লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি।
চোদ্দো-পনেরো শতকের কথা। প্লেগের প্রকোপে গোটা ইউরোপ তখন বিধ্বস্ত, আজকের করোনা-বিপর্যয়ের মতো সে দিনও ইটালি ধুঁকছিল রোগের প্রভাবে। দেশের ভেনিস বন্দরে প্রবেশ করা প্রতিটি জাহাজকে বাধ্যতামূলক ভাবে চল্লিশ দিন অপেক্ষা করতে হত এবং প্রমাণ করতে হত যে সেই জাহাজের সমস্ত নাবিক সুস্থ। তবেই তাদের ভেনিস বন্দর ও ইটালির মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হত। চল্লিশ দিন অপেক্ষার রীতি তৎকালীন ইটালির চিকিৎসকরা প্রচলন করেছিলেন প্লেগের মতো মহামারির হাত থেকে বাঁচতে। ল্যাটিন ভাষায় চল্লিশ দিন মানে কোয়ারেন্টিনা, যে শব্দ পরে প্রতিটি মহামারিতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা আজকের করোনা-আক্রান্ত পৃথিবীতে ‘কোয়রান্টিন’ হিসেবে আবালবৃদ্ধবনিতার মুখের বুলি হয়ে উঠেছে।
সেই সময় ইউরোপের মানুষ বিশ্বাস করত যে, দূষিত বাতাসের কারণেই সমস্ত মহামারি ছড়ায়। তারা এই দূষিত বাতাসকে বলত ‘মায়জমা’। তাদের এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ছিল এক রকমের অন্ধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস দূর করতে পারেননি বিজ্ঞানীরাও। আঠারো-উনিশ শতকের আগে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি, তাই ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাসের কথা জানতেও পারেননি চোদ্দো-পনেরো শতকের বিজ্ঞানীরা। প্রতিটি মহামারিতেই মানুষ স্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যেত, পূজা-প্রার্থনার মাধ্যমে রোগ থেকে বাঁচার কথা ভাবত। সেই সময় সাধারণ মানুষের প্লেগ সম্পর্কে ধারণা ছিল ‘বিষাক্ত বাষ্প, হৃদয়ের শত্রু’, অর্থাৎ মন্দ বাতাসেই ভেসে আসে মানুষের দুঃসময়। এর হাত থেকে বাঁচতে মানুষ সুগন্ধি রুমাল কিংবা সুগন্ধযুক্ত ফুলের পাপড়ি রেখে দিত জামার পকেটে বা ভাঁজে। অনেকে আবার বিভিন্ন লতাপাতার ও সুগন্ধি তেলে ভেজানো ছোট পুঁটলি হাতে নিয়ে পথ চলত, মাঝে মাঝে তার ঘ্রাণ নিত।
১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইটালির মিলানে ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল, যার রেশ প্রায় দু’বছর টিকে ছিল। এমনিতেই ইটালির মিলান শহর ছিল উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। মানুষ এখানে দিনরাত্রি আনন্দমুখর সময় কাটাত। উত্তর ও পশ্চিমে আল্পস পর্বতমালা, তার পিছনেই ফ্রান্স, চার দিকে নদী দিয়ে ঘেরা মিলান শহরে এক লাখের উপর মানুষ বাস করত। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পণ্ডিতরা অসাধারণ বক্তৃতা দিতেন, শিল্পী লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি সেখানেই ব্যস্ত ‘ভার্জিন অব দ্য রকস’ বা ‘লা বেল ফেরোনিয়া’-র মতো ছবি আঁকতে। তাই প্লেগ ছড়িয়ে পড়তে স্বাভাবিক ভাবেই হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হল। সুস্থ মানুষরা দলে দলে শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করল। মিলানের রাস্তায় রাস্তায় তখন কেবল মানুষের পচাগলা মৃতদেহ। রাস্তায় বা গলিতে বেরতে হলে মানুষকে নাকে কাপড় চাপা দিতে হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছেও কোনও সুরাহা নেই এই রোগ আটকাবার। শহরের প্রশাসনিক কর্তা, চিকিৎসাকর্মী আর সাফাইকর্মীদের মিলিত উদ্যোগে অসুস্থ মানুষদের আলাদা করে, মৃতদের কাপড় জামা, মলমূত্র পুড়িয়ে ফেলে রোগের হাত থেকে বাঁচার পথকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। শহরে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জনের প্লেগে মৃত্যু হচ্ছিল সেই সময়। জানা যায়, চতুর্দশ শতকে শুধু প্লেগের প্রকোপেই ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়।
সেই সময়ের মিলানের শাসক লুদোভিচ, তাঁর সমস্ত সভাসদদের নিয়ে শহর পরিত্যাগ করেন। তিনি শহর ত্যাগের সময় প্রিয় শিল্পী লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির কাছেও প্রস্তাব রাখেন মিলান ছেড়ে চলে যাওয়ার, কিন্তু লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি থেকেই গেলেন প্লেগবিধ্বস্ত মিলানের স্পোরজ়া প্রাসাদের স্টুডিয়োতে, তার কয়েক জন প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে। দিনরাত বিনিদ্র চিন্তায় ডুবে থাকলেন প্লেগের হাত মুক্তি পাওয়ার উপায় সন্ধানে। সতর্কতার সঙ্গে মিলানের অলিতে গলিতে ঘুরে তিনি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, মিলানের মহামারির প্রাদুর্ভাবের পিছনে লুকিয়ে আছে পরিকল্পনাহীন নগরব্যবস্থা। শহরের সঙ্কীর্ণ রাস্তাঘাট প্রায় সময়ই আবর্জনায় পরিপূর্ণ। তার উপর পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা খুবই খারাপ, তাই সমস্ত রাস্তায় উপচে পড়ে নোংরা জল।
স্টুডিয়োয় ফিরে এসেই লিয়োনার্দো একটা নকশা তৈরি করে ফেললেন আধুনিক মিলান নগরের, যেখানে থাকবে উন্নত পয়ঃপ্রণালী, জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বড় বড় রাস্তা, প্রশস্ত মূল সড়ক এবং একটি বৃহৎ লকগেট-সহ সেচখাল। সেচখালের সাহায্যে উন্নত নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা, মালপত্র পরিবহণ এবং নিকাশি ব্যবস্থাকেও পোক্ত করার কথা ভেবেছিলেন তিনি। শহরের উঁচু স্থানে ধনী ব্যক্তিদের বসবাসের ভবন, সঙ্গে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থার নির্দেশও ছিল তাঁর পরিকল্পনায়। লিয়োনার্দো গোটা শহরকে ধৌত করার জন্য একটি উন্নত যন্ত্রের পরিকল্পনা করেন, তার নকশাও প্রস্তুত করেন। নগর সভ্যতা আরও উন্নত করতে বায়ুকলের সাহায্যে ফুল-ফলের বাগান তৈরির কথাও পরিকল্পনায় ছিল।
তার পর এক সময় প্লেগের প্রকোপ কমে এল মিলানে, মানুষ ধীরে ধীরে শহরে ফিরতে শুরু করল। মিলানের শাসক লুদোভিচ লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির কাছে ফিরে এলেন এবং তার প্রিয় শিল্পীর নকশা অনুযায়ী স্থপতি ও নির্মাতাদের নিয়োগ করলেন মিলানকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে। নতুন নতুন অট্টালিকা নির্মাণ করা হল, শহরের রাস্তাগুলোকে ভেঙে আরও প্রশস্ত করে তৈরি করা হল এবং সুন্দর করে বাঁধানো হল। উদ্যান, বাগিচা, মূর্তি, স্তম্ভ, ফোয়ারা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হল মিলানকে। সাধারণের মানুষের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন লিয়োনার্দো। তাঁর স্পোরজ়া প্রাসাদও হয়ে উঠল দর্শনীয় স্থান। সে সময় লুদোভিচের অনুরোধে লিয়োনার্দো এঁকেছিলেন মিলান শাসকের রক্ষিতা সিসিলিয়া গাল্লিরানির প্রতিকৃতি বা ‘দ্য লেডি উইথ আরমিন’, যা পরে পৃথিবীবিখ্যাত ছবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy