গবেষক: মুহম্মদ আবদুল হাই। ডান দিকে, তাঁর লেখা বই ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’
ইউরোপ এবং আমেরিকার বাইরে ভাষা ও ভাষা সংক্রান্ত বিবিধ বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার দরজা প্রথম উন্মুক্ত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাধারণের পরিচিত শাস্ত্রগুলির পাশাপাশি এই নতুন শাস্ত্রটিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকের নামই আমাদের কাছে খুব পরিচিত। স্বাভাবিক ভাবে এঁরা অধিকাংশই বাঙালি, কারণ এই নতুন শাস্ত্রটির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রথম শুরু হয় কলকাতায়।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিবর্তন নিয়ে যাঁরা প্রথম সারির গবেষণা করেছিলেন তাঁদের তিনজনের নাম বাঙালির সংস্কৃতি জগতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এঁরা হলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সুকুমার সেন। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সমসাময়িক আরও দুই বাঙালি ভাষাশাস্ত্র অধ্যয়ন ও গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন— বটকৃষ্ণ ঘোষ ও হেমন্তকুমার সরকার। তবে হেমন্তকুমার অল্প বয়সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ভাষাচর্চার পথ থেকে অনেকটাই দূরে সরে যান। সুনীতিকুমার ও তাঁর সমসাময়িক যাঁরা, তাঁদের যদি প্রথম প্রজন্মের ভাষাশাস্ত্রী বলে চিহ্নিত করা যায়, তা হলে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাষাশাস্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি হলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। আজ আমাদের কাছে তিনি প্রায় বিস্মৃত। অথচ এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ।
আবদুল হাই-এর জন্ম ১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগর থানার মরিচা গ্রামে। গ্রামের একটি জুনিয়র মাদ্রাসা স্কুলেই তাঁর পড়াশোনার শুরু। পরে তিনি রাজশাহী উচ্চ মাদ্রাসা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই পাশ করেন। এর পর ঢাকা ইসলামিক কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সম্ভবত তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম মুসলমান ছাত্র। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সরকারি কলেজে। প্রথমে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ এবং দেশভাগের পরে রাজশাহী সরকারি কলেজে কিছু দিন অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। তার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন।
ভাষাবিজ্ঞানে তাঁর পঠন-পাঠন ও গবেষণার সূত্রপাত কিন্তু বিদেশে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহের পরামর্শে উচ্চতর শিক্ষার আশায় তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ়’ বিভাগ থেকে ভাষাবিজ্ঞানে, বিশেষত ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। পাশাপাশি পড়েছিলেন আরবি, সংস্কৃতের মতো ভাষাও। কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখায় আবদুল হাই উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছিলেন তা মূলত ধ্বনিবিজ্ঞান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহও প্রথম জীবনে তাঁদের মৌলিক গবেষণাগুলি করেছিলেন ধ্বনিবিজ্ঞানে। তবে সুনীতিকুমার এবং শহীদুল্লাহ, এই দুজনেই পরবর্তী কালে তুলনামূলক শব্দবিদ্যার আলোচনার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। বিদেশ থেকে ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চতর শিক্ষালাভ করে নিজের মাতৃভাষার বিশ্লেষণে যাঁরা বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, আবদুল হাই তাঁদের অন্যতম। এ ব্যাপারে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিলেন দুই অগ্রগণ্য বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী।
আবদুল হাই-এর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা নাসিক্যধ্বনি ও বাংলা ভাষার অনুনাসিকতার ধ্বনিবৈজ্ঞানিক ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। তাঁর এই গবেষণা অনেকটাই ছিল যন্ত্রপাতিনির্ভর, যাকে এখনকার দিনে ও পরিভাষায় বলা হয় ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফোনেটিক্স’। আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বাংলা ভাষার ধ্বনিগুলির বিশ্লেষণে তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কারণ তখন বিদেশেও পরীক্ষামূলক ধ্বনিবিজ্ঞানের চর্চা খুব বেশি এগোয়নি। আর এ দেশে পরীক্ষামূলক ধ্বনিবিজ্ঞানের চর্চার কোনও পরিকাঠামোই তখন ছিল না।
ধ্বনিবিজ্ঞান বিষয়ে তিনি ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। ইতিপূর্বে বাংলায় ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে এ রকম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হয়নি। আবদুল হাই এই গ্রন্থটির জন্যই ভাষাবিজ্ঞানের জগতে সর্বাধিক পরিচিতি হলেও তাঁর অন্যান্য বইগুলিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ (১৯৫৪), ‘ভাষা ও সাহিত্য’ (১৯৬০), ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ (১৯৫৯), ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ (১৯৫৮) এবং ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (দ্বিতীয় খণ্ড)। শেষের বইটি সৈয়দ আলি আহসানের সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এই বইটির প্রথম খণ্ডটি লিখেছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে, আবদুল হাই সেই সময়ে ছিলেন বিলেতে। বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে রাষ্ট্র, প্রতিবাদে মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে চিন্তাশীল সকল মানুষের কলম। আবদুল হাইও কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনিও তাঁর লেখালিখির মধ্যে দিয়ে ভাষার উপর আক্রমণের প্রতিবাদ করেন। তাঁর ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ বইটি মূলত ভ্রমণকাহিনি হলেও প্রচলিত ভ্রমণ কাহিনিগুলির থেকে একটু আলাদা। ইংল্যান্ডের মানুষের জাতীয়তাবোধ, তাঁদের জীবনের শিক্ষণীয় বিষয়গুলি তিনি এই বইয়ে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। হয়তো স্বদেশের করুণ ও নির্মম পরিস্থিতিই তাঁকে এই বই লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাঙালি আবার নতুন করে তার জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলুক, সেই আশার কথাই এই বইয়ে ধ্বনিত। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার তাঁর মৌলিক গবেষণা সম্বন্ধে জানতেন। তরুণ গবেষক আবদুল হাই-এর ইংরেজি ও বাংলা ধ্বনির তুলনামূলক আলোচনাগ্রন্থটির সবিশেষ প্রশংসা করেছিলেন তিনি।
আবদুল হাই ছিলেন এক জন সুদক্ষ সম্পাদকও। ‘সাহিত্য পত্রিকা’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় পত্রিকাটি মূলত তাঁর উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়। তাঁর সম্পাদনায় এটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি উচ্চ স্তরের গবেষণা পত্রিকা রূপেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এই পত্রিকাতেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন।
দীর্ঘ জীবন লাভ করেননি আবদুল হাই। ১৯৬৯ সালের ৩ জুন, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ঢাকার কাছে এক রেল দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। যে সময় দুই বঙ্গে ভাষাবিজ্ঞান চর্চা হাতে গোনা কয়েকটি মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেই সময় আবদুল হাই-এর মতো প্রতিভার অকালপ্রয়াণ নিঃসন্দেহে এক অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। আজ তাঁর শতবর্ষেও ক’জনই বা তাঁকে মনে রেখেছি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy