেতে না হাতি,” মজিদ সাহেবের জবাবে বাঁকা হাসল রুদ্র, “গেছে তো গুটখা চিবোতে। আমাকে-আপনাকে মারবে সিগারেট, আর ওদের দু’টোকে ওই গুটখা। দেখে নেবেন আপনি!” বলে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র, “আপনি ওদেরকে ও সব সেরেটেরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলুন, দশ মিনিটের মধ্যে।”
“ইয়েস স্যর!” ল্যান্ডলাইনের রিসিভারটা কানে তুলে নিলেন মজিদ।
রুদ্রর টেবিল ঘিরে গোল হয়ে বসে সবাই। সবার সামনে চায়ের কাপ। কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়ে সবার দিকে তাকাল রুদ্র, বলল, “আমাদের কাজটা কী তা এত ক্ষণে জেনে গেছি সবাই। নেপাল থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়ে পাচার হয়ে চলে আসে এ পারে। যে কোনও স্টেটে মেনলি রেড লাইট এরিয়াগুলোয় রুটিন অ্যান্ড ফরম্যাট রেড চালায় ওই সব রাজ্যের অ্যান্টি-ট্রাফিকিং ডিপার্টমেন্ট আর মিসিং স্কোয়াড। মোটামুটি একটা ট্রেসও পাওয়া যায় মেয়েগুলোর। এ বারের কেসটা আমার কাছে একটু অন্য রকম প্রধানত তিনটে কারণে। এক, মুম্বই, পুণে, কলকাতা, শিলিগুড়ি, দিল্লি, সব ক’টা রেড লাইট এরিয়ায় বার বার রেড চালিয়েও বেশ কিছু মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুই, এই ধরনের ঘটনা খুব বেশি বেড়ে গেছে মাত্র বছরখানেক হল। লাস্ট অব অল, মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, মেয়েগুলো সবাই নেপালি এবং মাইনর। প্রাথমিক ভাবে প্রিভিয়াস রিপোর্টগুলো দেখে আমার মনে হচ্ছে ডেঞ্জারাস অ্যান্ড ভেরি মাচ পাওয়ারফুল একটা ডার্ক নেক্সাস কাজ করছে এর পিছনে। এদের হাত ছড়ানো বহুদূর পর্যন্ত। খুব সম্ভবত ফোর্সের নরম্যাল প্রসিডিয়োর আর রুটিন ফরম্যাটে এ কেসটা সল্ভ হবে না। ফলে রুটিন ইনভেস্টিগেটিং সিস্টেমটা ভাঙতে হবে আমাদের, বার বার। আমি আজও মনে করি, টেকনোলজির এই অ্যাডভান্সমেন্টের যুগেও সোর্স বা ইনফর্মারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে। আমাদের নতুন, পুরনো, যত ইনফর্মার বেস আছে সেগুলোকে অ্যাক্টিভ করতে হবে কাল থেকেই। একটা ওয়ার লাইক সিচুয়েশনে কাজে নামতে হবে টিমের প্রত্যেককে। এ বার আপনি ভেবে দেখুন মজিদসাহেব,” মজিদের চোখে চোখ রাখল রুদ্র, “রিটায়ারমেন্টের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি আপনার। এই অবস্থায় এ রকম একটা অস্বাভাবিক আর চরম বিপজ্জনক মিশনে আপনি জয়েন করবেন কি না। বাকি তিন জনকেও এই একই কথা বলছি আমি...” মজিদসাহেবের থেকে চোখ সরিয়ে সুনীল, সন্তোষীদের দিকে তাকাল রুদ্র, “বড়সাহেবের সঙ্গে আজ সকালেই কথা হয়েছে আমার। এই টিম থেকে কেউ যদি এই মিশনে থাকতে না চায়, সে এই মুহূর্তে টিম ছেড়ে পুরনো ডিপার্টমেন্টে ফিরে যেতে পারে। তাতে তার সার্ভিস রেকর্ড বুকে কোনও দাগ পড়বে না। নাউ দ্য ডিসিশন ইজ় ইয়োর্স।”
রুদ্রর কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই টেবিলের ওপর একটা হাত রাখল তারক, “এই কেসটায় আমি স্যরের সঙ্গে আছি। বাকি যারা থাকতে চায় তারা আমার হাতে হাত রাখুক।” সেকেন্ড দু’-তিনেকের নীরবতা। পর পর তিনটে হাত এসে পড়ল তারকের হাতের ওপর।
দাদার স্টেশনের ডান দিকে শেষ প্ল্যাটফর্মটার ওপর ওভারব্রিজ থেকে নেমেই বাঁ দিকের ফুটে বিশাল পাইকারি সব্জি আর ফুলের বাজার। স্থানীয় ভাবে তো বটেই, গোটা মুম্বইয়ের মানুষ এলাকাটাকে চেনে সব্জি মান্ডি বা ফুল মান্ডি নামে। ক্রেতা-বিক্রেতা-পথচারীর বেজায় ভিড়, ঠেলাঠেলি, হইহল্লা, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক আর ভ্যানগাড়ির জ্যামজট সামলে কবুতর ফাউন্টেনের মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরলেই অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তাটা। মোটামুটি ভাবে মধ্যবিত্ত জনবসতি। কিছুটা এগিয়ে একটা গলির মুখে এঞ্জেল নার্সিং হোম। তিনতলা বাড়ি। সব মিলিয়ে খুবই সাধারণ আর ছোটখাটো। দোতলায় নিজের চেম্বারে ফোনটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর বিবেক সমর্থ। মুম্বইয়ের মৃদু শীত। ২৭ পয়েন্টে এসি চলছে। তবুও বিনবিনে গুঁড়িগুঁড়ি ঘাম ডক্টর সমর্থের কপালে। প্রচণ্ড উদ্বেগের ছাপ চোখেমুখে। এইমাত্র অর্ডার এসেছে, আবার সেই কাজটা করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy