ছবি:অমিতাভ চন্দ্র।
ডিসেম্বর, ১৫৮৫। তুষারাবৃত কাশ্মীরের সীমানায় দাঁড়িয়ে বিরাট এক সেনাবাহিনী। সার সার অশ্বারোহী, পদাতিক সেনা অপেক্ষা করে আছে তিন সেনাপতির আদেশের। শিবিরের সামনে পতাকা, তাতে জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর-এর প্রতীক। খোদ মুঘল সম্রাটের আদেশ, এ বার কাশ্মীর জয় করতে হবে, বন্দি করতে হবে এ রাজ্যের রাজা ইউসুফ শাহ চাক-কে।
যে সে রাজা নয়। ইউসুফ শাহ চাক বিখ্যাত ‘চাক’ রাজবংশের রাজা, যে রাজবংশ কাশ্মীর শাসন করছে গত তিরিশ বছর। তার আগে ছিলেন সুলতান জয়নুল আবেদিন ও শাহমিরি রাজবংশ। জয়নুল আবেদিন ধর্মে মুসলমান হয়েও জিজিয়া কর লোপ করেছিলেন, হিন্দুজের পুজোআচ্চা, উৎসবে যোগ দিতেন। ঝিলাম নদীর ওপর প্রথম কাঠের সেতু তাঁর আমলেই। কাশ্মীরে কারিগর এনে কার্পেট তৈরি, কাগজের মণ্ডের শিল্প, রেশমশিল্প তাঁরই অবদান। শাহেনশাহ আকবরের ঠাকুরদা বাবর মধ্য এশিয়া থেকে যখন এ দেশে এসেছেন, তাঁর সঙ্গীরাও মুগ্ধ হয়েছেন কাশ্মীরে। ‘সমরখন্দ, বোখারার কিছু জায়গায় চমৎকার কারিগর দেখা যায়। কিন্তু কাশ্মীরে তারা ঘরে ঘরে,’ আত্মজীবনীতে লিখছেন বাবরের ভাই মির্জা হায়দার দৌলগত। পীরপঞ্জাল পর্বতের নীচে এই রাজ্য আকবরের তাই চাই-ই চাই!
আসল কারণ অন্যত্র। সুলতান ইউসুফ শাহ চাক অপমান করেছেন খোদ মুঘল সম্রাটকে। আকবর চান, কাবুল থেকে দক্ষিণে সমুদ্র অবধি উড়বে মুঘল জয়পতাকা, কাশ্মীরও বাদ যাবে না। দু-দু’বার দরবারে ডেকে পাঠিয়েছেন ইউসুফকে। কিন্তু রাজা এমনই বদতমিজ, সম্রাটের তলব পেয়েও আসেনি! বেয়াদবির উচিত শিক্ষা দিতেই কাশ্মীরের দোরগোড়ায় পা ঠুকছে মুঘল সেনা।
ইউসুফ শাহ চাক, কাশ্মীরের প্রকৃত শেষ স্বাধীন রাজা, সে বার বীরের মতো প্রতিহত করেছিলেন মুঘল সেনাকে। ডিসেম্বরের কাশ্মীরে হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা আর বরফ, মুঘল সেনারা খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। তবে ইউসুফ শাহ চাক সে বারের মতো কাশ্মীরকে বাঁচাতে পারলেও, মুঘল সেনাপতির হুমকি-চিঠি পেলেন, দিল্লি এসে আত্মসমর্পণ করতেই হবে, নইলে পরের বার আর ছাড় নেই কাশ্মীরের।
সত্যিই আর ছাড় মেলেনি। স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীর পরাধীন হয়েছিল, নতিস্বীকার করেছিল দিল্লির সম্রাটের কাছে। কিন্তু সে ইতিহাস যত না পরাজয়ের, তারও বেশি প্রতারণার, বিশ্বাসঘাতকতার।
ইউসুফ শাহ চাক ছিলেন অতি উদার, সংস্কৃতিমনা। কিন্তু দুর্বল, সিদ্ধান্ত নিতে-না-পারা এক শাসক। এক দিন ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছেন, দেখলেন, আখরোটের বাগানে নিজের মনে গান গাইছেন সুন্দরী এক নারী। সুন্দরী চাষিঘরের বউ, কিন্তু কবি। প্রেমের কী আর বাকি থাকে? যথাসময়ে সুলতানের বেগম হলেন তিনি। এই নারীই কাশ্মীরের অন্যতম কবি— হাব্বা খাতুন। সুন্দরী বউ, শিল্পসাধনায় মতি, ফলত প্রশাসনে ঢিলেমি। প্রজারা নাখোশ হল রাজার ওপর। শত্রু রাজারা আক্রমণ শানাতে লাগলেন কাশ্মীরে, শেষমেশ ইউসুফ শাহ চাক সিংহাসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন— তাঁর ভাই লোহার চাক-এর হাতে।
লোহার চাক কাশ্মীরের মসনদে ছিলেন মেরেকেটে মাস তেরো। তার পরেই ইউসুফ হৃত রাজ্য ফিরে পেতে ফের ময়দানে নামেন। যোগাযোগ করলেন লাহৌরের শাসক, মুঘল প্রতিনিধি মানসিংহের সঙ্গে। মানসিংহ রাজাকে বললেন, আগ্রায় খোদ সম্রাট আকবরের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করতে। ইউসুফ তা-ই করলেন, ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের দরবারে এসে হাজির হলেন। আকবরও সুযোগ খুঁজছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ রাজা মানসিংহকে আদেশ করলেন প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ইউসুফের সঙ্গে যেতে।
আগ্রা থেকে কাশ্মীর ফেরত যাওয়ার পথে ইউসুফ চাক বুঝতে পারলেন, মস্ত ভুল করে ফেলেছেন। আকবর এই সুযোগে নিজেই দখল করে নেবেন কাশ্মীর। তিনি বুদ্ধি করে মানসিংহকে বললেন, আমার সেনার সঙ্গে এখনই আপনার কাশ্মীর ঢোকার দরকার নেই। আমি বরং একাই দেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে পারা যায় কি না দেখি!
পারা গেল। লোহার চাক-এর মন্ত্রী আবদাল ভাটকে যুদ্ধে পরাজিত করল ইউসুফ চাক-এর সেনারা। ইউসুফ ফের রাজা হয়ে বসলেন কাশ্মীরে। কথা ছিল, তাঁর সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মানসিংহকে আমন্ত্রণ জানাবেন কাশ্মীরে। কিন্তু সেই ডাক আর আসে না। মানসিংহ বুঝতে পারলেন, ইউসুফ শাহ চাক মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করতে চান না।
সম্রাট আকবর চান একটাই ভারত, একটাই মুঘল সাম্রাজ্য থাকবে। অন্য রাজারা থাকবেন বটে, কিন্তু মুঘল শাসনের প্রতিনিধি হিসেবে। তাই ইউসুফের স্বাধীনচেতা মনোভাব ভাল চোখে দেখলেন না তিনি। কাশ্মীররাজকে সন্ধিপ্রস্তাব দিয়ে ডেকে পাঠালেন নিজের দরবারে। ইউসুফ প্রায় প্রত্যাখ্যান করলেন সেই তলব। নিজে না গিয়ে ছোট ছেলে ইয়াকুব চাককে পাঠালেন আকবরের কাছে।
মুঘল সম্রাট রেগে কাঁই। ১৫৮৫-র অগস্টে কাবুলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে অক্টোবরে পঞ্জাব ফিরে, দুজন প্রতিনিধিকে পাঠালেন ইউসুফের কাছে: তিনি যেন পত্রপাঠ সম্রাটের কাছে হাজিরা দেন। এ বার বারণ করল ইউসুফের মন্ত্রী-সেনাপতিরাই। ইউসুফ এলেন না। তার পরেই ডিসেম্বরে সেই সেনা পাঠানো। বিরাট সেনাবাহিনী, তিন সেনাপতি। তাঁদের মধ্যে এক জন বীরবল! কবি, বিদূষক, গায়ক বীরবল। আকবরের আশা ছিল, আট হাজার সেনা পাঠিয়ে ইউসুফের মন গলানো সম্ভব না হলেও, বীরবল নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু সম্রাটের প্রিয় বয়স্যও কিছু করতে পারেননি।
শেষমেশ আকবরের আর এক সেনাপতি, রাজা ভগবানদাস ইউসুফ চাককে নিয়ে এলেন আকবরের কাছে। কিন্তু আসার আগে যে চুক্তি হয়েছিল ভগবানদাস আর ইউসুফ চাক-এর মধ্যে, আকবর সে সব মানলেনই না। সম্রাট বলে কথা!
বরং নিয়ম ভেঙে বন্দি করলেন ইউসুফকে। মুঘল সম্রাটের এ হেন বিশ্বাসঘাতকতায় বিরক্ত, বিষণ্ণ ভগবানদাস আত্মহত্যা করলেন। ইউসুফ শাহ চাকও আর ফিরে যেতে পারেননি নিজের রাজ্যে। টোডরমলের অধীনে আকবর রেখে দেন তাঁকে। বন্দি দশায় ছিলেন এই বাংলাতেই, পরে মনসবদার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহারে। সেখানেই মারা যান তিনি। নালন্দা জেলার বিসওয়াক-এ আছে তাঁর সমাধি।
ইউসুফের বন্দিদশার খবর পেয়ে কাশ্মীরের মানুষ তাঁর ছেলে ইয়াকুব শাহ চাককে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। তাতেও লাভ হয়নি। ইয়াকুব দক্ষ শাসক ছিলেন না, রাজ্যে অরাজকতা লেগেই ছিল। সেই সুযোগেই আবার ঢুকে পড়ল মুঘলরা। এমনও শোনা যায়, দুজন সুন্নি ধর্মগুরু নাকি কাশ্মীরে আকবরের ‘সাহায্য’ প্রার্থনা করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সে যা-ই হোক, আকবরের আদেশে ১৫৮৬ সালের ২৮ জুন কাশিম খান কাশ্মীর আক্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করলেন— ৪০ হাজার অশ্বারোহী আর ২০ হাজার পদাতিক সৈন্য নিয়ে। প্রথমে রাজৌরি, তার পর শ্রীনগর হাতে নিয়ে নিল মুঘল সেনা। কাশ্মীরও হারাল তার স্বাধীনতা। দরজা খুলে গেল ভবিষ্যতের অগুনতি বিদেশি আক্রমণের।
ছেলের দশাও পরে হয়েছিল বাবার মতোই। পরে বিহারে দেখা হয়েছিল বাবা আর ছেলের, দুজনেই তখন বন্দি। কোথায় ভূস্বর্গ কাশ্মীর আর কোথায় গনগনে গরমের বিহার! ও দিকে প্রাক্তন রাজরানি হাব্বা খাতুন পড়ে রইলেন একা। ইউসুফ চাক-এর বিরহে গান লিখে গাইতেন একাকী, নিজের মনে।
নিজেদের সাম্রাজ্যের সীমানা আরও বাড়াতেই মুঘলদের কাশ্মীর দখল। সমতলের ঝাঁ-ঝাঁ গরম থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁরা কাশ্মীরে গিয়ে শরীর জুড়োতেন। পরবর্তী কালে আফগান আর শিখরাও দখল নিয়েছে কাশ্মীরের। ডোগরা শাসক গুলাব সিংহ তো ৮৫ লক্ষ নানকশাহি শিখদের বসবাসের জন্য কাশ্মীরকে আক্ষরিক অর্থে কিনেই নিয়েছিলেন। কাশ্মীরের সীমানা প্রসারিতও করেছিলেন তিনি, কায়েম করেছিলেন নিজের রাজত্ব। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলছিল এ ভাবেই। গুলাব সিংহের উত্তরসূরিরা কাশ্মীরি মুসলিম প্রজাদের উপর কম অত্যাচার করেনি। কাশ্মীরি মুসলিমরা তো সেই ১৫৮৬ সালেই স্বাধীনতা হারিয়েছিলেন। তাই ১৯৩১ সালে যখন তাঁরা ডোগরা রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, সে ছিল আর এক স্বাধীনতার লড়াই। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যার প্রত্যক্ষ কোনও যোগ নেই। কিন্তু রাজনীতির খেলায় যেমনটা হয়ে থাকে— কাশ্মীর জড়িয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের মধ্যে। আজও দু’কোটি মানুষের জীবন আপন্ন ভারত পাকিস্তান আর চিনের নিরন্তর লোফালুফিতে।
আকবরের সঙ্গে ইউসুফের লড়াইয়ের কাহিনিতেও চমকের অভাব নেই। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ইউসুফের নিজেরও দোষ ছিল, নিজের পতনের পথ তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু আসল কথা হল, যুদ্ধে আকবরের বাহিনী দুরমুশ হয়েছিল ইউসুফ শাহ চাকের সৈন্যদের হাতে, আর যদি ইউসুফ আকবরের ফন্দিতে বন্দি না হতেন, আকবরের কাশ্মীর বিজয়ও সম্ভব হত না। আকবর সে দিন প্রতারণা না করলে, কাশ্মীরের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy