Advertisement
২৮ নভেম্বর ২০২৪

Novel: ডানায় ডানায়

গল্প শুনতে শুনতে বল্লালের কাছটায় ঘেঁষে আসে তমা। খুব শান্ত গতিতে, ধীর গলায় গল্প বলছে বল্লাল।

ছবি: কুনাল বর্মন

ছবি: কুনাল বর্মন

রূপক ঘটক
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৩৮
Share: Save:

গল্প শুনতে শুনতে বল্লালের কাছটায় ঘেঁষে আসে তমা। খুব শান্ত গতিতে, ধীর গলায় গল্প বলছে বল্লাল। বলতে বলতে কখনও তার হাত রাখছে তমার কোমরে, কখনও কাঁধে। কিন্তু সেই স্পর্শে কোনও ইঙ্গিত নেই।

তমা বলে, “তার পর?”

বল্লাল বলে, “এক দিন কী কারণে চকের সব দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ করার ফতোয়া জারি হল। লোকটা মাঝদুপুরে বাড়ি ফিরে এল। কোনও দিনই এই সময়ে সে ফেরে না। সকালে খেয়েদেয়ে যায় আর ফেরে সন্ধে পেরিয়ে। অসময়ে ফিরে সে দরজায় বেল বাজাল। কেউ দরজা খোলে না।”

তমা বলল, “এই দরজা?”

বল্লাল বলল, “এই দরজা। লোকটার কাছে এক গোছা চাবি থাকত সব সময়। সে ভাবল, ঘরের কাজকর্ম করে বৌ হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথবা টেলিভিশন দেখছে।”

তমা ছোট্ট শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে বলল, “তার পর?”

মোমবাতির আলো তখন প্রায় নিভে এসেছে। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না বল্লালকে। বল্লাল মৃদুতম স্পর্শে তমার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, “তার পর ঘরে ঢুকে সে দেখল এক আশ্চর্য দৃশ্য!”

তমা বলল, “এই ঘরে?”

বল্লাল বলল, “এই ঘরে।”

তমা বল্লালের বুকের কাছটায় আরও সরে গিয়ে বলল, “কী গো? এই, তুমি ভূতের গল্প বলছ না তো?”

বল্লাল বলল, “ভূতই বটে। মানুষের মাঝখানে স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার জন্য যারা আসল আমিটাকে লুকিয়ে রেখে স্বাভাবিকের মুখোশ পরে থাকে, তারা তো ভূতই। তার পর কী হল শোনো! লোকটা এই দরজার কাছে এসে দেখে...” বলে থেমে যায় বল্লাল।

তমা বলল, “কী হল?”

বল্লাল বলল, “দাঁড়াও, হাতে লাগছে।” বলে হাত নামিয়ে সে পাশবালিশে মাথা রেখে শুল। তমা তখন হাতটা কনুই থেকে বাঁচিয়ে মাথাটা তুলে বল্লালের সামনাসামনি হল। হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল বল্লালের রোমশ বুকে।

বিশ সেকেন্ড বিরতির পর বল্লাল শুরু করল তার কাহিনি, “লোকটা নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দেখল, তার সেই বৌ গলাটা যত দূর সম্ভব চেপে গান গেয়ে চলেছে। তার একটা হাত তোলা, তাতে সঙ্গীতের মুদ্রা, অন্য হাত কোলে, তার চোখ মুদিত। চোখ থেকে অঝোরে বইছে অশ্রু। লোকটা তখন আধাফৌজি, আধাবণিক। গান তার কানে সুধাবর্ষণ করে, কিন্তু তার ব্যাকরণ সে বোঝে না। সে শব্দ করল না। মেঝেতে বসে পড়ল। শুনতে শুনতে সে তন্ময় হয়ে গেল। স্ত্রী যখন চোখ মেলল, তখন পায়ের কাছে তার তালেবর স্বামীকে দেখে, তার গুণমুগ্ধ চোখ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। লোকটা তখন ইঙ্গিতে তাকে বলল, গান চালিয়ে যাও। স্ত্রী গান চালিয়ে গেল। একটু পরে স্ত্রী ভজন ধরল। এ বার একটু বুঝতে পারল লোকটা। বুঝেও কিছু করল না। হাত জোড় করে মেঝেতেই বসে থাকল। এ বার স্ত্রীর গান শুনে লোকটার চোখ বুজে এল, ধারাবর্ষণ শুরু হল লোকটার চোখ থেকে।”

তমা বলল, “তার পর?”

বল্লাল বলল, “তার পর স্ত্রী নেমে এসে তার হাত ধরে তুলল।”

তমা বলল, “এখন?”

বল্লাল বলল, “এখন তাদের দারুণ মিল। বৌ-ও দোকানে যায়, কখনও বসেও ক্যাশবাক্স হাতে নিয়ে। এখন তারা কোথায় থাকে? এই তো, তিনতলায়। এই ঘরটা বড্ড ছোট হচ্ছিল ওদের।

তত ক্ষণে মোমবাতির বিন্দুবৎ আলোকশিখাও নিভে গেছে। খোলা জানলায় দেহরাদূনের আকাশে তখন গভীর রাতের নিকষ অন্ধকার। তমা বল্লালের বাহুতে এক বার নাক ঘষে বলে, “তুমি খুব বাজে।”

বল্লাল তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “কেন?”

তমা স্পষ্ট অভিযোগের সুরে বলে, “বাজে নও? ভূতের গল্পকেও টেনে বানালে প্রেমের গল্প।”

বল্লাল হেসে বলল, “ওরা এক যুগের পুরনো দম্পতি তমা।”

তমা বলল, “হোক না, প্রেম তো সেই
প্রথম এল।”

বল্লাল বলল, “কেন, ভূতের গল্প হতেই বা বাধা কোথায়? ভূতেরা কি প্রেম করে না?”

খোলা জানলা থেকে শিরশিরে হাওয়া আসছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হলেও ঠান্ডা ভাবটা বোঝা যাচ্ছে। বল্লালের প্রশ্নের উত্তরে তমা বলল, “ভূতেরা কী করে প্রেম করে তাও জানো ইতিহাসবাবু? বলো তো কী করে তারা প্রেম করে?”

“কঙ্কালে কঙ্কালে?”

“দেখি তো, কঙ্কালের প্রেম কেমন!” বলে বল্লালের নাকে, কপালে, গালে মৃদু চুমু খায়। বল্লাল তার হাত দুটো দিয়ে এ বার, এই প্রথমবার জড়িয়ে ধরল তমাকে। তমা বল্লালের কাঁধে একটা চুমু খেয়ে বলল, “মন্দ নয়। তা হলে তো এই ভূতটাকে আদর করা যায়।”

বল্লাল বলল, “আমি তো আগেই বলেছিলাম, এই মেয়েটা মানুষ নয়, পেতনি!” ক্রমশ তমা তার সমস্ত শরীর নিয়ে বল্লালের ওপর উঠে আসে। ক্রমশ তমা বল্লালের মুদিত চোখের পাতা, কান, গাল, চিবুক পেরিয়ে তার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখে। একটা চুম্বন শেষে আদুরে গলায় বলে, “আমি তোমার কে হই বল্লাল?”

জড়ানো গলায় বল্লাল বলে, “তুমি আমার প্রিয়তমা নদী।”

বল্লালের গালে একটা কামড় দিয়ে তমা বলে, “আমরা এখন কোথায় বল্লাল?” বল্লাল কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। তার পর বলে, “এ মা, তুমি জানো না? আমরা তো এখন মুন্সিয়ারিতে।”

তমাও বল্লালের মতো আধশোয়া হয়ে বসে। একটু সরে বল্লালের গা ছুঁয়ে বলল, “তুমি এখন কী দেখতে পাচ্ছ বল্লাল?”

বল্লাল তাকাল সামনের জানলার দিকে। সেখানে তখন অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। সেই জানলা দিয়ে দূরে কোথাও দৃষ্টিকে পাঠিয়ে সে উত্তর দিল, “মেঘে ঢেকে রেখেছে মুন্সিয়ারির আকাশ। আমরা রয়েছি সেই গেস্ট হাউসের দোতলায়। নীচে ছাত্রদের কলরব থেমে গেছে। জীবেশের ঘরের দরজা বন্ধ। রাতে ফেরেনি তোমার গরিমা।”

আবারও একটা অর্ধচুম্বন সেরে বল্লালের ঠোঁটে ঠোঁট রাখে তমা। তার পর প্রায় অশ্রুত শব্দে বলে, “আমাদের গল্পটা কোথায় থেমে গিয়েছিল মনে আছে তোমার?”

বল্লাল তার হাত দিয়ে তমাকে জড়িয়ে রেখে বলে, “গভীর রাতে পঞ্চচুল্লি দেখে তুমি আমাকে চুমু খাওয়ার পর।”

তমা চোখ বোজে। ভাবতে চেষ্টা করে, সে যেন বসে আছে সেই অপার্থিব হলঘরে। তার একটা দেওয়াল কাচের। সেখানে ধাক্কা খাচ্ছে জ্যোতিষ্কলোকের আলো। যেন সেই পঞ্চচুল্লির শীতল বাতাস এসেই ফিসফিস করে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে যুগলকে। হয়তো সে এই ভাবেই ছুঁয়ে দিয়েছিল গরিমা আর তার দোসরকে।

বল্লালের দিকে আরও সরে গিয়ে সে জানতে চায়, “সে দিন তোমার রাগ হয়েছিল?”

বল্লাল উত্তর দেয় না। তমা তার আঙুল দিয়ে বল্লালের হাত ছুঁয়ে থেকে বলে, “আমি তোমার সঙ্গে একটা কথাও আর বলিনি। অকারণেই চুপ করে গিয়েছিলাম। নিজেই প্রগল্ভ হয়েছি, নিজেই পাঁচিল তুলেছি। বল্লাল, তা হলে সে দিন নিশ্চয়ই দুঃখ হয়েছিল তোমার?”

এ বার বল্লাল ছেলেমানুষের মতো ওপর নীচে মাথা নাড়ে। তমা বলে, “সময়কে পিছিয়ে দাও ইতিহাসবাবু।”

বল্লাল আচ্ছন্নের মতো বলে, “দিলাম।”

তমা তার শরীরের ভার বল্লালের ওপর ছেড়ে দিয়ে বলে, “গল্পটা এ বার তার পর থেকে শুরু হোক ইতিহাসবাবু?”

বল্লাল আত্মসমর্পণ করার সুরে ফিসফিস করে, “তা-ই হোক তমা।”

তমা তার নাক বল্লালের বাহুতে ঘষে বলল, “সেই নক্ষত্রের আলোয় ভেসে যাওয়া রাতে তোমার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে আমি এলাম।”

বল্লাল ফিসফিসের থেকেও মৃদুস্বরে বলে, “এসো তমা।”

তমা বলে, “ঘরের দরজাটা তো তা হলে বন্ধ করে দিতে হয়।”

বল্লাল বলে, “যাচ্ছি দাঁড়াও।”

তমা বলে, “তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো, আমি বন্ধ করে আসছি।”

এ কথা বলে সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়ায় তমা। দরজা বন্ধ করে। জানলা বন্ধ করে। দেহরাদূনে রাতের হাওয়ায় বেশ ঠান্ডাই লাগছে। এক বার তার ইচ্ছে হয় নিরাবরণ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বল্লালের বুকে। কিন্তু সঙ্কোচ বাধা দেয়। সে উঠে আসে বিছানায়। বল্লাল দু’হাত ছড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নেয়।

তমা আচ্ছন্নের মতো গলায় বলে, “এই, গরিমা রাতে ফেরত আসবে না তো?” এ বার বল্লাল দু’হাত দিয়ে তাকে বেষ্টন করে রাখে। তার পর বলে, “সে এখন তার প্রেমিকের কোলে ঘুমোচ্ছে।”

তমা আদর খেতে খেতে বলে, “এই, ছেলেমেয়েরা কেউ উঠে এসে দরজায় নক করবে না তো?”

বল্লাল বলে, “ওরাও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।”

তমা আদুরে, জড়ানো গলায় বল্লালকে বলে, “কাল অনেক হাঁটাহাঁটি আছে। রাত জাগলে অসুবিধে হবে না?”

তমা আবার বলে, “এই, গরিমা ওর পাকা চোখে ধরে ফেলবে না তো আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম?”

বল্লাল বলে, “বুঝবেই তো, তখন তোমার গা থেকে বেরোবে আমার গন্ধ।” তমা তার জড়ানো গলায় বলে, “তুমি কে বল্লাল?”

বল্লাল ঘন হয়ে বলে, “তোমার শিমুল ফুল।”

তমার কথা বন্ধ হয় না। কখনও সে বলে, “আমি ঘরে ফিরে যাব বল্লাল?” বল্লাল আর কিছু বলতে পারে না। তার সব কথা হারিয়ে যায় তমা নদীর স্রোতে। তমা-নদীর ভিতরে হারিয়ে যায় ইতিহাস-পুরুষ। তমা আশ্লেষে যখন বলে, “তুমিই আমার শিমুল ফুল?”

বল্লাল উত্তর দিতে পারে না। উত্তর না পেয়েও তমা বলে যায়, “আমরা কি কাল মুন্সিয়ারি ছেড়ে যাব বল্লাল? আবার কবে আসব? পঞ্চচুল্লির মাথায় পূর্ণিমার চাঁদের আলো আমায় দেখাবে না? আমায় মুন্সিয়ারির ভোর দেখাবে না? এই বল্লাল, আমি কেন তোমার ঘরে এলাম? তুমি কেন আমায় ভালবাসলে? আমি বাড়ি ফিরব না বল্লাল, আমার খুব একা লাগে।”

তার পর তারা বাকি রাত জেগে গল্প করে। তমা নালিশ করে, “দিব্যি বানানো গল্প বলে দিলে!”

বল্লাল বলল, “ঘটনাটা বিলকুল সত্যি।”

তমা বলে, “তোমায় কে বলল?”

বল্লাল বলল, “আসল কথা তো বলাই হয়নি।”

তমা চোখ কপালে তুলে বলল, “এখনও আসল কথা? সেটা কী ইতিহাসবাবু?”

বল্লাল বলল, “এই দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে যা হয়নি এ বার তা-ই হল, ওদের সংসারে তার পরই পুঁটির আগমন হল।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy