জিনিয়াস। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেলে দশ এপিসোডের ওই সিরিয়াল এখন বিজ্ঞানের জগতে আলোচনার বিষয়। সিরিয়ালের প্রযোজক হলিউড-খ্যাত রন হাওয়ার্ড, ব্রায়ান গ্রেজার এবং গিগি প্রিৎজকার। চিত্রনাট্য লিখেছেন কেন বিলার। চ্যানেলের ঘোষণা, এই প্রথম কোনও সিরিয়াল এগোল লিখিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী। ওটা আসলে এক বায়োপিক। কার? না, অনুমানের জন্য কোনও প্রাইজ নেই। বিজ্ঞানে যদিও অনেক জিনিয়াসের ভিড়, তবু সাধারণের চোখে ওঁদের মধ্যে বিশেষ এক জনই ওই অভিধায় পরিচিত। আলবার্ট আইনস্টাইন।
প্রথম এপিসোডের প্রথম দৃশ্যে এক ধাক্কা। সময় জুন ১৯২২। বার্লিনের রাস্তায় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারালেন জার্মানির বিদেশমন্ত্রী এবং আইনস্টাইনের বন্ধু ওয়াল্টার রাথনাউ। খুন করল নাত্সি যুবক। অর্থাৎ, জার্মানির মাটিতে অ্যাডল্ফ হিটলার নামে এক দৈত্যের পদধ্বনি। সে এক উত্তাল দিনকাল।
পরের দৃশ্য। কাট টু আইনস্টাইন। তাঁর পড়ার ঘর। বইঠাসা তাক। এক দিকে ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে হিজিবিজি ফিজিক্সের ফর্মুলা। সেই ঘরে বিজ্ঞানী। না, এখন তিনি কেতাবে ডুবে নেই। বরং তাঁর সঙ্গে এক জন। সেক্রেটারি বেটি ফ্রিডম্যান। মহিলা এবং আইনস্টাইন আলিঙ্গনাবদ্ধ। ওঁদের কথোপকথন।
আইনস্টাইন : আমার সঙ্গে থাকবে এসো।
বেটি : পারব না। আমি বিবাহিতা।
আইনস্টাইন : আমি তো বাখ এবং মোৎজার্ট দু’জনকেই ভালবাসি। তা হলে কেন তুমি এবং এলসা দু’জনকে কাছে রাখতে পারব না?
বেটি : আপনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে অনেক জানতে পারেন, তবে মানুষের ব্যাপারে কিছু বোঝেন না।
‘আ টেন্স সাইকোলজিকাল থ্রিলার, ফুল অব পলিটিকাল অ্যান্ড রোম্যান্টিক মেলোড্রামা’। সিরিয়াল সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস-এর মন্তব্য। মূল্যায়ন যথাযথ। ১০ বছর আগে প্রকাশিত ওয়াল্টার আইজাকসন-এর লেখা বেস্টসেলার ‘আইনস্টাইন, হিজ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স’ অবলম্বনে লেখা স্ক্রিপ্টে কিন্তু বিজ্ঞান পিছনে। সামনে তাঁর দিনকাল। সমাজ, রাজনীতি। আর ব্যক্তিজীবন। প্রেম-ভালবাসা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞানের বাইরে ব্যক্তি আইনস্টাইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ দশকের পর দশক যে ইমেজ মনে গেঁথে রেখেছিল, তা সন্ন্যাসীসুলভ। গবেষণার বাইরে তিনি যেন এক আপনভোলা বৈরাগী। ওই মূর্তি-প্রচারে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন দু’জন। বহু কাল ধরে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত সচিব হেলেন ডুকাস এবং অর্থনীতির প্রফেসর ও আইনস্টাইনের বন্ধু অটো নাথান। আইনস্টাইনের জীবনী-লেখকেরা বিজ্ঞানীর দলিলপত্র কী এবং কতটুকু ঘাঁটতে পারবেন, তা বহু কাল ঠিক করে দিতেন ওই দু’জন। আর, বলা বাহুল্য, ওঁরা চাইতেন যেন কোথাও বিজ্ঞানীর ভাবমূর্তিতে কোনও আঁচড় না লাগে।
ওঁদের প্রয়াণের পর অনেক মামলা-মোকদ্দমা করে জেরুজালেমে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকায় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস দখল নিয়েছে বিশাল আইনস্টাইন সংগ্রহশালার। গবেষণাপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, স্মরণিকা এবং হাজার হাজার চিঠি। নেওয়া হয়েছে বড়সড় উদ্যোগ। আইনস্টাইন পেপার্স প্রোজেক্ট। জীবনের পর্ব ধরে ধরে পর পর ছাপা হচ্ছে এক এক খণ্ড। মোট সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় তিরিশ। বেশ কিছু খণ্ড এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও অনেক বাকি।
প্রকাশিত নথিপত্রে ভাঙছে ভাবমূর্তি। প্রতিভাত হচ্ছেন রক্তমাংসের আইনস্টাইন। নিষ্ঠাবান গবেষক, সমাজ-সচেতন নাগরিক, জেদি এবং একরোখা পুরুষ। আর অবশ্যই, বহুগামী প্রেমিক। নতুন তথ্যে আলোকিত এই আইনস্টাইনকে তাঁর বইতে আইজাকসন তুলে ধরেছিলেন কিছুটা। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের সিরিয়ালে মিলেছে ওই বিজ্ঞানীর ঝলক।
আর তাতে চটেছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে মোক্ষম। আইনস্টাইন স্মরণীয় কিসে? নিশ্চয়ই বিজ্ঞানে। তা হলে তা পিছনে রেখে ব্যক্তিজীবন টানা কেন? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, সেক্রেটারির সঙ্গে আইনস্টাইনের মাখামাখিটা জানতেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এলসা। বেচারি সে কারণে ছেড়ে যাননি তাঁকে। কিন্তু, ও সব নাকি তুচ্ছ ব্যাপার। না দেখালেও চলত।
অতএব, বিতর্ক। চলত, না চলত না? আশ্চর্য, বিতর্কে যোগদানকারীরা কিন্তু এক বারও ভেবে দেখছেন না সিরিয়াল-নির্মাতাদের অভিপ্রায়। কী দেখাতে চাইছিলেন ওঁরা? আইনস্টাইনের দুনিয়া-বদলানো আবিষ্কার নিয়ে তো ডকুমেন্টারি আছে শয়ে শয়ে। আর একটা রিলেটিভিটির প্রাইমার বানানো তো উদ্দেশ্য ছিল না সিরিয়ালের। নির্মাতারা যে চাইছিলেন দর্শকদের রক্তমাংসের আইনস্টাইন উপহার দিতে। তা হলে?
ব্যক্তি আইনস্টাইনের মতো গবেষক আইনস্টাইনকেও এখন দেখা হচ্ছে ভিন্ন আলোয়। হ্যাঁ, একার চেষ্টায় বিশ্ববীক্ষায় যে পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি, বিজ্ঞানে তার নজির আর নেই। তিনি জিনিয়াসদের জিনিয়াস। কিন্তু তাঁকে অতিমানব ভাবা ভুল। গবেষণায় ভুল যে তাঁরও হত। হ্যাঁ, ভুল। সে সব ভুলের কথা এ লেখায়। তাঁর এক বিখ্যাত ভুলের শতবার্ষিকী এ বছর।
১৯১৭। জেনারেল রিলেটিভিটি থিয়োরি আবিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে এক বছরেরও বেশি আগে। তার ফর্মুলার দিকে তাকিয়ে খুশি হলেন না আইনস্টাইন। যদিও সে ফর্মুলার আবিষ্কর্তা স্বয়ং তিনি। নিজের উদ্ভাবনে অসন্তুষ্টি? আসলে জেনারেল রিলেটিভিটি হল মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটি ব্যাখ্যার থিয়োরি। আর সে ব্যাখ্যা আইজাক নিউটনকে নস্যাৎ করে। নিউটনের তত্ত্বে গ্র্যাভিটি হল দু’টো বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বল। আর তার ফলে বস্তু দু’টোর চলার পথের পরিবর্তন। আইনস্টাইন-উদ্ভাবিত জেনারেল রিলেটিভিটিতে গ্র্যাভিটি কোনও আকর্ষণ বলই নয়। তা বরং অন্য ব্যাপার। কী? আইনস্টাইনের গণিত দেখাল, কোনও জায়গায় বস্তু থাকলে সে বস্তু তার চারপাশের শূন্যস্থানকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। সে দোমড়ানো জায়গার মধ্যে অন্য বস্তু এসে পড়লে, তার চলার পথ বেঁকে যায়। স্পেস নিজে দোমড়ানো, তাই দ্বিতীয় বস্তুর চলার পথ বাঁকা। কতটা পদার্থ চারপাশের স্পেসকে কী পরিমাণ দোমড়াবে, তা বলে দেয় জেনারেল রিলেটিভিটির ফর্মুলা।
তো সেই ফর্মুলার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তির কারণ আছে বইকী। গোটা ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে ওই ফর্মুলা কাজে লাগালে যে বিপদ! পদার্থ থাকলে স্পেস দোমড়াবে। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এত পদার্থ। তা হলে তাদের প্রভাবে ব্রহ্মাণ্ডের আয়তন তো সংকুচিত বা প্রসারিত হওয়ার কথা। বিশ্ব স্থিতিশীল হওয়ার কথা নয়। অথচ অ-স্থির বিশ্ব আইনস্টাইনের মন মানতে চায় না। আর তিনি তা মানেনই বা কী করে, ব্রহ্মাণ্ডের সংকোচন বা প্রসারণের কোনও চিহ্নই যে তখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনও পরীক্ষায় ধরা পড়েনি। কী করা যায়?
১৯১৭ সালে ব্রহ্মাণ্ডকে স্থিতিশীল রাখার উপায় বের করলেন আইনস্টাইন। কল্পনা করলেন এমন এক বলের, যা রিলেটিভিটির দরুন ব্রহ্মাণ্ডকে দুমড়ে সংকুচিত হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে। অর্থাৎ, সে বল আকর্ষণের উলটো— বিকর্ষণ। তা ব্রহ্মাণ্ডকে প্রসারিত করতে চায়। স্পেস দুমড়ে সংকোচনের বিরুদ্ধে প্রসারণ। দুয়ে মিলে ব্যালান্স। ব্রহ্মাণ্ড স্থির। প্রসারণমুখী ওই বিকর্ষণ বলের নাম আইনস্টাইন দিলেন ‘কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট’। ওই জিনিসটাকে রিলেটিভিটির ফর্মুলায় ঢুকিয়ে ফর্মুলাটাকেই পালটে ফেললেন আইনস্টাইন।
১৯২০-র দশকের শেষ ভাগ। জ্যোতির্বিজ্ঞান পরীক্ষা দিল নতুন খবর। ব্রহ্মাণ্ড হুহু করে প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ, তা অ-স্থির। আইনস্টাইনের মনে হল, মিছেই ব্যালান্সিং ফ্যাক্টরের কল্পনা করেছেন তিনি। রিলেটিভিটির ফর্মুলা থেকে সরিয়ে দিলেন কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট। ভাবলেন, বড় ভুল হয়েছিল তাঁর।
না, তা হয়নি। ১৯৯৮ সালে দু’দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে যা জেনেছেন, তা বিস্ময়কর। ওঁরা দেখেছেন, ব্রহ্মাণ্ড যে প্রসারিত হয়ে চলেছে তা শুধু নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রসারণের স্পিডও আবার বাড়াচ্ছে। আগে যে সময়ে ব্রহ্মাণ্ড আয়তনে বেড়েছে যতটা, এখন তা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি। ভবিষ্যতে বাড়বে আরও বেশি।
আবিষ্কারে হইচই পড়েছিল চার দিকে। কৃতিত্বের জন্য ২০১১ সালে দু’দলের তিন বিজ্ঞানী পেয়েছেন ফিজিক্সের নোবেল প্রাইজ। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট-কে নিজের ভুল ভাবাই ভুল হয়েছিল আইনস্টাইনের!
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনস্টাইন বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন দার্শনিক আর্নস্ট ম্যাক-এর চিন্তায়। ম্যাক বিশ্বাস করতেন বিশ্ব অপরিবর্তনীয়। ওই মতের শরিক না-হলে প্রসারণশীল ব্রহ্মাণ্ড, এবং সেই সুবাদে কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্বের জন্মের কথাও প্রথম বলতে পারতেন তিনি। ব্রহ্মাণ্ড যদি ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলে, তবে সুদূর অতীতে কোনও এক দিন তা নিশ্চয়ই সংকুচিত অবস্থায় ছিল। ছিল বিন্দুবৎ। সেই দশা থেকে শুরু হয়েছিল প্রসারণ। তো তখন জন্ম হয়েছিল এই বিশ্বের। হ্যাঁ, এ দাবি বড় বেশি ধর্ম-ঘেঁষা। যেন ওই ঈশ্বরের ইচ্ছাক্রমে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম। বিজ্ঞানী হিসেবে ও দাবি মানতে চাননি আইনস্টাইন। দাবি হোক না ধর্ম-ঘেঁষা, বিজ্ঞানের গণনায় যদি তার সমর্থন মেলে, তবে তা মানায় আপত্তি করা ভুল কাজ। সে ভুল করলেন আইনস্টাইন।
প্রসার্যমাণ বিশ্বের ধারণায় পৌঁছনোর মূলে অনেকের গবেষণা। আর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক জন। জর্জ লেমাইত্রে। জন্মসূত্রে বেলজিয়ান। পেশায় পাদ্রি। আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানীও। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় ভেস্টো স্লিফার লক্ষ করেন, ব্রহ্মাণ্ডে গ্যালাক্সিগুলো একটা আর একটার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ওই পর্যবেক্ষণে উৎসাহিত হয়ে ব্রাসেলস শহর থেকে প্রকাশিত এক জার্নালে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এক পেপার লেখেন লেমাইত্রে। তাতে আইনস্টাইনেরই আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটির ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে প্রমাণ করেন, মহাবিশ্ব ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে। ওই বছর ব্রাসেলস শহরে পদার্থবিদ্যার সম্মেলন। যোগ দিতে এলেন আইনস্টাইন। তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন লেমাইত্রে। জানালেন নিজের গণনালব্ধ ফলের কথা। শুনে আইনস্টাইনের মন্তব্য: ‘‘আপনার গণনা নির্ভুল, তবে ফিজিক্সের জ্ঞান বিচ্ছিরি।’’
সহযোগী: সত্যেন্দ্রনাথ বসু
বেচারা লেমাইত্রে। একে তো তাঁর পেপার ছাপা হল অখ্যাত জার্নালে। তার পর তা আবার ফরাসি ভাষায় লেখা। তাই তা নজরে পড়ল না বেশি গবেষকের। তা পড়ল চার বছর পরে ১৯৩১ সালে। যখন ওই পেপারের ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হল ‘মান্থলি নোটিসেস অব দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটি’ জার্নালে। পেপার পড়ে অনেকে বুঝলেন যে প্রসার্যমাণ বিশ্বের ধারণায় ভুল নেই। আশ্চর্য, তাতেও কিন্তু দমলেন না আইনস্টাইন। পরিবর্তনশীল ব্রহ্মাণ্ড তাঁর চোখে এতই অপাঙ্ক্তেয় যে, কোনও এক মুহূর্তে বিশ্বসৃষ্টি তিনি মানতে পারেন না। কোনও এক মুহূর্তে বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বের নাম পরে হয়েছে বিগ ব্যাং থিয়োরি। আইনস্টাইনের দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে গবেষকরা সম্প্রতি জেনেছেন, ওই ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দেও আইনস্টাইন চেষ্টা করেছেন বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিরোধিতার। কী ভাবে? আইনস্টাইন তখন আমেরিকায়। বেড়াতে গিয়েছেন। ওখানকার হোটেলের নোটপ্যাডে মিলেছে তাঁর লেখা পেপারের খসড়া। তাতে দেখা যাচ্ছে, আইনস্টাইন তত দিনে মেনে নিয়েছেন প্রসার্যমাণ ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। কিন্তু মানতে পারছেন না কোনও এক মুহূর্তে বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপার। প্রসার্যমাণ বিশ্বকে অপরিবর্তিত রাখা যায় কী করে? যদি সেই বিশ্বের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে জন্মায় নতুন নতুন পদার্থ, তবে সে ব্রহ্মাণ্ড থাকতে পারে এক রকম। ওই খসড়া প্রবন্ধে আইনস্টাইন চেষ্টা করলেন এটা দেখাতে যে, কী ভাবে প্রসার্যমাণ ব্রহ্মাণ্ডে তৈরি হতে পারে নতুন নতুন কণা। ওই রচনা অবশ্য কোথাও ছাপতে পাঠাননি তিনি। কারণ, কিছু দূর এগিয়ে আইনস্টাইন বুঝতে পারেন, গণনায় ভুল হচ্ছে তাঁর।
ও রকম ভুল করে পরে আইনস্টাইন তা বুঝতে পেরেছেন আরও এক ব্যাপারে। কী? হ্যাঁ, এই ২০১৭ সালে যে বিষয়ে ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হল, সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শূন্যস্থানের মধ্যে কোনও কিছুর তরঙ্গাকারে বিস্তার (যেমন শব্দ বা আলো) নয়, খোদ শূন্যস্থানের তরঙ্গ বা কাঁপন। শূন্যস্থানের নিজের পালাক্রমে এক বার প্রসারণ ও পর মুহূর্তে সংকোচন। এর মূলে মহাকর্ষ থাকে বলে ওই ক্রিয়ার নাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। ওই তরঙ্গ আসলে শূন্যস্থানের প্রসারণ ও সংকোচনের তরঙ্গাকারে বিস্তার। আইজাক নিউটন মহাকর্ষের যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তাতে ও রকম তরঙ্গের অস্তিত্ব নেই। মহাকর্ষ ব্যাখ্যায় আইনস্টাইনের তত্ত্বে (জেনারেল রিলেটিভিটি) ওই তরঙ্গ থাকা সম্ভব। সম্ভব হলেও তা এত সূক্ষ্ম যে, তা শনাক্ত করা খুব কঠিন। সে কাজে সাফল্যের জন্য এ বার নোবেল পেয়েছেন তিন পদার্থবিজ্ঞানী। তা পান, কিন্তু আইনস্টাইন নিজেই যে এক সময় ওই তরঙ্গ থাকা অসম্ভব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। আর, তা নিয়ে একটা হেস্তনেস্তও করে বসেছিলেন।
১৯৩৬। আইনস্টাইন এবং তাঁর সহকারী নাথান রোজেন লিখলেন এক পেপার। ‘ডু গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস এগজিস্ট?’ শিরোনামে ওই প্রশ্ন তুলে পেপারে দেওয়া হল উত্তর। বলা হল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। আইনস্টাইন এবং রোজেন পেপার ছাপতে পাঠালেন পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজিকাল রিভিউ’-তে। জার্নালে কোনও পেপার ছাপতে এলে নিয়মানুযায়ী তা পাঠানো হয় ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাছে। পেপারের গণনা বা প্রতিপাদ্যে কোনও ভুলচুক আছে কি না, তা দেখতে। বিশেষজ্ঞরা যদি বলেন যে কোথাও ভুল নেই, তবে পেপার ছাপতে যায়। আর যদি বিশেষজ্ঞরা ভুল বের করেন, তবে তাঁদের মন্তব্য সহ পেপার ফেরত যায় লেখকের কাছে। তিনি ভুল শুধরে দিলে পেপার যায় ছাপতে। আইনস্টাইন এবং রোজেন-এর লেখা পেপার ফিজিকাল রিভিউ-এর এডিটর পাঠালেন এক বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি খুঁত বের করলেন দু’জনের গণনায়। জার্নালের এডিটর বিশেষজ্ঞের মতামত সহ পেপার ফেরত পাঠালেন ওঁদের কাছে। সঙ্গে অনুরোধ: ওঁরা যদি বিশেষজ্ঞের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পেপার শোধরান, তবে এডিটর বাধিত হবেন।
চিঠি পেয়ে আইনস্টাইন গেলেন খেপে। জার্মানিতে থাকাকালীন তাঁর লেখা পেপার কোনও জার্নালের এডিটর বিশেষজ্ঞকে দিয়ে যাচাই করার কথা ভাবতে পারতেন না। তিনি প্রবন্ধ পাঠালেই তা ছাপা হত। আমেরিকায় অন্য নিয়ম। সে নিয়ম যে আইনস্টাইনের অজানা, তা টের পাওয়া গেল ফিজিকাল রিভিউ-এর এডিটরকে পাঠানো তাঁর চিঠিতে। তিনি লিখলেন, ‘আমি ও রোজেন আপনাকে একটা পেপার পাঠিয়েছিলাম ছাপার জন্য। আমরা আপনাকে অনুমতি দিইনি ছাপার আগে তা অন্য কাউকে দেখাতে। আপনার বিশেষজ্ঞের ভুল(!) মন্তব্যের জবাব দেওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। এই ঘটনার পর আমি পেপারটি অন্য কোথাও ছাপতে চাই।’ ব্যস, ওই চিঠির সঙ্গে ছিন্ন হল ‘ফিজিকাল রিভিউ’-এর সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক। আর কখনও ওই জার্নালে পেপার লিখলেন না তিনি।
কিন্তু ওই পেপারটির ভাগ্য? হ্যাঁ, আইনস্টাইন আর রোজেন তা ছাপলেন ফিলাডেলফিয়া থেকে প্রকাশিত ‘জার্নাল অব দ্য ফ্র্যাংকলিন ইনস্টিটিউট’ পত্রিকায়। এখানে ছাপা পেপারের সিদ্ধান্ত উলটো। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব আছে। আসলে ‘ফিজিকাল রিভিউ’ ফেরত পাঠানোর পর আইনস্টাইন এবং রোজেন নিজেরা বুঝতে পারেন, তাঁরা সত্যিই ভুল করেছিলেন পেপার লিখতে।
ব্ল্যাক হোল। আইনস্টাইনের বিখ্যাত ভুলের আর এক নমুনা। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যানালস অব ম্যাথমেটিক্স’ জার্নালে এক পেপার লিখলেন তিনি। শিরোনাম ‘অন আ স্টেশনারি সিস্টেম উইথ স্ফেরিকাল সিমেট্রি কনসিস্টিং অব মেনি গ্র্যাভিটেটিং মাসেস’। প্রতিপাদ্য স্পষ্ট। মহাশূন্যে ব্ল্যাক হোল— প্রচণ্ড ভারী বস্তু, যাদের করাল গ্রাস থেকে আলোও নিস্তার পায় না— থাকা সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার, ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আইনস্টাইন কাজে লাগালেন তাঁরই আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটি। এর কয়েক মাস পরে ‘ফিজিকাল রিভিউ’ জার্নালে এক পেপার লিখলেন দুই গবেষক রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘অন কন্টিনিউড গ্র্যাভিটেশনাল কনট্রাকশন’। প্রবন্ধের দাবি, ব্ল্যাক হোল তৈরি হওয়া সম্ভব। ওপেনহাইমার এবং স্নাইডার কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটির সাহায্যেই। এ কারণে আইনস্টাইন হলেন ‘ব্ল্যাক হোলের অনিচ্ছুক পিতা’।
আমাদের বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনে আইনস্টাইনের ভূমিকা কী, তা সবাই জানে। যে পেপারের সূত্রে সত্যেন্দ্রনাথ আজ জগৎপ্রসিদ্ধ, তা তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। আইনস্টাইনই ওটি জার্মানে অনুবাদ করে ‘জাইৎটশ্রিফ্ট ফুর ফিজিক’ জার্নালে ছাপান। গুরুর এই দাক্ষিণ্য জীবনে ভোলেননি সত্যেন্দ্রনাথ। এ ব্যাপারটা সবার জানা। যা অজানা, তা হল, সত্যেন্দ্রনাথের কোনও কোনও ধারণা আইনস্টাইন সমর্থন না করায় বাঙালি বিজ্ঞানীর দুঃখ। যা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন মনের কোণে। এ রকম এক দুঃখ এক বার তিনি ফাঁস করেছিলেন নিজের ছাত্র, বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষের কাছে। তার আগে অবশ্যই পার্থকে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করতে হয় যে, তিনি আর কাউকে তা জানাবেন না। ইতিহাস রক্ষার খাতিরে পার্থ সে প্রতিজ্ঞা ভাঙেন ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায়। পার্থ জানান, তাঁর পেপারে আলোর কণা ফোটনের এক ধর্মের কথা লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। আইনস্টাইন তা কেটে দেন। অথচ, সত্যেন্দ্রনাথ যে ধর্মের কথা বলেছিলেন, তা পরে শনাক্ত হয়। তখন কেন সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের ভুল ধরিয়ে দেননি? ছাত্র পার্থ এ প্রশ্ন করেছিলেন মাস্টারমশাই সত্যেন্দ্রনাথকে। তাঁর জবাব: ‘‘কে বলেছে ওই ধর্মের কথা, তাতে কী আসে-যায়? ধর্মটা শনাক্ত হয়েছে, তাই যথেষ্ট।’’ গুরুভক্তি? হবেও বা।
আইনস্টাইনের ভুল নিয়ে আলোচনা তাঁকে নিন্দা করতে নয়। এ ব্যাপারে শেষ কথাটি লিখেছেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ, ‘আইনস্টাইন নিশ্চয়ই বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী, আর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের এক জন। তাঁর ভুল নিয়ে কথা বলা হয়তো আত্মম্ভরিতা মনে হবে। কিন্তু অগ্রগণ্য বিজ্ঞানীদের সাফল্যের চেয়ে ভুলভ্রান্তি অনেক সময় বেশি দেখায় তাঁদের সময়ের ধ্যানধারণা। আমরা যারা ভুল করি, তারা একটু সান্ত্বনা পেতে পারি এটা ভেবে যে, ভুল আইনস্টাইনও করতেন। বুঝতে পারি, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বসূরিরা পির-পয়গম্বর নয় যে তাঁদের রচনা ধ্রুব সত্য বলে মানতে হবে। ওঁরা ছিলেন বড় বড় মানুষ। আমাদের জ্ঞানার্জনের পথ প্রশস্ত করেছেন।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy