নিদর্শন: লোথাল শহরে সাধারণ মানুষজনের বাড়ির অবশিষ্ট ইটের গাঁথনি। নিজস্ব চিত্র।
মুহূর্তে চলে এসেছি কয়েক হাজার বছর পিছনে। দাঁড়িয়ে আছি যেখানে, তার খানিক দূরেই বিশাল জলাশয়, পাড় বাঁধানো সুন্দর করে। খানিক দূরে দেওয়াল ও তার পাশে ঘরের আভাস। একটি বিশাল উনুন, যাতে গোটা গ্রামের রান্না হতে পারে। এই সব তৈরি হয়েছে অন্তত চার হাজার দুশো বছর আগে!
এ সবই সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত। যে সভ্যতার সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১৩০০ সাল। এই জায়গাটার নাম লোথাল, গুজরাত রাজ্যে। আমদাবাদ শহর থেকে আটাত্তর কিলোমিটার রাস্তা। সিন্ধু সভ্যতার দক্ষিণতম এই অঞ্চল আর্কিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া আবিষ্কার করে ১৯৫৪ সালে। খনন শুরু হয় ১৯৫৫-তে, আর তা চলে ১৯৬০ পর্যন্ত। কিন্তু শুধু সিন্ধু সভ্যতার অংশ হিসাবেই নয়, লোথালের আর একটি বিশেষ পরিচয় আছে।
কিছু দ্বিমত থাকলেও বলা যায়, লোথাল পৃথিবীর প্রথম বন্দর। এখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল সবরমতী নদী, সেই নদীর উপরেই এই বন্দর লোথাল। অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধ জেলার বিভিন্ন শহর থেকে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বাণিজ্য সরণি, আর তারই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এই লোথাল। লোথাল বন্দরের পাশেই লোথাল শহর। সেই শহর থেকে দামি পাথর ও পুঁতি যেত পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায়। এই সব কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পাওয়া গিয়েছে লোথালে। লোহার আবিষ্কার তখনও হয়নি। সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত হত ব্রোঞ্জ।
লোথালে পাওয়া গিয়েছে স্তূপ, বাজার এলাকা এবং এই বন্দর। এই বন্দরে এখনও জল টলটল করছে। বাঁধানো পাড় অটুট। আমরা সকলেই জানি মহেঞ্জোদড়োর কথা। সেই মহেঞ্জোদড়ো থেকে লোথালের দূরত্ব ৬৭০ কিমি। গুজরাতে দু’টি জায়গার আবিষ্কার, লোথাল ও ধোলাভিরা, সিন্ধু সভ্যতার সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার।
গুজরাতি ভাষাতে ‘লোথাল’ মানে মৃতের স্তূপ। সিন্ধু সভ্যতা বলতেই যা মনে আসে, অর্থাৎ মহেঞ্জোদড়ো— তার মানেও তাই। এই লোথালে প্রাচীন নিদর্শন যা পাওয়া গিয়েছে, আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এ রকম আর কোথাও পায়নি। আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার, মূল সিন্ধু সভ্যতা অর্থাৎ মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার বহু বছর পরেও লোথাল টিকে ছিল। প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায় বন্যা ও ঝড়। প্রাকৃতিক কারণেই লোথাল নগরীর বিলুপ্তি ঘটে।
মহেঞ্জোদড়োর মতো লোথালও সুপরিকল্পিত শহর ছিল। বন্যা থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছিল লোথাল। পুরো শহর এক থেকে দু’মিটার উচ্চতার বেদিতে ভরা। বেদিগুলি ইটের তৈরি, যে ইট তৈরি হয়েছে পুড়িয়ে নয়, রোদে শুকিয়ে। প্রতিটি বেদির উপরে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে থাকত কুড়ি-তিরিশটি বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি ওই রোদে পোড়ানো ইটের তৈরি, গাঁথনি কাদার।
ব্রিটিশ কলকাতায় শুনেছি ভাগ ছিল ব্ল্যাক টাউন আর হোয়াইট টাউনের। শাসক আর শাসিতের ভাগ লোথালেও ছিল। শাসক থাকতেন মাঝের উঁচু জায়গায়, এখানকার বাড়ির নির্মাণ অবশ্যই বেশি যত্নে করা হত, জল নিকাশি ব্যবস্থাও ছিল বৈজ্ঞানিক। এখানে ভাটায় পোড়ানো ইট ব্যবহার হত। যে রকম নিয়ম করে রাস্তা বাড়ি ঘর সব বানানো হয়েছিল এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল তাতে মনে হয়, প্রশাসনিক কড়াকড়ি ছিল ভালই। বাজার এলাকাতেও রাস্তার মাপ একই এবং কোথাও তা সরু হয়ে যায়নি। এ ছাড়া ধাতব পাত্র, সোনার গয়না এবং নানা রকম পাথর বসানো অন্য ধাতুর গয়না যা পাওয়া গিয়েছে, তাতে এখানকার মানুষ যে সংস্কৃতিমনস্ক ও সমৃদ্ধ ছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
লোথালে পাওয়া ধাতব যন্ত্রাদি, বাটখারা, সিল, মৃৎপাত্র, গয়না— সবই হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োতে পাওয়া জিনিসের মতোই। মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা থেকে বিপুল পরিমাণে তামা, মাঝারি দামের পাথর ইত্যাদি আমদানি হত লোথাল বন্দরের মাধ্যমে। এখান থেকে এ সব ছড়িয়ে পড়ত সারা ভারতে। আবার এখান থেকে রফতানি হত মিশর ও মেসোপটেমিয়ার সুমেরে।
মনে করা হয়, এক বিশাল বন্যায় শুরু হয় লোথালের পতন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৯০০ নাগাদ হয় এই ভয়ানক প্লাবন। উঁচুতে থাকা বাড়ি সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ হলেও তা মজবুত হয়নি। ব্যবসাও কমতে থাকে, বড় জাহাজ আসা বন্ধ হয় লোথাল বন্দরে। মানুষের সমৃদ্ধিও অনেক কমে যায়। শেষ ধাক্কা, খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০-এর বিধ্বংসী বন্যা। লোথালের শেষ সেখানেই। পুরো বন্দর ভরে যায় পলি ও জলে ভেসে আসা ইট, বালি, পাথরে। এই বন্যা শুধু লোথালকেই শেষ করে দেয়নি, সৌরাষ্ট্র ও দক্ষিণ গুজরাতেরও ক্ষতি করে দিয়ে গিয়েছিল।
লোথালের মানুষের আরাধ্য দেবতা অগ্নির এক রূপ, যাঁর ছবি আমরা সিলের উপর দেখতে পাই। এখানে রয়েছে পাথরের তৈরি যজ্ঞবেদি। এ ছাড়াও পূজিত হতেন সমুদ্রমাতা। এখনও লোথালের আশপাশের গ্রামে পূজিত হন সমুদ্রদেবী, তাঁর নাম ‘ভানুভতি সিকোতারিমাতা’। প্রথমে মৃত ব্যক্তির সমাধি দেওয়ার প্রথা হয়তো ছিল এখানে, অল্প কিছু সমাধি পাওয়াও গিয়েছে, কিন্তু পরে লোথালবাসী মৃতদেহ দাহ করার প্রথাই গ্রহণ করেন। সমাধিতে এক সঙ্গে পুরুষ ও রমণীর দেহও পাওয়া গিয়েছে এখানে। তখন সহমরণ ধরনের প্রথা ছিল কি না, তা অবশ্য জানা নেই।
লোথালে যা পাওয়া গিয়েছে তার অনেকটাই সংরক্ষিত স্থানীয় জাদুঘরে। মৃৎপাত্র, সোনা বা ব্রোঞ্জের গয়না, সিল সবই আছে এখানে। মনে হয় ছোটবেলায় পড়া ইতিহাস যেন চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। খননকালে ২১৩টি সিল পাওয়া গিয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার দুই প্রধান শহর ছাড়া এত বেশি সিল আর কোথাও মেলেনি। আর এর মধ্যে একটি সিল আছে, যা এসেছে সুদূর বাহরাইন থেকে।
বন্দর, বাড়িঘর, পট ফার্নেস, মিউজ়িয়ম সব দেখে এক প্রান্তে এসে চোখে পড়ল পাঁচিলে ঘেরা বেশ বড় একটা অঞ্চল। পুরোটাই কালো পাথরে ঢাকা। কালো হয়ে আছে আশপাশের দেয়ালও। মনে হল, এটাই ছিল শ্মশান। এখানে একটা টিলার মতো আছে। তার উপরে উঠলে পুরো লোথাল দেখা যায়।
অল্প সময়ের জন্য মনে হল চার হাজার বছর পেরিয়ে ফিরে গিয়েছি সেই সময়ে, শুনতে পাচ্ছি মানুষের কলরব, দূরে যজ্ঞ চলছে, পট ফার্নেসে রান্না হচ্ছে শিকার করে আনা সম্বর, গ্রামের সবাই ভোজ খাবেন। পুঁতি তৈরির কারিগরেরা কাজ করছেন। নানা রকম যন্ত্রের আওয়াজ আসছে তাঁদের ঘর থেকে। এখানে তৈরি কার্নেলিয়ান পুঁতি পাওয়া গিয়েছে ক্রিশ, উর (ইরাক), জালালাবাদে।
খামবাটের এক পুঁতি কারিগরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি জানালেন, লোথালে চার হাজার বছর আগে যে প্রক্রিয়ায় পুঁতি তৈরি হত, সেই একই প্রক্রিয়ায় আজও পুঁতি তৈরি করেন তাঁরা। যেন এক আশ্চর্য সময় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy