কলকাতার আইস-হাউস। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
নিদাঘের তপ্ত দুপুরে মাঝে মাঝে কবি আশ্রয় নেন তহখানায়। কোনও কোনও বছর রমজানের সময়েই ভীষণ গরম পড়ে যায়। পুড়ে যায় দিল্লি-আগরা। বেশি গরম সহ্য করতে পারেন না মশহুর এই শায়র। মাটির নীচের ঠান্ডা এই ঘরটা তখন আরাম দেয় তাঁকে। তিনি যখন থাকেন এখানে, গোলাপজল ছিটিয়ে ঠান্ডা করা হয় ঘর। কানের লতিতে, কব্জিতে জাহাঙ্গিরি আতর ঘষে নেন কবি। আধো অন্ধকার চার দিক, জাফরির কাজ করা মোমদানির আলোয় আলোকিত খানিক। আলোর মুখ না দেখা শীতল শরাব আর শরবতে ডুবে থাকেন মির্জা গালিব। লেবু দিয়ে গুড়ের শরবত তৈরি হয় তার জন্য। এতে মাঝে মাঝে খানিকটা দ্রাক্ষারস মিশিয়ে নেন। ঝিমঝিমে এক ঘোর ঘিরে থাকে তাঁকে। বই পড়তে পড়তে কবিতার পঙ্ক্তি মাথায় আসে তাঁর। অন্যমনস্ক হন তিনি।
শুধু গালিব নন। কাঠফাটা গরমে দিল্লি-আগরার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির সদস্যরা দুপুরের বেশ খানিকটা সময় কাটান তহখানাতে। বিকেলে একটু একটু বাতাস বইতে শুরু করলে বাড়ি-সংলগ্ন জলাশয়গুলির হাওয়ায় শরীর শীতল করেন। এই বাওয়ালিগুলির ভিতরে ধাপে ধাপে চলে যায় সিঁড়ি। এর মধ্যে ঘর বানিয়ে রাখেন তাঁরা। জলের শব্দে হাওয়ার শব্দ মিশে প্রাণ জুড়োয়। প্রাসাদ বা বাড়ির উপরে যে ছতরিগুলি থাকে, সেখানে বসে বায়ু সেবন করেন তাঁরা। মুখোমুখি জানলায় জালির কাজ বাতাস ঢুকতে দেয় ঘরেও।
সম্রাট আকবরের সাময়িক রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ছিল ‘আবদারখানা’। এখানে আকবরের পানীয় গঙ্গাজল রাখা থাকত। সঙ্গে রাখা হত আম বা তরমুজ। যাঁরা জল রাখতেন, তাঁদের বলা হত ‘আবদার’। ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, আকবর জল ঠান্ডা রাখার জন্য ‘সল্ট পিটার’ বা সোরার ব্যবহার শুরু করেন। আবদাররা ছোট পাত্রে জল ভরে সেটাকে জল এবং সল্ট পিটার ভরা বড় একটি পাত্রের মধ্যে রেখে দিতেন। মিনিট দশ-পনেরো বাদে ছোট পাত্রগুলিকে সরিয়ে বড় পাত্রের মধ্যে নতুন ছোট পাত্র বসানো হত। এ ভাবে সারা রাত ধরে চলত জল ঠান্ডা করা। এখানেই শেষ নয়। গরমে স্বস্তি পেতে মোগল বাদশারা বরফ আনাতেন কাশ্মীর থেকে। আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরি’তে লিখেছেন, লাহোর থেকে ৪০ কিমি দূরের পানহান ছিল বরফ আমদানির কেন্দ্র। অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে মোগল সভাসদ আনন্দ রাম মুখলিশ, ‘তক্তাফ-ই-ইয়াখ’ অর্থাৎ বরফের পাতলা চাদরের কথা বলেছেন। সমসাময়িক লেখক মির-ইহা-কাশি বরফের পাতলা আস্তরণকে তুলনা করেছেন প্রেমিকার ভ্রুকুটির সঙ্গে। অর্থাৎ সেই সময় ঠান্ডা জমা জল সুপরিচিত ছিল। কাঠের বাক্সের মধ্যে কাঠের গুঁড়ো দিয়ে আসত সে জিনিস। পথে নষ্ট হত প্রচুর। তাও যা এসে পৌঁছত, তা কম নয়। শাহি হামামে সেই বরফ দিয়ে স্নান করতেন মোগলরা। ‘সর্দখানা’য় বসে আরাম করতেন তার পর। সম্রাজ্ঞীরা হামামে দিতেন গোলাপের পাপড়ি, বরফকুচি আর সুগন্ধি তেল। সেই সময় দু’কিলো বরফের দাম ছিল এক টাকার কিছু কম। অতি মহার্ঘ এই জিনিসের দাম আরও বাড়ত বর্ষায়। কিন্তু ধনীরা সারা বছর বরফ ব্যবহার করতেন। অবস্থা এমন ছিল যে, এর ব্যবহার বলে দিত কে কতটা ধনবান। শহরের ধনীদের মধ্যে বরফ আনিয়ে প্রতিযোগিতা চলত বিত্ত জাহির করার। শাজাহানের এক আধিকারিক চন্দ্রভান লিখেছেন, সম্রাট বহু দূর থেকে তুষার নিয়ে এসে সভাসদদের পদমর্যাদা অনুযায়ী সবার মধ্যে বিলি করতেন। কুলফি ফিরনি ফালুদা থেকে নানা পানীয়, সবই বরফ দিয়ে ব্যবহার করতেন তাঁরা। ১৬৬০ সাল নাগাদ সময়কার বই ‘মিরজানামা’য় বলা হয়েছে— মধু, দুধ, ময়দা আর নানা রকম বীজ দিয়ে তৈরি মখমলি ফালুদা এমন ভাবে বরফ দিয়ে খাওয়া হত, যাতে ঠান্ডায় দাঁত শিরশির করে।
ইংরেজরা এ দেশে আসার পর এখানকার ভয়ঙ্কর গরমের মোকাবিলা করার জন্য সোরার মিশ্রণে পানীয়ের বোতল ডুবিয়ে রাখতেন। কিন্তু তখন আর মোগল আমলের মতো কাশ্মীর থেকে বরফ আনা সম্ভব ছিল না। ‘কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ বইয়ে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “আমাদের পাড়ার বৃদ্ধ মধু মুখুজ্যের নিকট শুনিতাম যে হুগলীতে গুঁড়িগুঁড়ি বরফ পড়িত। খড়ের চালার উপর সকালবেলা যেন চুন ছড়াইয়া দিয়া গিয়াছে, এই রূপ তিনি বাল্যকালে দেখিয়াছিলেন এবং খড় বিছিয়ে সরাতে জল দিয়া ফাঁকে রাখিলে তাহা বরফ হইয়া যাইত। তবে আমাদের বাল্যকালে বরফ পড়া দেখি নাই।” হুগলিতে বরফ পড়া নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও ইংরেজ আমলে হুগলিতে যে সেটি তৈরি হত, তার বেশ কিছু প্রমাণ তৎকালীন বইপত্রে পাওয়া যায়।
১৭৮৭ সালে কলকাতায় ইংরেজদের এক পার্টি সম্পর্কে ‘কলকাতা গেজেট’-এ লেখা হয়েছিল, পার্টিতে যে বরফ ব্যবহার হয়েছিল, তা এসেছিল হুগলির আইস ফিল্ড থেকে। শীতে বিপুল পরিমাণ বরফ তৈরি হত এখানে। ‘দ্য জার্নাল অব দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এ বলা হয়েছে, এর আগে কলকাতা এবং শ্রীরামপুরে এই জিনিস তৈরির চেষ্টা হয়। কিন্তু সমুদ্র থেকে হুগলির দূরত্ব, মাটির ধরন সবই বরফ তৈরির জন্য বিশেষ উপযুক্ত ছিল। বালির আস্তরণের উপর দোআঁশ মাটি ফেলে উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হত। সাধারণত নভেম্বর মাসে বরফ তৈরি শুরু হত, চলত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর জন্য ১২০ ফুট লম্বা আর ২০ ফুট চওড়া আয়তাকার গর্ত খুঁড়ে সেখান থেকে দু’ফুট মাটি তুলে ফেলা হত। জায়গাটিকে কিছু দিন রোদ খাইয়ে শুকিয়ে তার মধ্যে বিছিয়ে দেওয়া হত খড়। কিছু আলগা খড় উপরে বিছানো থাকত। পুরোটার জন্য লাগত দেড় ফুট জায়গা। বাকি আধফুট জায়গা খালি রাখা হত। এমন অসংখ্য জায়গা তৈরি করে তার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের জন্য মাটির আলের মতো কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতেন আবদাররা। এর মধ্যে বিরাট বিরাট মাটির জালা বসিয়ে দেওয়া হত। পাত্রগুলিতে রাখা থাকত বরফ তৈরির জন্য ব্যবহার করার জল। আশপাশের জলাশয় থেকে জল সংগ্রহ করা হত এই কাজের জন্য। এর পর গর্তগুলির মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হত কিছু অগভীর মুখের মাটির পাত্র। মোটামুটি ৪৫৯০টি পাত্র থাকত বরফ তৈরির জন্য। আট আউন্স না চার আউন্স কতটা জল দেওয়া হবে, সেটা নির্ভর করত সে দিন কতটা বরফ তৈরি হবে তার উপর। কতটা বরফ তৈরি হবে, সেটা আবার নির্ভর করত সে দিনের আবহাওয়ার ওপর। অতিরিক্ত বায়ু চলাচল হলে বা শিশির পড়লে সে দিন ভাল বরফ তৈরি হত না। এই ক্ষেত্রগুলির যে দিকে সকালে সূর্যের প্রথম রশ্মি পড়বে, সেই দিকে জল বেশি দেওয়া হত, যাতে জমে যাওয়া বরফ কাটতে সুবিধে হয়। সাত-আট জন মহিলা ছুরি দিয়ে জমা জল কেটে বার করতেন। পাত্রগুলি খালি হয়ে গেলে পুরুষরা সেগুলি নিয়ে খালি করতেন অন্য একটা পাত্রে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে আধারের পুরো জলই মাঝে মাঝে বরফে পরিণত হত। একে বলা হত ‘পাক্কা বরফ’। রাত দুটো-তিনটে নাগাদ পাতলা এক স্তর বরফ পাওয়া যেত। পাঁচটা নাগাদ আরও খানিক স্তর বেশি বরফ জমত, একে বলা হত ‘ফুল বরফ’। বরফ পাওয়া গেলে তা রাতের মধ্যে কলকাতা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হত। ফ্যানি পার্কার তাঁর বইয়ে লিখেছেন, বরফ পাওয়ার পর আবদার তা ওজন করে বাজারে পাঠাতেন। কুলিরা পথে তার কিছু বিক্রি করে দিতেন ‘নেটিভ’দের কাছে। এদেশীয়রা কিছু নিজেদের ব্যবহারের জন্য রেখে বাকিটুকু দেড় কেজি দু’আনা দরে আবার বিক্রি
করে দিতেন।
কিন্তু এতেও সাহেবদের যে খুব মন উঠত, তা নয়। হুগলি থেকে যে বরফ পাওয়া যেত, তা ছিল থকথকে এক রকম অর্ধকঠিন মিশ্রণ। সেই জন্য সাহেবরা একে বলত ‘হুগলি স্লাশ’। তার উপরে গরমকালে সে জিনিস মোটেই পাওয়া যেত না। কলকাতার পঞ্চম বিশপ ড্যানিয়েল উইলসন ১৮৩৩-এ একটি চিঠিতে লিখেছেন, দমবন্ধ করা গরমে এমনই অবস্থা তাঁদের যে, অন্যের দেখলে দয়া হবে। তাঁর আগের বিশপ কলকাতার প্রবল গরমে মারাই গিয়েছিলেন। অকল্যান্ড লেখেন যে, এ দেশে ইংরেজদের মদ এবং মাংস খাওয়ার অভ্যেসের ফলে প্রায় প্রত্যেকেরই বিপুল উদর। তার ফলে তাদের অবস্থা আরও হাঁসফাঁস। ঠান্ডা ছাড়া তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। গরমে যখন ইংরেজদের এমন ত্রাহি ত্রাহি রব, তখনই আমেরিকার এক তরুণ ব্যবসায়ী ফ্রেডরিক টিউডর ম্যাসাচুসেটস থেকে ভারতে বরফ সরবরাহের ব্যবসা শুরু করলেন। সোজা ছিল না কাজটা। কফির ব্যবসায়ে বিপুল লোকসান করা টিউডর মরিয়া ছিলেন একটা লাভজনক ব্যবসার জন্য। প্রযুক্তি আর ব্যবসায়িক বুদ্ধি সম্বল করে অবশেষে বরফ ভরা জাহাজ ‘টাস্কানি’, ১৮৩৩ এর ৬ সেপ্টেম্বর এসে ভিড়ল কলকাতা বন্দরে। সেই জিনিস সংরক্ষণের জন্য ১৮৩৫ কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী চাঁদা তুলে স্ট্র্যান্ড রোড এবং হেয়ার স্ট্রিটে তৈরি করল বরফঘর। প্রথম যে দিন কলকাতার বাজারে বিক্রি হল এটি, সে দিন ৭৮ কেজির একটি বরফের চাঁই দেখে চমকে গেল সবাই। এই দিন সাহেবদের ঘরে ঘরে উৎসব লেগে গেল প্রায়। সব অফিস ছুটি দিয়ে দেওয়া হল। প্রত্যেকে প্রত্যেককে রাতের ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন। কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া হল। মাংস, মদের ফোয়ারা ছুটল। ‘মুরিজ় হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়া’য় লেখা হল, উত্তপ্ত আবহাওয়ায় ঠান্ডা পানীয়ের থেকে আকর্ষক আর কিছু নেই। এই জিনিস আমাদের মনকে উদ্দীপ্ত করে, শরীরকে বলশালী করে।
শুধু ইংরেজরা নয়, উচ্চবিত্ত ইংরেজ-ঘনিষ্ঠ বাঙালিরাও বরফের আগমনে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এর আসা-যাওয়া নিয়মিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তৈরি হওয়া নয় সদস্যের কমিটির এক জন ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। বাঙালি হিন্দুরা শেষে গঙ্গাজলের সঙ্গে বরফ মিশিয়ে খেতে লাগলেন। কলকাতার পর বোম্বে এবং মাদ্রাজেও এটি পাঠানো হল। বোম্বের বিখ্যাত ব্যবসায়ী নাইট উপাধিধারী জামশেদজি জিজিবয় প্রথম এক দিন ডিনারে অতিথিদের আইসক্রিম খাওয়ালেন। তাতে আবার সবার খুব ঠান্ডা লেগে গেল। গুজরাতি খবরের কাগজ ‘বম্বে সমাচার’ লিখল, অজানা বিদেশি দ্রব্য খেয়ে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখনও বরফ ছিল শুধুই উচ্চবিত্তদের নাগালে। দাম প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেল, যখন ইটালীয় ব্যবসায়ীরা আলপাইনের বরফ কলকাতার বাজারে নিয়ে এলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁরা প্রতিযোগিতায় পেরে উঠলেন না। ‘আইস কিং’ টিউডর শুধু কলকাতা থেকেই বরফের ব্যবসায় লাভ করেন ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। টিউডর মারা যাওয়ার পর পরিবেশগত ও প্রযুক্তিগত কারণসহ বেশ কিছু অসুবিধের জন্য আস্তে আস্তে কলকাতায় তাঁর পত্তন করা তুষার-সাম্রাজ্যের ভিত শিথিল হল। ১৮৭৮-এ কলকাতায় তৈরি হল বেঙ্গল আইস কোম্পানি, যারা কৃত্রিম বরফ তৈরি করত। এরও অনেক পরে ঘরে ঘরে সুলভ হল বরফ। তবে সে এক অন্য গল্প।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy