পূর্বানুবৃত্তি: তমার কথা থেকে জানা যায়, গরিমার স্বামীর নাম স্নেহময়। কিন্তু তার সঙ্গে দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি গরিমার। সে এই সম্পর্ক ছেড়ে আসার পথে। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে তমাল নামে এক যুবকের। সে তার সহমর্মী। মুন্সিয়ারিতে সেও এসেছে। বল্লাল আগেই ধরে ফেলেছিল গরিমার গোপন অভিসার। সে রাতে পঞ্চচুল্লির অপূর্ব রাতের শোভা তমাকে দেখায় বল্লাল। মুহূর্তের আবেগে কাছাকাছি আসে তারা। তার পর আসে ফেরার পালা। বাকি সময়ে বল্লালের সঙ্গে আর একটিও কথা হয় না তমার।
সে প্রতি বার ফেরার পর ডুব দিত স্মৃতিচারণে। এ বার সেই স্মৃতি রোমন্থনের পালা শুরু হল হাওড়া থেকে বাড়ি ফেরার পথেই। কেউ ছিল না, যে তাকে ডেকে বলে দেয়, ‘ওরে, এ ঘটনা এখনও সে ভাবে স্মৃতিই হয়নি, তোর গায়ে এখনও লেগে আছে মুন্সিয়ারির ধুলো, ফুসফুস এখনও ওগরাচ্ছে পাহাড়দেশের শ্বাস।’
ট্যাক্সি যখন আবাসনের দরজায় এসে দাঁড়াল, তখন আরও গাঢ় হয়েছে মেঘ। হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়া দিচ্ছে। গরম লাগার কথা ক্যালেন্ডার মাস অনুযায়ী। কিন্তু এ যেন মুন্সিয়ারির প্রকৃতিই পার্সেল ভরে তার স্পর্শ পাঠাচ্ছে তার নবীন অনুরাগী প্রিয়দর্শিনীকে। তমার বাসা দোতলায়। ট্রলিটা নিয়ে সে গটগট করে ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাইরের ঘরের এক পাশে রাখল তার ট্রলি, ভিতরের ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে রাখল হাতব্যাগ। তার পর গোটা বাড়ি টহল দিতে শুরু করল। খুলে দিল সমস্ত জানলা, সদর দরজা বাদে বাকি দরজাও। ঘরে হাওয়া এল, যেন প্রাণ ফিরল। যেন দীর্ঘ সময় পর দৃঢ় বন্ধনের অন্তর্বাস খুলে ছুড়ে ফেলার অনুভূতি। ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ দূর হয়ে শীত-শীত গন্ধমাখা বাতাস এসে এক বার ঘরময় হুটোপাটি করে চলে গেল। যেন কিছু কথা ওরা বলে গেল। তমা বুঝতে পারল না শুধু ওদের ভাষাটা জানে না বলে। বুঝতে পারল না, কিন্তু ওদের উপস্থিতি তার ভাল লাগল। সে এক বার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। নিচে থেকে করবী গাছের শাখা তার ঘর, ঝুলবারান্দা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার নাকে স্পর্শ লাগে সবুজ পাতার। আসন্ন বৃষ্টির ঘ্রাণে যেন তারা কাঁপছে। না কি তারাও কিছু বলতে চায়! তমা বুঝতে পারে না তার মন কেন অভূতপূর্ব আনন্দ-অনুভূতিতে ভরে যাচ্ছে। বুঝতে পারে না, কিন্তু সেই অনুভূতি টের তো পায়। মনে হচ্ছে যেন সব কিছুই ভাল লাগছে তার। সেই হাসিমুখেই সে উপরের দিকে তাকাল। শহরের মেঘে ছাওয়া ইস্পাতরঙা আকাশে দু’দিকে ডানা মেলে হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার আনন্দ নিচ্ছে একটা বক। দুধসাদা রং। তমার ভীষণ ভাবে মনে হল, ওই ডানা ছড়ানো বকের ধারেকাছে নিশ্চয়ই তার জুড়ি থাকবে। সে তো গ্রামের মেয়ে। তার ছেলেবেলা তো সুখুচরে খালি পায়ে কাদামাখা দিনের বর্ণমালায় লেখা। সেখানে তো বুড়িদি তাকে প্রথম জানিয়েছিল, পৃথিবীটা আসলে জুড়ি বাঁধার। সবাই জুড়ি বাঁধে। ব্যাংও, সাপও। হাত ধরে কত দৃশ্য সে দেখিয়েছিল তার দর্শনকে প্রমাণ করার জন্য। সে-ই তো আঙুল তুলে দেখিয়ে বলত, চিল যখন হাওয়া কেটে যায়, তখন বুঝবি মা চিল তার বাসায় ফিরবে বলে হড়বড় করছে। আর যখন দেখবি চিল বা বক এ ভাবে দু’দিকে ডানা ছড়িয়ে দেয়, জানবি সেটা ওদের খেলা। জানবি, তখন ওর জুড়িও কাছে থাকে। কে জানে, এ সব সত্যি কি না! কে জানে জীবতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব এই রকম তত্ত্ব মানে কি না। সেই ডাগর ডাগর চোখের বুড়িদি তাকে জীবনের পাঠশালায় তার নিজের আবিষ্কারই আপ্তবিদ্যা বলে চালিয়ে দিত কি না জানা নেই। কিন্তু উদাহরণ দেখিয়ে দেখিয়ে ঠিক নিজের তত্ত্বকথা মিলিয়ে দিত সে। ছোট তমা চোখ বড় বড় করে বলত, ‘ওরা বাসায় যাচ্ছে না কেন?’ বুড়িদি বলত, ‘দূর, ওরা কী মানুষ যে সব সময় বাসায় ফিরবে? ওরা খোলা আকাশে, ঠান্ডা হাওয়ায়, শীতের রোদে, বসন্তের বাতাসে মেলামেশা করে!’ এখন নিজের কর্মজীবনে কর্মব্যস্ত লোকজনের বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ততা দেখে তার কখনও কখনও মনে পড়ে বুড়িদির বলা সেই সব কথা। কেন কে জানে! কী থাকে বাড়িতে?
তার কলেজের বন্ধু অনঘ একটা ব্যবসা শুরু করেছে। কুরিয়ার সার্ভিসের ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি। এক বার কথায় কথায় সে-ও বলেছিল, ঘড়ির কাঁটা ছ’টার দাগ স্পর্শ করলেই তিন-তিন জন কর্মচারী ব্যস্ত হয়ে ওঠে৷ ছ’টা এক হলেই সব ভোঁ-ভাঁ। কী আছে বাঙালির বাড়িতে কে জানে। গবেষণা করলে হয়! কোন বিভাগের শিক্ষক এই গবেষণার গাইড হবেন? সোশিয়োলজি না মনস্তত্ত্ব? না, বিপ্লবের মতো লোক হলে বলে দেওয়া যায় খুব হিসেবি লোকরাই বোধ হয় এ রকম করে।
তমাকে স্বস্তি দিয়ে ঝোড়ো হাওয়ার বেগ আরও বাড়ল। ক্রমশ বিকেল আরও ঘন হয়ে এল সন্ধের দিকে। এই রকমই একটা বিকেলে এই বাসাবাড়িতে প্রথম বার এসেছিল বিপ্লব। চাকরি পাওয়ার পর তমা তখন এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। পেয়িং গেস্টের খোলস ছেড়ে সেই প্রথম তার নিজের, আস্ত একটা থাকার ঠিকানা। যেখানে সে রং মিলিয়ে পর্দা টাঙাতে পারবে, যেখানে সে দুপুর পর্যন্ত হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোতে পারবে, শেষ রাত পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে গান বাজিয়ে এবং রান্না না চড়িয়ে থাকতে পারবে। যেখানে কাউকে নেমন্তন্ন করতে হলে অন্যের মত নিতে হবে না। যেখানে তার অতিথিকে ‘আজ থেকে যা না বাবু’ বলা যাবে অনায়াসে। যেখানে তার দূরে থাকা বাবা-মা এসে জিরোতে পারবেন, থাকতে পারবেন, পায়ের ওপর পা তুলে ‘তমু, আচ্ছা আজ ইলিশ আনিস’ বলতে পারবেন। চাকরি পাওয়ার তৃতীয় মাসের পঞ্চম দিনে সে যখন পোঁটলা পুঁটলি-সহ সেই মেসবাড়ি থেকে এই আবাসনে এসেছিল, তখন সঙ্গে ছিলেন বাবা-মা। দিন ছয়-সাত কেটে গেল স্বপ্নের মতো। তার কোচবিহারের সুখুচরের ছোটবেলাই যেন উঠে এল এই শহরের উঠোনে। কী পরম মমতায় মা রান্না আর বাবা বাজার করলেন। তখন কলেজে গরমের ছুটি চলছে। তাই এই স্থানান্তরের ঝুঁকিটা নিয়েছিল সে। দিনগুলো কেটে গেল দ্রুত। তার পর এক দিন সকালে বাবা-মাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিল সে। ফেরার পর মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। তমা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দিনটা। এই তো, এই চেয়ারটাতেই বসে আছে সে। হাতের ফোনে চলে এসেছে বাবা-মার নির্বিঘ্নে পৌঁছনোর সংবাদ। বিকেল যেন শ্যামলা মেয়ে হয়ে তার লাবণ্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবু তার মন খারাপ। ঘরে, বারান্দায় এখনও লেগে রয়েছে বাবা-মার গন্ধ। তার নিজেকে একা একা মনে হচ্ছে। তখনই বাজল ফোন। বিপ্লব।
“কী করছিস?”
“কিছু না।”
“ঘর গোছাচ্ছিস না?”
“ঘর গোছানো শেষ। এখন অগোছালো করছি।”
“কাকু, কাকিমা বকছেন না এই বেয়াদপির জন্য?”
“নেই তো! বাড়ি চলে গেছে।”
“তা হলে তুই একা?”
“হুঁ।”
“তা হলে তো তোর মনখারাপ।”
“মন খারাপই তো। কিছু ভাল লাগছে না।”
“আমি মন ভাল করে দিতে পারি।”
“দে না! আমি তো মন হাতে নিয়েই বসে আছি।”
“তা হলে তো আসতে হবে কাছে। দূর থেকে মন ভাল করার মন্ত্র জানা নেই আমার।”
মুহূর্তে বুকের রক্ত চলকে উঠেছিল তমার। এটা তো ছিল তাদের বহুপ্রতীক্ষিত মুহূর্ত। কিন্তু কেন তার মন সাড়া দিচ্ছে না? কেন তার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে? সে জন্যই কি একা মন খারাপ করে বসে থাকলেও সে বিপ্লবকে যেচে ফোন করেনি? সাদর আমন্ত্রণ জানায়নি? তমা জানত, তার মধ্যে একটা বেখাপ্পা বদমেজাজি মেয়ে আছে। সে রাগী নয়, কিন্তু অভিমানী। সে খারাপ ব্যবহার করে না, কিন্তু সে হিসেব মেলানো ছন্দে বাজে না অনেক সময়। অথচ বিপ্লব তো হিসেব ও ছন্দে চলা ছেলে। ফোনে তমার কণ্ঠে ধরা দেয়নি সেই স্বতঃস্ফূর্ততা। সে বলেছিল, “বিপ্লব, আমার মুখটা কেমন বেগুনভাতের মতো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে তেতো গিলেছি। আমার কিছু ভাল লাগছে না কেন?”
“ও রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক তমা। তোর বাবা-মা চলে গেছেন বলে বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমার মনে হয় আমি গেলে তোর ভাল লাগবে। অবশ্য যদি তোর আপত্তি না থাকে।”
“আচ্ছা আয়। দিগ্বলয় আবাস। তুই তো চিনিস বাড়িটা। আমাদেরটার নাম মোহর অট্টালিকা। এটা পিছন দিকে। মোহরের দোতলায় উঠেই দেখবি নাম ফলকে ‘যা ইচ্ছে যেমন খুশি’ লেখা। তাড়াতাড়ি আয়। আমি চা বসাচ্ছি।”
তখনও তার গায়ে পাড়াগাঁয়ের গন্ধ। মা বলতেন সৃষ্টিছাড়া। বাবা বলতেন বিশ্বখেপা। স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁরা ব্যস্ত হয়েছিলেন তার বিয়ের জন্য। সে লজ্জা পেয়েছিল। বলেছিল, আর একটু গুছিয়ে নিয়ে তার পর সে যাবে ছাদনাতলায়। ইঙ্গিত দিয়েছিল, পছন্দের পাত্র সে পেয়েওছে। তখন তার বৃত্তে বিপ্লব। বাঁকুড়ার ছেলে। ঠেলে ঠেলে শিখেছে তথ্যপ্রযুক্তি। তার পর শহরের সুউচ্চ বহুতলে চাকরি পেয়েছে। কলেজে বন্ধুদের বন্ধুরাও বন্ধু হয়। তাদের বন্ধুদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ হয়। কারও চাকরি পাওয়া, ডক্টরেট প্রাপ্তি বা বিয়ের ভোজসভায় তেমন তস্য বন্ধু, বন্ধুর বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়। তেমন ভাবেই তমার সঙ্গে বিপ্লবের দেখা হয়েছিল। মনে হয়েছিল তারা তাদের জন্য নির্বিকল্প পছন্দ। মনে হয়েছিল তারা সেই জুটি, যারা এক সঙ্গে ম্যাচ খেলার জন্য প্যাভিলিয়ন থেকে পা ফেলে এগোচ্ছে পিচের দিকে। সেই মনখারাপের বিকেলে বিপ্লব আসবে শুনে মনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল তমার। আজ চেয়ারে বসে থাকা তমা দেখতে পাচ্ছে সেই দিনটার প্রতিটা মুহূর্ত। এই তো সে ছিটকে গেল চেয়ার থেকে। গোটা ঘরটা ঘুরে নিল এক পাক। আয়নার সামনে দাঁড়াল এক বার। তার পর ঘটা করে সাজতে বসল। তমা তো সাজতে ভালবাসে না, হেলাফেলা করে সাজে। তা হলে সে দিন কেন সে যত্ন করে শাড়ি পরেছিল? জানে না সে। জানতে চায়ও না। আপাতত সে কাঠের চেয়ারের ওপর দুটো পা তুলে হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে বসে। অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানলা থেকে জলবিন্দুর ভগ্নাংশ এসে লাগে তার গালে, হাতে। সে ওঠে না। জানলা বন্ধ করে না। প্রকৃতির খাতায় হুবহু এক রকম দুটো দিন। আজকের দিনটায় তমা একা। চলে যাওয়া দিনটায় সে একা ছিল না।
পনেরো মিনিটের মধ্যে শাড়ি পরে ফের এই ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল তমা। মনে পড়েছিল বুড়িদির কথা। দু’জন মানুষের জোড়। তমার সেই জুড়ি আসছে। ডানা মেলে আকাশে ওড়ার সঙ্গী এই এল বলে। তার পরই ডোরবেল বাজল। তমার মনে হল তার খুব লজ্জা করছে। সে ধীরে ধীরে গিয়ে দরজা খুলল। বৃষ্টি মাথায় করে এসেছে, কিন্তু এক বিন্দুও ভেজেনি বিপ্লব।
সে যত্ন করে ভাঁজ করা ছাতা রেখেছিল
দরজার পাশে। তার পর তাকে দেখে বলেছিল, “ও বাবা শাড়ি!”
“কেন, ভাল লাগছে না?”
“না, ভাল লাগছে। কিন্তু বাড়িতে কি কেউ শাড়ি পরে? তাই বললাম। আমি ভাবিনি তুই
শাড়ি পরবি।”
“তুই কী ভেবেছিলি?”
“আমি তো ভেবেছিলাম কিছুই পরবি না!”
বিপ্লব তো এ রকমই কথা বলে। কিন্তু সে দিন কেন যে তার কানে কথাটা লেগেছিল! সত্যি তার কান, মন, চোখ অন্য কোনও পদার্থে গড়া যা আর পাঁচ জনের মতো নয়। তমা দেখতে পায়, বিপ্লবকে বসতে বলে সে রান্নাঘরে যাচ্ছে চা বসাতে। বিপ্লব বসে না। তার পিছন পিছন গিয়ে এ কথা-ও কথা বলে। ফ্ল্যাটের কোথায় দরজা, কোথায় জানলা... নানা অর্থহীন কথা। কথা বলতে বলতে এক বার তার ঘাড়ে চুমু খায়। আমূল কেঁপে ওঠে তমা। আজ তমা রান্নাঘরের দিকে তাকায়। তাকিয়ে ভাবে, এইখানে দাঁড়িয়ে এই তো তার ঘাড়ে গভীর চুম্বন করছে বিপ্লব। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরছে তার কোমর। আলোড়িত হচ্ছে তমা, মুখে কপট শাসন করছে। অন্য দিকে ভাবছে সে সাহসী হবে কি না! ভাবছে তার জুড়িকে নিয়ে গভীরতর রাতের জন্য অপেক্ষা করবে কি না! ভাবছে দরজা জানলা খুলে দিয়ে সব আলো নিভিয়ে ছোট একখানা মোমবাতি জ্বালিয়ে দু’জনে ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে কি না! কোনও এক অপার্থিব অনুভূতিতে একটু একটু করে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত পিছিয়ে রেখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে কি না সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সে জন্য তার জুড়িকে তার সঙ্গে বয়ে যেতে দিতে হবে সময়। সে তখন কোন পোশাক পরবে? বিপ্লবই বা কী পরবে তখন? ভাবতে ভাবতে ভেবেছিল কী ভাবে সে বলবে এ কথা। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, জুড়িদের বুঝে যেতে হয় সঙ্গিনীর না-করা উচ্চারণ। এই তো চা করতে করতে ভাবছে তমা। তখন তার কাঁধে চেপে বসেছে বিপ্লবের ঠোঁটের কামড়। কোমর থেকে বিপ্লবের হাত সরিয়ে কপট শাসনের ভঙ্গি করে তমা বলেছে, “সোজা বসার ঘরে গিয়ে বোস। চায়ের সঙ্গে পাঁপড়ভাজা খাবি?”
বিপ্লব বলেছিল, “চা-ও খাব না। বসার ঘরেও যাব না।”
“যাবি না তো বসে রান্না কর,” বলে দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে এই বসার ঘরেই এসে বসে ছিল তমা। খাবার টেবিলে চকলেটের একটা মাঝারি প্যাকেট। বিপ্লব এনেছিল। কিন্তু বলতে ভুলে গিয়েছিল। বিপ্লব কি মোটা দাগের? সেই প্রথম, প্রথম বার হঠাৎ প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল তার।
আয়েস করে চা-টা খাওয়া হয়নি। বিপ্লবকে একটু বিরক্ত মনে হচ্ছিল। তমা বুঝতে পারে, কিন্তু সে নিজেকে বদলাতে পারে না। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য সে নিজেই কথা শুরু করেছিল
সেই সন্ধ্যায়।
“ফ্ল্যাটটা ছোট।”
“এখন শহরে সব ফ্ল্যাটই এরকম।”
বিপ্লব বলে। তমা ফের আহত হয়। সে ভেবেছিল, বিপ্লব বলবে ‘চল, তোর ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখি।’ তা বলেনি। গোঁজ হয়ে চা খাচ্ছিল বিপ্লব। তমা বলেছিল, “বাইরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে,” উত্তর দেয়নি বিপ্লব। তমা বলেছিল, “এই শোন না, আলো নিভিয়ে দেব? বৃষ্টির শব্দ শুনবি?”
বিপ্লব তখন খুশি হল। তমা আলো নিভিয়ে এসে বসার পর সে তার গা ঘেঁষে এসে বসল। সরে যায়নি তমা, কিন্তু দ্বিতীয় বার তার মনে হয়েছিল ছেলেটা হয়তো মোটা দাগেরই।
“শুনতে পাচ্ছিস বৃষ্টির শব্দ?”
“এ আর শোনার কি আছে?”
আজকের তমা আবার আরাম করে বসে। এই স্মৃতিরোমন্থন তার কাছে কি সুখের, দুঃখের, নাকি ঠিক-ভুল ফিরে দেখার? কে জানে! কিন্তু সে সব কাজ ভুলে গায়ে বৃষ্টির গন্ধ মেখে ফিরে যায় প্রায় বছর খানেক আগের এমনই এক সন্ধ্যায়। বিপ্লবের বিগড়ে যাওয়া আচরণকে ঠিক পথে আনার দায়িত্বটা সে নিজের কাঁধেই নিয়েছিল।
ক্রমশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy