আন্দোলন: আর জি কর কাণ্ডে ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে পথে নাগরিক মিছিল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
ও আলোর পথযাত্রী
শোন রে মেয়ে, মিছিলে যাচ্ছিস, যা। কিন্তু যাওয়ার আগে মুখে কিছু দিয়ে যা। তোর বন্ধুদের জন্যে চারটে টিফিন কেরিয়ার ভর্তি করে পাউরুটি, ডিম আর কলা রাখা আছে, ব্যাগে ভরে নিয়ে যা। আমি জানি, এত কম খাবারে কারও পেট ভরবে না। কিন্তু তুই-ই তো একটু আগে আমাকে ধমক দিয়ে বললি যে, বন্ধুরাও খাবার নিয়ে আসবে।
না। আমি যাব না। এক্ষুনি থার্মোমিটার দিয়ে দেখলাম, আমার একশো তিন জ্বর। ঠকঠক করে কাঁপছি, কম্বল মুড়ি দিয়েও শীত যাচ্ছে না। তার সঙ্গে শুরু হয়েছে ভুল বকা, ডিলিরিয়াম। কিন্তু তোকে আটকাব না। তুই যা। এই কথাটাও শুনে যা, তোদের এই আন্দোলন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, এখনও শেখাচ্ছে। তার জন্যে তোর কাছে, তোদের কাছে, গোটা তরুণ প্রজন্মের কাছে কৃতজ্ঞ।
বিশ্বাস কর মা, ২০২৪ সালের ৯ অগস্টের পরের দিন ও রাতগুলো আমার নাকে ঝামা ঘষে বুঝিয়েছে, এমন আন্দোলন আমার জীবৎকালে বাংলায় ঘটেনি। অভূতপূর্ব, অনির্বচনীয়, অকল্পনীয় সব ঘটনা তোরা একের পর এক ঘটিয়ে চলেছিস। যেগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আমার পক্ষে ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে।
৯ অগস্টের সেই রাত আন্দোলনের প্রারম্ভ-বিন্দু হলেও আমি ঘটনাটিতে ঢুকব না। খবরের কাগজ ও টিভি নিউজ় চ্যানেলে বিষয়টি বহুচর্চিত। এ ছাড়া আছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স হ্যান্ডল, ইনস্টাগ্রাম। মেনস্ট্রিম মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আছে কিছু নিউজ় পোর্টাল, যারা ‘ভিউ’ তথা ‘রেভিনিউ’ পাওয়ার জন্যে যা ইচ্ছে তাই ছড়াচ্ছে। সব রকম মিডিয়া মিলে যে বিপুল দৃশ্য ও আখ্যানের জন্ম দিচ্ছে, তা অনতিঅতীতে কোনও ঘটনা নিয়ে দেখেছি, শুনেছি বা পড়েছি বলে মনে পড়ে না।
জানিস মা, আমি নিজের মতো করে চেষ্টা করছি এই সব বহমান দৃশ্য-শ্রাব্য আখ্যান মথিত করে কতটা গরল আর কতটা অমৃত উঠে আসছে, সেটার তুল্যমূল্য বিচার করার। ৯ অগস্টের ঘটনা আমাকে ক্রুদ্ধ, ব্যথিত, অভিমানী, অসহায়, অপমানিত, পরাজিত এবং লড়াকু করে তুলছে। আমার মন খারাপ ছিলই। আজ থেকে শরীরও খারাপ। এই শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা কী করে কাটাব বুঝতে না পেরেই তোর সঙ্গে কথা বলছি। জ্বরের প্রলাপ হিসেবে একে উড়িয়ে দিস না। প্লিজ়, শোন...
যুগসঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া
জানিস মেয়ে, আমি এমন একটা সময়ে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি, যখন নকশাল আন্দোলন স্তিমিত। সেই আন্দোলন সম্পর্কে আমার কোনও স্মৃতি নেই। পরবর্তী কালে পড়াশোনা করে বুঝেছি, আন্দোলনটি ছিল সশস্ত্র। ছাত্ররা সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও নেতৃত্বে ছিলেন কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি। হিংসার কারণে আন্দোলনটি পরের দিকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আর একটু পরের দিকে আসি। আমি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে পড়তে ঢুকি ১৯৮৫ সালে। আশির দশকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনের পরিণতি ছিল তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের পরিকল্পিত সরকারি হত্যাকাণ্ড। প্রায় দশ লক্ষ লোকের জমায়েত তৎকালীন চিন সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের ফল কী? সরকারি হিসাবে দুশো এবং বেসরকারি হিসাবে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু।
এ সব শুনে কী লাভ? আহা, যা বলছি শোন না রে মেয়ে! আমার কলেজজীবনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন ছিল ‘অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশন’ বা ‘এবিজেডিএফ’ মুভমেন্ট। দুই জুনিয়র ডাক্তারের সাসপেনশন প্রত্যাহার, ভাতা বৃদ্ধি, এমার্জেন্সি বিভাগের পরিবেশ বজায় রাখা, ওষুধের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা ছাড়াও একাধিক দাবি নিয়ে সেই আন্দোলনও তখনকার প্রশাসকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। দুই জুনিয়র ডাক্তারের সাসপেনশন উঠে গেলে ও ভাতা বৃদ্ধি হলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
আসা যাক ‘আরব বসন্ত’র কথায়। এটা তো তোদের মতো কমবয়সি ছেলেমেয়েদের জানা, তাই না? ২০১০ সালের শেষের দিকে টিউনিসিয়ার সরকার-বিরোধী বিক্ষোভটি ব্যাপক ভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিল ইন্টারনেট। আরব বসন্ত-র কারণেই টিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিশর এবং ইয়েমেনে সরকারের পতন ঘটে। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের কথাও এখানে একটু বলে রাখি।
এই তো! এত ক্ষণে ধরতে পেরেছিস! আমি বেছে বেছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনগুলোর কথাই বলছি। কখনও সেই প্রতিষ্ঠানের নাম রাজ্য, কখনও রাষ্ট্র। সবগুলোই শুরু হয়েছিল ছাত্র আন্দোলন হিসেবে। পরে তা অন্য চেহারা নেয়। অনেক ক্ষেত্রে রক্ত ঝরেছে, প্রাণ গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনের ঝাঁঝ কমতে কমতে সেটি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
এখান-ওখান থেকে খামচা মেরে উদাহরণগুলো কেন তুলে আনলাম? ঠিক প্রশ্ন। তুলে আনলাম, কারণ এগুলোই আপাতত মনে পড়ছে। তুলে আনলাম, কারণ তোদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ মুভমেন্টটি চরিত্রগত ভাবে এই সব আন্তর্জাতিক বা দেশজ আন্দোলন থেকে একদম আলাদা। যাকে ইংরেজিতে ‘প্যারাডাইম শিফ্ট’ আর বাংলায় ‘আমূল পরিবর্তন’ বলে।
কেন বলছি? সেটা জানতে হলে আমার এই প্রলাপ তোকে শুনতে হবে মা!
এ যে কুয়াশা, এ যে ছলনা
আরব বসন্ত এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এলে ‘পোস্ট ট্রুথ এরা’ তথা ‘উত্তরসত্য যুগ’ সম্পর্কে আলোচনা হওয়া বাধ্যতামূলক। আমাদের ছোটবেলায়, জানিস মা, খবরের কাগজ পড়ে বুঝতে পারতাম কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে। কোনটা খবর আর কোনটা সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিকোণ। কোনটা নিউজ় আর কোনটা মিডিয়া হাউসের পলিসি।
সত্যি আর মিথ্যের দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার কাজ আমাদের দেশে কবে শুরু হল? আমার স্মৃতি বলছে দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের হাত ধরে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি’র মাধ্যমে এর অনুপ্রবেশ। যদি কেতাবি তথ্য চাস, তা হলে বলি, ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘ভাষা, অর্থ, সত্য’ গ্রন্থে শ্রীসুকান্ত চৌধুরী মহাশয় লিখেছেন, “মিথ্যা কথা তো চিরকাল লোকে বলে আসছে: শুনতে খারাপ লাগলেও ওটা মানবধর্মের বৈশিষ্ট্য, একমাত্র মানুষই মিথ্যা বলে। কিন্তু কোনও কিছু মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে গেলেও তো সত্যটা জানতে হয়। সেই সত্যের সংজ্ঞা নিয়ে আজ আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বিভ্রান্তি দুটো স্তরে: এক, কোনও বিশেষ তথ্য সঠিক কিনা; দুই, সত্য কাকে বলে... দ্বিতীয় সমস্যাটা কঠিন হলেও প্রথমটা সাদামাটা: যদু আমার মানিব্যাগ সরিয়েছে কি না, মধুর তিনটে বিয়ে কি না, ছেলে রাত এগারোটা অবধি কোচিং ক্লাসে ছিল না অন্য কোথাও। উত্তর যদি সহজলভ্য নাও হয়, প্রশ্নগুলো বুঝতে অসুবিধা নেই। উত্তরসত্যের জগতে কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব এত গোলমেলে যে প্রশ্নটা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। যা দেখছি শুনছি (বা সাবধানে বলি, মনে হচ্ছে দেখছি শুনছি) তার সঙ্গে লোকে যা বলছে ভাবছে, আর আমাদেরও বলাতে ভাবাতে চাইছে, তার আদৌ মিল নেই...”
‘প্রশ্নটা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।’ এই চারটে শব্দ খেয়াল করেছিস তো মা? করেছিস? ভাল। তোদের অবশ্য এত তত্ত্বকথা জানার দরকার নেই। তোরা প্রত্যেক দিনের ডিজিটাল অভিজ্ঞতা দিয়ে জানিস যে, উত্তরসত্যের নির্মাতারা বাস্তবের কিছু উপাদান গ্রহণ করে এবং সেটা থেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে অন্য একটি আখ্যান নির্মাণ করে।
এত কথা কেন বললাম বল তো, মেয়ে? কারণ ৯ অগস্ট-পরবর্তী সময়ে আমাদের সবার সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইন উপচে উঠছিল ভুল তথ্য, মিথ্যে অডিয়ো ক্লিপ, ভুয়ো ফরেনসিক রিপোর্ট, কুৎসিত মিম আর নারকীয় রেপ থ্রেটে। তোদের মতো কমবয়সি ছেলেমেয়ের জন্যই অবস্থাটা বদলাল। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ার দখল নিলি তোরা। তার পর জানালি রাত দখলের আহ্বান। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই কলকাতা শহরের মাত্র তিনটি জায়গায় শুরু হয়ে বিদ্যুতের থেকেও দ্রুত গতিতে সেই আহ্বান ছড়িয়ে পড়ল সারা বাংলায়। এবং এখনও কী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তোদের নানা ভাল কাজের তথ্য, নথি, ভিডিয়ো। স্যালুট মেয়ে, তোদের স্যালুট।
এ বালুচরে আশার তরণী তোমার
যেন বেঁধো না
আর একটা জিনিসও খেয়াল করলাম এই আন্দোলন প্রসঙ্গে। তোরা কোন ম্যাজিকে দলীয় রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রাখছিস রে? ১৪ অগস্টের রাত দখলের লড়াইয়ের ডাক কোনও রাজনৈতিক দল দেয়নি। দিয়েছিল কয়েকটি মেয়ে। সেই মুভমেন্টের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ও তীব্র সাফল্য আমাকে অবাক করেছে। ১৮ অগস্টের ডার্বি ম্যাচ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে বাঙাল ও ঘটির মিলিত আবেগের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তাতে রাজনৈতিক দলবিরোধী স্লোগান থাকলেও কোনও রাজনৈতিক দল সেই আন্দোলনকে নিজের বলে দাবি করেনি। ২৭ অগস্ট ‘ছাত্র সমাজ’-এর নামে বিজেপির ডাকা নবান্ন অভিযানে তোদের নেতৃত্বকে দেখতে পাইনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে তোরা আশ্চর্য সংযম দেখিয়েছিস।
‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ আন্দোলনটি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই, শুরু হয়েছিল রাধাগোবিন্দ কর নামাঙ্কিত মেডিক্যাল কলেজে, জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। অতি দ্রুত সেটা ছড়িয়ে পড়ে অন্য মেডিক্যাল কলেজে। তার পর সব চিকিৎসকের মধ্যে। নিজের পেশার মানুষের উপরে অত্যাচারের কারণে চিকিৎসকরা সহযোদ্ধা হবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আন্দোলনটি সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হল দলীয় ঝান্ডাকে দূরে রাখার কৌশল। এর ফলে এক দিকে যেমন সমাজের সব স্তরের মানুষ তোদের সঙ্গে চলেছেন, অন্য দিকে তেমন আন্দোলনটি পেশাদার রাজনীতিবিদদের হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছে। নিজেদের অপ্রয়োজনীয় ভাবতে কার ভাল লাগে, বল?
এবং তোরা কী বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজটা করছিস রে মা! তোদের পরিণত বুদ্ধি দেখে আমি অবাক! এই নির্লিপ্তি, এই সংযম, এই নিরপেক্ষ অবস্থান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমিও কমবয়সে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে শামিল হয়েছি। হ্যাঁ, আমাদের নিরাপত্তার দাবিতেই সেই আন্দোলন হয়েছিল। আমরা কিন্তু দলীয় পতাকাহীন ছিলাম না। আজ মনে হয়, সেই কারণেই বোধহয় আন্দোলনগুলো মানুষের মনে সাড়া ফেলেনি। আজ তোরা যখন মেডিক্যাল শিক্ষা জগতের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছিস, লবি আর হুমকি সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছিস, এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং তার আদর্শ উত্তরপত্র ফাঁস নিয়ে চিৎকার করছিস— তখন সাধারণ মানুষ ভয় পাচ্ছেন। মেডিক্যাল শিক্ষার এই অন্ধকার যুগে যে সব চিকিৎসক জন্মাচ্ছেন, তাঁদের কাছে চিকিৎসা করাতে কী করে যাবেন, এই কথা ভাবছেন। শোন মা, তুই মিছিলে যা। তোর সহপাঠীরাও যাক। সমূলে উপড়ে ফেল বিষবৃক্ষ। না হলে আমাদের পেশা, চিকিৎসাশাস্ত্র নামের এই ‘নোবেল প্রফেশন’ চিরকালের জন্যে কালিমালিপ্ত হয়ে যাবে। চিকিৎসক হিসেবে আমি মানুষের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।
আহ্বান, শোন আহ্বান, আসে মাঠ-ঘাট
বন পেরিয়ে
তোদের এই দলীয় পতাকাহীন অবস্থান এবং দ্বিধাহীন ভাবে মানুষের অংশগ্রহণ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক আগের ‘চাপাটি আন্দোলন’-এর কথা। ইতিহাসে পড়েছিস নিশ্চয়ই! উত্তর ভারতের কিছু গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে হাতে গড়া রুটি বা চাপাটি। মানুষের হাত ঘুরে সেই চাপাটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে হাজার মাইল দূরে। এই রুটি কি কোনও গোপন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে? এর পিছনে কি কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে? ইংরেজ শাসকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, রুটি বিতরণ আদতে আসন্ন বিদ্রোহের বার্তা। মনে রাখতে হবে, সিপাহি বিদ্রোহও শুধুমাত্র সেপাইদের বিদ্রোহ ছিল না। তা ছিল ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে কৃষক, জনতা এবং সেপাইদের সম্মিলিত প্রতিরোধ।
ইতিহাস কী ভাবে ফিরে আসে দেখ রে মেয়ে! তোদের এই আন্দোলন আর তোদের নেই রে! ১৪ অগস্ট সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে দেখলাম, বালিখাল বাসস্ট্যান্ডের কাছে কয়েকটি মেয়ে জড়ো হয়ে উত্তেজিত আলোচনা করছে। বাড়ি ফেরার সময় জানলাম, ওরা ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ লেখা পোস্টার নিয়ে মিছিল করবে। হাতে থাকবে মোমবাতি আর মোবাইলের টর্চ। মিছিলের স্লোগান কী হবে, এই নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বার শুরু হল হোয়াটসঅ্যাপে খবর আসা। সিপাহি বিদ্রোহের রুটি যে ভাবে হাত থেকে হাতে, গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়েছিল, অবিকল সেই কায়দায়। স্কুলের ব্যাচমেটদের গ্রুপে, স্কুলের গ্রুপে, অন্য নানা অকাজের গ্রুপে আলাদা আলাদা মিছিলের আহ্বান আসতে শুরু করল। তাও তো এখনও ডাক্তারদের নিজস্ব গ্রুপের কথা বলিনি। কলেজের ব্যাচমেটদের গ্রুপ, কলেজের গ্রুপ, স্থানীয় আইএমএ গ্রুপ— সব জায়গায় একই আহ্বান: রাত দখল করো।
আমি একটি জমায়েতে ছিলাম। শিশু ও বৃদ্ধ, পুরুষ ও নারী, হিন্দু ও মুসলমান, ঘটি ও বাঙাল— সমাজের সব স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন সেই মিছিলে। মিছিলে স্লোগান ছিল না। ছিল গান। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ ‘এ জীবন পুণ্য করো’ থেকে শুরু করে ‘যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো’ পর্যন্ত যেতে যেতে দেখলাম শ’খানেক মানুষের মিছিল জনজোয়ারে পরিণত হয়েছে। আশপাশের রাস্তা আর গলি থেকে বেরিয়ে আসছেন স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবী, প্রেমিক-প্রেমিকা। আসছেন বাচ্চা-কাঁধে বাবা, ছেলের হাত ধরে মা, ঠাকুমার লাঠি-পাকড়ানো নাতি। যে সব বয়স্ক মানুষ আর অথর্বরা আসতে পারছেন না, তাঁরা একতলার জানলায় বা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাচ্ছেন। রবি ঠাকুর আর সলিল চৌধুরীর গান সম্বল করে আমরা হাঁটছিলাম।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এত মানুষ কেন হাঁটছেন? এই স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণের ব্যাখ্যা আমি পাইনি। আমরা সবাই মিলে কী চাইছি? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন মনে রাখে যে ‘আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’? তারা যেন মনে রাখে, ‘শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি’?
জানি না রে মা, সত্যিই জানি না।
উত্তাল তালে উদ্দাম নাচে মুক্ত স্রোত নটিনী
জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃবৃন্দের বিচক্ষণতা, সংযম, উইট— এগুলোর জন্যে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়! কলকাতা পুলিশ যখন তোদের লালবাজারে যেতে বাধা দিল, তখন তোরা ‘বিনীত’ভাবে বলেছিলি, যেতে না দিলে রাস্তায় অবস্থান করবি। তার পর শুরু হল স্নায়ুর লড়াই। দীর্ঘ সময় পরে কলকাতা পুলিশের প্রধান আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করলি। এবং অবাক কাণ্ড! তাঁর কাছে তাঁরই পদত্যাগের দাবি জানালি। পাশাপাশি উপহার দিলি একটি প্রতীকী শিরদাঁড়া।
শিরদাঁড়া এখন বাঙালি মননে বহুচর্চিত বিষয়। হঠাৎই অনেকে মেরুদণ্ডী হয়ে উঠছেন। তাঁদের মধ্যে মার্কামারা চিকিৎসক যেমন আছেন, তেমনই আছেন ‘বুদ্ধিজীবী’ ছাপ মারা এক দল মানুষ।
এঁদের কারও মেরুদণ্ড প্লাস্টিসিন দিয়ে তৈরি, কারও জ্যাম দিয়ে, কারও জেলি দিয়ে। কেউ কেউ আবার সাপের মতো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেরুদণ্ড, কিন্তু খুবই বিষাক্ত।
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ আন্দোলনটিই পারে বিষবৃক্ষ সমূলে উপড়ে ফেলতে। যে কোনও ছোট মিছিল জনসমুদ্র হয়ে উঠতে সময় নিচ্ছে না। উজ্জ্বল মোমশিখায় ভোরের প্রতীক্ষা। না হলে চিরকালের মতো কলঙ্কিত হয়ে যাবে চিকিৎসার মতো একটি মহৎ পেশা, প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যাবে নারীর মৌলিক নিরাপত্তার দাবি।
2nd part
এঁদের নিয়ে আলোচনার কোনও মানে হয় না। আমি বলতে চাইছি তোদের কথা। ভোরবেলায়, যখন চেয়ারে বসে পুলিশরা বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখন তোরা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলি! প্রত্যেকটি পুলিশ রাত জাগার ক্লান্তি নিয়েই দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। এমন অভিনব, অহিংস ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ আগে দেখিনি।
তা ছাড়া প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে আন্দোলনের গতি বজায় রাখার মতো শক্ত কাজও তোরা করে চলেছিস। এখন মানুষের মনঃসংযোগ ক্রমশ কমছে। কোনও বিষয়ে পাঁচ মিনিটের বেশি আগ্রহ থাকে না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে টানা এক মাস পার করে আন্দোলনের নদীকে ক্রমশ বেগবতী করার মতো অসাধ্যসাধন তোরা কী করে করছিস?
আর আলাদা করে বলতেই হয় মেয়েদের কথা। না না! শুধু রাত দখলের কথা বলছি না। মিছিলের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার কথাও বলছি না। মেয়েরা এখন পাবলিক স্পেসে— ট্রেনে, বাসে, অটোয়, টোটোতে, কর্মস্থলে— শরীরের উপরে নিজের অধিকার নিয়ে চিৎকার করে কথা বলছেন। পাবলিক টয়লেটে প্রস্রাব করতে গেলে কী অসুবিধে হয় সে কথা যেমন বলছেন, তেমনই শেয়ার করছেন জীবনের প্রথম ‘মলেস্টেশন’-এর কথা। প্রথম ‘গ্রোপ্ড’ হওয়ার কথা। বলছেন রেপ থ্রেট, রেপ কালচার, নারী শরীরের পণ্যায়ন নিয়ে। তাঁদের শরীরী ভাষার বদল শুধুমাত্র কর্মস্থলে দেখছি না। বাজারে মাছ বা পেঁয়াজ বিক্রি করেন যে দিদি, তাঁর মধ্যেও দেখছি।
এই বঞ্চনার দিন পার হলেই পাবে জনসমুদ্রের ঠিকানা
এই প্রসঙ্গে ছুঁয়ে যাই সমাজের নানা অংশের মানুষদের কথা। বৃহন্নলারা মিছিল করে বিচার চাইছেন, সমাজমাধ্যমে দেখেছি। যৌনকর্মীরা প্রতিবাদ করেছেন তাঁেদর নিজস্ব ভাষায়। সেবিকা থেকে গায়ক, লেখক থেকে অভিনেত্রী, আইনজীবী থেকে গিগ কর্মী— সবাই আন্দোলনে শামিল। সমালোচকরা বলছেন, এ হল ছবি তোলার আন্দোলন। ‘ভাইরাল কনটেন্ট’ তৈরি করতে হলে ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয়ে কাজ করতে হবে। #জাস্টিসফরআরজিকর বা #উইওয়ান্টজাস্টিস এখন ট্রেন্ডিং।
এই যুক্তির বিরোধিতা না করে নিজের অভিজ্ঞতা বলি। এটা সমাজমাধ্যমের কোনও কনটেন্ট নয়। গত শনিবারের ঘটনা।
প্রতি শনিবার আমাদের বাড়িতে রেস্তরাঁ থেকে খাবার আনানো হয় ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে। সে দিন এসেছিল দক্ষিণ কলকাতার ‘মিশেলিন তারকা’ওয়ালা রেস্তরাঁ থেকে। ‘রাইডার’ আমাকে ফোন করে বাড়ির ঠিকানা জেনে, একতলায় খাবার দিয়ে চলে গেছেন। মিনিট পাঁচেক পরে রাস্তায় স্লোগান শুনে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, জি টি রোড দিয়ে একটি মিছিল যাচ্ছে। আর কমলা পোশাক পরা রাইডারটি আমার বাড়ির সামনে ব্যাগ-সহ বাইক রেখে মিছিলে অংশ নিয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে হাঁটছেন। দৃশ্যটি দেখে নীচে নেমে বাইকের পাশে দাঁড়ালাম। লোকটি ফিরে আসার পরে আলাপও করলাম। উর্দুভাষী মুসলিম, পার্ক সার্কাস এলাকায় থাকেন, মোটামুটি বাংলা জানেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “মিছিলে কেন গেলেন?”
ভাঙা বাংলায় উনি বললেন, “দাঁড়িয়ে তো থাকতেই হত। রোজই কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সব মিছিলেই একটু করে হাঁটি। আমার একটা মেয়ে আছে। আই ওয়ান্ট জাস্টিস।”
শুধু আমাদের ‘মিছিল নগরী’ কলকাতার কথা বললে হবে? গত ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জুড়ে ২৬টিরও বেশি দেশের ১৩০টিরও বেশি শহরে এই ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে। আমেরিকার বে এরিয়া থেকে লুইভিল, ওরল্যান্ডো, ট্যাম্পা, মেরিল্যান্ড, অ্যাটলান্টা-সহ আরও অনেক শহর মুখরিত হয়েছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনিতে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গাতেও একই ঘটনা ঘটছে। কানাডার এডমন্টন থেকে নায়াগ্রা, নরওয়ের অসলো থেকে নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ, জার্মানির কোলন থেকে বন— আন্দোলন চলেছে সর্বত্র। মিছিল করছেন লেখক দোমিনিক লাপিয়েরের ‘সিটি অফ জয়’ উপন্যাসের প্রতীক, কলকাতার রিকশাচালকরা। ‘বাংলা’ ও ‘বিশ্ব’, ঘর ও বাহির এই একটি বিষয়ে এক হয়ে গেছে রে মা। দলহীন, পতাকাহীন দ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব জুড়ে।
আর কত দূর, ওই মোহনা
আবার জ্বর আসছে, বুঝলি মেয়ে। না না! আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। তুই যা। আমি ঠিক সামলে নেব। জ্বরের বড়ি অনেক ক্ষণ আগে খেয়েছি, আর একটা খেয়ে দেখি কী হয়। কী বললি? আমি ভুল বকছি? হাসালি! এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কল্পনার হিস্টিরিয়া কেন হবে?
এই আন্দোলনকে ‘ঐতিহাসিক’ বলেছি বলে হাসছিস? তোরা সত্যিই বুঝতেও পারছিস না যে, তোরা ইতিহাস তৈরি করতে করতে এগোচ্ছিস? বুঝতে না পারলে আমি কী করব বল? বকবকানির শুরুর দিকেই অতগুলো আন্দোলনের কথা কেন বলেছিলাম বুঝতে পারিসনি, তাই না? বলেছিলাম, ওই সব আন্দোলনের সঙ্গে ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ আন্দোলনের গুণগত মিল আর অমিল বোঝাতে।
প্রথমত, তোদের আন্দোলনও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। দ্বিতীয়ত, তোদের আন্দোলন অহিংস। তৃতীয়ত, তোদের আন্দোলনের গায়ে দলীয় রাজনীতির গন্ধ নেই, তোদের হাতে নেই দলীয় পতাকা। চার নম্বর কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক ব্যবহার! চতুর্থ কারণের জন্যেই আন্দোলনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং ক্রমাগত বড় হয়ে চলেছে। কলকাতা থেকে শুরু হয়ে শহরতলি, মফস্সল, জেলা শহর, গ্রাম— সমস্ত ডেমোগ্রাফির মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। ছাত্র আন্দোলন আর তোদের মতো ছাত্রছাত্রীর হাতে থাকছে না। তা ক্রমে জনতার আন্দোলন হয়ে যাচ্ছে।
এ বার সময় হল। তুই যা রে মা। বন্ধুদের সঙ্গে মিছিলে পা মেলা। এক মহিলা পড়ুয়া-চিকিৎসক ‘নাইট ডিউটি’ করতে গিয়ে কর্মস্থলে ধর্ষিতা ও খুন হলেন, এটা কোনও মেয়ে মেনে নিচ্ছেন না। মেয়ের বাবা, দাদা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক, স্বামী হিসেবে এটা মেনে নিচ্ছেন না ছেলেরাও। সবাই বিচার চাইছেন। সবাই ন্যায় চাইছেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে, মোমবাতি হাতে নিয়ে মিছিলে হাঁটছেন আর চিৎকার করে বলছেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’
প্রশাসনের কাছে বিচার চাইলে প্রশাসন এত রেগে যাচ্ছে কেন রে মেয়ে? তুই কি আমার বাড়ির কেউ? না কি আর জি করের সেই মেয়ে? না কি তুই উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়া অথবা কামদুনির মেয়েটি? আমার মাথা আর কাজ করছে না রে মা! তোর নাম যা-ই হোক না কেন, তুই যা। আমি বাড়ি অন্ধকার করে একা বসে থাকব আর তোদের জয় প্রার্থনা করব। জ্বরের ঘোরে উচ্চারণ করব, “জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী। অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy