প্রণয়ী: লাল কানওয়ার। শিল্পীর তুলিতে যেমন
যমুনায় সন্ধে ঘনাচ্ছে। জলে অদ্ভুত মায়াবী আলোর খেলা। বজরা, নৌকায় ভেসে যাচ্ছে মানুষের দল। অদূরেই রাজপ্রাসাদ। ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে দুজনে, সোহাগে-আদরে নিবিড়।
নিভৃতে কথা বলছেন ওঁরা। যমুনায় মায়া-খেলা দেখে হঠাৎ অদ্ভুত আবদার প্রণয়ীর। জানো, আমি কোনও দিন নৌকাডুবি দেখিনি! এটুকুই যথেষ্ট। মুহূর্তের মধ্যে এত দিন না দেখা নৌকাডুবির দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। দূরে শোনা গেল ডুবন্ত মানুষের অসহায় আর্তনাদ। প্রেয়সীর (মতান্তরে স্ত্রী) দিকে তাকিয়ে প্রেমিক হাসেন, গর্বের হাসি!
কথিত, এক বার নাকি এই প্রেয়সীর ইচ্ছেতেই হঠাৎ ফয়াজ ক্যানালের দু’ধারে থাকা সমস্ত বড় বড় গাছ কেটে ফেলার নির্দেশ দেন প্রেমিকটি। এমনই নানান লোকশ্রুতি প্রচলিত এই যুগলের নামে। প্রেয়সীর নাম লাল কানওয়ার। অনেকের মতে, তিনি মিঞা তানসেনের এক উত্তরাধিকারী। প্রেয়সীর এমন খামখেয়ালিপনা মেটাতে পারেন যে প্রেমিক, তিনিও সাধারণ কেউ নন। আওরঙ্গজেবের নাতি, বাহাদুর শাহের পুত্র, মুঘল বাদশা জাহান্দার শাহ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দুজনের প্রণয়ের সূত্রপাত কী ভাবে, তা নিয়ে ইতিহাস নীরব। শোনা যায়, কানওয়ার ছিলেন এক জন ‘কলাওয়ান্ত’, নৃত্য-গীতে পারদর্শী শিল্পী, এক মজলিসে কানওয়ার হিল্লোল তোলেন বাদশার মনে। সম্পর্কের সেই শুরু। সেই হিল্লোলে ভর করেই কানওয়ারের উত্থান প্রায় উল্কার গতিতে। হয়ে গেলেন ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয়দের এক জন।
কেমন ছিল এই ‘ক্ষমতা’, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সরবুলন্দ খান বাহাদুরকে আমদাবাদের অন্যতম শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হল। তীব্র বাধা এল উজির ও অন্যান্য কর্তাদের কাছ থেকে। কারণ, সরবুলন্দের বাদশা ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বাদশার সিদ্ধান্তে নড়চড় হয় না। সরবুলন্দের নিয়োগ যে কানওয়ারের পছন্দে! কানওয়ারের বন্ধু, আত্মীয়রাও একে একে প্রশাসনের বড় বড় পদ পেতে থাকলেন। যোগ্যতা নয়, কানওয়ারের নেক-নজরে থাকাই সাফল্যের এক মাত্র মাপকাঠি।
কানওয়ারের এমন প্রতাপও অন্তত দু’বার বেশ মিইয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা, লাল কানওয়ারের ভাই নিয়ামত খান কলাওয়ান্তকে মুলতানের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগকে কেন্দ্র করে। কানওয়ারের প্রভাবে বাদশা উজিরকে নিয়োগপত্র তৈরির নির্দেশ দেন। উজির জুলফিকর খান প্রমাদ গুনলেন, এই লোককে শাসনভার দিলে তো রাজ্য লাটে উঠবে! তিনিও ছক কষলেন। সে যুগে এক বিশেষ রীতি ছিল— নিয়োগপত্র দেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় অর্থ বা উপঢৌকন পাঠাতে হত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। জুলফিকর এক আজব আবদার করে বসলেন নিয়ামতের কাছে, ‘এক হাজার সারেঙ্গি চাই।’ নিয়ামত কোনও মতে দুশোটা জোগাড় করেই রণে ভঙ্গ দিলেন, অনুযোগ করলেন লালের কাছে। লালও বাদশার কানে বিষ ঢালা শুরু করলেন। বাদশা জাহান্দার উজিরকে তলব করলে জুলফিকর বলেন, সঙ্গীতজ্ঞকে শাসনকর্তা করা হলে তো যুদ্ধাস্ত্র ছেড়ে সারেঙ্গিই হাতে ধরতে হবে! এর পরে অবশ্য কথা বাড়েনি।
প্রকৃত গুণীর কদরের জন্য মুঘল বাদশাদের সুনাম ছিল, জাহান্দারের আমলে এক ঘটনায় তা ধুলোয় গড়াগড়ি খেল। কানওয়ারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন জুহারা নামে এক মহিলা। এক বার হাতির পিঠে চেপে এক সরু গলি দিয়ে সঙ্গী পরিবৃতা জুহার চলেছেন। উল্টো দিক থেকে পালকিতে আসছিলেন হায়দরাবাদের বিখ্যাত আসফজাহি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং আওরঙ্গজেব, ফারুখশিয়রদের কাছের লোক, নিজাম-উল-মুলক চিনকুলিচ খান। অপরিসর রাস্তায় সামান্য ধাক্কা লাগল কানওয়ারের সঙ্গীদের সঙ্গে, জুহারার সঙ্গীরা নিজামকে বলে বসেন ‘অন্ধের পুত্র’। এই সূত্রে দ্বন্দ্ব। এক দিকে কানওয়ার-বাদশা। উল্টো দিকে উজির, নিজাম, ফারুখশিয়র।
এ সব থেকেও শিক্ষা নেননি যুগল। মুঘল সাম্রাজ্যের আলোকসজ্জা চিরকালই নজরকাড়া। কানওয়ারেরও তা খুব পছন্দ। প্রেয়সীর পছন্দ জেনে বাদশা নির্দেশ দিলেন, মাসে তিন বার হবে আলোর রোশনাই। কথিত আছে, এই রোশনাইয়ের জৌলুস না কি এতটাই ছিল যে রাজ্যে তেলের অভাব তৈরি হয়। তবে তাতেও জাহান্দারের কাছে কানওয়ারের কদর কমেনি, বরং বেড়েছে। বাদশা তাঁকে ‘ইমতিয়াজ মহল’ শিরোপা দেন। বার্ষিক হাতখরচ হিসেবে দেওয়া হতে থাকে বর্তমান মূল্যে প্রায় দু’কোটি টাকা। এই বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করেন আওরঙ্গজেবের কন্যা, জিনাত-উন-নিশার মতো কেউ কেউ। কিন্তু তাতে জাহান্দারের সঙ্গে পরিজনদের সম্পর্ক খারাপ হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি।
তবে এত কিছুর মধ্যেও এই যুগল স্মরণীয় তাঁদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার জন্য। ফকির-দরবেশ-সন্ত-পুরোহিত-পণ্ডিতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন দুজনে। দশেরার অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও দেখা যেত তাঁদের। মুক্ত হস্তে দান-ধ্যানেও কমতি ছিল না।
দুজনের এই সুখ সইল না। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ায় আগরার অদূরে যুদ্ধক্ষেত্রে ফারুখশিয়রের কাছে বিধ্বস্ত হলেন জাহান্দার। তাঁকে উদ্ধার করে দিল্লি নিয়ে এলেন লাল কানওয়ারই। ছদ্মবেশ ধরেছিলেন বাদশা, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। দিল্লিতে ফারুখশিয়রের সেনার হাতে ধরা পড়লেন জাহান্দার। খবর পেয়ে বিধ্বস্ত লাল কানওয়ারও চাইলেন জাহান্দারের সঙ্গে কারা-যাপন করতে। অনুমতি মিলল। তাঁকে দেখে জাহান্দার বললেন, ‘‘অতীতকে মনে রেখে আর কী লাভ! এস, আমরা সর্বশক্তিমানের শরণ নিই।’’
নতুন বাদশার কাছ থেকে খুনের পয়গাম নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করলেন কয়েক জন জল্লাদ। কী হতে চলেছে, আন্দাজ করলেন কানওয়ার। প্রেমিকের জীবনভিক্ষা চাইলেন। মিলল পদাঘাত। গড়িয়ে পড়লেন সিঁড়ি দিয়ে। এর পরেই জাহান্দারের মুণ্ডচ্ছেদ!
সুহাগপুরায় পাঠিয়ে দেওয়া হল লাল কানওয়ারকে। আশ্চর্য, তাঁর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আর কোনও তথ্য বা লোকশ্রুতি মেলে না। তবে তাঁর অদ্ভুত প্রেমকাহিনি বুকে নিয়ে জেগে আছে তাঁর সমাধি। জাকির হুসেন রোডের উপরে, দিল্লি গলফ ক্লাবের কাছে ‘লাল বাংলা’ বলে যে সমাধিক্ষেত্রটি রয়েছে, সেখানেই লাল শায়িত আছেন বলে মনে করা হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy