সন্ধিক্ষণ: অষ্টমীর শেষ ও নবমীর শুরু নিয়ে হয় এই বিশেষ পুজো। একশো আটটি প্রদীপ জ্বালানো সন্ধিপুজোর অন্যতম অঙ্গ
অষ্টমী তিথির শেষ লগ্নে এবং নবমীর সূচনামুহূর্তে যখন দেবীর সম্মুখে একশো আটটি প্রদীপ জ্বলে ওঠে, ঢাকের তুমুল বাদ্য পৌঁছে যায় দূর-দূরান্তে, বোঝা যায় সন্ধিপুজো চলছে। আগে পরাক্রমশালী রাজা বা জমিদারদের আমলে সন্ধিপুজোর সূচনায় কামান দাগার বা তোপধ্বনির রেওয়াজ ছিল। আর ছিল একশো আটটি পশুবলি। কালের নিয়মে রাজার শাসন ও জমিদারিতন্ত্রের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটায় কামান দাগার রেওয়াজ এখন নেই বললেই চলে। তবে কোনও কোনও পারিবারিক পুজোয় পশুবলির বিষয়টি আজও চলে আসছে। চার দিনের দুর্গাপুজোর যে সামগ্রিক উদ্যাপন, সেখানে সন্ধিপুজো এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। অথচ সন্ধিপুজোর সেই বিশেষ মুহূর্তে আমরা ভেবে দেখি না যে দুর্গাপুজোর সাধারণ আচারবিধি এবং পদ্ধতির সাপেক্ষে এই পুজো কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ কথা বলার কারণ, সাধারণ ভাবে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দুর্গাপুজো সম্পন্ন হয় বৈদিক মতে। অথচ সন্ধিপুজো সম্পন্ন হয় তন্ত্রমতে। অর্থাৎ অন্য ভাবে বললে সন্ধিপুজো হল বৈদিক দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ তান্ত্রিক অঙ্গ। অতএব প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, প্রধানত বৈদিক দুর্গাপুজোর বিধি-ব্যবস্থাতে তন্ত্রভিত্তিক সন্ধিপুজোর বিশেষ কী তাৎপর্য। যে হেতু শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গাপূজা রাম কর্তৃক অকালবোধন নামে পরিচিত, সেই রামের ভূমিকা এ ক্ষেত্রেও সমান ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে রাম রাবণ বধের জন্য দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমীতে। বৃহদ্ধর্মপুরাণের আখ্যানে রাবণের মধ্যম ভ্রাতা অতিকায় দৈত্য কুম্ভকর্ণ ত্রয়োদশীতে, অমাবস্যার রাত্রিতে ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, প্রতিপদে মকরাক্ষ, দ্বিতীয়াতে দেবান্তক প্রমুখ শক্তিশালী বীর রাক্ষসেরা রামের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলেন। এর পরে স্বয়ং রাবণের সঙ্গে অন্তিম যুদ্ধের কালে সপ্তমীতে দেবী রামের অস্ত্রে প্রবেশ করলেন। অষ্টমীতে রাম-রাবণের প্রবল যুদ্ধ হল, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণকে রাম বধ করলেন। বোঝাই যায় যে বৃহদ্ধর্মপুরাণের এই আখ্যান প্রচলিত কাহিনির থেকে পৃথক। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে নবমী পুজোর অন্তে দশমীর দিনে রাম রাবণকে বধ করেছিলেন।
এখন বৃহদ্ধর্মপুরাণের এই আখ্যান অনুসারে দেবী রামের মনোবাসনা অর্থাৎ রাবণ বধে সহায়তা করেন চণ্ডিকা রূপ ধারণ করে। কিন্তু দেবীর এই চণ্ডিকা রূপ কি সরাসরি তাঁকে তান্ত্রিক দেবী হিসেবে শনাক্ত করে? অবশ্য ‘চণ্ডিকা’ নামের ব্যঞ্জনায় তন্ত্রের সঙ্গে এই দেবী রূপের আভাস অনেকেই পেতে পারেন। তৎসত্ত্বেও বৃহদ্ধর্মপুরাণে এ বিষয়ে সরাসরি কোনও দিকনির্দেশ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যায় না। সন্ধিপুজোর সময়কালকে যদি বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখা যাবে, মহাষ্টমীর শেষ এক দণ্ড এবং মহানবমীর প্রথম দণ্ড, অর্থাৎ ২৪+২৪=৪৮ মিনিট ধরে এই পুজো হয়। আশ্চর্যের কথা এই যে, বৃহদ্ধর্মপুরাণ মতে দেবী পূজিতা হন না, কালিকাপুরাণ অনুযায়ী দেবীকে আবাহন করা হয় এবং সন্ধিপুজোর বৈশিষ্ট্যই হল, এখানে বৈদিক মতে পূজিতা দেবী দুর্গাকে চামুণ্ডারূপে আরাধনা করা হয়। অবশ্যই তান্ত্রিক মতে যথাবিহিত পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে সংক্ষিপ্ত ন্যাসাদি করে চামুণ্ডার ধ্যানান্তে ষোড়শোপচারে দেবী পূজিতা হন। কালিকাপুরাণ অনুযায়ী পুজোর শেষ অর্ধে, অর্থাৎ মহানবমীর প্রথম ২৪ মিনিটের মধ্যে এই পশুবলির বিধান দেওয়া আছে। সেই ভাবেই সন্ধিপুজোর শেষ ২৪ মিনিটের কালপর্বে দেবী চামুণ্ডার উদ্দেশ্যে বলি প্রদানের ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। ইদানীং পশুবলির পরিবর্তে আখ, কুমড়ো ইত্যাদি ফল ও আানাজকেও বলির উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হচ্ছে। আবার পশুবলির দৃষ্টান্তও কমবেশি পরিলক্ষিত হয়। যে ভাবে সন্ধিপুজোর ক্রিয়া-অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হয়ে থাকে, তাতে সব মিলিয়ে এটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে, এই বিশেষ পুজোয় সাত্ত্বিক দেবী তামসিক রূপে পূজিতা হন এবং তাঁর এই তামসিক রূপেরই আরাধনা করা হয় তান্ত্রিক পদ্ধতিতে।
এত কিছুর পরেও যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকে যায় তা হল, কী কারণে বৈদিক মতে পূজিতা দেবী দুর্গার আরাধনায় তামসিক রূপের নিমিত্ত তান্ত্রিক পদ্ধতিতে সন্ধিপুজোর আয়োজন করতে হল। শাস্ত্রীয় দিক থেকে বিচার করলে ‘যে কৃষ্ণ সেই কালী’-র মতো করে সমন্বয়বাদী ভাবনাকে অনুসরণ করে অনেকেই হয়তো বলবেন যে শাক্ত ধারার যে বৈদিক এবং তান্ত্রিক ঐতিহ্য, সন্ধিপুজোর সূত্রে দুর্গাপুজোর ন্যায় মহাশক্তির আরাধনায় এই দুই ঐতিহ্যের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। সে দিক থেকে যে তাৎপর্যটি উঠে আসে তা হল, শারদীয়া দুর্গাপুজো সেই ধর্মীয় উদ্যাপন, যেখানে বৈদিক ও তান্ত্রিক ধর্মীয় মতের সমন্বয় সাধিত হয়েছে, যা এক ভাবে ভারতবর্ষের মূল সুর ‘বিবিধের মাঝে মিলন’-কেই যেন কোথাও ছুঁয়ে যায়। কিন্তু সমন্বয়বাদী এই ধারণাকে স্বীকার করেও প্রশ্ন জাগে, এই সমন্বয়ের প্রয়োজন হল কেন। প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা এখানেই যে, যে সমন্বয়ের ধারণাকে এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, তা যেমন দু’টি ভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় নয়, তেমনই আবার একই ধর্মের দু’টি পৃথক শাখার মধ্যেও মিলন নয়। এখানে সমন্বয় সাধিত হচ্ছে একই হিন্দুধর্মের অন্তর্গত বিশেষ শাক্ত ঐতিহ্যের দু’টি মতের মধ্যে। সমন্বয়ের এই ধারাকে যদি এক বার আমরা এই ভাবে দেখতে শুরু করি, সে ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় মাত্রাকে ছাপিয়ে বিশেষ ঐতিহাসিক এবং সামাজিক পটভূমির সন্ধান পেতে পারি। তখন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে দু’টি বিশেষ শাস্ত্রমতের গণ্ডিতে আবদ্ধ না থেকে এক বৃহত্তর সামাজিক-ধর্মীয় পরিবর্তনের নিরিখে বিষয়টি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
আসলে অষ্টম শতাব্দীতে ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে। বাংলার পাল রাজাদের আমলে এই ধর্ম আরও কিছু দিন টিকে ছিল। কিন্তু বাংলাতেও ক্রমবর্ধমান হিন্দুধর্মের দাপটে বৌদ্ধদের নিজেদের সাধনপদ্ধতি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ক্রমশ অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে নিজস্ব সাধনপদ্ধতি গুপ্ত ভাবে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক ঐতিহ্য। উদ্দেশ্য হিন্দুধর্মের হাত থেকে বৌদ্ধ সাধনপদ্ধতিকে রক্ষা করা এবং চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই ভাবে যে বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি হল, ভারতে তথা বাংলায় মুসলিম শাসনকালে এই বৌদ্ধতন্ত্রেরই বেশির ভাগ রীতিনীতি হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। বৌদ্ধরা যে হিন্দুধর্মের হাত থেকে নিজেদের সাধনপদ্ধতিকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে তন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন, মুসলিম বিজয়ের ফলস্বরূপ হিন্দুধর্মকেও অতঃপর একই পন্থা অবলম্বন করতে হয়। যার ফলে বৌদ্ধতন্ত্রের অনেক কিছুই হিন্দুধর্মের উপাসনা পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়, সচেতন অথবা অচেতন যে ভাবেই হোক না কেন। দীর্ঘ মুসলিম শাসনে বাংলায় যে সকল শক্তিশালী দেশীয় হিন্দু রাজা এবং জমিদারদের আবির্ভাব হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে কমবেশি তাঁরা সকলে হিন্দুধর্ম রক্ষার্থে তান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। বিশেষ উদ্যোগ করেন যাতে এর মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্ম ইসলামি আগ্রাসনের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। মধ্যযুগের হিন্দু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধীরে ধীরে তান্ত্রিক পদ্ধতি হিন্দু উৎসবাদির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, যার অন্যতম নিদর্শন এই সন্ধিপুজো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। কারণ অষ্টাদশ শতকের বাংলায় এক জন নেতৃস্থানীয় হিন্দু রূপে তিনি যে সকল শাক্ত উৎসবের সূচনা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, সেখানে বৈদিক রীতির স্থানে তান্ত্রিক রীতিকেই প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ তাঁর প্রচলিত শক্তিপূজায় দেবী অন্নপূর্ণা ও জগদ্ধাত্রী পূজিতা হন তান্ত্রিক মতে, বৈদিক মতে নয়।
অর্থাৎ এমন মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, দেবীর সন্ধিপুজো পরবর্তী সময়ে প্রক্ষিপ্ত, যখন তন্ত্রমত দেশীয় হিন্দু রাজাদের হাত ধরে হিন্দু সমাজে মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। আজকের দিনে সন্ধিপুজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো, আতশবাজি ফাটানো কিংবা পশুবলি ইত্যাদি সহযোগে যে পরিবেশটি রচিত হয়, তার সঙ্গে অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায় আসন্ন শ্যামাপুজোর। সময়ের নিরিখে দেবী দুর্গার তুলনায় কালী অনেক নবীনা। তা ছাড়া বহু দিন যাবৎ সাধারণের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ়মূল ছিল যে দশমহাবিদ্যার দেবীকে প্রকট করে পুজো করতে নেই। এই দশমহাবিদ্যার প্রধান দেবী যে হেতু কালী, অতএব এই কালীর আরাধনা যে অনেক পরের ঘটনা, সেটা সহজেইঅনুমেয়। তবে বৈদিক দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজোর মধ্য দিয়ে এই তান্ত্রিক হস্তক্ষেপ, তা যেন কোথাও আমাদের তামসিকতার প্রতি ঝোঁককে প্রতিফলিত করে। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপুজোর মধ্য দিয়ে আমরা যেন তামসিক রূপের সর্বপ্রধানা দেবী কালীকে আহ্বান জানাতে প্রস্তুত হই, এবং সেটাই স্বাভাবিক। কালকে কলন করেন যে কালী, তাঁকে আবাহন ও যথাবিহিত পুজোর মধ্য দিয়েই তো সমাপ্তি ঘটে মাতৃপক্ষের, যে পক্ষের প্রধান উৎসব শারদীয়া দুর্গাপুজো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy