Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Remembering Gauhar Jaan

তাঁর প্রতিভার প্রতিস্পর্ধায় কেঁপে গিয়েছিল পুরুষতন্ত্র

কিন্তু তাঁর প্রেমের আকুতির দিকে ফিরে তাকাননি কেউই। বহিরঙ্গে তাঁর জীবন বর্ণময়। তাঁর গয়না পাহারা দিত সশস্ত্র রক্ষী, তাঁকে নিয়ে যেতে ভাড়া করা হত গোটা রেলগাড়ি, পোষা বিড়ালের বাচ্চা হতেও নাকি কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে পার্টি দিয়েছিলেন।

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:০৯
Share: Save:

কলকাতার নেশাঙ্গনে নিশাঝড় তুলছেন যে নবীনা, তিনি কি জানেন, লখনউ-মুদ্রার যে-কণামাহাত্ম্যে রোজ আসর মাত করেন, তাতে গোটা উপমহাদেশ কাঁপাতেন এক নারী?

মুম্বইয়ের নামী স্টুডিয়োয় যে শিল্পী আবারও তুমুল গান উপহার দিতে চলেছেন জাতিকে, জানেন তিনি যে, এ গানেরই আদিরূপে বৈয়াকরণের কাঠিন্য মাধুর্যে ভাসিয়েছিলেন এক ‘তওয়াইফ’?

দিল্লির উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আমলা-কনসার্টে যে গায়িকা ‘নাউ, আয়্যাম গোয়িং টু প্রেজ়েন্ট আ ট্র্যাডিশনাল সং’ বলে ধরলেন বহুশ্রুত ঠুংরি, তিনি জানেন, গানটা কার তৈরি?

জন্মের দেড়শো বছর কেটে যাওয়ার পরেও গওহরের ‘জান’ বেঁচে এঁদের সবার মধ্যে, উত্তরাধিকারে। কৃত্রিম মেধামন্ত্র আর প্রযুক্তিবাজিতে প্রয়াত শিল্পীর কণ্ঠে নবগান সংস্থাপনে এ আর রহমান ‘সফল’ যদিও হন, গওহরের ক্ষেত্রে সে সুযোগ সম্ভবত কম। প্রথম কারণ, রেকর্ডে ধরা গওহরের ক্ষয়ক্ষীণ কণ্ঠকে আজ আর স্বকীয়-মধুর বলা যায় না। দ্বিতীয় কারণ, যাপিত শীতের ক্লান্ত জীবনমূল্যে পাওয়া এক বাজার-বসন্তের নাম গওহর। বসন্ত এসে গেলে যে শিহরনের আর আন্দাজ মেলে না ইতিহাসে বা মেধায়!

‘রসকে ভরে তোরে নয়না’

পানশালায় কান-পোড়ানো সাউন্ডবক্সে ‘রসকে ভরে তোরে নয়না’। কে না জানেন, অজয়-করিনার ‘সত্যাগ্রহ’ ছবিতে গেয়েছেন শফকত আমানত আলি, প্রসূন জোশীর লিরিকে, আদেশ শ্রীবাস্তবের সুরে। তবে রাগরূপ বদলালেও শুরুর পঙ্‌ক্তিটি গওহরজানের। গওহর-গানেরই ‘অ্যাডাপ্টেশন’ ঘটিয়েছেন আমানত-প্রসূন-আদেশরা। যেমন, জয়দেব ১৯৭৮ সালে হীরাদেবী মিশ্রের গলায় এই গানেরই অন্য বয়ানে নেশা ধরিয়েছিলেন।

‘রসকে ভরে তোরে নয়না’ গওহর রেকর্ড করেছিলেন কলকাতায়, ১৯০৮ সালে। ভৈরবী ঠুংরি। তাঁরই কম্পোজ়িশন। ‘হে পথিক, কৃষ্ণের দেখা পেলে জানিয়ো, রাধিকার দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে! জিজ্ঞেস কোরো, কবে ফিরবেন বৃন্দাবনে?’— পরে অজস্র বার নানা শ্রুতিকৃতী রের্কড করেছেন এ গান। ভীমসেন জোশীর কণ্ঠে প্রণম্য হয়ে উঠেছে। বহু ছবিতে ব্যবহার হয়ে চলেছে আজও ‘রসকে ভরে’।

এমনই নানা গওহর-গান। যেমন, তিলক-কামোদে কাজরি ‘আয়ি কারি বদরিয়া’, পাহাড়ি-ঝিঁঝিটে দাদরা ‘যাও যাও মোসে না বোলো’ কিংবা মালকোশে খেয়াল ‘কৃষ্ণ-মাধো-রাম নিরঞ্জন’। এ সবের কিছু গওহরের রচনা, কিছু গুরুকুলবাহিত। তবে প্রায় সব ক’টিরই প্রথম রেকর্ড গওহরজানের।

সে ইতিকথার সিংহভাগ গাঁথা কলকাতার চিৎপুর রোডের বাড়িতে। সেখানে থাকতেন গওহরজান। যাঁর প্রতিভার প্রতিস্পর্ধায় কম্পমান ছিল দেশি-বিদেশি পুরুষতন্ত্র, আর যাঁর প্রেমের কাঙালপনার দিকে ফিরেও তাকাননি কেউ।

বাবু-বিবি সম্বাদ

বারাণসীর অনতিদূরে আজমগড়। দু’টি চরিত্র— হার্ডি হেমিংস, রুক্মিণী। রুক্মিণীকে বিয়ে করেছিলেন হার্ডি। রুক্মিণী খ্রিস্টধর্ম নিয়ে এলিজা হন। সুখী দাম্পত্যে দু’টি মেয়ে হয়েছিল। হার্ডির অকালমৃত্যুতে এলিজা কাজ নিলেন কারখানায়। সেখানে সুপারভাইজ়ার আর্মেনীয় তরুণ রবার্ট উইলিয়ম ইয়োওয়ার্ড। এলিজার বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়া প্রেমে পড়ল রবার্টের। বিয়ের পরের বছর, ১৮৭৩ সালের তেসরা জুন তাঁদের মেয়ে জন্মাল— এলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড।

রবার্ট কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সুকণ্ঠী ভিক্টোরিয়া কবিতাও লিখতেন। প্রতিবেশী এক সঙ্গীতজ্ঞের পরামর্শে শুরু হল গান শেখা। সঙ্গীতজ্ঞ যোগেশ্বর ভারতীর সঙ্গে সাধারণ বন্ধুতা হয়েছিল ভিক্টোরিয়ার। কিন্তু অন্য সন্দেহে ‘ডিভোর্স’ দিলেন রবার্ট। সকন্যা ভিক্টোরিয়াকে বাড়িছাড়া করলেন।

ভিক্টোরিয়া অথৈ জলে। এলিজার কাজ বন্ধ। অ্যাঞ্জেলিনা অসুস্থ। গান শেখাতে শুরু করলেন ভিক্টোরিয়া। দারিদ্র শুকোল না। এখানে আবির্ভাব নতুন চরিত্র, খুরশিদ, এসরাজে-কাব্যে ঝোঁক। খুরশিদ সাহায্যেরই প্রস্তাব দিলেন। তবে স্পষ্ট জানালেন, তিনি ভিক্টোরিয়ার শয়নাভিলাষী। প্রস্তাবে ‘চিরস্থায়ী’ বন্দোবস্তের অঙ্গীকার থাকায় মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে ভিক্টোরিয়া রাজি হলেন এবং সমাজ তাঁকে ‘নষ্ট মেয়ে’ বলল। এলিজা-ভিক্টোরিয়া-অ্যাঞ্জেলিনা-খুরশিদ চলে এলেন বারাণসী। বাড়ির ব্যবস্থা, শাড়ির ব্যবসা, ভিক্টোরিয়া-অ্যাঞ্জেলিনার ধর্মান্তর গ্রহণ— সব করলেন খুরশিদ।

ইসলামে দীক্ষিত হয়ে ভিক্টোরিয়ার নাম হল মলকা, যিনি পরে ‘বড়ে মলকাজান’ হবেন। আর বছর ছয়-সাতের অ্যাঞ্জেলিনার নতুন নাম গওহর, ফারসি-মানে রত্ন, যে নামের সামনে এক দিন সসম্ভ্রম দাঁড়াতে বাধ্য হবেন বণিক, জমিদার, রাজা, নবাব, ইংরেজ কর্তা, সঙ্গীতবেত্তা, যৌনকর্মী, শিল্পী, ধর্মপ্রাণ, আইনজ্ঞ, স্বাধীনতা-যোদ্ধা। যে নামের কণ্ঠতরঙ্গে কম্পিত হবে দেশের প্রথম বাণিজ্যসফল গ্রামোফোন রেকর্ড— ১৯০২ সালের নভেম্বরে, কলকাতায়— সাত ইঞ্চির এক-পিঠের ডিস্ক— গানের শেষে স্বরস্বাক্ষর ‘মাই নেম ইজ় গওহরজান’।

‘ইতনে যোবন দমন না করিয়ে’

‘বাই’ শব্দটি সম্মাননাসূচক। ‘জি’-সংযোগ সম্বোধন-অঙ্গ। কিন্তু ‘বাইজি’র শব্দার্থ বদলে হল নর্তকী-গায়িকা, পরে দেহোপজীবিনী নর্তকী-গায়িকা।

প্রতিভা-পরিশ্রমে বাইজি হিসেবে নাম করলেন মলকা। নামে জুড়ল ‘জান’ শব্দটিও। ‘জান’ তাঁরাই, যাঁরা নাচে-গানে শাস্ত্রসম্মত পারদর্শী। ‘মলকাজান’ নামে তখন আরও তিন জন কাঁপাচ্ছেন— মুলক-পুখরাজ মলকাজান, আগ্রাওয়ালি মলকাজান, চুলবুলওয়ালি মলকাজান। তাই বারাণসীর মলকা হয়ে উঠলেন ‘বড়ে মলকাজান’।

এ বার মলকা নজর দিলেন মেয়ে গওহরের কলানৈপুণ্যের বিকাশে। পেয়ে গেলেন নামী শিক্ষক বেচু মিশ্রকে। গওহর ডুব দিলেন মার্গসঙ্গীতসমুদ্রে। মেহফিলে মায়ের সঙ্গে গলা শোনা যেতে লাগল মেয়েরও। খুরশিদ এ বার কলকাতায় গিয়ে ব্যবসার কথা ভাবলেন। মা মারা যাওয়ায় বিমর্ষ মলকা। সবাই বলছে, মলকাজানের উচিত কলকাতা যাওয়া। সেখানে রয়েছেন কলাশিল্পের শ্রেষ্ঠ মানুষটি, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। বাঁশির সমাদর শ্রীকৃষ্ণ করবেন না তো কে করবেন!

সপরিবার কলকাতায় এলেন মলকাজান।

উজানপথে গহিন জলে

মলকাজানেরা কলকাতার চিৎপুরে ভাড়াবাড়িতে। মলকাগমনের বার্তা রটি গেল ক্রমে। এই ‘রটি গেল ক্রমে’ লিখবেন যিনি, তাঁদের পরিবার ঠাকুরবাড়ি নানা তরফে তখন বিরাজ করছে কলকাতায়। রয়েছে অভিজাত নানা বাবু-পরিবারও। এই সব পরিবারই সঙ্গীতপিপাসু, বাইজিবান্ধব। ১০ বছরের গওহর যখন কলকাতায়, রবীন্দ্রনাথ তখন ২২, মেটিয়াবুরুজের নবাব ৬১।

নবাবের আমন্ত্রণ দেরি করল না। এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন মলকা! ঠিক করলেন— দরবারে মেয়েকে নিয়েই গাইবেন নবাব-রচিত দুই সুগন্ধি বন্দিশ— ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরী’, ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়’।

স্বপ্নের দিন। আসরে পৌঁছে দেখলেন— ঠিক ওই দু’টোই গাইছেন নামী তহেরাবিবি! আকাশ ভেঙে পড়ল মলকার। তাঁদের ডাক এল।তাঁরাও ওই দু’টি গানই পেশ করলেন। সভা দেখল— শ্রাবণ ঘনিয়েছে নবাবের চোখে, অঝোর কাঁদছেন।

মলকাজানকে সভাগায়িকা নিযুক্ত করলেন ওয়াজিদ আলি। সে দিন দরবারে ছিলেন এমন এক গায়ক-নৃত্যশিল্পী, যাঁদের ঘরানাকে আজ লখনউ ঘরানা বলা হয়। তিনি বিন্দাদীন মহারাজ। তিনি মুগ্ধ গওহরের প্রতিভায়। গওহরের শিক্ষার ভার নিতে চান। হাতে পৃথিবী পাওয়ার পর চাঁদও পেলেন মলকাজান।

কে বিন্দাদীন? পাঠক, আমরা বরং সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিটি একটু দেখে নিই। ওই যে বসে ওয়াজিদ-রূপী আমজাদ খান। ওই যে মহল আলো করে নাচছেন শাশ্বতী সেন। ওই যে তারযন্ত্রী আর তবলচির সঙ্গে গায়কটি গাইছেন— ‘কানহা, ম্যায় তোসে হারি’। ভৈরবী ঠুংরি। যাঁর রচনা, তিনি বিন্দাদীন। ছবিতে কণ্ঠটি ব্রিজমোহননাথ মিশ্রের। বিরজু মহারাজ। তিনি বিন্দাদীনের পৌত্র— বিন্দাদীনের ভাই কালিকাপ্রসাদের ছেলে অচ্চনমহারাজের সন্তান।

পসার বাড়ায় ভাড়াবাড়িটা ৪০ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছিলেন মলকা। বিন্দাদীনের কাছে ঠুংরি-কত্থকের তালিমের পাশাপাশি মলকা মেয়েকে আরও ‘কিছু’ শিক্ষক দিলেন। সৃজনবাইয়ের কাছে ধ্রুপদ। রমেশচন্দ্র দাসের কাছে কীর্তন। বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে বাংলা গান। মেয়েকে ফারসি-উর্দু নিজেই শেখাতেন, ইংরেজির জন্য ‘টিচার’। মায়ের কাছে কবিতা লেখার হাতেখড়িও ঘটল গওহরের। কিন্তু মলকার খ্যাতি খুরশিদের হীনম্মন্যতার জ্বলন-শলাকা হল। স্বভাব বদলাল খুরশিদের। এক দিন খবর এল— খুন খুরশিদ। জগৎ শূন্য গওহরের। পরে যখন মায়ের কাছে শুনল, খুরশিদ তার আসল বাবা নন, দগ্ধ হল গওহর।

গওহর ধর্ষিত হল তেরোতম জন্মদিনে। সে দিন ছিল পেশাপ্রথার নথভাঙা অনুষ্ঠান। বহু বাবু নিমন্ত্রিত। খানাপিনা-নাচাগানা। নেশায় চুর মলকা। নিয়মের নেশা করেছিল গওহরও। নিমন্ত্রিতদেরই এক জন খয়েরাগড়ের বুড়ো রাজা। পরের সকালে বিধ্বস্ত গওহরকে খুঁজে পাওয়া গেল। ত্রয়োদশীর নেশার ‘সদ্ব্যবহার’ করেছেন খয়েরাগড়াধিরাজ।

গওহর অন্তঃসত্ত্বা হল। সমাজ সামলাতে মেয়েকে বারুইপুর পাঠালেন মলকা। সেখানেই প্রসব— মৃত সন্তান।

প্রথম একক, ‘জান’-পহেচান

চিৎপুরে ফিরে মায়ের সঙ্গে আসরে বসলেও গওহর এখন জ়িন্দা লাশ। ১৮৮৭ সালে নবাব দেহ রাখলেন। মেটিয়াবুরুজ নিবে গেল। মলকাকে পেশায় মন দিতে হল। গওহরও লখনউ যায় বিন্দাদীনের তালিম নিতে। এরই মধ্যে আমন্ত্রণ দারভাঙারাজ লঙ্কেশ্বর সিংহের। মলকা ঠিক করলেন, পেশকারি করবে গওহর। যদি মেয়ের মন ভাল হয়।

দারভাঙা জয় করল চতুর্দশী গওহর। সভাগায়িকার খেতাব। তার নামেও জুড়ল ‘জান’। একই বছরে, ১৮৮৭ সালের শীতে গওহরের জীবনে প্রথম বসন্তসমাগম। বারাণসীর রাইবংশের তরুণ ছগন কলকাতায় এলেন গওহর শুনতে। প্রেমে পড়লেন গওহর। মলকা মেয়ের মুখে হাসি দেখলেন। গওহর-ছগনের সম্পর্ক জমে উঠল। ছগন গওহরকে বারাণসী নিয়ে যেতে চাইলেন। গওহর রাজি। রাজি মলকাও। বারাণসীতে কিছু কাল ‘দাম্পত্য’ কাটাল গওহর। তবে আবারও কাঁটা। ছগনের অন্যত্র বিয়ে ঠিক হল। ‘দয়ালু’ ছগন অবশ্য গওহরকে থেকে যেতেই বললেন। জানালেন, ‘অবৈধ’ আসা-যাওয়া কমলেও থাকবে, যদি না ‘বৈধ’ স্ত্রী আপত্তি করেন। এই প্রথম গওহর ‘রক্ষিতা’র অর্থ বুঝলেন। আঠারোর গওহর কলকাতায় ফিরে এলেন।

বেশ কিছু দিন আর গওহরজান রইলেন না গওহর। তবে আবারও পটবদল। কলকাতার শেঠ দুলিচাঁদের আসর। মূল আকর্ষণ ধ্রুপদ-ঠুংরির কিংবদন্তি গণপত রাও। আসরে বাকি নক্ষত্রদের সঙ্গে গওহরও। সে আসর মাতই করলেন গওহর। তবে গণপত পেশ করলেন মইজুদ্দিন নামের এক যুবককে। এঁকে গওহর দেখেছেন বেনারসে। দুলিচাঁদের আসরে যুবকের গানে বিহ্বল গওহর। সঙ্গে হারমোনিয়ামে গণপতের সুরগতি পাগল করে তুলল। গওহরের মনে হল, কিছুই শেখা হয়নি! অনুষ্ঠান-শেষে পায়ে পড়লেন গণপত-মইজুদ্দিনের। শিখতে চান। মাথায় সস্নেহ স্পর্শও পেলেন। শেখাবেন গণপত। লজ্জালীন মইজুদ্দিনও রাজি।

শিক্ষার্থী মন আজীবন সঙ্গ দিয়েছে গওহরকে। অনেকে বিশ্বাস করতে পারেননি, গওহরজানও শিখতে চান! শিখতে গিয়ে বিপন্নতাও এসেছে। যেমন, পাতিয়ালা ঘরানার কালে খান-পর্বে। খানসাহেব গওহরের বাড়িতেই থাকতে শুরু করলেন। শোনা যায়, ‘গুরুদক্ষিণা’ হিসাবে তিনি ‘ঘনিষ্ঠতা’ চেয়েছিলেন গওহরের। গুরুভার তানপুরা বিদেয় করেছিলেন গওহর।

‘মাই নেম ইজ় গওহরজান’

১৮৭৮ সালে টমাস এডিসনের সিলিন্ডার ফোনোগ্রাফ আবিষ্কারের সূত্র ধরে এমিল বার্লিনারের গবেষণার ফসল ১৮৯১ সালের প্রথম জিঙ্ক-ডিস্ক এবং গ্রামোফোন-শিল্প তৈরি হয়ে ওঠায় যিনি স্বরলিপির কাজ করে গিয়েছেন, তিনি পিয়ানোবাদক ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেসবার্ক। নাম বদলে ভারতে যখন পা রাখল ‘গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড’, তখন কিছু দেশি-বিদেশি সংস্থাও একই চেষ্টায় ব্রত। সবারই লক্ষ্য, ভারতের সাংস্কৃতিক-সাঙ্গীতিক বাজার ধরা।

বাজার ধরতেই রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গেসবার্গের ভারতে আসা। কলকাতায় দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করা। এক মজলিশে গিয়ে দেখলেন, সভায় মান্যগণ্য, রাস্তা লোকারণ্য। ঘোড়াগাড়ি থেকে নামলেন এক সুন্দরী। সভাগৃহে ঢুকলেন সালাম-প্রণাম করতে-করতে। স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে ইউরোপীয়দের সম্ভাষণ করলেন। গেসবার্গ বুঝলেন, বাইরের ভিড় এঁর জন্যই! শুনলেন, নাম তাঁর গওহরজান। শুরুতে কোনও গানেরই ভাষা বুঝলেন না গেসবার্গ। তবে গওহরজান আসরে সব ভাষাভাষীর জন্যই গাইতেন। এই আসরেও গেসবার্গদের দেখে ধরলেন— ‘সিলভার-থ্রেডস আমং দ্য গোল্ড’। গেসবার্গের মন-পিয়ানো বলল— ইউরেকা!

গেসবার্গের আগেই কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াটসন হড এসে গিয়েছিলেন কলকাতায়। রাজি করিয়ে রেখেছিলেন গওহরজানকে, যিনি এক আসরে কমপক্ষে ‘মাত্র’ এক হাজার টাকা নিতেন তখন। রেকর্ডিংয়ের প্রথম পর্বে ন’টি ছোট্ট গানের জন্য গওহর নিয়েছিলেন তিন হাজার টাকা।

কী করলেন গওহরজান? এক-দেড় ঘণ্টার খেয়ালকে, কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের দাদরা-ঠুংরিকে তিন মিনিটেরও কমে বেঁধে ফেললেন। কারণ, রেকর্ডের সীমাগতি তখন তিন মিনিটেরও কিছু কম।

১৯০২ সালের ৮ নভেম্বরের কলকাতা। প্রথম দেশীয় গানের রেকর্ড করলেন গেসবার্গরা। হোটেলের অস্থায়ী স্টুডিয়োয়। রেকর্ড হল থিয়েটারের গান আর ‘নচ-গার্ল’ মিস শশীমুখী, মিস ফণীবালার গান। এই পর্ব চলল ১০ তারিখ অবধি।

১১ নভেম্বর, মঙ্গলবার গওহরজান এলেন রেকর্ডিংয়ে। চোখ-ধাঁধানো পোশাকে, অলঙ্কারে। লম্বা চোঙায় মুখ ঢুকিয়ে, দেহ স্থির রেখে, জোরে গাইতে হবে। গেসবার্গ ফের বলে দিতে চাইলেন পদ্ধতিটা। থামিয়ে দিয়ে গওহর বললেন— ‘মে উই স্টার্ট, মিস্টার গেসবার্গ?’

১৯০৮ অবধি রেকর্ডিংয়ের পরে কাঁচা বয়ানটি চলে যেত জার্মানির হ্যানোভারে। তৈরি হয়ে ভারতে আসতে লাগত বছরখানেক। ১৯০৩ সালে কলকাতায় পৌঁছল মিস গওহরজানের রেকর্ড। অবিভক্ত ভারতের সব বড় শহরে বাণিজ্যলক্ষ্মীর আলপনাপথ এঁকে দিল। প্রতি গানের শেষে কণ্ঠস্বাক্ষর— ‘মাই নেম ইজ় গওহরজান’। হ্যানোভারে রেকর্ডের ভিড়ে যাতে শিল্পী-নাম গুলিয়ে না যায়, তারই কৌশল। তবে দেশের কাছে ‘মাই নেম ইজ় গওহরজান’ হয়ে উঠল ‘নেটিভ’ মেয়ের শ্লাঘা-সাফল্যের বৈজয়ন্তী।

১৯০২ থেকে ১৯১৬ সাল (মতান্তরে ১৯২০) অবধি গওহর নানা সংস্থার সঙ্গে বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি-উর্দু-আরবি-ফারসি-ফরাসি-পুশতু-মরাঠি-তামিল-গুজরাতি, নানা ভাষায় প্রায় ৬০০ গান রেকর্ড করেছিলেন। খেয়াল, ধ্রুপদ, ধামার, তারানা আর কর্নাটকি শৈলীর গান তো ছিলই, ছিল দাদরা, হোরি, চৈতি, কাজরি, ভজন, বাংলা কাব্যগীতিও। গওহরজান রের্কডিংয়ের ঢের আগেই বিখ্যাত ছিলেন। রেকর্ডিং-পর্বে মজলিশের ঝাড়বাতি সমুজ্জ্বল রেখেই প্রবেশ করলেন ধনী গৃহস্থের বৈঠকখানায়। তাঁর রেকর্ডের দৌলতে সুখী গৃহকোণে শোভা পেতে লাগল গ্রামোফোন।

তখন পিকচার পোস্টকার্ডে তাঁর ছবি কিংবা ইনদওর-রাজের দেওয়া লক্ষ রৌপ্যমুদ্রায় আচ্ছন্ন মঞ্চ, যে অর্থ গওহর বিলিয়ে দেবেন দীনদুঃখীদের মধ্যে। খ্যাতি বিদেশেও। প্রমাণ, অস্ট্রিয়ার দেশলাইবাক্সে তাঁর ছবি।

জীবন বা চিত্রনাট্য

তাঁকে ঘিরে নানা গল্প। অধিকাংশ সত্য, কিছু রং-চড়ানোও। যেমন— গয়না পাহারা দিতে সশস্ত্র রক্ষী রাখা, তাঁকে অনুষ্ঠানে আনতে গোটা রেলগাড়ি ভাড়া করা। শোনা যায়, পোষা বিড়ালের বাচ্চা হওয়ায় গওহর ‘পার্টি’ দিয়েছিলেন কুড়ি হাজার টাকায়। এ কাহিনিটিও বহুশ্রুত— ফিটন গাড়িতে গর্ভনর বেরিয়েছেন ভ্রমণে। ফিটনে গওহরও বেরিয়েছেন হাওয়া খেতে। তাঁকে দেখে গর্ভনর ভাবলেন, সম্ভ্রান্ত ইংরেজ পরিবারের কেউ। অভিবাদন জানালেন। পরে যখন জানলেন, মহিলা গওহরজান বাইজি, রেগে আগুন। কারণ, দেশীয় কারও তো ফিটনে ঘোরার ‘কথা’ নয়। অতএব, জরিমানা— এক হাজার টাকা। গওহর ফিটনে চাপা বন্ধ করেননি, জরিমানার টাকাটাও দিয়ে দিতেন। এই গওহরজানকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পঞ্চম জর্জের ভারতাগমনে। ১৯১১ সালে, দিল্লিতে। আমন্ত্রণ গর্ভনরের অফিস থেকেই।

গওহরের রোজগার তুমুল। খরচ তুমুলতর। মলকা দানধ্যান করতেন। মসজিদে, কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট টাস্টে। গওহর মায়ের এক কাঠি উপরে। সামাজিক প্রয়োজনে অনুষ্ঠানের পুরো টাকাই দিয়ে দিতেন।

স্বরাজযুদ্ধে বাইজি, নর্তকী বা দেহোপজীবিনীদের কথা পাঠ্যে রাখা ‘পাপ’! যদিও চরবৃত্তির মাধ্যমে তাঁরা বহু কঠিনকে সহজ করেছিলেন। অর্থ দিয়েছিলেন বিপ্লবে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় ‘তওয়াইফ সভা’ চালাতেন ‘বারাণসী বেশ্যা’রা। দেশি ‘খদ্দের’দের দেহশর্তে বাধ্য করতেন অসহযোগে। সেই সভার নেত্রী হাসনাবাই আজ বিস্মৃত।

একই ভাবে, গওহরজানকেই মনে রাখিনি যখন, স্বরাজসাধনায় তাঁর অংশীদারিত্ব মনে রাখব কেন! ১৯২০ সাল। মহাত্মা গান্ধী স্বরাজ ফান্ডের অর্থসংগ্রহে ব্যস্ত। সহায়তার প্রস্তাব গেল গওহরজানের কাছে। আপ্লুত গওহর রাজি। তবে শর্ত— স্বরাজকোষের জন্য তাঁর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হবে মহাত্মাকে। রাজি গান্ধী। অনুষ্ঠান তুমুল সফল। প্রায় ২৪ হাজার টাকা উঠল। যা দিয়ে সে কালে প্রায় তিন কিলো সোনা কেনা যেত। তবে কাজের চাপে মহাত্মা আসতে পারেননি। পাঠিয়েছিলেন মৌলানা শওকত আলিকে। মৌলানার হাতে ১২ হাজার টাকা দিয়ে গওহর জানালেন— মহাত্মা তাঁর অর্ধেক কথা রেখেছেন, না-এসে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন, তাই প্রতিশ্রুতি অর্ধ-রক্ষার কারণে অর্ধেক টাকাই ‘বাইজি’র তরফে মহাত্মা-পাদপদ্মে নিবেদিত হল।

আদালত ও একটি মেয়ে

প্রথম বার শমন বারাণসীতে। ছগন-পর্বে। এক ব্যবসায়ী মাখনলালের অভিযোগ ছিল, বেনারসি কিনে টাকা দেননি গওহর। সে মিথ্যে অভিযোগ টেকেনি। অনুমান, নামী বাইজি হীরাবাইয়ের হাত ছিল ষড়যন্ত্রে।

পরের মামলা কঠিন। আজমগড়ের বন্ধু, তথা পরিচারিকা আশিয়া আর তাঁর ছেলে ভগলুকে কলকাতায় ঠাঁই দিয়েছিলেন মলকা। চিৎপুরের বাড়ির কিছুটা দানও করেছিলেন তাঁদের। মলকার মৃত্যুর পর ভগলু দাবি করলেন, তিনিই মলকার বৈধ পুত্র, সম্পত্তির বৈধ অধিকারী আর গওহর মলকার ‘রক্ষিতা’পর্বের সন্তান। গওহর তাঁর নবনিযুক্ত সেক্রেটারি-ম্যানেজার গুলাম আব্বাসের সহায়তায় আইনি নোটিস পাঠালেন। মিথ্যা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় দক্ষতা দেখাতে শুরু করলেন ভগলুর আইনজীবী। গওহর নিত্যচর্চিত হয়ে উঠলেন। মায়ের সম্মান ধুলোয় লুটোতে দেখলেন। ঠিক করলেন, তাঁর মা-বাবার সম্পর্ক যে বৈধ ছিল, তিনি যে তাঁদেরই বৈধ সন্তান, তার প্রমাণ হিসাবে জন্মদাতা বাবা রবার্টকে আদালতে হাজির করাবেন।

ছদ্মবেশে বাবা খুঁজতে বেরোলেন। জানা গেল, রবার্ট থাকেন ইলাহাবাদে। পেলেন গওহর। দেখা করলেন। রবার্ট বললেন, ভিক্টোরিয়া বা অ্যাঞ্জেলিনা নামের কাউকে চেনেনই না! মাকে দেওয়া রবার্টের বিয়ের আংটি দেখালেন গওহর, নিজের ‘গওহরজান’ পরিচয়টিও জানালেন। এ বার রবার্ট চমকিত। কে না চেনে গওহরজানকে! গওহর পায়ে পড়ে গেলেন। বললেন, রবার্ট পিতৃত্ব স্বীকার করলে বেঁচে যায় মর্যাদাও। রবার্ট ইয়োওয়ার্ড জানালেন— তিনি রাজি, তবে ন’হাজার টাকা লাগবে।

গওহর কাঁদলেন। ফিরে এলেন কলকাতায়। উকিল জানালেন, রবার্ট বাধ্য সাক্ষ্য দিতে। রবার্ট আদালতে সাক্ষ্য দিলেনও। জানালেন, ভিক্টোরিয়া ওরফে মলকা তাঁর বিয়ে করা স্ত্রী, অ্যাঞ্জেলিনা ওরফে গওহর তাঁদেরই সন্তান। জয় হল গওহরের।

পরের মামলা বিবাহবিচ্ছেদের। ওই যে আব্বাস, সেক্রেটারি-কাম-ম্যানেজার, তাঁর সঙ্গে। ভগলু-পর্বে গওহরকে শক্তি জুগিয়েছিলেন আব্বাস। দু’জনের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। গওহর একাকিত্ব কাটাতে চুক্তিভিত্তিক বিয়েতে রাজি হন। প্রেম বিশ্বাস-সরণি ধরে দ্রুত ছুটতে থাকায় চিৎপুরের বাড়িটার দানপত্রও করে দেন আব্বাসকে। অচিরে আব্বাসের বাবা পরিজন নিয়ে সেখানে উঠে তাথৈ নৃত্য করতে লাগলেন। গওহরের রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। কাউকে আঘাত না দিয়ে গওহর ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে বাড়ি কিনে চলে এলেন। কিছু দিন বাদে জানলেন, আব্বাস এক নবীনা বাইজিতে হাবুডুবন্ত। আবারও একা গওহর। ক্লান্তি ঘিরে ধরল। দেশজোড়া আসরের ফাঁকেই চিঠি লিখে যাচ্ছেন আব্বাসকে, যদি সব ঠিক করে নেওয়া যায়। লাভ হল না। শেষে স্থির করলেন, বেরোতে হবে সম্পর্ক থেকে। সে মামলাতেও গওহর জিতলেন, বিয়ে ছিঁড়ে গেল। আব্বাসের তিন হাজার টাকা জরিমানা হল। সেই টাকা না নিয়ে গওহর উল্টে আব্বাসকে একটা বাড়ি লিখে দিলেন।

আইনি লড়াইয়ের জেরে গওহরকে প্রায় সব সম্পত্তিই বেচতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানেও মন লাগছিল না। ওয়েলেসলি স্ট্রিটে দু’কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। কিছু টাকা ঢেলেছিলেন শেয়ার বাজারে। সেটুকুও ধসে গেল। তা নিয়ে আবারও আদালত-ঘর।

ক্রমে পূর্ণ নিঃস্ব গওহরজান। ‘গওহরপিয়া’ নামে যে সব কালজয়ী গান বেঁধেছিলেন, বেচতে শুরু করলেন। সংস্কৃতি-চর্চার নন্দিত সময়ে বন্দিত শহরে গান বিক্রি হতে লাগল— গানপ্রতি এক টাকা দরে।

‘জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই’

১৯২৪ সালে দার্জিলিং গেলেন গওহর। এক অবস্থাপন্নের ব্যবস্থাপনায়। প্রকৃতির কোলে রেওয়াজে, গান শিখিয়ে ভালই লাগছিল। কিন্তু এক যুবকের প্রতি গওহরের স্নেহপূর্ণ ব্যবহারকে অন্য চোখে দেখলেন প্রতিবেশীরা। বিষ আর নিতে পারলেন না গওহর। ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগলেন কখনও দারভাঙা, কখনও রামপুর। রামপুরে নবাব হামিদ আলির আতিথ্যে এসে ঘটল আর এক ঘটনা। লর্ড আরউইন এলেন রামপুরে। ১৯২৬ সাল। গওহরের গান শোনায় আগ্রহী লর্ড। মুগ্ধ হলেন গওহরের পেশকারিতে। শোনা যায়, গওহরের বুকের মেডেল ছুঁয়ে দেখতে চেয়ে অঙ্গস্পর্শের উপক্রম করেছিলেন। গওহর প্রতিবাদ করায় উল্টে গওহরকেই চূড়ান্ত অপমান করলেন নবাব। গওহর রামপুর ছাড়লেন। গেলেন মুম্বই। শেঠ গোকুলদাস ভাড়াবাড়ির ব্যবস্থা করে অনুষ্ঠানের চুক্তিপত্র করলেন। মুম্বইয়েই মহীশূরের যুবরাজ কান্তিবর নরসিংরাজ গওহরের গানে মুগ্ধ হলেন, প্রস্তাব এল সভাগায়িকা হওয়ার। আলো দেখলেন গওহর। গোকুলদাসও বাড়িভাড়ার টাকা না-নিয়ে, শর্তমুক্তি দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন ‘বোন’ গওহরকে।

তখনও গওহর জানতেন না, গোকুলই আইনি নোটিস পাঠাবেন চুক্তিভঙ্গের। জানতেন না, তাঁর জন্য মহীশূর-রাজ মাসে ৫০০ টাকা মাইনে ধার্য করেছেন, কাটা হবে আয়কর। তার মধ্যেই ধরা সঙ্গতকার-সম্মানী। ১৯২৮ সালে মহীশূরে এসেছিলেন গওহর। বাকি জীবন ৫০০ টাকার কাটছাঁট অঙ্কেই কেটে গেল সেই তাঁর, যিনি প্রথম রের্কডিংয়েই নিয়েছিলেন তিন হাজার টাকা, লক্ষ টাকার ভেট যিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই চোখে অস্ত্রোপচার। বম্বে-পর্বের বাড়িভাড়া, চুক্তিভঙ্গের ক্ষতিপূরণ ‘মাসমাইনে’ থেকে কাটা যাওয়া। ১৯২৯ সালে এক বার কলকাতায় আসা। মহীশূর ফিরে বুঝলেন, তাঁর আর দাম নেই। আইনি পথ নিয়ে গোকুল-মামলাতেও জয়ী হলেন গওহর। তবে হেরে গেলেন জীবনের মকদ্দমায়।

১৯৩০ সালের জানুয়ারিতে ভর্তি হলেন স্থানীয় হাসপাতালে। নির্বান্ধব, নিরাত্মীয়। ১৭ জানুয়ারি শান্তি এল শেষ নিঃশ্বাসে। সাতান্ন বছর বয়সে এ বার চিরমিলনের পালা তাঁর নায়কের সঙ্গে।

‘আন-বান জিয়া মে লাগি’

অমৃতকেশব নায়ক। কবি-লেখক-গায়ক। হিন্দি-গুজরাতি নাটকের নামী ব্যক্তিত্ব। শেক্সপিয়রের নাটকের উর্দু অনুবাদে ঝড়-তোলা অমৃতে উন্মাদ মুম্বই-মঞ্চ। মুম্বইয়ে তাঁর সঙ্গে গওহরের দেখা। যদিও প্রথম দেখা নয়। প্রথম বারাণসীতে, বিন্দাদীনের আখড়ায়। অমৃত সেখানে কত্থক শিখতেন।

অমৃত অল্প বয়সে বিবাহিত। পাণ্ডিত্যের প্রতাপে দাম্পত্য একেবারেই সুরে বাজেনি। মুম্বইয়ে গওহর-দর্শনে সমে এল অমৃতের জীবনবাদ্য। গওহর মুম্বইয়ে বেশ কিছু দিন ছিলেন অমৃতের বাড়িতেই। তিনিও আছড়ে পড়লেন অমৃত-অভিকর্ষে। শীতচন্দনপঙ্কের আস্তর পড়তে লাগল গওহরের মনে।

আর এক জনের প্রেমেও আওয়াজ করে পড়েছিলেন গওহর। বহরমপুরের জমিদার নিমাই সেনের। হাজারদুয়ারির অনুষ্ঠান হাজারো দুয়ার খুলে দিয়েছিল। ছগন-অধ্যায়ের অপমান ভুলিয়ে দিয়েছিলেন নিমাই। গওহর ‘বোকামি’ করে ফেললেন! স্ত্রী হতে চাইলেন। কিন্তু জমিদার নিমাই বাইজির সঙ্গে ‘ইয়ে’তে রাজি হলেও ‘বিয়ে’তে নন। সম্পর্ক রাখলেন না গওহর। যদিও নিমাই মৃত্যুশয্যায় শুনে তিনি গিয়েছিলেন বহরমপুর। তত ক্ষণে নিমাই নেই। পরিচারকের কাছে রেখে গিয়েছেন গওহরেরই দেওয়া হিরের নাকছাবি।

অমৃত-পর্বে গওহর আর সামাজিকতার আকাশকুসুম গাঁথলেন না। শান্তি খুঁজলেন। অমৃত লিখতেন, গওহর সুর বসাতেন। দু’জনে মিলেও গড়ে তুলতেন গানপ্রতিমা। এরই মধ্যে খবর এল, মলকা অসুস্থ। গওহর কলকাতায় ফিরলেন। ১৯০৬ সালে চলে গেলেন মলকাজান। অনুষ্ঠান, রেকর্ডিং সব বন্ধ করে দিলেন গওহর। অমৃত মুম্বই চলে আসতে বললেন। গওহর খিদিরপুর, বেলেঘাটার সম্পত্তি বিক্রি করে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে বাড়ি কিনলেন। বাকি টাকা নিয়ে মুম্বইয়ে এলেন। অমৃতের সঙ্গ তাঁকে শান্তি দিল। যদিও ক্ষণিকের। ১৯০৭ সালে নাটকের মহড়া চলাকালীন হৃদ্‌রোগে মৃত্যু লিখলেন বছর-তিরিশের অমৃত।

তপন সিংহের ‘অতিথি’ ছবি। বজরা ভেসে যায়। ভেসে আসে মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রীকণ্ঠ। দাদরা— ‘আন-বান জিয়া মে লাগি/ পেয়ারি চিত কৌন দিয়া, আন বসি ক্যায়সে ফসি’। আন-বান মানে বোধ হয় সম্মান, গরিমা। তবে, ক্ষতি কী ‘বাণ’ অর্থে ধরলে বয়ান যদি এমন হয়— প্রেমের এ বাণ হৃদয়ে বিঁধেছে/ বুঝলাম, আমি বন্দি আজ!

এ গান ১৯০৪ সালে রেকর্ড করেছিলেন গওহর, মুম্বইয়ে অমৃতযোগের পরে-পরেই। অমৃতের কবিতায় গারা রাগে সুর করেছিলেন গওহর। সে ছিল তাঁদের নিভৃতির উদ্‌যাপনে।

গওহর ভালবাসতেন তাঁদের চিৎপুরের বাড়িটা। ভালবাসতেন দুর্গাপুজো-দোল, ময়দানের মখমল, নাখোদা মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান। আর ভালবাসতেন বাড়ি থেকে কিছু-সামান্য দূরের পাড়ার রবিবাবুর গান। তখনও রবিবাবুর গান রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠেনি। তাঁর মনে হত, রবিবাবুর গানে খুব শান্তি মেলে! বড় প্রিয় ছিল পিলু-ভীমপলশ্রীতে বাঁধা— ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধুলো যত’!

তাঁর অমৃতকে, তাঁর কেশবকেও শুনিয়েছিলেন এ গান নিশ্চিত গওহর। যেমন শুনিয়েছিলেন বা হয়তো এখনও শোনাচ্ছেন তাঁর সেই যতমত-ততপথ গজ়লটা— ‘মেরে হজ়রত নে মদিনে মে মনায়ি হোলি’...

তথ্যঋণ: ‘মাই নেম ইজ় গওহর জান’— বিক্রম সম্পত, ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’— শ্রীপান্থ,‘মিস্ট্রেস অব মেলোডিজ়’— নবেন্দু ঘোষ, ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’— অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ঢাকার বাইজি উপাখ্যান’— আরিফ নজবুল সম্পাদিত, ‘কুদ্‌রত্ রঙ্গিবিরঙ্গি’— কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলি, সারেগামা ইন্ডিয়া লিমিটেড

অন্য বিষয়গুলি:

Gauhar Jaan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy