ছবি: রৌদ্র মিত্র
আজন্মলালিত অবসাদ প্রতিস্পর্ধী চোখে তাঁকে জরিপ করেছে বার বার। তার হাতে ঝিকিয়ে ওঠে অস্ত্র। তরবারি নয়, বন্দুক নয়। আপাতনিরীহ একটি কলম। যার আঘাতে বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তিনি। কখনও বা পালাতে চেয়েছেন নিজেরই কাছ থেকে। বার বার জামা টেনে ধরেছে সেই নাছোড় কলম। পালানো যেমন হয়নি, ফেরাও হয়নি কখনও। যে বিষাদসিন্ধুতে তাঁর নিত্য অবগাহন, তারই জল থেকে উঠে এসেছে অমৃতের সন্তানরা। কখনও যার নাম গ্রেগর সামসা, কখনও জোসেফ কে। আর তিনি, ফ্রান্জ় কাফকা, বয়ে চলেন দানিয়ুবের স্রোতের মতো। এক লেখা থেকে অন্য লেখায়। এক নারী থেকে অন্য নারীতে।
বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন, তিনি লিখতে পারেন না। যা লেখেন, সবই ছাইভস্ম। তাই জীবনের শেষ লগ্নে এসে এক দিন স্তূপীকৃত জঞ্জালের মতো নিজের প্রায় সমস্ত পাণ্ডুলিপি তুলে দিয়েছিলেন বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের হাতে। বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পরে সব পুড়িয়ে দিয়ো।” ম্যাক্স বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন বটে। ভাগ্যিস ম্যাক্স কথা রাখেননি!
নারীসঙ্গ ছাড়া চলত না কাফকার। চল্লিশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে প্রেমে পড়েছেন বার বার। উজাড় করে ভালবাসতে চেয়েছেন। কিন্তু থিতু হতে পারেননি কারও সঙ্গে। ভেঙে গিয়েছে প্রেম। সরে গিয়েছেন বান্ধবীরা।
শুধু লেখা নয়— চেহারা, পৌরুষ, যৌন ক্ষমতা— নিজের সব কিছু নিয়েই ঘোর সংশয় ছিল তাঁর। দেখতে আহামরি কিছু নন। শয্যাতেও কি মেয়েদের কাঙ্ক্ষিত হতে পারবেন? হীনমন্যতা বরাবর তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাঁকে।
জন্মসূত্রে চেক কাফকা থাকতেন অবিভক্ত চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে। যৌনপল্লিতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। মজে থাকতেন পর্নোগ্রাফিতেও। যে যৌনতায় আনন্দ পেতেন, অবসাদ থেকে ক্ষণিক মুক্তি ঘটত, সেই যৌনতা নিয়েই ভুগতেন তীব্র পাপবোধে। নারীদেহের দাস হয়ে বেঁচে থাকতে চাইতেন না। আবার শরীরী তাড়নাকেও উপেক্ষা করা সম্ভব হত না। পাপবোধ নিয়েই যৌনতার কাছে ফিরে আসতেন বার বার।
যৌনতার গ্লানির সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছিল একের পর এক ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক। আর সেই সঙ্গে সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আপাতব্যর্থতা। তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিলেন বাবা হারমান কাফকা। ছেলের জীবনের প্রতিটি ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতেন তিনি। বাধ্য করতেন তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। আত্মবিশ্বাসহীন কাফকা বাবার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। বার বার অবসাদে ডুবে যাওয়ার পিছনে তাঁর বাবাও অন্যতম কারণ।
এক দিন বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাড়িতে গিয়ে তাঁরই আত্মীয়া এক তরুণীর প্রেমে পড়েন কাফকা। ফেলিৎসে বাউয়ার। বছর ছয়েক সম্পর্ক ছিল। দেখা হয়েছিল সাকুল্যে তিন থেকে চার বার। পুরো যোগাযোগটাই ছিল চিঠিতে। সেই চিঠিতেই নিজের মনের কথা, অবসাদের কথা, বিপন্নতার কথা উজাড় করে লিখতেন কাফকা। অথচ, ফেলিৎসে কখনও দেখা করতে চাইলে রাজি হতেন না। তাঁর মনে হত, একা না থাকলে লেখা যাবে না। আর প্রেম সেই একাকিত্বকে কেড়ে নিলেই তো সর্বনাশ!
ফেলিৎসেকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি (যা পরবর্তী কালে ‘লেটার্স টু ফেলিৎসে’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়) কতটা প্রেমপত্র আর কতটা কাফকার আত্মবিশ্লেষণ, তা নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। অধিকাংশ চিঠিরই ছত্রে ছত্রে যিনি ধরা দেন, তিনি প্রেমিকের থেকেও অনেক বেশি করে যন্ত্রণাবিদ্ধ এক মানুষ।
একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘...আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে তোমাকে ভালবাসি, প্রিয় এফ। এটুকু ভরসা আমার ওপরে করতে পারো। তবে বাকিটা জানি না। কারণ, আমি নিজেও নিজেকে পুরোটা চিনি না। আমার জীবনের পরতে পরতে অপেক্ষা করে চমক আর হতাশা।’
ফেলিৎসের সঙ্গে দু’বার বাগদান হয়েছিল তাঁর। কিন্তু দু’বারই কাফকা নিজে তা ভেঙে দেন। প্রথম বার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাবা হারমান কাফকা। আর দ্বিতীয় বার বাগদানের কিছু দিন পরেই ধরা পড়ে, লেখক যক্ষ্মায় আক্রান্ত। ফেলিৎসের সঙ্গে প্রেমপর্বের ওই ছ’বছরেই ‘দ্য মেটামরফোসিস’, ‘দ্য ট্রায়াল’, ‘দ্য স্টোকার’, ‘দ্য জাজমেন্ট’ এবং অসমাপ্ত ‘আমেরিকা’-র মতো একের পর এক লেখা বেরিয়েছে কাফকার কলম থেকে।
সম্পর্ক নিয়ে তিনি যে প্রবল আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগতেন, কাফকার বহু চিঠিই তার সাক্ষী। ফেলিৎসেকে এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ‘আমার মনে হয়, যে কোনও রকম সম্পর্ক তৈরিতেই আমি অপারগ, অসমর্থ।’ আর একটি চিঠিতে যেন অনেকটা সতর্ক করার ঢঙেই বলছেন, ‘এটা জেনে রাখো, আমার সঙ্গে থেকে নির্ভেজাল সুখ তুমি কখনওই পাবে না। তবে নির্ভেজাল কষ্ট যত খুশি চাও, পেতে পারো।’
পত্রনির্ভর এই প্লেটোনিক প্রেম যখন চলছে, তখনই নাকি গ্রেটা ব্লখ নামে ফেলিৎসেরই এক বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কাফকা। ম্যাক্স ব্রড দাবি করেছেন, গ্রেটার সঙ্গে রীতিমতো শারীরিক সম্পর্ক ছিল তাঁর বন্ধুর। ১৯১৪ সালে গ্রেটার যে ছেলে হয়, কাফকাই তাঁর বাবা বলে দাবি করেছেন ম্যাক্স। ম্যাক্সকে লেখা গ্রেটার কিছু চিঠিতে নাকি তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে। পরবর্তী কালে অবশ্য কাফকার জীবনীকারেরা এই তত্ত্বকে মানতে চাননি। তাঁদের বিশ্বাস, সন্তানটি কাফকার নয়।
সব চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হল, কাফকার যে পাঁচ প্রেয়সীর কথা জানা যায়, তাঁদের তিন জনই মারা গিয়েছেন হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। গ্রেটা ব্লখও তাঁদের এক জন। ১৯৪৪ সালে গেস্টাপোর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। ঠাঁই হয় অউশভিৎজ়-এ। তার পরে মৃত্যু।
ফেলিৎসে আর গ্রেটার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরেও জীবন বা সাহিত্য, কোনওটাই থেমে থাকেনি কাফকার। ১৯১৯ সালে চিকিৎসার জন্য এল্ব নদীর ধারে শেলসেন শহরে গিয়েছেন। সেখানেই পরিচয় এবং প্রেম ক্যানসার-আক্রান্ত ইউলি ওরিৎজেকের সঙ্গে। ইউলির সঙ্গেও বাগদান হয়েছিল কাফকার। কিন্তু সে বারেও বাবা হারমান বেঁকে বসায় হার মানলেন কাফকাই। যৌনতার বিষয়ে স্বাধীনচেতা ইউলিকে পছন্দ ছিল না বাবার। ১৯৪৪ সালে জার্মানরা চেকোস্লোভাকিয়ার দখল নিলে গ্রেটা ব্লখের মতো ইউলিরও ঠাঁই হয় আউশভিৎস-এ। সেখানেই মারা যান তিনি।
‘আপনার দ্য স্টোকার গল্পটি অনুবাদ করতে চাই। যদি অনুমতি দেন, বাধিত হব।’— প্রাগে লেখকের বাড়িতে এক দিন এল এমনই একটি চিঠি। প্রেরকের নাম মিলেনা ইয়েজেনস্কা। তরুণী। সুন্দরী। সাংবাদিক। নিবাস ভিয়েনা। কাফকা অনুমতি দিলেন, সঙ্গে নিজের হৃদয়টিও। ফেলিৎসের মতো মিলেনাকেও রোজ চিঠি লিখতেন কাফকা (‘লেটার্স টু মিলেনা’ নামে যার সঙ্কলন পরে প্রকাশিত হয়)। প্রেমের রাংতায় মোড়া অবসাদের আখ্যান। মিলেনার সঙ্গে তখন তাঁর স্বামীর সম্পর্ক তলানিতে। কাফকার সঙ্গে বার দুয়েক দেখা হয়েছিল তাঁর। কাফকা চেয়েছিলেন মিলেনা তাঁর সঙ্গে এসে থাকুন। কিন্তু মিলেনা বিবাহবিচ্ছেদে রাজি হননি। শেষমেশ সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন কাফকা। এই সম্পর্ক চলাকালীনই কাফকা লিখেছিলেন
‘দ্য ক্যাসল’।
মিলেনাকে একটি চিঠিতে কাফকা লিখছেন, ‘লিখিত চুম্বনেরা কখনও গন্তব্যে পৌঁছয় না। মাঝপথেই ভূতেরা এসে তাদের পান করে নেয়।’ আপাত রসিকতার আড়ালে এখানেও লুকিয়ে কাফকার বরাবরের সেই তীব্র আর অদ্ভুত এক নিরাপত্তাহীনতা। আর এক জায়গায় লিখছেন, ‘নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছে সংবরণ করতে করতেই জীবনটা কেটে গেল।’
পরবর্তী কালে জার্মান সেনা চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করলে গ্রেফতার হন মিলেনা। পরের বছরই তাঁকে পাঠানো হয় র্যাভেন্সব্রাক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। গ্রেটা এবং ইউলির মতো নাৎসিদের হাতে মৃত্যু হয় তাঁরও।
মিলেনার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে অসুস্থতা বাড়ল কাফকার। শরীর জুড়ে রাজত্ব করছে যক্ষ্মা। আর সেই ব্যাধিকেই ধীরে ধীরে জমি ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। তবু তারই মধ্যে আবার প্রেম। শেষ বারের মতো।
ডোরা ডিয়ামান্ট। ১৯২৩ সালে বাল্টিক সাগরের ধারে এক রিসর্টে আলাপ দু’জনের। পরিচয় প্রেমে গড়াতে দেরি হয়নি। নিঃসঙ্গ, অবসন্ন, অসুস্থ কাফকা তখন খড়কুটোর মতোই আঁকড়ে ধরেছিলেন ডোরাকে। অসুস্থতার জন্য তত দিনে ছেড়ে দিয়েছেন বিমা সংস্থার চাকরি। শরীরের লড়াই আর কত দিন চালাতে পারবেন, তাও জানতেন না। কিন্তু মনের লড়াইয়ে এই প্রথম এক সক্রিয় সহযোদ্ধাকে পেলেন। ম্যাক্স ব্রড যাঁকে কাফকার ‘জীবনসঙ্গী’ বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘ডোরার সঙ্গে আরও কিছু দিন আগে আলাপ হলে হয়তো ওর (কাফকা) বাঁচার ইচ্ছেটাও অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠত।’
বাবার সঙ্গে দীর্ঘ দিনের তিক্ত সম্পর্কে দাঁড়ি টানতে চাইছিলেন কাফকা। প্রাগ থেকে না বেরোলে তা যে সম্ভব নয়, তা-ও জানতেন। কিন্তু বাবাকে এতটাই ভয় পেতেন যে, সাহসে কুলিয়ে উঠত না। ডোরা তাঁর জীবনে আসার পরই প্রথম বার হাওয়ার বিপরীতে দাঁড় বাইতে সাহস পেলেন তিনি। বাড়ি ছেড়ে বান্ধবীর হাত ধরে চলে এলেন বার্লিনে। ছাড়লেন বলা ভুল, আসলে পালিয়ে এলেন। যাতে কেউ সন্দেহ না করে, তার জন্য সঙ্গে বিশেষ মালপত্রও নিলেন না। তবু, ওইটুকু সাহসও এত দিন জুগিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
সাহিত্যজগতে যে তাঁর কোনও ভবিষ্যৎ নেই, তত দিনে সে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে কাফকার। তবু হাতের কলম নামিয়ে রাখতে পারেননি। লিখে যেতেন লেখার নেশায়। যক্ষ্মায় ধুঁকতে থাকা সেই ব্যর্থ লেখকের সঙ্গেই বার্লিনে ছোট্ট সংসার পাতলেন দস্তয়েভস্কির ভক্ত ডোরা। তিনি একাই তখন রোজগেরে। প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। তবু অনটন ঘোচে না। কিন্তু সেই দিন আনি-দিন খাই অবস্থাতেই বয়ে যেত অনাবিল এক আনন্দধারা। ডোরা কাজে বেরোলে লেখার খাতা নিয়ে বসতেন কাফকা। বিকেলে প্রেয়সী ফিরে এলে তাঁকে বাহুডোরে নিয়ে পড়ে শোনাতেন পাণ্ডুলিপি। কখনও হয়তো ক্লেইস্টের বই থেকে পড়ে শোনাতেন ডোরা। আবার গ্যেটের বই থেকে কবিতা পড়তেন কাফকা।
অবসাদহীন কাফকা? তা-ও কি হয়? ওই বিষাদসিন্ধুই তো তাঁর আশ্রয়। কিন্তু ডোরার সঙ্গে সংসার পেতে এই প্রথম মনখারাপ থেকে ছুটি নিলেন তিনি। কঠিন দারিদ্রের মধ্যেও আনন্দে ছিলেন দু’জনে। খবরের কাগজ কেনারও সামর্থ্য ছিল না। রাতের নিভন্ত মোমের আগুনে সকালের রান্না গরম করতেন ডোরা। জ্বালানির জোগানও যে অপ্রতুল। আবার সেই মোমের আলোতেই আঙুলের ছায়া দেওয়ালে ফেলে শিশুদের মতো খেলায় মেতে উঠতেন দু’জনে। ডোরা বলেছিলেন, ‘‘দেওয়ালে আঙুলের ছায়া নিয়ে খেলতে খুব ভালবাসত ফ্রান্জ়। দেখে মনে হত, বহু দিন ধরে এটাই করে আসছে। অবসাদ ওর জন্মগত বৈশিষ্ট্য ছিল না।’’
ডোরার সঙ্গে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন কাফকা। প্যালেস্টাইনে গিয়ে রেস্তরাঁ খোলার পরিকল্পনাও করেছিলেন দু’জনে। ঠিক হয়েছিল, সেই রেস্তরাঁয় ডোরা হবেন রাঁধুনি আর ‘মেটামরফোসিস’-এর স্রষ্টা হবেন ওয়েটার। সে আশা পূর্ণ হয়নি। কারণ কাফকার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে দ্রুত। ১৯২৪-এর শুরুতে বার্লিনে তখন শীত। কাফকার প্রবল জ্বর। একা ডোরা তাঁকে আগলে রেখেছেন। সেবাযত্ন করছেন। কিন্তু কাফকার বাড়ির লোকজনের কাছে খবর পৌঁছতে দেরি হল না। তাঁরা এসে আবার প্রাগে নিয়ে গেলেন কাফকাকে। কাফকার সেখানে মন টেকে না। দিনে অন্তত দুটো করে চিঠি লেখেন ডোরাকে।
এর কয়েক মাস পরে এপ্রিলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যক্ষ্মা ছড়িয়ে গিয়েছে স্বরযন্ত্র পর্যন্ত। ঠিক হল, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে ভিয়েনার কাছে এক হাসপাতালে। কাফকার পরিবার খবর পাঠাল ডোরাকে। ডোরা ছুটে এলেন।
হাসপাতালেও অবস্থার উন্নতি হল না। গলার যন্ত্রণায় কথা বন্ধ। সামনে দাঁড়ানো ডোরাকে কাগজে লিখে জানাতেন মনের কথা। ওই অবস্থাতেই ডোরার বাবাকে চিঠি লিখলেন কাফকা। ‘আপনার মেয়েকে ভালবাসি। বিয়ে করতে চাই।’ ডোরার বাবা ধর্মপ্রাণ ইহুদি। রাবাইয়ের পরামর্শ নিয়ে জানিয়ে দিলেন, এ বিয়ে সম্ভব নয়। ডোরা বাবার অমতেই বিয়েটা করে ফেলতেন, কিন্তু ওই অবস্থায় কাফকার পক্ষে বিয়ের ধকল নেওয়া সম্ভব ছিল না।
জীবনের নড়বড়ে সাঁকোটা যে এ বার পেরিয়ে যেতে হবে, তা বুঝতে পারছিলেন কাফকা। ও পারে কী আছে, তিনি জানেন না। আর যা-ই থাক, ডোরা নেই সেখানে! চিকিৎসক ডক্টর ক্লপস্টক-এর সঙ্গে রোগীর সঙ্গে এক গোপন বোঝাপড়া হয়েছিল। তিনটি উপায়ের কথা ভেবেছিলেন কাফকা। এক, তাঁকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে। দুই, ডোরা ও তিনি একসঙ্গে মারা যাবেন। তিন, তাঁর অন্তিম মুহূর্ত আসার আগেই ডোরাকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যাতে কাফকার মৃত্যুযন্ত্রণা তাঁকে দেখতে না হয়। ডাক্তার তৃতীয় ব্যবস্থাটি মেনে নেন।
সেই মতো ১৯২৪ সালের ৩ জুন ডাকবাক্সে চিঠি ফেলার অছিলায় বাইরে পাঠানো হল ডোরাকে। কিন্তু তাঁকে না দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন কাফকা। তাঁর অনুরোধেই দৌড়ে গিয়ে ডোরাকে ডেকে আনলেন কেউ। প্রিয়তমের জন্য এক তোড়া ফুল কিনেছেন ডোরা। সেটা হাতে নিয়েই এলেন কাফকার সামনে। চোখ বেয়ে নামছে অঝোর ধারা। ধীর পায়ে বসলেন রুগ্ণ শরীরটার পাশে।
সময় বেশি নেই। সাঁকোয় পা রেখেছেন সাহিত্যিক। ও পারে অন্ধকার এক জগৎ। এ পারে ডোরার বাহুডোর। চোখ বুজে এল তাঁর। তবু এক বার তাকালেন ওই মুখখানা দেখবেন বলে। কান্নায় গলা বুজে এল ডোরার। মৃদু হাসলেন সাহিত্যিক। ফুলের ঘ্রাণ নিতে মাথাটা তুললেন এক বার। কপালে খেলে গেল ডোরার আদর।
নিস্পন্দ দু’টি চোখে অবশেষে নেমে এল সারা জীবনের কাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি। আজ আর কোনও অবসাদ নেই। আজ আর কোনও ভয় নেই। আজ আর কোনও দুঃখ নেই।
ডোরা আর বিসর্জিত পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তাদেরও যে পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy