ছবি: বৈশালী সরকার
এই সাতসকালেই জানলার পর্দা টেনে রেখেছে মিহিকা। ঘরময় আবছা আঁধার। তারই মধ্যে স্কার্ট টপ পরে গানের তালে আলগা শরীর দোলাচ্ছে মেয়ে। বাড়ন্ত আলোর সেই ঘরেও মঞ্জীরা বুঝল দারুণ এক আবেশে বোনের চোখ বন্ধ হয়ে আছে, মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে তার বারো বাই দশের বেডরুম। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে মিহিকার শ্যাম্পু করা চুল।
দৃশ্যটা আত্মস্থ করতে কিছুটা সময় নিল মঞ্জীরা। তার পর বন্ধ করল ব্লুটুথ স্পিকার।
থমকে নাচ থামিয়েছে মিহিকাও।
মঞ্জীরা হাসিমুখে বলল, “কখন বেরোবি?”
“এই তো এগারোটা নাগাদ। অনেক কাজ আছে। তুই বোস না দিদিয়া।”
মঞ্জীরা বসেনি। লঘু গলায় বলেছিল, “কার সঙ্গে ফোনে এত গুজগুজ হচ্ছিল? সামওয়ান স্পেশাল?”
মিষ্টি করে হেসেছিল মিহিকা, “তুই নোটিশ করছিলি, না? জীয়ন ফোন করেছিল। আর তার পর উত্তীয়দার সঙ্গেও কয়েকটা জরুরি কথা ছিল।”
মঞ্জীরার ভুরু কুঁচকে গেছিল, “উত্তীয়, মানে?”
এক মুখ হেসে মিহিকা বলেছিল, “সেই তো সব রে দিদিয়া! আমার প্রজেক্টের সর্বত্র যার ছোঁয়া, যাকে ছাড়া একটা দিনও আমি ভাবতে পারি না, দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি ব্যাঙ্কার... দ্য গ্রেট উত্তীয় মজুমদার।”
ছায়াময় ঘরে মানুষের মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না তবু মিহিকা বুঝেছিল, দিদির মুখের থেকে সবটুকু হাসি একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এমনিতে মিহিকা এ সব ছোটখাটো ডিটেলে বিশেষ পাত্তা দেয় না, কিন্তু আজ সকালে দিদিয়ার চোখে এমন কিছু ছিল, যা দেখে চমকে গিয়েছিল সে। একটু রাখঢাক যে দিদিয়া করেনি তা নয়, তবে চেপে ধরার পর যা বলেছিল তা শুনে রীতিমতো ভোম্বল হয়ে গেছিল মিহিকা। এতটা কি কো-ইনসিডেন্স হতে পারে! উত্তীয়দা গত তিন বছর দিদিয়ার বন্ধু, সেই উত্তীয়দাই আবার মিহিকার কাফের মেন্টর অথচ দিদিয়া নাকি এত সবের কিছুই জানে না!
দিদিয়া উত্তীয়দাকে ‘ক্লোজ় ফ্রেন্ড’ বলেছে। মিহিকার খটকা এখানেই। আর খটকাটা গলায় মাছের কাঁটার মতো বিঁধে আছে সেই থেকে। অনেক রকম ভাবে ভাবতে চেষ্টা করেছে মিহিকা অথচ তল পায়নি কিছুতেই।
সেই থেকে মিহিকার মনে ঝড় চলছে। সে দেরি করেনি। যত তাড়াতাড়ি পেরেছে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আর তার পর এই এখানে বাস থেকে নামা পর্যন্ত এক অদ্ভুত অস্থিরতা তাড়া করে বেড়িয়েছে তাকে।
হুড়মুড়িয়ে কাফেতে ঢুকে পড়ল মিহিকা। বাইরের তীব্র দিবালোক থেকে আসার ফলে ভিতরে এসে চোখ সইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগল তার। আর তার পরে এক রকম স্তম্ভিত হয়ে গেল মিহিকা।
অস্বাভাবিক সুন্দর দেখাচ্ছে তার কাফেটেরিয়া। দেয়ালে ছোট এলইডি, পাশের দেয়ালে সুন্দর চিত্রকলা, রঙিন বাহারি কাচের জানলা, ছোট দুটো দরজার ও পারে যথাক্রমে কিচেন আর এক চিলতে ওয়াশরুম। কাচের দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে ক্যাশ কাউন্টার আর বাকি জায়গা জুড়ে পাঁচটা টেবিল, সব মিলিয়ে এক সঙ্গে প্রায় জনা কুড়ি কাস্টমারকে সার্ভিস দিতে পারবে মিহিকার কাফে।
প্রতিটি টেবিলে সুদৃশ্য ফুলদানি, আজ তাতে তরতাজা ফুলের গোছা। ছোট ছোট পটে নুন আর গোলমরিচ। তিন রকম কাচের কেতাবি পাত্রে টমেটো কেচাপ, রেড চিলি সস আর ভিনিগারে ডোবানো গোল পিঁয়াজ।
মিহিকা অবাক চোখে কাফেটা দেখছিল। তার চোখে কে যেন মায়াকাজল পরিয়ে দিয়েছে। এত দিনের স্বপ্ন আজ এ ভাবে চোখের সামনে, অথচ কেন পুরোপুরি খুশি হতে পারছে না মিহিকা?
এই মুহূর্তে জীয়ন কাফেতে নেই, বাইরে কোনও কাজে গেছে হয়তো। ভালই হল, উত্তীয়দার সঙ্গে কথা চলাকালীন জীয়ন সেখানে না থাকলেই ভাল।
মিহিকা উত্তীয়র পাশে এসে দাঁড়াল, “উত্তীয়দা, তোমার সঙ্গে কথা আছে। একটু এ দিকে এস।”
এখন সম্পর্কটা আগের চেয়ে পুরনো। তাই মিহিকা উত্তীয়কে ‘তুমি’ আর উত্তীয় মিহিকাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। উত্তীয় মিহিকার দিকে তাকাল না। দেওয়ালে একটা মস্ত পেন্টিং ঝোলাচ্ছে দুটো ছেলে। খুব সাবধানে দেখতে হয় এই সময়টা। একটু উঁচু-নিচু হয়ে গেলে বিসদৃশ লাগবে, এত বড় পেন্টিং আবার নতুন করে লাগানো এক বিরাট হাঙ্গামা।
উত্তীয় ছেলেগুলোর কাজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই বলল, “আরে, এসে গেছিস? একটু সময় দে। কাজটা সেরে নিয়ে আসছি।”
কিন্তু উত্তীয়র সময় হল না। কাফের পরিসর তেমন বড়সড় নয়। পেন্টিং সেটিং-এর ছেলেগুলো যেতে না যেতে দু’জন কুক এসে গেল, তাদের সঙ্গে বসতে হল মিহিকা আর উত্তীয়কে। সেই পর্ব মিটলে মেনু কার্ড ডেলিভারি দিতে এসে গেল দুটো ছেলে, হাজার বার বলা সত্ত্বেও কার্ডে একটা বানান ভুল থেকে গেছে। ছেলেদুটো অবশ্য ঠিক করে দেবে বলেছে, তবু যে ক’দিন নতুনগুলো না আসে তত দিন কাজ চালানোর জন্য কয়েকটা মেনু কার্ড রেখেই দিল ওরা।
তোরণ তৈরির লোকগুলো দেরি করল। তারা এল প্রায় বিকেলে। তাদের কাজ আগাগোড়া খুব মন দিয়ে দেখতে হল জীয়ন, উত্তীয় আর মিহিকাকে। এই কাজ ছেলেগুলোকে দিয়ে জোর করে করানো হচ্ছে , তাই ফাঁকি থাকার আশঙ্কা প্রবল। এক চুলও চোখের আড়াল করল না ওরা ছেলেগুলোকে। তবে কাজ পছন্দ হয়েছে শেষমেশ। মিহিকার কাফে বাইরে থেকে বিকেলের শেষ আলোয় রীতিমতো আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।
উত্তীয়কে মিহিকা একা পেল সন্ধে নামার একটু আগে।
জীয়ন এরই মধ্যে একটা কাণ্ড করেছে, সে কাফের সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে। তার পরিকল্পনা অভিনব। মিহিকার জন্মের সময় সন্ধে পৌনে ছ’টা। ঠিক সেই সময় এক সঙ্গে সব ক’টা আলো জ্বেলে দেবে সে। এই কাফে মানেই তো মিহিকা চ্যাটার্জির নতুন জন্ম।
স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় মায়াবী হয়ে ছিল কাফের অন্দরটা। কোণের দিকের একটা টেবিলে চুপচাপ বসে ছিল উত্তীয়। মিহিকা তার সামনের চেয়ারে বসল, দুপুরের ঝাঁঝ তার মধ্যে আর নেই, কিন্তু সে ঠিকই করে নিয়েছিল সরাসরি কথা বলবে।
উত্তীয়র চোখে চোখ রেখে মিহিকা বলল, “দিদিয়াকে কত দিন চেনো উত্তীয়দা?”
উত্তীয় তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মিহিকার কথা শুনে সে কয়েক মুহূর্ত থামল, মৃদুস্বরে বলল, “জানতে পেরেছিস? আরও আগে কেন জানতে পারিসনি সেটাই ভাবছিলাম।”
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা গোপন করে কি ঠিক কাজ করেছ? তোমার মনে হচ্ছে না আমি একটা এক্সপ্ল্যানেশন ডিজ়ার্ভ করি!”
উত্তীয় জবাব দিল না। মিহিকা আবার বলল, “পলাশবাবুর সংস্থার ব্যাপারটা পুরোটাই ভাঁওতা, তাই তো?”
উত্তীয় চট করে উত্তর দিতে পারল না। পলাশ তার দীর্ঘ দিনের পরিচিত। তার অনুরোধেই পলাশ মিহিকার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, মিহিকা জানে না। উত্তীয় মিহিকার দিকে তাকাল, মিহিকার সুন্দর সাজের সঙ্গে অত্যন্ত বেমানান হয়ে তার ডান ভুরু প্রায় কপালে উঠে গেছে। সে জবাবদিহি চাইছে। শরীরী ভাষায় তেজি ঘোড়ার ভঙ্গি।
উত্তীয় শান্ত স্বরে বলল, “না মিহিকা, পলাশের কোম্পানির প্রপার ডকুমেন্টেশন আছে, তোর কাফের সব কাগজপত্রও অথেন্টিক,” গলা নামাল উত্তীয়, “শুধু আমাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে ওদের টাই-আপ নেই, এটা লুকিয়েছিলাম তোর কাছে।”
“কেন?”
উত্তীয় চমকে তাকাল। মিহিকার চোয়াল শক্ত। সে বলল, “তোমার দিদিয়া নিশ্চয়ই তোমায় সব বলেছে। আমি আর কী বলব নতুন করে?”
“আমার দিদি আমাকে যা বলেছে, সেটা আমি শুনেছি। আমি তোমার ভার্শনটা জানতে চাইছি। আশা করি আজকের দিনে কিছু গোপন করবে না। আই ওয়ান্ট এভরিথিং ক্লিয়ার, রাইট নাউ।”
কর্তৃত্বের স্বরে বলল মিহিকা।
তার দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিল উত্তীয়, তার পর সে তার কথা শুরু করল। কথা সামান্য। অথবা সামান্য নয়। বিপুলা এ পৃথিবীতে কত বড় বড় ঘটনা ঘটে যায় প্রতিনিয়ত। আগুনে ছাই হয়ে যায় বনভূমি, বড় বড় প্রাচীর গুঁড়িয়ে যায়, যুদ্ধের আগুনে ধ্বংস হয়ে যায় দেশ, প্রাণ হারায় মানুষজন। আর এ তো সামান্য ভালবাসাবাসির আখ্যান।
তবু সে বড় নিকটকথা। এটুকু ভালবাসা আছে বলেই তো আজও বিশ্বাস হারায়নি মানুষ, বার বার আঘাত পেয়েও তাই ভালবাসার মানুষের হাত ছাড়ে না সে। দূরে থাকা প্রিয়জনের জন্যও বুকের ঘরে একটা কুঠুরি ঠিক ফাঁকা থাকে।
কিছুই লুকোল না উত্তীয়। আজ তিন মাস মিহিকার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা করেছে সে। হতে পারে এই কাফেটেরিয়ার জন্য তার অবদান অনেক, তবু তার মানে এই নয় যে এই মেয়ের কাছে আসল পরিচয় গোপন রাখার অধিকার আছে তার।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল উত্তীয়। কাঁধে ব্যাগ তুলে নিয়েছে। এখানকার খেলা শেষ, তার আর প্রয়োজন নেই এখানে। মিহিকা স্বাবলম্বী এবং কঠিন ধাতের মেয়ে। সে এই ব্যবসা সামলে নিতে পারবে, জানে উত্তীয়। আর জীয়ন তো রইলই। প্রাণ দিয়ে ভালবাসে মিহিকাকে, খুব কাছ থেকে এত দিন দু’জনকে দেখেছে উত্তীয়। এ বার সে এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতেই পারে।
মিহিকা উত্তীয়র দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। উত্তীয় হাসল, “চলি রে। ভাল থাকিস। যে কোনও প্রয়োজনে, মনে রাখিস উত্তীয়দা ইজ় জাস্ট আ ফোন কল অ্যাওয়ে। যদি তোকে কোনও ভাবে দুঃখ দিয়ে থাকি, ক্ষমা করে দিস।”
মিহিকা বিড়বিড় করল, “তার মানে, আমি...আমি জাস্ট তোমার প্রজেক্টের পার্ট!”
উত্তীয় সহজ ভাবে বলল, “মিথ্যে বলব না, প্রথম দিকে তা-ই ছিলি। কিন্তু তুই যে কী, তা তুই নিজেই জানিস না মিহিকা। তোকে যে চিনবে সে তোকে ভাল না বেসে পারবে না। ওই জীয়নটাকে দেখে বুঝিস না?”
মিহিকা টেবিলে হাত রেখে মুখ গুঁজে দিল। তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল উত্তীয়। মুখ ঢাকা অবস্থাতেই মিহিকা বুঝল উত্তীয়দা হেঁটে যাচ্ছে কাফের গেটের দিকে।
জীয়ন ছুটে এল, “তুমি চলে যাচ্ছ কেন? আরে উদ্বোধন তো এখনও বাকি।”
“আমার কাজ শেষ, বস। আর তা ছাড়া তুই তো রইলি। ঠিক সামলে নিবি জানি,” মিহিকার দিকে ইশারা করল উত্তীয়, “টেক ভেরি গুড কেয়ার অব হার, জীয়ন।”
জীয়ন লাজুক হেসে বলল, “জীয়ন না উত্তীয়দা, জিয়ান। তুমি ডাকলে ভাল লাগে।”
মৃদু হেসে জীয়নের কাঁধে হাত রাখল উত্তীয়, তার পর দ্রুতপায়ে কাফের বাইরে বেরিয়ে গেল।
মিহিকা দীর্ঘ সময় চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারল না। একই ভাবে টেবিলে মাথা নিচু করে বসে রইল। জীয়ন ডাকতে এসে ফিরে গেল। সে জানে মিহিকাকে এখন ডেকে লাভ নেই। এই আচরণের কারণ জানতে চাওয়াও অর্থহীন। সময় হলে নিজেই জীয়নকে সব বলবে সে। মিহিকা তার কাছ থেকে কিছু লুকোয় না, জীয়ন জানে।
মিহিকার মনে তীব্র আলোড়ন চলছে। এ ভাবেও কেউ কাউকে ভালবাসতে পারে? দিদির অবিশ্বাস আর দ্বিধার জবাব এ ভাবে দিয়ে গেল লোকটা? দিদিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সে শুধু দিদিকে নয়, দিদির কাছের মানুষগুলোকে পর্যন্ত সামলে রাখার ক্ষমতা রাখে! এটাই কি প্রমাণ করতে চেয়েছিল উত্তীয়দা!
তার পর সময় হল। কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে কাফের সব আলো জ্বেলে দিল জীয়ন। আলোর ছটায় কাফের ভিতরকার জমাট আঁধার মিলিয়ে গেল এক লহমায়। মিহিকা চোখ তুলে চাইল। তার কাফে গমগম করছে।
কলেজের কয়েক জন বন্ধুকে জুটিয়ে নিয়ে এসেছে জয়িতা। ছোটমাসি, মেসোমশাই আর মেজজেঠুকেও দেখল সে। কখন যেন গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দিদি আর ডাম্বোও। দিদি একটা ঘিয়ে রঙের জারদৌসি পরেছে, হালকা মেকআপ, সামান্য লিপস্টিক আর কাজল, তাতেই দিদিয়াকে তার পৃথিবীর সেরা সুন্দরী মনে হচ্ছে।
কাফে ভর্তি লোকদের অবাক করে মিহিকা এক ছুটে গিয়ে মঞ্জীরাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা রেখেছে দিদিয়ার।
মঞ্জীরা রীতিমতো ঘাবড়ে গেল, এ কোন মিহিকা! খুব ছোটবেলায় দিদি ছাড়া আর কাউকে চিনত না এই মেয়ে। মায়ের থেকেও দিদিয়া বেশি প্রিয় ছিল তার কাছে। কবে থেকে যেন সব পাল্টে গেল? কবে সেই ছোট্ট মেয়েটা বড় হতে হতে দূরে সরে গেল মঞ্জীরার কাছ থেকে?
আর আজ এমন দমকা হাওয়ার মতো তার বুকে মিশে গেল মেয়েটা। এ ভাবেই কি মানুষ ফিরে আসে প্রিয়জনের কাছে? মঞ্জীরা বুঝল মিহিকার শরীরটা কাঁপছে। মঞ্জীরার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে উষ্ণ ধারায়।
আশ্চর্য! এমন আলোয় ভরা বাসর, এমন স্বপ্নপূরণের মুহূর্তে বোন কেঁদে ভাসাচ্ছে কেন? এমন দিনে কি কাঁদতে আছে?
মঞ্জীরা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী হয়েছে মিহিকা? অ্যাই মেয়ে! কাঁদছিস কেন পাগলি?”
মিহিকা মুখ তুলল না, কথা বলতে গিয়ে গভীরতর এক কান্নায় তার স্বর ডুবে গেল, “বলব না। কোনও দিন নয়।”
১০
উত্তীয় দাঁড়িয়ে আছে গৌরগোপালের কেবিনে। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করা লোকের মুখের ভাব সহজে বোঝা যায় না। তবু গৌরগোপালের মনে হচ্ছে উত্তীয়র মুখ থমথম করছে। অথচ মিনিট তিনেক আগে যখন উত্তীয় এই ঘরে ঢুকেছিল তখন তার মুখ ছিল দারুণ উজ্জ্বল, ঝকঝকে হাসি মুখে দরজার ফাঁক দিয়ে কায়দা করে জিজ্ঞেস করেছিল, “মে আই কাম ইন স্যর?”
তিন মিনিটের মধ্যে উত্তীয়র মতো প্রাণবন্ত ছেলের হাসিমুখ যদি শুকিয়ে পাংশু হয়ে যায় তবে ধরে নিতে হবে কোথাও বড় ধরনের গোলমাল পেকেছে। ঘটনা সত্যিই তাই। গৌরগোপাল আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এই ছেলের অনেক আবদার সহ্য করেছেন, এ বার একটু কড়া তাঁকে হতেই হবে।
কিন্তু ঘটনা হল, কথাবার্তা শেষ হয়ে গেলেও উত্তীয় চেম্বার ছেড়ে নড়ার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না। গৌরগোপাল আড়চোখে নিজের মোবাইলের দিকে তাকালেন। সেখানে অনলাইন গেম পজ় করে রাখা আছে। তাঁর হাত নিশপিশ করছে।
উত্তীয় মাথা তুলল, তার মুখেচোখে স্পষ্ট অসন্তোষ, “এই তা হলে আপনার শেষ কথা?”
“উঁহু উত্তীয়, একদম না। নট এনি মোর। সাদা-কালো বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিয়ে আমায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা কোরো না।”
“না স্যর। আমি শুধু আপনার কাছ থেকে একটা ফাইনাল স্টেটমেন্ট চাইছিলাম।”
“এক মিনিট,” গৌরগোপাল তাঁর বিশাল বপু নিয়ে সামনে ঝুঁকে মোবাইল হাতে নিলেন, “এই দেখো, সোশাল মিডিয়ায় পর্যন্ত আমাদের ব্যাঙ্কের সার্ভিস নিয়ে হাসিঠাট্টা শুরু হয়ে গেছে। শোনো কী লিখেছে— ফুড ডেলিভারি অ্যাপ থেকে বয় লাঞ্চপ্যাক ডেলিভারি দিতে আমাদের ব্যাঙ্কে এসেছে আর তাকে বলা হয়েছে, লাঞ্চ আওয়ার চলছে, এক ঘণ্টা পরে আসুন!” গৌরগোপাল গর্জে উঠলেন, “ছি ছি! কী লজ্জার কথা! তুমি বলতে চাও এ সব বিনা কারণে ছড়াচ্ছে? আমাদের কোনও দায় নেই?”
“প্লিজ় স্যর। আপনি সোশ্যাল মিডিয়াকে এত সিরিয়াসলি নেবেন না। দু’বেলা অমন রাবিশ কিছু লোক অহরহ ছড়িয়ে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেউ রেহাই পায় না স্যর। সেখানে আপনি আমি কোন ছার বলুন।”
গৌরগোপাল কনভিন্সড হলেন না, “তা বললে তো হবে না উত্তীয়। সেন্স অব রেসপন্সিবিলিটি একটা বিরাট ব্যাপার। এটা আবার ইন-বিল্ট কোয়ালিটি, কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। মোদ্দা কথা হল, ইনস্পেকশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি অফিস ছেড়ে এক পা-ও নড়বে না।”
উত্তীয় অসহায়ের মতো বলল, “কিন্তু স্যর, আজকের দিনটা খুব ভাইটাল। আমায় একটু বেরোতেই হবে। অলরেডি খুব দেরি হয়ে গেছে। প্লিজ় স্যর!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy