সখী: প্রাসাদের ছাদে রাজকুমারী। তানপুরা বাজিয়ে তাঁকে কেউ গান শোনান, কেউ বা বাতাসে মুছিয়ে দেন স্বেদশ্রান্তি
দিল্লি শহরকে কচুকাটা করে, ১৭৩৯ সালের প্রখর গ্রীষ্মে ৭০০ হাতি, ৪ হাজার উট ও ১২ হাজার ঘোড়ার পিঠে যাবতীয় ধনরত্ন বোঝাই করে পারস্যে ফিরে গেলেন নাদির শাহ। সোনাদানা, মণিমুক্তো ছাড়াও লুঠ-করা ওই ধনরত্নের মধ্যে থেকে গেল শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন। সেখানেই গাঁথা রয়েছে কোহিনুর হিরে ও লালরঙা তৈমুর রুবি... তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে দামি দুই রত্ন।
নাদির শাহ ইরান-আফগান সীমান্তের এক যাযাবর পশুপালকের পুত্র। সামরিক প্রতিভাবলে পারস্যের সেনাবাহিনীতে দ্রুত উত্থান, অবশেষে ১৭৩২ সালে সেখানকার সিংহাসন দখল। তার সাত বছর পরে আফগানিস্তান হয়ে, খাইবার পাস পেরিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ বন্দুকধারী সেনা নিয়ে পৌঁছলেন ভারতে। দিল্লির অনতিদূরে, হরিয়ানার কার্নালে তাঁর পথ আটকাতে তখন প্রায় দশ লক্ষ মুঘল সেনা। সংখ্যার বিচারে তারা যে কোনও মুহূর্তে নাদির শাহকে হারিয়ে দিতে পারে।
নাদির প্রথমেই মুঘল সেনাকে সরাসরি আক্রমণে প্রলুব্ধ করলেন। মুঘলরা কাছাকাছি আসতেই পারসিক সেনারা পরদা ফাঁক করার মতো দু’ভাগে সরে গেল। দেখা গেল, ঘোড়ার ওপর ‘সুইভেল গান’ নিয়ে সব পারসিক সেনা। সুইভেল গান মানে, বন্দুকটা ঘোড়ার পিঠে একটা জায়গায় রেখে, গুলি চালাতে চালাতে যে কোনও দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের এই নতুন আবিষ্কারটি মুঘলদের হাতে ছিল না। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে সেই বন্দুক দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাল
নাদির শাহের সেনারা। কয়েক মিনিটের মধ্যে মুঘল সেনা নিথর হয়ে মাটিতে।
অতঃপর দিল্লিতে লুঠতরাজ। যাবতীয় সোনারুপো গলিয়ে, ময়ূর সিংহাসন নিয়ে স্বদেশে পাড়ি জমালেন নাদির শাহ। পুরোটা অবশ্য নিয়ে যেতে পারেননি। গ্রীষ্মশেষে সে বার প্রবল বর্ষা নামল, সোনাদানার বস্তা-বোঝাই কিছু ঘোড়া, খচ্চর ঝিলাম নদীর স্রোতে হারিয়ে গেল। হিন্দুকুশ পর্বত পেরনোর সময় আরও কিছু প্রাণী পা পিছলে খাদে পড়ে গেল। কিন্তু লুঠতরাজের বেশির ভাগ ধনরত্নই যে ভারত ছেড়ে চিরতরে চলে গেল, নির্দ্বিধায় বলা যায়।
অভিসারিকা: বর্ষার রাতে কুঞ্জবনের পথে শ্রীরাধা
নাদির শাহের এই চূড়ান্ত আঘাতই মুঘল সাম্রাজ্যকে ফোঁপরা, দেউলিয়া করে দিল। এর আগে অর্ধশতাব্দী ধরে সেই সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হচ্ছিল, কিন্তু এর পর সে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। প্রজারাও যেন মুক্তির স্বাদ পেল। ২০০ বছরের মুঘল শাসন শেষে বেশ কিছু অঞ্চলে হিন্দু রাজারা স্বাধীন হলেন।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চলে এল অর্থনীতি ও শিল্পের স্বাধীনতা। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এ সব রাজ্যে মিনিয়েচার ছবির চিত্রশালা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৭৩৯ সালে, নাদিরের আক্রমণের পর সেই সব রাজ্যের রাজস্ব আর দিল্লিতে পাঠানোর দরকার পড়ল না। রাজারা নতুন ভাবে স্থানীয় কেল্লা, প্রাসাদের সংস্কারে মন দিলেন, মিনিয়েচার ছবির বরাত দিলেন। ইতালির রেনেসাঁয় যেমন ফ্লোরেন্স, জেনোয়া এক একটা শহর তৈরি করেছিল শিল্পকলার নিজস্ব ভাষা, ভারতেও সে রকম ঘটল।
রাজস্থানি মিনিয়েচার ছবির আসল কথা এটাই। হিমাচল থেকে রাজস্থানের মরুভূমি, পঞ্জাবের সমতল অবধি তখন প্রায় দুই ডজন রাজপুত রাজ্য। মুঘলরা এঁদের মিত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, রাজপুত কন্যাদের বিয়েও করেছিলেন। বহু বিশ্বাস ও বহু সংস্কৃতির এই মিলন থেকেই মুঘল ও রাজপুত মিনিয়েচার ছবির সৃষ্টি।
এই মিলনধারায় কে নেই? আকবরের মা হামিদাবানু শিল্পীদের নির্দেশ দিয়ে তাঁর জন্য চিত্রিত একটি রামায়ণ তৈরি করিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগেও সেটি পাঠ করার জন্য চেয়ে পাঠালেন। শাহজাহানের ছেলে দারাশিকো ফারসি ভাষায় ভগবদ্গীতা তরজমা করালেন। তাঁর বিশ্বাস, কোরানের ধর্মীয় সূত্রের সঙ্গে বেদ ও উপনিষদের অনেক জায়গাতেই মিল রয়েছে। আকবর বুঁদির রাজা সুর্জন সিংহকে বারাণসীতে রাজ-প্রতিনিধি করে পাঠালেন, সুর্জন সিংহ দেশে ফেরার সময় তাঁর কেল্লা ও রাজপ্রাসাদ সংস্কারের জন্য বারাণসীর মুসলমান শিল্পীদের নিয়ে এলেন। রাজস্থানের আম্বের বা মধ্যপ্রদেশের ওর্ছায় রাজপুত রাজারা দিল্লির লালকেল্লার আদলে দরবারকক্ষ তৈরি করলেন। নাদির শাহের দিল্লি আক্রমণের এক দশক আগেই আর একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। মুঘল দরবারে আগে যা হয়নি, সম্রাট মহম্মদ শাহের দরবারে সেতার ও তবলার সঙ্গতে রাধাকৃষ্ণের প্রেম নিয়ে ধ্রুপদ গেয়ে শোনানো হয়েছে। হিন্দু বনাম মুসলমান নয়, বহু সংস্কৃতির এই উজানেই মুঘল ও রাজপুত মিনিয়েচার ছবির জগৎ।
এই উজান শিল্পের। ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সাল অবধি সারা ভারত জুড়ে যখন বিভিন্ন রাজ্য প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শানাচ্ছে, তখনও রাজপুত মিনিয়েচারে যুদ্ধের কোনও প্রতিচ্ছবি নেই। সেখানে সুন্দরী মেয়েরা প্রমোদকাননের দোলনায় ঝোলে, প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘন অরণ্যে মিলিত হয়, রাজকন্যা প্রাসাদের ছাদ থেকে বিরহাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শৃঙ্গার রসই এই সব চিত্রকলার থিম।
আরও পড়ুন: জেমস বন্ডও তাঁর কাছে ছিলেন শিশু
মুঘল পেইন্টিং-এর থেকে রাজপুত মিনিয়েচার এখানেই আলাদা হয়ে গেল। মুঘল চিত্রকলাই ছিল উৎস, কিন্তু ছোট্ট একটা তফাত আছে। আকবর, জাহাঙ্গিরের আমল থেকে মুঘল দুনিয়া পোর্ট্রেট আঁকা, একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ, প্রকৃতিবীক্ষণের মাধ্যমে শাসন, স্মৃতিকথা ও রাজনীতির কথা বলে। তার পাশে রাজপুত মিনিয়েচার মিথ, পুরাণ ও কবিতার কথা বলে।
উৎস একই, কিন্তু ওই যে বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষার মিলিত স্রোত! মিনিয়েচার ছবির জগৎ মুঘলরাই প্রথম দেখিয়েছিল। কিন্তু রাজপুত চিত্রকলায় তার সঙ্গে এল ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব। রাধা-কৃষ্ণের বিরহ তো শুধু ঐশ্বরিক নয়, ভগবানের সঙ্গে মিলনের জন্য ভক্তের আর্তি। ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব জানত, ধর্ম, অর্থের পাশাপাশি কামও মোক্ষ লাভের অন্যতম বর্গ। মিনিয়েচার ছবির প্রথম ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষক, ঔপনিবেশিক শাসক ডব্লিউ জি আর্চার এই কথাটাই পরিষ্কার ভাবে লিখেছিলেন, ‘এই সব ছবিতে ফুল শুধুই ফুল নয়। মেঘও নয় নিছক মেঘ। মেঘ, বৃষ্টি আর বিদ্যুৎচমক এখানে প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গনের প্রতীক।’ রাজপুত মিনিয়েচার ছবিতে তাই বজ্রবিদ্যুতের মাঝে পথ চলেন শ্রীরাধা। তাঁর পাশে ফলভারানত আমগাছ, পায়ের কাছে সাপ। দয়িতের সঙ্গে মিলনপথে, বাদলা রাতের অন্ধকারে সেই সাপও তুচ্ছ।
বাঙালি পাঠকের মনে পড়তে পারে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: শ্রাবণ মাসে ঘন ঘন বরিষে/ সেজাত সুতিআঁ একসরী নিন্দ না আইসে। …শ্রাবণ মাসে একাকিনী শয্যায় নিদ্রা আসে না। আষাঢ় মাসে নতুন মেঘের গর্জন। বড়ায়ি, এই ভরা যৌবনে কানু নিরাশ করল।
বৈষ্ণব ভাবে প্রাণিত রাজপুত মিনিয়েচার ছবিতে তাই হিন্দু বনাম মুসলমান নেই। ভারতীয় শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ এই ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল দুইয়ের মিলনেই। ১৭১৯ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখশিয়র মারা গেলেন, তাঁর প্রাসাদের অন্যতম চিত্রকর ভবানীদাস দিল্লি ছেড়ে চলে এলেন জয়পুরের অনতিদূরে কিষণগড়ের রাজার কাছে। তখনকার হিসাব-বই জানাচ্ছে, মুঘল ঘরানায় প্রশিক্ষিত শিল্পীরা স্থানীয় শিল্পীদের থেকে বেশি নজরানা ও উপঢৌকন পেতেন। সংস্কৃত নন্দনতত্ত্ব জানত, শিল্পীর ধর্মের ওপর সমঝদারিত্ব নির্ভর করে না। সহৃদয় দর্শক বা পাঠকই সেখানে আসল ভোক্তা। ১৯১৬ সালে যখন হিন্দুস্তান-পাকিস্তান নিয়ে ভারত বিতর্কের মধ্যগগনে, হিন্দু ও মুসলমানেরা নিজেদের আলাদা জাতিসত্তা ভাবতে শুরু করল, সেই সময়েও নন্দনতাত্ত্বিক কুমারস্বামী জানাচ্ছেন, ‘রাজপুত মিনিয়েচার ছবির জগৎ পরাবাস্তব বা কাল্পনিক নয়, বরং শিল্পসুষমা ও চিরন্তন ভাবনার প্রকাশ। প্রেমের দৃষ্টি থেকে যাঁরা বঞ্চিত নন, তাঁরা অবশ্যই এর রসাস্বাদনে সক্ষম হবেন।’
এ সবের মধ্যেই উনিশ শতকে এল আধুনিক ফোটোগ্রাফি। লোকে তখন বক্স ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ‘বাবু, চেহারা উঠাইবেন?’ হারিয়ে গেল মিনিয়েচার ছবির সমঝদারিত্ব।
পঞ্চাশের দশকেও রাজপুত রাজারা মাত্র কয়েক হাজার ডলারের বিনিময়ে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই সব ছবি বিক্রি করে দিয়েছেন। ইন্দিরা গাঁধীর রাজন্যভাতা বিলোপ ও নানাবিধ সমাজতান্ত্রিক কার্যকলাপের সময়টা সংগ্রাহকদের স্বর্ণযুগ। তখনই রাজস্থানের রাজপরিবারগুলি থেকে বাজারে অজস্র মিনিয়েচার বাজারে আসতে শুরু করে, দামও কমে যায়।
বিলুপ্তির কিনারে দাঁড়ানো, অন্য যুগের রাজনীতি ও নান্দনিক বোধে উজ্জীবিত রাজপুত মিনিয়েচার আজ দুনিয়ার অনন্য ঐতিহ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy