Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakrabarty

চুয়ান্ন

সাবু নর্থ বেঙ্গল চলে যাচ্ছে! আশ্চর্য তো!

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:২৫
Share: Save:

এ কে ফোন করেছে আমায়! এনা!

চুয়ান্ন দিনের মাথায় এনা ফোন করল আমায়! কেন! কেন করল ফোন? সামান্য বিরক্ত লাগল আমার। তার পরেই মনে হল ভালই হয়েছে। এ বার এনাকেও জিজ্ঞেস করব, ও জানে কি না যে, সাবু চলে যাচ্ছে নর্থ বেঙ্গল!

সাবু নর্থ বেঙ্গল চলে যাচ্ছে! আশ্চর্য তো!

আমি ফোনটা কানে লাগালাম। তার পর ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা এনা, সাবু না কি নর্থ বেঙ্গল চলে যাচ্ছে! তুমি জানো কিছু?”

১৮

সাবু

এ জীবন কী? শূন্যতায় গড়া এক খণ্ড সময়? হাওয়ার তৈরি কেল্লা? না কি অনর্থক বালির ওপর ভেঙে পড়া একের পর এক অকারণ ঢেউ! শূন্য থেকে তৈরি হই আমরা, তার পর আবার শূন্যতেই মিলিয়ে যাই। তা হলে কেন এই সংঘর্ষ! কেন এই প্রতিনিয়ত এত চেষ্টা! এত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে এগোনো? কেন সব সাজিয়ে রাখার আগ্রহ! অনেক আগে পড়েছিলাম, ‘এভরিথিং ইজ় সো ওয়ান্ডারফুল প্রিসাইজ়লি বিকজ় এভরিথিং ইজ় সো পয়েন্টলেস’। পয়েন্টলেস! সত্যিই সব পয়েন্টলেস! আজকাল আমার এ সবই মনে হচ্ছে বার বার।

মনে হচ্ছে, এ মনুষ্যজীবন কি সত্যি আশীর্বাদ, না কি আমরাই একে অকারণে গ্লোরিফাই করি আমাদের নিজেদের অতিমাত্রায় চাহিদা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার বেড়াজালে জড়িয়ে। নিজের সম্বন্ধে আমাদের মনে কি এতটাই হীনমন্যতা থাকে যে, অন্যের প্রশংসা না পেলে আমরা ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হয়ে যাই! কিছুই তো সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারব না! তা হলে তুচ্ছতার প্রতি, ক্ষণস্থায়ী বস্তুর প্রতি, অন্যের প্রতি কেন এত টান আমাদের? কেন এত চাহিদা? হিংসা? ক্ষমতালিপ্সা? না-পাওয়ার মনখারাপ? কেন এত হারা-জেতার অঙ্ক? এ কি শুধুই মায়া? শুধুই মোহ? না কি আরও গূঢ় কোনও ইঙ্গিত আছে এর?

আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি বুঝতে চাই এই সব। কিন্তু কিছু ক্ষণ ভাবার পরে আমার মাথা কেমন গুলিয়ে যায়। কিছুতেই মূল কথাটা বুঝতে পারি না! শুধু মনে হয়, তা হলে কি জীবনের মূল বলে কিছু হয় না! তা হলে জীবন কি শুধু একটা তুলো বীজের উড়ে চলা! অনির্দিষ্ট ও আচমকা!

মাথা গুলিয়ে গিয়েছে আমার। আজ চোদ্দোই অগস্ট। কালকের মধ্যে আমায় জানিয়ে দিতে হবে যে, আমি আদৌ নর্থ বেঙ্গল যাব, না এখানেই থেকে যাব। জিনাদি গতকালও আমায় ফোন করেছিল। নানা কাজকর্মের কথার ফাঁকে এই কথাটাও মনে করিয়ে দিয়েছিল।

জিনাদি বলেছিল, “পরশুর মধ্যে অবশ্যই জানিয়ে দিস। না হলে অন্য কাউকে তো পাঠাতে হবে। তুই বলেছিলি বলে আমি তোকেই ফার্স্ট চান্স দিলাম। কিন্তু আমি চাই তুই কলকাতাতেই থাক। আমরা আরও স্প্রেড করার কথা ভাবছি। কলকাতার আশপাশে ছড়িয়ে দিতে চাইছি আমাদের কাজ।

আর শুধু খাবারদাবার নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও আমরা এই ভাবে কালেক্ট করে নিডি মানুষদের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছি। আমরা তোকে অপারেশন চিফ করে দেব। সো, মেক ইয়োর ডিসিশন ওয়াইজ়লি। বুঝলি?”

কাল রাতে জিনাদির ফোন কলের কথা বাবাকেও বলেছিলাম।

আসলে এ সবের আভাস পেয়ে ক’দিন হল মা খুব চিৎকার করেছে। বলেছে, মোটেই অত দূর নর্থ বেঙ্গল যেতে হবে না। বলেছে, সব ছেড়ে দিতে। বলেছে পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। কোন এক বান্ধবীর ছেলে নাকি ইউ এস-এ থাকে। তার নাকি অনেক দিন থেকেই আমাকে পছন্দ। তার সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেবে!

আশ্চর্য যুক্তি! আমেরিকা যেন নর্থ বেঙ্গলের চেয়ে কাছে! মায়ের লজিক আলাদা লেভেলেই চলে!

বাবাকে রাতে এই সব নিয়েই বলছিলাম।

বাবা একটা বই পড়ছিল। কী সব যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা। নন-ফিকশন হাতে পেলে বাবা আর কিছু চায় না।

আমি বাবার হাত থেকে বইটা সরিয়ে নিয়ে বলেছিলাম, “আমি চলে যাব শুনে তুমি যে কিছু বললে না?”

বাবা হেসেছিল। চশমা খুলে ভাঁজ করে পাশের ছোট নিচু টেবিলটায় রেখে বলেছিল, “আমি কী বলব বল? বলেছিলাম তো ইচ্ছে হলে শিলিগুড়ি যাবি। আসলে মানুষ তো পাখি! এক দিন তো নিজের কাজে সে উড়ে চলে যাবেই। তুই আমার মেয়ে হলেও নিজে এক জন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ! তোর একটা নিজস্ব অরবিট আছে। সেখানেই তো তোকে যেতে হবে। যাবি।”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়েছিলাম।

বাবা বলেছিল, “জানিস, বাবা-মায়েদের ভেতর দু’টো মানুষ সারা ক্ষণ দড়ি টানাটানি করে চলে। একটা মানুষ চায় সন্তানকে বুকের কাছে আগলে রাখতে সারা জীবন। আর আর-এক জন চায়, সে যেন অনেক বড় হয়। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। আমাদের মন সব সময় চায় এই দড়ি টানাটানির খেলায় প্রথম জনই জিতুক। কিন্তু যুক্তি জিতিয়ে দেয় দ্বিতীয় জনকেই।”

“আমি যদি যাই, তুমি আসবে তো মাঝে মাঝে আমার কাছে? আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং যাব। কার্শিয়াং যাব। আরও নানা জায়গায় ঘুরতে যাব। আসবে তো?”

বাবা স্থির চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তার পর বলেছিল, “সাবু, পুঁটির থেকে এ রকম ভাবে পালাতে পারবি?”

আমি থমকে গিয়ে তাকিয়েছিলাম বাবার দিকে।

বাবাও তাকিয়েছিল আমার দিকে। বলেছিল, “আমি বুঝি রে! না হলে কেন তোর পায়ে লাগার খবর আগ বাড়িয়ে দেব ওকে?”

আমি অস্ফুটে বলেছিলাম, “কী বোঝো?”

“এই যে কষ্ট পাচ্ছিস! এটা বুঝি। কিন্তু পালিয়ে গেলে কি সেটা চলে যাবে?”

আমি মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম।

বাবা হেসে বলেছিল, “লোকে বলে মনখারাপ হলে কোথাও থেকে একটু ঘুরে এসো। আরে, মন কি এখানে ফেলে রেখে মানুষ ঘুরতে যাবে? সে তো এক নিরাকার ঝঞ্ঝাটবিশেষ। সঙ্গছাড়া হতেই চায় না! ফলে দূরে চলে গেলেও কি আর মন থেকে কেউ মুছে যায়? তোর মন থেকে কি মুছে যাবে পুঁটি! বাই দ্য ওয়ে, পুঁটি কি একটা নাম হল! একটা ভাল নামওয়ালা ছেলে দেখে প্রেমে পড়তে পারলি না!”

আমি ঠোঁট টিপে অন্য দিকে তাকিয়েছিলাম এ বার। পুঁটি মেসেজ করেছে আমায়। কিন্তু আমি উত্তর দিইনি। তার পর আবার মেসেজ করে জানতে চেয়েছে, আমি নর্থ বেঙ্গল চলে যাচ্ছি কি না। সেটারও কোনও উওর দিইনি আমি। কেন দেব? আমি কোথায় যাচ্ছি বা যাচ্ছি না সেটা তো ওর দেখার বা জানার কথা নয়! ও কে? কেন আমায় এ সব কথা জিজ্ঞেস করছে!

স্কুটিটা টালিগঞ্জ রেলব্রিজের নীচ দিয়ে সোজা চালিয়ে দিলাম। বিকেল শুরু হচ্ছে কলকাতায়। আর আমার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য! মনে হচ্ছে আমি স্কুটি নয়, একটা পাহাড় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি! মনের কষ্ট বুঝি হাড় ভাঙার চেয়েও বেশি! এত কষ্ট হয় কেন ঠাকুর!

ঠাকুর! তুমি কি সত্যি আছো? থাকলে কিছু একটা করে আমার কষ্টটা কমিয়ে দাও না! সবাই বলে কষ্ট এক দিন কমে যাবে। আরে বাবা, এক দিন যাবে বুঝলাম, কিন্তু এখন কী হবে? এখন আমি বাঁচব কী করে? সামলাব কী করে নিজেকে?

আমার মনে হল ঠাস করে একটা চড় মারি এনাকে! যখন সেকেন্ড টাইম ফোনে কথা হল, তখন কে তোকে বলেছিল ও সব বলতে! আমি না জানলে তো এমন এক মহাসাগর মাছ আমার বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল করত না!

সাড়ে তিনটে বাজে এখন। চারটের সময় রাসবিহারী মোড়ে দেখা করবে এনা আর পুঁটি! হ্যাঁ, এটাই এনা আজ আমায় ফোন করে বলেছে।

সে দিন দীপ্যদাকে ঝেড়ে ফেলে বেরোবার সময় এনা ফোন করেছিল আমায়।

জিজ্ঞেস করেছিল, “পুঁটি কি সত্যি আমায় ভালবাসে? মানে যতটা বলে, ততটাই কি ভালবাসে? সত্যি করে বল আমায়। লুকোবি না প্লিজ়!”

আমার মনে হয়েছিল বলি, ‘একটুও বাসে না। ও স্কুল-লাইফে আমায় চুমু খেয়েছিল। আমার পেছনে পাগলের মতো টাইম দিয়েছিল। আমি তো গাধা তাই ওকে বারণ করেছিলাম। সেই কারণে কলেজে ও তোর দিকে গিয়েছিল। আসলে ও আমাকেই ভালবাসে, তোকে নয়! বুঝেছিস!’

কিন্তু অবভিয়াসলি আমি এটা বলিনি। মানে কেন বলব? আমাকে তো আর ভালবাসে না পুঁটি।

আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ বাসে। কেন?”

এনা বলেছিল, “আমি এই রিলেশনটা থেকে বেরোতে চাই। দিস লিভ টুগেদার থিং ইজ় নট মাই কাপ অব টি। প্লাস রণজিৎ ইস আ সেলফিশ পিগ। হি ওনলি নিড্স সেক্স। আয়্যাম সো ফাকিং ডিসগাস্টেড!”

“তাই আবার পুঁটি?” আমি অবাক হয়েছিলাম।

“হ্যাঁ,” বলেছিল এনা, “হি ইজ় আ বিট ক্লিঙি। বাট আ কিউট গাই। চার্মিং। ইউ ক্যান রেজ়িস্ট বিউটি, বাট ইউ ক্যান নট রেজ়িস্ট চার্ম! তাই না?”

আমি কিছু না বলে চুপ করেছিলাম। এই মেয়েকে ভালবেসেছে পুঁটি?

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakrabarty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy