উদয়াস্ত: সংসারে আর একটু সুরাহার জন্যই এভাবেই মাথায় ভার তুলে নেন শ্রমিকবৌরা।
টালির চালের নীচে হাঁড়ি কড়াই উনুন ঘুঁটে কয়লা ঝুলকালির সংসার। শুরু হয়েছিল বাইশ বছর আগে। এই দ্বীপেরই পরশমণি গ্রাম থেকে সুবর্ণা মণ্ডলের লাক্সবাগানের শ্বশুর বাড়ি আসা। কিন্তু বাইশ বছর টানা একই দ্বীপে ওই টালির নীচে সংসার করা হয়নি। চামড়ায় রোদে পোড়া দাগ। হাড়ভাঙা খাটুনিতে শরীরের বাঁধুনি আলগা। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। বাইশ বছরে মাঝে সাত মাস, আট মাস, দেড় বছর, দু’বছর করে অনেক বছর কেটেছে টিন, অ্যাসবেস্টাস, ঢালাই সিমেন্ট... নানা রকম ছাদের তলায়। আবার কখনও নির্মীয়মাণ বাড়ির কোনও এক খোলা দেওয়ালের ঘরে চট প্লাস্টিক টিন টাঙিয়ে। সে সব সুন্দরবনের এই সাতজেলিয়া দ্বীপের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বিদ্যাধরী, মাতলা ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে আন্দামানে। কখনও আন্দামান, কখনও নিকোবর, কিংবা হ্যাভলক। ওর ভাষায় সে সব বিদেশ।
সন্তান এসেছে গর্ভে বার বার। ভারী পেট নিয়েও লেবারের কাজ করে গেছে। সন্তান প্রসব করেছে। কোনওটা বেঁচেছে। কোনওটা মরেছে পেটেই। বেঁচে থাকা সন্তানদের কেউ কেউ একটু বড় হতে না হতেই চলে গেছে লেবার বাবা-মায়ের সঙ্গে দূরতর দ্বীপে। বাকি সন্তানরা থেকে গেছে ফেলে যাওয়া সংসারে, প্রতিবেশীর বা পিসি-মাসির দেখাশোনায়। অপেক্ষা করেছে বাবা-মায়ের ফেরার।
সিমেন্ট বালি মাখার কাজে গিয়ে মাখামাখি সম্পর্ক করতে চেয়েছে অন্যান্য পুরুষ লেবার। সুবর্ণা বলেছিল, “ও সব বিদেশে এ লাইনে মেয়েমানুষদের সৎ থাকা কঠিন। ধরেন গিয়ে, একটা লেবার আর একটা হেল্পার মেয়েছেলে কাজ করতে গেল কোনও ফাঁকা বাড়িতে। মানে সে বাড়ি তৈরি হচ্ছে তখন। ওইখানে তো দূরে দূরে বাড়ি। প্রথমেই তো আর বলবে না তোমার সাথে প্রেম করব, ভাব-ভালবাসা করব। দুপুরবেলা টিফিন টাইমে এক ঘণ্টা রেস্ট। তখন এই গল্প করতে করতে বলল, ‘বৌদি, আপনেরে বেড়াতে নিয়ে যাব।’ সেরম মেয়েমানুষ হলে মুখের উপর জবাব দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে। আর ঠিকেদারগুলোও অনেক সময় খুব বদ হয়। যাদের সাথে ধরেন গিয়ে, একটু মাখামাখি, তাদের দিয়ে কম খাটাবে, দুটো ইট কম তোলাবে। তাদের কম কাজে বেশি পয়সা। আর যখন চেকপোস্টে গিয়ে কাজ করতে হয় তখন তো চেকপোস্ট অবধি গিয়ে, সেইখান থেকে কোথায় পাঠাবে তার ঠিক নেই! সেই একলা একটা ব্যাটাছেলে মিস্ত্রির সঙ্গে চলে যেতে হবে বাসে করে। আন্দামানে তো টেরেন চলে না! ভোর অন্ধকার থাকতে উঠে রান্ধাবাড়া সেড়ে টিফিনকারিতে ভাত-তরকারি ভরে নিয়ে চললাম। আবার অন্য রকম বদমাইশিও করে ঠিকেদারগুলো। প্রথম পনেরো দিন ধরেন দিনের পয়সা দিনে দিনে দিয়ে দিল। বিশ্বাস জন্মাল মনে। কুড়ি দিন বাদ থেকে আর দিল না। আবার ধরেন, ছয় হাজার বলে কাজ করিয়ে চার হাজার ধরিয়ে দিল। এক বাড়িতে ভোর ছয়টা থেকে কাজে লেগেছি, রাত বারোটা অবধি ঢালাইয়ের কাজ। কী বৃষ্টি! হাঁটু অবধি জলে দাঁড়িয়ে কাজ করে গেছি। এক কাপ চা দেয়নি সে বাড়ির লোক। দুপুরে এক বেলা যা খেয়েছি ওই! কী করব! কত টাকা চোট গেছে। ঝগড়া ঝামেলা করব! ও সব করলে আর কে কাজ দেবে? খাওয়াবে কে বিদেশে?”
বিয়ের পর থেকে প্রতি বার লেবার স্বামীর সঙ্গে সুবর্ণা চলে গেছে আন্দামানে। সুবর্ণার চার ছেলেমেয়ের জন্ম ওর লেবারের কাজে ঢোকার পরেই। কাজটা জোগাড়ের। স্বামীর সঙ্গে গেলেও এক সঙ্গে কাজ নয়। সেখানে কখনও ভাড়া ঘর, কখনও লেবার ক্যাম্প। তিন পাশ টিন মাথায় টিন। শুধু শোয়া যায় তাতে।
সুবর্ণার জীবনে ঠিকাদারের প্রেম ভালবাসা আদৌ কি এসেছিল? এলে এই শ্রমিকবৌয়ের হাড়ভাঙা খাটুনি তাতে কিছু কমেছিল কি? এ সব উত্তর আর দিতে পারেনি মুখ ফুটে। তবে যতটুকু বলেছিল তাতে বোঝা গিয়েছিল, কনস্ট্রাকশন সাইটে জোগাড়ে হিসেবে কাজের বদলে অন্য কাজে লাভ হয়েছিল সামান্য বেশি।
যে বছর বড় তিন ছেলেমেয়েকে ছেড়ে রেখে ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল আন্দামানে, টানা ছিল দু’বছর। ভোর থেকে রাত মাথায় গামছা বেঁধে শাড়ির উপর শার্ট চাপিয়ে ইট তোলে, সিমেন্ট বালি মেশায়, মাখা সিমেন্ট বালিতে ভারী কড়াই তুলে দেয় ঘড়াঞ্চি চড়ে। ওর ছোট্ট মেয়ে ওর পায়ে পায়ে ঘোরে। সুবর্ণার সঙ্গে সেও সিমেন্টের ধুলোয় ধূসর হয়ে যায়, রোদের তাপে তেতে ওঠে, বৃষ্টির জলে চুপচুপে ভেজে। লেবারদের টিফিন-টাইমে থালা হাতে দাঁড়ায় মায়ের সঙ্গে খাবারের লাইনে। আন্দামানের ঝড় জল সিমেন্টের ধুলো-বালি আর দু’বেলা কোনও রকমে খাবার খেয়ে চার বছরের শৈশব কাটে। সাইটের মধ্যেই সুবর্ণার কাজের বদল হয় ঠিকাদারকে ধরে করে। আরও দুই বিধবা লেবার আর এই সন্তান-সহ সধবা সুবর্ণার ভেতর কে রাঁধুনির কাজ পাবে, তা নিয়ে ঠিকাদারকে তদবির করতে হয়েছিল অনেক। শেষে সুবর্ণার আর্জি টিকে যায়। সুবর্ণা পেল জোগাড়ের বদলে রাঁধুনির কাজ। আর বাকি দুই বিধবা মহিলা রাঁধুনির জোগাড়ের কাজ। সুবর্ণার মেয়ে পেল ধুলো সিমেন্ট রোদ বৃষ্টির বদলে তেল কালি ধোঁয়া তাপ ভর্তি রান্নাঘর। লাক্সবাগানের সুবর্ণার সামনে তখন বিশাল বিশাল উনুন জ্বলছে। কোমরে গামছা জড়িয়ে দু’হাতে কালো কড়াইয়ে বিশাল লোহার খুন্তি নাড়ছে সে। দেড়শো-দু’শো লোকের রান্না। তিন বেলা।
রবিবারের রুটিন আরও অদ্ভুত। রাত দেড়টা থেকে রান্না শুরু। ভোর পাঁচটার মধ্যে রেডি হতে হবে। পাঁচটা থেকে লেবাররা লাইন দেবে থালা হাতে। সে দিন লেবারদের ডিউটি ভোর ছ’টা থেকে দুপুর দুটো, অন্য দিন শুরু আটটা থেকে। তাই দেড়টার বদলে রাত তিনটে থেকে রান্নার জোগাড় শুরু। তবে রবিবারগুলোই ছিল সুবর্ণার পক্ষে সৌভাগ্যের।
ভাগ্য কিছু বদলাল রান্নার কাজ করতে করতেই। সাইটের দু’শো আড়াই’শো লেবার খেতে আসে, তাদের ভাত-ডাল-তরকারির সঙ্গে আর একটা বস্তুর চাহিদা যে খুব বেশি, তা আন্দাজ করেছিল সুবর্ণা। রান্নাঘরের পাশে লেবার-ক্যাম্পে আড়াই হাজার লোক থাকে। সমুদ্র-ঘেরা দ্বীপে পরিবার ছেড়ে আসা লেবারেরা সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর যা চায়, সুবর্ণা সেই বস্তুটিরই জোগান দিল হাতে হাতে।
সুবর্ণা হাসতে হাসতে বলল, “মালের ব্যবসা করতাম, একটু পয়সার মুখ দেখেছিলাম তাই। রবিবার লেবারদের খড়চি পাওয়ার দিন। সে দিন মাল বিক্রিও হত বেশি।”
মাল বলতে নাম, লেবেল ছাড়া চোলাই। সুবর্ণার মুখে শোনা, আন্দামানে মদের কারখানা নেই। সব যায় চেন্নাই থেকে। পেঁয়াজ রসুন মরিচের সঙ্গে কাচের শিশিতে করে যায়, ভাটুবস্তির বাজারে বিক্রি হয়।
দুপুরবেলা লেবার ক্যাম্প ফাঁকা। লেবাররা সব তখন কাজে গিয়েছে সাইটে সাইটে। সেই ফাঁকা দুপুরে সুবর্ণা রওনা দিত ভাটু বস্তির বাজারের দিকে। ব্যাগে ভর্তি করত বোতল। আড়াইশো, সাড়ে সাতশো, এক লিটার, নানা সাইজ়ের বোতল। চোলাই বোঝাই ব্যাগ এনে চলে যেত পিছনের জঙ্গলে। যেখান থেকে ও জ্বালানির কাঠ কেটে আনে। ও দিকে কেউ বিশেষ যায় না। সেই জঙ্গলে বোতল লুকিয়ে রেখে এসে রান্নার আয়োজন শুরু করত। বড় বড় হাতা খুন্তি হাতে রান্না করছে, আর পেটটা অনেকখানি ফুলে আছে। যেন ন’মাসের প্রসূতি। আসলে সুবর্ণার পেটে তখন আটটা-দশটা চোলাই ভর্তি বোতল গামছা দিয়ে জড়িয়ে আঁট করে বাঁধা। ওই ভারী পেট নিয়ে ও উঠছে বসছে নড়ছে চড়ছে। পেটের মধ্যে বোতলের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ করে নড়ছে চোলাই। উনুনের আঁচে রান্নার তাপে ঘামে ভিজে যাচ্ছে সুবর্ণার পেটে বাঁধা গামছা।
লেবারদের সামনে জঙ্গল থেকে নিয়ে আসার উপায় নেই। বোতল চুরির ভয়। রান্নাঘরে বা নিজের ঘরে রাখলেও পুলিশের ভয়। শাড়ির আঁচলে সামান্য গা ঢাকা দিয়ে পিছন ফিরে বার করে দিত সেই বোতল। কখনও আস্ত বোতল। কখনও ভেঙে গ্লাসে ঢেলে বিক্রি।
“তিনশো টাকার মাল কিনে সতেরোশো আঠেরোশো টাকার ব্যবসা করেছি। বোতল ভেঙে বিক্রিতে লাভ বেশি,” বলতে বলতে হাসিতে ভরে ওঠে শ্রমিকবৌয়ের মুখ। মুখের হাসি মিলিয়ে যায় পরক্ষণেই, “আমি প্রথম শুরু করেছিলাম ওই ব্যবসা। আমার দেখাদেখি ছয় জন শুরু করে দিল। লাভ কমে গেল। পুলিশে ধরার ভয়ও বাড়ছিল। বুঝলাম, পিছোতে হবে এ বার। যেই পিছোলাম, তার সাত দিনের মধ্যে একটাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল।”
তার পর ওই লেবার ক্যাম্পের রবি সোম মঙ্গল বুধে সুবর্ণার রোজগারের ফারাক রইল না। সুবর্ণা এই বর্ষায় অপেক্ষা করে আছে লকডাউন শেষের। ফের দূর দ্বীপে কোনও বাড়ি তৈরির ইট মাথায় তোলার।
এই নোনা মাটির দ্বীপ থেকে প্রতি দিন কত কত মেয়ে-বৌ এই সাতজেলিয়া দ্বীপের সুকুমারি ঘাট থেকে ফেরিতে চেপে বসে। গোসাবা, কুমিরমারি, বালি, ছোট মোল্লাখালি, পাথরপ্রতিমা থেকেও রওনা দেয়। পাড়ার জামাই, দুঃসম্পর্কের আত্মীয়, ঠিকাদার বা স্বামীর সঙ্গে। সাধুপুরের চোদ্দো বছরের মেয়েটা ফিরেছিল কোনও এক বদ্ধ ঘর থেকে। গিয়েছিল দিল্লি। গৃহস্থালির কাজে। পাড়ার জামাইবাবু ছিল দিল্লির মেয়ে পাচারের এজেন্ট। খাঁড়িতে কাঁকড়া ধরতে যাওয়া বাবা পাড়ার জামাইয়ের সঙ্গে সেজ মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছিল এতগুলো পেট চালানোর অন্য উপায় না পেয়ে। কোনও রকমে বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে পাড়ার মামা কানাই মণ্ডলকে বুথ থেকে ফোন করে। ফিরেছিল এক মাস পর, প্রতি দিন প্রতি রাতে বহু শরীরের অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে। সুকুমারির ঢাকি নিতাই মণ্ডলের মেয়ে আর ফেরেনি। ও গিয়েছিল পাড়া-বেপাড়ার বারো জন মেয়ের সঙ্গে। অন্য রাজ্যে। বাসন মাজা ঘরমোছার কাজে। পাড়ার ঠিকাদার ক্যানিং পৌঁছে দিয়েছিল। তার পর হাত বদল। অন্য দশ জন ফিরেছে। বাকি দু’জন কোথায় আছে, কী ভাবে আছে জানা যায়নি আর।
দেশে লকডাউন হয়। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বাচ্চা কোলে শ্রমিক বৌ-মেয়েদের অন্য রাজ্য থেকে পায়ে হেঁটে, ট্রেনে ট্রেনে ফিরতে দেখা যায়। কখনও স্বামীর সঙ্গে, কখনও পাড়ার দাদা ভাই কাকা জামাইবাবুর সঙ্গে। আর কে যে ফিরল না, মাঝপথে কোথায় চলে গেল, খোঁজ পাওয়া যায় না আর। নদীর জোয়ারে নোনা কাদামাটি নরম হয়ে গেলে ম্যানগ্রোভ শিকড়, কাণ্ড মাটিতে ডুবিয়ে দেয়। ভাটায় আবার বেরিয়ে আসে লবণাম্বুজের শিকড়, শ্বাস নেয় খোলা বাতাসে। নোনা ডাঙাকে জলে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয় মাটিতে শিকড় আঁকড়ে। টালি টিন অ্যাসবেস্টাসের চাল ছেড়ে মেয়েরা তখন রওনা দেয় আকাশের নীচ দিয়ে। বাঁচতে, বাঁচাতে বা মরতে…
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy