Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Smaranjit Chakrabarty

চুয়ান্ন

এর মধ্যে আর একটা ঝামেলাও শুরু হয়েছে। সেটা হল ভিডিয়ো কল। মাঝরাতে এর মধ্যে দু’দিন আমায় ভিডিয়ো কল করেছিল দীপ্যদা! এক বার গত সপ্তাহে আর এক বার গতকাল রাতে।

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

লোকজন বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল বাবা এলে আরও এক চোট নাটক হবে। কিন্তু আমার বাবা নাটক জমাতে পছন্দ করে না একদম। যত কম ঝামেলায় বেঁচে থাকা যায় সেটাই চেষ্টা করে।

লোকটা যাওয়ার আগে সুর বদলে ফেলে, আমার কাছে এসে অনেক বার সরি বলেছিল। সেই রাগ বা তেজ আর ছিল না। নিজে থেকে নিয়ে যেতেও চেয়েছিল ডাক্তারখানায়। বাবা চায়নি।

ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ বাবাকে ভাল মানুষ বলছিল। কেউ বলছিল বোকা।

আমার পায়ে ব্যথা করছিল খুব। কিন্তু তার মধ্যেও এ সব কথা শুনে মনে হয়েছিল আমরাও ফুটপাত জবরদখল হয়ে যাওয়া শহরের মতোই হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ।

আমার এক্স-রে হয়েছিল। হাড় ভাঙেনি আমার। কিন্তু ভালই স্প্রেন হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলেন সাত দিন বেড রেস্ট।

সাত দিন বাড়িতে! আমি তো পাগল হয়ে যাব।

আর সত্যি বলতে কী এই তিন দিনেই আমি হাফ-পাগল হয়ে গিয়েছি।

বাইরে একটানা বৃষ্টির সঙ্গে মায়ের জ্ঞান, দিদির রাগারাগি। মনে হচ্ছে লোকটা আমায় এ ভাবে ছ্যাঙাপোড়া করে না রেখে তো মেরে কোমায় পাঠিয়ে দিতে পারত।

দীপ্যদা সেই যে দিদির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না বলে দিয়েছিল, তার পর থেকে দিদি যে কী হয়ে গিয়েছে, সে আপনারা আমাদের বাড়িতে না এসে থাকলে বুঝতে পারবেন না!

আমি তো গতকাল আর থাকতে না পেরে বলেইছিলাম, “তুই তো ওকে কিছু দিন আগে জীবন থেকে তাড়াবি বলে উঠেপড়ে লেগেছিলি, সেখানে সে নিজেই বিদেয় হতে চাইছে যখন, তখন এমন ভিক্টিম সাজছিস কেন বল তো?”

আমি ডান পা-টা সামনে কয়েকটা বালিশের ওপর রেখে শুয়েছিলাম। আমার কথা শুনে ও দাঁড়ানো অবস্থা থেকে ঝপাং করে বসেছিল বিছানার পাশে। ঝাঁকুনিতে বেশ কষ্ট হয়েছিল আমার। মেয়েটার কি কোনও হুঁশ নেই!

দিদি বলেছিল, “কী বললি তুই! ওর সাহস কী করে হয় এমন করার আমার সঙ্গে! না করতে হলে আমি করব! ও না করার কে! কে আমার পেছনে ঘুরঘুর করত? কে এসে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত? কেন দামি দামি গিফট নিয়ে আসত? আর এখন ‘না’ করা হচ্ছে! কে এত সাহস দিল ওকে!”

আমার আজকাল সারা ক্ষণ মনে হয়, মানুষ এখন অ্যাটেনশন চায়, প্রশংসা চায়, সব সম্পর্কে আপার হ্যান্ড নিতে চায়, কিন্তু ভালবাসা চায় না।

আমি আর কথা বলিনি। দিদি যত বার দীপ্যদার কথা তোলে, আমার কেন যেন সিগারেট আর পুরনো পেতলের গন্ধ মনে পড়ে। আমার গা গুলিয়ে ওঠে।

গন্ধ আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে ভাল স্মৃতি আর খারাপ স্মৃতির অনেকখানি গন্ধের ওপর নির্ভর করে। দীপ্যদার ওই ব্যাপারটা মনে পড়লেই আমার আরও আগে সেই বিদিশাদের বাড়ির বারান্দার সন্ধেটাও মনে পড়ে যায়। পুঁটিটা যে কী আফটার শেভ মাখে! মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়। এমন একটা কষ্ট, যার কোনও উপশম নেই।

এর মধ্যে আর একটা ঝামেলাও শুরু হয়েছে। সেটা হল ভিডিয়ো কল। মাঝরাতে এর মধ্যে দু’দিন আমায় ভিডিয়ো কল করেছিল দীপ্যদা! এক বার গত সপ্তাহে আর এক বার গতকাল রাতে।

আমি তো গত সপ্তাহে ধরিনি। কিন্তু গতকাল ক্রমাগত কল করেই যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়েই ফোনটা ধরে ফেলেছিলাম।

দীপ্যদা ইউরোপ গিয়েছে। আমি জানতাম না। কাল ফোনে কথা বলার সময় জানলাম।

দীপ্যদা বসে ছিল বারান্দায়। কথা বলছিল জোরে। পাশে ওয়াইনের গ্লাস দেখেছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি কানে হেডফোন লাগিয়ে নিয়েছিলাম। গভীর রাতে এ ভাবে কথা বললে মুশকিল আছে।

আমি বলেছিলাম, “এ রকম ভাবে আমায় ফোন কোরো না।”

“কেন করব না!” দীপ্যদার গলায় জেদ টের পেয়েছিলাম, “আই লাভ ইউ। তাই ফোন করেছি। যাকে মানুষ ভালবাসে, তাকে ফোন করে না?”

“প্লিজ় এ সব বোলো না...” আমার হেল্পলেস লাগছিল। দীপ্যদার গলা জড়ানো।

“কেন বলব না! আমি ভালবাসি বলেই তো জার্মানি থেকে ফোন করছি! না হলে আমার কিসের ঠেকা!” বলেছিল দীপ্যদা।

“প্লিজ় আমায় ফোন কোরো না। আমি ভালবাসি না তোমায়!” আমি চাপা গলায় বলেছিলাম।

“আজ বাসো না। পরে বাসবে। এতে অসুবিধে নেই। একটু ভাবলেই ভালবাসা আসবে।”

মহা জ্বালা! আমি, “মা আসছে।” বলে ফোন কেটে দিয়েছিলাম।

কিন্তু আবার ফোন করেছিল দীপ্যদা। আমি ধরিনি প্রথমে। কিন্তু আবার ক্রমাগত ফোন করে গিয়েছিল। লিখে পাঠিয়েছিল, ফোন না ধরলে বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করবে! আমি অগত্যা ফোন ধরেছিলাম।

দীপ্যদা বলেছিল, “আই ওয়ান্ট ইউ! তোমার দিদি মানুষ নয়। আই ডোন্ট লাভ হার। আমি মিশে বুঝেছি। টাকা আর নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। তুমি খুব ভাল মানুষ। আই আডোর দ্যাট। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই!”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে ছিলাম। সামান্য সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করে ভেবেছিলাম, শেষের কথাগুলো যদি পুঁটি বলত!

“আমি কি তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব?” দীপ্যদা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।

আমি চোয়াল শক্ত করে বলেছিলাম, “দীপ্যদা প্লিজ় স্টপ। আমি অন্য এক জনকে ভালবাসি। তোমায় নয়।”

“কে সে?” দীপ্যদার গলাটা আচমকা কেমন যেন ভেঙে গিয়েছিল।

আমি আমার মিথ্যেটাকে বজায় রেখে বলেছিলাম, “সেটা তোমায় বলব না। বাই। আর ফোন কোরো না প্লিজ়। আমি আনফেথফুল হতে পারব না।”

তার পর থেকে আর এখনও পর্যন্ত ফোন করেনি দীপ্যদা।

দুপুর থেকে আবার তেড়ে বৃষ্টি নেমেছে। এখনও মানে এই সাড়ে চারটের সময়ও বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। দিদি আর বাবা নেই বাড়িতে। মা নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে।

টিংটং করে ডোরবেল বাজল। এখন আবার কে এল!

দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। আর তার পরেই লামাদাদুর গলার স্বর। মনটা ভাল হয়ে গেল আচমকা।

লামাদাদুর পিছনে দেখলাম লেবুদাও উঁকি মারছে। মা ওদের আমার ঘরে বসিয়ে রেখে আবার চলে গেল।

লামাদাদু হাতের ঝোলা থেকে একটা বড় প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “বই আছে। পড়। মোবাইলটা রাখ। সারা ক্ষণ শুধু খুটখুট করা!”

লেবুদা বলল, “মোবাইল কিন্তু দারুণ জিনিস যা-ই বলো! মানে টপ টপ টপ জিনিস! আমি তো ভাবছি একটা মোবাইলের দোকান করব। বাবাকে বলব।”

আমি বললাম, “ভালই তো। করো।”

লেবুদা বলল, “কিন্তু বাবা রাজি না হলে! গত বছর বাবাকে বলেছিলাম একটা গিটারের দোকান করব। বড় বড় চুল রেখে সারা গায়ে ট্যাটু করে বসব দোকানে। শুনে বাবা হেবি খচে গেল। জুতোফুতো ছুড়ে মারল। যা সাংঘাতিক টিপ না! অলিম্পিকে এই ইভেন্ট থাকলে বাবার গোল্ড বাঁধা! এ বারও যদি অমন করে! তাই ভয়ে বলতে পারছি না!”

“এত বাজে বকিস না!” লামাদাদু বলল। তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর বাবা ফোন করেছিল আজ। বলল তোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার কাজ আছে একটা গিরিশ পার্কে। তাই যাবার আগে ভাবলাম তোকে দেখে যাই।”

লেবুদা আবার বলল, “আমিও ভাবলাম দেখে যাই। আচ্ছা, মোবাইল বাদ দে, একটা ম্যাট্রিমোনিয়াল অফিস খুললে কেমন হয়!”

“তুমি বিয়ে দেবে? ঘটক?” আমি তাকালাম লেবুদার দিকে।

“হ্যাঁ। কেন পারব না! ফার্স্ট ক্লায়েন্ট হবি তুই। প্রথমে তোর বিয়ে দেব।”

আমি আঁতকে উঠলাম, “পাগল না কি!”

লেবুদা বলে চলল, “পুঁটির সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। ভাল হবে না? সে দিন ব্যাটাকে দেখলাম ওর অফিসের কাছে। কেমন মরা মাছের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! কী হয়েছে মালটার! এক দিন ওকে ধরে একটা অমিতাভের বই দেখিয়ে দেব। ব্যস! দেখবি চাঙ্গা পুরো!”

লামাদাদু আরও দশ মিনিট বসল। মা চা করে এনেছিল। কিন্তু কিছুতেই খেল না। বলল তাড়া আছে। লেবুদা নিজেই দু’কাপ চা খেয়ে নিল।

লামাদাদু চলে যাওয়ার আগে আমার মাথায়

আলতো করে একটু হাত বুলিয়ে বলল, “ভাল থাকিস। মনখারাপ করিস না!”

আমি হেসে বললাম, “না, না, আমার

কিসের মনখারাপ!”

লামাদাদু কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার পর বলল, “সে আমি কী জানি! তোকে বললাম। তুই করিস না মনখারাপ। বুঝলি!”

লেবুদাও যাওয়ার আগে বলল, “তবে ওই কথাই রইল। প্রথম ক্লায়েন্ট! ঘটক ব্যাপারটাকে পুরো ভেতরে নিয়ে নেব আমি দেখিস!”

আমায় একটা ক্রাচ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার খুব অসুবিধে হয়। একদম দরকার না হলে আমি তাই বিছানা থেকে উঠি না।

লামাদাদুরাও যখন গেল আমি উঠলাম না। শুধু শুনলাম দরজা খোলার আওয়াজ। মায়ের গলা। তার পর ওদের নেমে যাওয়ার শব্দ। কিন্তু দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম না। বরং আর একটা গলার আওয়াজ পেলাম আমি! সেটা আমার এত পরিচিত যে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম যে আমার পায়ে ব্যথা।

চেনা গলার আওয়াজটা শুনেই আমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে গেলাম বিছানা থেকে। কিন্তু আবার “উঃ!” বলে বসে পড়লাম পায়ে লাগল বলে। তবে আমি আমল দিলাম না। শুধু ভাবলাম, কত্ত দিন পরে আমাদের বাড়িতে এল পুঁটি!

মা পুঁটির সঙ্গে এল আমার ঘরে।

কালো একটা প্যান্টের সঙ্গে সাদা জামা

পরে আছে পুঁটি। রোগা লাগছে। সামান্য এলোমেলো চুল। গালে দাড়ি। সাধারণত পুঁটি ক্লিন শেভ করে রাখে। আমি বলি স্টাবল রাখতে, রাখে না।

কিন্তু এখন ওকে এমন আবছা দাড়ি অবস্থায় কেমন যেন লাগছে।

মা ওকে বসিয়ে রেখে, “তোরা গল্প কর, আমি আসছি” বলে চলে গেল।

আবার কত্ত দিন পরে আমি আর পুঁটি আমার ঘরে একা! এই সেই ঘর, যেখানে ওকে আমি বলেছিলাম আমরা জাস্ট বন্ধু, আর কিছু না।

এই সেই চেয়ার, যেখানে বসে পুঁটি মাথা নিচু

করে কেঁদেছিল।

আর কেন জানি না মনে হচ্ছে, আজ খেলা উল্টে গিয়েছে। আজ আমায় চোখের জল আটকাবার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

পুঁটির হাতে একটা প্যাকেট। ও আমার দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসল একটু। তার পর হাতের প্যাকেটটা পাশের টেবিলে রাখল। বলল, “এনার জিনিসগুলো।”

আমি বললাম, “এই জন্য এলি!”

“কাকু ফোন করেছিল। বলল পড়ে গিয়েছিস। চোট পেয়েছিস। সেটাও একটা কারণ।”

আমি বললাম, “এনাকে কবে দিতে পারব জানি না। বেশ কয়েক দিন তো বেরোনো বন্ধ আমার।”

পুঁটি আবার হাসল। ওকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। চোখের তলায় কালি পড়ে গিয়েছে পুঁটির। মুখটাও যেন স্পষ্ট নয়।

“সে সময় করে দিস। শুনেছি ও নাকি লিভ-ইন করছে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।

পুঁটি হাসল, “রিজু বলেছে আমায়। আমি তো কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি না। রিজু সে দিন দেখাল, ওরা লাদাখ ঘুরতে গিয়েছে এক সঙ্গে।”

আমি কী বলব না বুঝে মাথা নিচু করলাম।

মা এসে একটা প্লেটে ফিশ ফ্রাই আর কাজুবাদাম রেখে গেল পুঁটির পাশে। কাজুবাদাম খেতে পুঁটি খুব ভালবাসে, মা জানে।

পুঁটি তাকাল না ও দিকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Smaranjit Chakrabarty Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy