Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

লকডাউন উঠলেও এমনটা হবে তো

বিরাট কোহালির চুল কেটে দিচ্ছেন অনুষ্কা শর্মা। গৃহকর্তা ঘর মুছছেন, বাসন মাজছেন। করোনা চলে যাওয়ার পরেও কি এ দৃশ্য দেখা যাবে, না কি সবাই ফিরবে পুরনো অভ্যেসে? লকডাউন শুরু হতে না হতেই মালতীর মা, মিনুমাসির আসা বন্ধ হয়ে গেল।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০০:০৯
Share: Save:

ও দিকে ফাইভ স্টার নাপিতের মাথায় হাত! অনুষ্কা শর্মা খবরের কাগজ ফুটো করে পরিয়ে বিরাট কোহালির বাহারের চুল কেটে দিচ্ছেন, আবার উঠতি হার্টথ্রব কার্তিক আরিয়ান ঝাঁট দিয়ে সাফ করছেন বাড়ি ঘরদোর। নিন্দুকে বলবে, শুধু কোটিপতি দেখলে হবে না, কেরানির ঘরেও ইনস্টাগ্রাম তাক করুন! বাঙালি গেরস্থের কুঠুরিতেও এখন পুরুষরা রান্না করছে, বাসন মাজছে, রুটি বেলছে। এবং এ সব কার্য সম্পাদন করে কী বীরের কেল্লাই না সব ফতে! ফেসবুক পোস্ট, টিকটক ভিডিয়ো, ইউটিউব লিঙ্ক— বাজার ছেয়ে গেল। আর ঈশ্বর ও প্রমীলা বাহিনী অলক্ষে ফিকফিক হাসিল।

এত দিন শত আন্দোলন, দিস্তা দিস্তা তথ্য, তর্ক-বিতর্ক, সেমিনার, সবাই মিলে ফেমিনিস্ট বলে শতেক গাল খেয়েও যা করতে পারেনি, তা এক করোনা এসে ধাঁ-যোগে করে দিল। লকডাউন শুরু হতে না হতেই মালতীর মা, মিনুমাসির আসা বন্ধ হয়ে গেল। আপিস বন্ধ হল, ‘বাড়ি থেকে কাজ’ করার সুযোগ মিলল এবং সঙ্গে ফাউ— বাড়ি-ঘর সামলানোর দায়ভার। এত দিন গিন্নি ও তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট তড়িঘড়ি ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, টিফিন বানিয়ে কর্তামশাইকে টিপটপ অফিস পাঠিয়ে, ছেলেমেয়েদের স্কুল রওনা করে, তার পর কেউ নিজে অফিস গিয়েছেন কেউ বা বাজার-দোকান-ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিস সেরে ফের বিকেলের জলখাবার, ছেলেমেয়েদের কোচিং দেওয়া-নেওয়া কিংবা স্কুলের হোমটাস্ক করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সারা দিন অফিস করে হা-ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন কর্তা, চা খেয়ে তার একটু পরে ডিনার করে শুতে গিয়েছেন। মাঝে টিভিতে খবর শুনে দেশের-দশের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়েছেন।

কিন্তু যাঃ! করোনা এসে একখানি মহাপ্যাঁচ দিল! বাড়ি থেকে টুকটাক অফিসের কাজ, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেদার সিনেমা-সিরিজ়ের মজা, ছেলেপুলের স্কুলের ঝামেলা নেই, এমনকি বাজার যাওয়াও নেই! এত সুখ কি কপালে সয়! এখন বাড়ির কাজে গিন্নিকে সাহায্য করো। ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে কর্তাটি কেবল ঝাঁট দেওয়া, মোছায় পারদর্শী নন, বাসন এমন মাজছেন যে বৌ থালা উল্টে আয়নার কাজ সেরে নিচ্ছেন মাঝে মাঝে। অনেকে বলছেন, সংসারের বাসিন্দা সংসারের কাজ করবে, এতে বিস্মিত হওয়াটাই তো প্রগতি-বিরোধী। হাসি-মজা ছেড়ে, অ্যাদ্দিন করেনি কেন, সেই হিসেব তলব করুন ভগিনিগণ! বৌ ভাল ঝাঁট দিলে সাতজন্মে মেডেল দেওয়া হয়েছে? বরং যতই কাজ করুক, স্বামীকে এতটুকু তোল্লাই না দিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিন, বৌদের কী থ্যাংকলেস জব করতে হয় দিনের পর দিন। সাত হাজার রাতে ভাল রান্না করলে কণামাত্র প্রশংসা নেই, এক দিন মাছের ঝাল বিগড়ে গেলে ব্যাঁকা ব্যাঁকা কথার হাট বসে যায়। এখন তা হলে অত ফুলমার্কসের প্রদর্শনী কেন?

ফেমিনিস্ট হোন বা না হোন, গিন্নি সম্প্রদায় এই পরিবর্তনে খুশি। শুধু সাহায্যের হাত পেয়েছেন বলে নয়, স্বামী সম্প্রদায় ঘরকন্নার কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন বলেও। হয়তো একটা ঐতিহাসিক ন্যায়বিচারের ইঙ্গিত সত্যিই আছে, অথবা স্রেফ নতুনত্বের ছোঁয়া। তবে ছেলে-গোষ্ঠী এতে রাগত, বিরক্ত না দুঃখিত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অনন্ত রসিকতা চলছে হোয়াটসঅ্যাপে, কিন্তু তা বলে কেউই ফিউডাল দাপট দেখিয়ে, ‘ছি, আমি বাসনে হাত দেব!’ গোছের সিংহবিক্রম প্রকাশ করছেন না। বরং এগিয়ে আসছেন, কাজ শিখে নিচ্ছেনও। দায়িত্ববোধ, দায়ে পড়ে রাজি হওয়া, দ-য়ে পড়ে ঢোক গেলা— এ কাণ্ডের কারণ যা-ই হোক না কেন, এই কার্যই তো আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, তাই না? স্বামী স্ত্রীকে বলছে, ‘তুমি অফিসের কাজ সারো, আমি কাপড় মেলে আসছি’, বা কর্তার মধ্যে সুপ্ত শেফ আত্মপ্রকাশ করছে ভেজ-বিরিয়ানির মাধ্যমে— এ সব বিপ্লবেরই তো আমরা সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলাম। শাঁখ-ঘণ্টা ছাড়াই সমানাধিকার এসে দোরগোড়ায় দাঁড়াবে, আমরা শাড়ির খুঁটে আনন্দাশ্রু মুছব, দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করব। কিন্তু হাত তুলতে গিয়ে খচ করে একটু খটকাও লাগছে।

এই পরিবর্তনটা কি স্থায়ী মানসিক পরিবর্তন? সত্যিই কি অনেক ছেলে এই করোনার পাল্লায় পড়ে মনে করছেন, আমাদের সব কাজে সমান ভাবে দায়িত্ব ও শ্রম ভাগ করে নিতে হবে? মনে করছেন, ‘মেয়েলি’ কাজ করার মধ্যে কোনও রকম গ্লানি নেই? তাঁরা কি সত্যিই, ‘এক জন দুঁদে পুরুষ অফিসার পেঁয়াজ কাটছেন’, এই দৃশ্য দেখে ‘এতে হাসির কী আছে?’ বলার মতো শিক্ষিত হয়ে উঠছেন? করোনা আমাদের নিত্যি জীবনে অনধিকার প্রবেশ করে আমাদের ল্যাজে-গোবরে করে যে বিভিন্ন নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে এবং করছে, তা কি আমাদের সঙ্গে এ বার অনন্ত কাল থেকে যাবে? করোনা চলে যাওয়ার পরেও, ছেলেরা কি এমনই অনায়াসে ঝাঁট দেবেন এবং মেয়েরাও তা দিব্যি মেনে নেবেন? (ছেলেরা কাজ করলে যে অস্বস্তি শুধু ছেলেদেরই হয় তা ভুল। বহু মেয়েই মনে করেন, পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা ও চেঁচিয়ে অন্য ঘর থেকে বৌকে ডেকে সামনের কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দিতে বলা ছেলেদের জন্মগত অধিকার।) লকডাউন ওঠার পর, অফিস শুরু হওয়ার পর, স্বামী অফিস থেকে ফিরেই রান্নাঘরে ঢুকবেন? ঘরকন্নার কাজ ভাগ-বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রটি একই থাকবে? খুব সম্ভব, না। তখন চাকা আবার ফিরে যাবে, যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই।

যদিও আজ স্বামীটি রান্নাঘরে ঢুকে বিলক্ষণ মালুম পাচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী কতটা অসহ্য আঁচে ও তাতে সারা দিনটা থাকেন। বুঝতে পারছেন, ও বাবা, আলু ছাড়াতে এতটা সময় লাগে, তা হলে তো ‘আলুর দম দিতে বললাম যে!’ বলে একটু পর থেকেই চেঁচামেচি জোড়া উচিত নয়। বুঝতে পারছেন, বাসনের ডাঁই গোছাতে গোছাতে শারীরিক শুধু নয়, মানসিক ক্লান্তিও কতটা থাবা বসায়। কিন্তু যখন এই দায় আর থাকবে না, তখন এই বোধ, এই সমানুভূতি কাজ করবে কি? না কি করোনার জন্য হঠাৎ পাওয়া এই নতুন জীবনটাকে নেহাত একটা ফান-এক্সপেরিমেন্ট, কিংবা লাইফ লেস্‌ন-এর হাবিজাবি ক্র্যাশ কোর্স হিসেবে দেখে, ফিরে যাবেন আগের জীবনে? অজুহাত থাকবে— অফিসে বিরাট চাপ, বসের মেজাজ খারাপ, ক্লায়েন্টকে ডেলিভারি দিতে হবে, না হলে কোম্পানির ক্ষতি? কেউ কেউ নিশ্চয়ই আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, সদিচ্ছাও থাকবে (আর এ কথা তো অবশ্যই সত্যি, কয়েক জন পুরুষ বাড়ির কাজে এমনিতেই হাত লাগান, সকলকে সাহায্য করার অভ্যেস তাঁরা বহু দিন থেকেই আয়ত্ত করেছেন, করোনার জন্য অপেক্ষা করেননি), কিন্তু বেশির ভাগ পুরুষ কি আর ঘর মোছার ন্যাতা ছোঁবেন, যেখানে করোনা মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য বসে নেই? বিবেক? হ্যাঁ সে একটু কুটকুট কামড়াবে বইকি, কিন্তু সে সব সামলাতে অফিস যাওয়ার সময়টুকু অনুতাপের জন্য বরাদ্দ করাই যথেষ্ট।

আর মেয়েরা? তাঁরা এত দিন অফিস-বাড়ি দুই-ই এক সঙ্গে চালিয়ে এসেছেন, ছেলেমেয়ের লাঞ্চ গোছাতে গোছাতে ফোনে সেরে নিয়েছেন প্রেজ়েন্টেশনের লাস্ট-মিনিট কারেকশন, বাচ্চার আয়া না এলে বাচ্চাকে কাঁচুমাচু মুখে বন্ধুর বাড়ি রেখে অফিস গিয়েছেন, বাচ্চার অসুখে তিনিই অফিস কামাই করেছেন, বাচ্চার বাবা নন— এই স্বল্প ভেকেশন ফুরোলে তাঁদের আবার ফিরতে হবে এই জাঁতাকলে। তখন কি খুব রাগ হবে, বিরক্তি বেড়ে যাবে? রোল রিভার্সাল স্থায়ী হল না বলে, স্বামীদেবতা বন্ধু থেকে ফের প্রভু হয়ে উঠলেন বলে, খ্যাচখ্যাচ করতে ইচ্ছে হবে? কক্ষনও না, তখন আরও এক বার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে করতে হবে সেই পুরনো কথাটিই, বহু দিনের উপলব্ধিটিই, তিনি যাঁকে বিয়ে করেছেন তাঁর বেড়ে ওঠায় গলদ আছে। সেই ছেলেটির হাউসওয়াইফ মা, বা চাকুরিরতা মা, তাঁকে সংসারের ‘মেয়েলি’ আঁচ বাঁচিয়ে বড় করেছেন। স্বামীদের বেড়ে ওঠার ডিএনএ-ই ডিফেক্টিভ। যদি বা কোনও ছেলে এ ধাঁচা বদলে নিতে চান, ’খোকার মা’ তখনই বলে ওঠেন, “চায়ের কাপটা তোকেই ধুতে হল?” কিংবা, “এঁটো তোলার কি আর কেউ নেই?” এ সব কথা ক্লিশে, কিন্ত এ সব আছে বলেই ক্লিশেরাও বহাল তবিয়তে আছে।

তাই, ‘করোনা এসে বাধ্যতামূলক ভাবে অনেকের রোল বদলেছে’, এই বাক্যে, ‘বাধ্য’-টা জ্বলজ্বল করছে। করোনা যদি পুরনো ধারা বদলে সত্যিই মানুষকে বিবর্তিত করতে পারে, তা হলে অতি উত্তম। কিন্তু আমাদের এই পোড়া সমাজে, শাস্তির ভয় ছাড়া কোনও ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে বদলেছে কি? বসের অপমান না থাকলে ডেডলাইন মানে ক’জন কর্মী? ৪৯৮এ না থাকলে পণের বলি আরও অনেক মেয়ে হত না কি? এত নারী ও শ্রমিক আন্দোলনের পরেও সমাজে যে যার অধিকার, যে যার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছে কই? তর্কের খাতিরে যে সব পরিবর্তনের কথা গলার শির ফুলিয়ে বলা হয়, সেটা সামগ্রিক চিত্রের মাত্র এক কণা। সেই পরিবর্তন অবশ্যই কাম্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই পরিবর্তন বহু পরিশ্রমের ফল, নাগাড়ে লড়াইয়ের ফল, ক্রমাগত সমাজকে প্রশ্ন করার ফল, সহমর্মিতার পাঠ পড়ানোর ফল।

এত বছরের এত পরিশ্রমে সমাজ যত ইঞ্চি এগিয়েছে, তার চেয়ে ঢের গুণ বেশি এই কয়েক মাসের লকডাউন এক ঠেলায় এগিয়ে দেবে, ব্যাপার এত সহজ নয়। এ হচ্ছে স্টপগ্যাপ বোধোদয়। যেই পরিস্থিতি স্টপ হবে, গ্যাপ বেড়ে যাবে। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে মনে পড়বে, বাড়িতে যে থেকেই গেল বা বাড়ি যে সামলাচ্ছে, তাকে সেই রান্না, টিফিন, মালতী মাসির না আসা— সব হ্যাপা পোয়াতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে কী? সারা দিন তো হট হট করে কত কিছুই মনে পড়ে। তাতে আমাদের ক্রিয়াকর্ম বদলায় কতটা? সুগার-প্রেশারের রুগি কি জানে না তার রোজ সকালে মর্নিংওয়াক করা উচিত আর রেড মিট খাওয়া উচিত নয়?

তাই এগুলো আসলে মজা। ব্যবস্থা টেম্পোরারি জেনে, কয়েক দিনের সীমায় পরিস্থিতিটা আটকে আছে জেনে, ইচ্ছে করে একটু প্রশ্রয়। নিজের খাটাখাটনিকে, স্ত্রীর স্বাধীনতাকে, বাড়ি চালানোর জন্যে সব কাজের সমান মর্যাদাকে। একটু মহানুভবতা, একটু ‘আহা রে’ মার্কা মায়া, একটু অশান্তি এড়ানোর পদ্ধতি। ঠিক যেমন লকডাউন উঠে গেলে বিরাট কোহালি আর অনুষ্কা শর্মার কাছে চুল কাটবেন না, তেমনই রামবাবু আর সীতাবৌদির হেঁশেল ঠেলবেন না। ওটা আপৎকালীন ব্যবস্থা। কেটে গেলেই, আপদ গিয়েছে বলে, সবাই আগের অবস্থানে ফিরে যাবেন। সুতরাং এখনই হুররে রবে, “সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে” বলে উদ্বাহু নেত্য করার সময় আসেনি। সে নেত্য ফেসবুকে পোস্ট করার ইচ্ছে থাকলে অবশ্য আলাদা কথা।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Virat Kohli Anushka Sharma
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy