Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Shantiniketan

শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র

নাম শিতোকু হোরি। দেশ জাপান। বৌদ্ধধর্মের শিকড় আর ভারতবর্ষের স্বরূপ সন্ধান ছিল তাঁর লক্ষ্য। ক্যামেরায় ধরে রাখতেন আশ্রম জীবনের নানা মুহূর্ত। তাঁতযন্ত্রের নকশা তৈরি করে অবাক করেছিলেন সকলকে। ভারত দেশটির চরিত্র বুঝতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।শান্তিনিকেতনে আসার পর এই ছাত্রটিকে ব্রাহ্ম-মন্ত্র শোনান রবীন্দ্রনাথ। জাপানের হিসেবে চার ইয়েন দামি একটি ধুতিও দিলেন।

গুরুদেব: শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ডান দিকে উপরে, শিতোকু হোরি।

গুরুদেব: শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ডান দিকে উপরে, শিতোকু হোরি।

রিম্পি
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৪৪
Share: Save:

ছোট ক্যামেরাটির দাম ১২৫ টাকা। সেটি হাতে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান শান্তিনিকেতন আশ্রমের আনাচ-কানাচে। তাঁর লেন্সে বাঁধা পড়ে যায় আশ্রম জীবনের নানা মুহূর্ত। সঙ্গী সাইকেলটি নিয়ে, আবার কখনও বা হেঁটে ইতিউতি যাওয়া আশপাশের গ্রামে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম বিদেশি ছাত্র। ভারতবর্ষের স্বরূপ সন্ধান করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর নাম শিতোকু হোরি। আর সেই ভারত-চরিত্র বুঝতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯০২-এর ১ জানুয়ারি হোরিকে (জন্মসাল ১৮৭৬) জাপান থেকে ভারতে নিয়ে এলেন শিল্প-সমালোচক, তেনশিন ওকাকুরা। মহাযান বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে দীক্ষিত হোরি চাইছিলেন বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান ও ‘সদ্ধর্ম’ সন্ধান করতে। তাই বৌদ্ধধর্মের জন্মভূমি ভারতবর্ষে এসে সে বিষয় সন্ধানের ইচ্ছে নিয়ে শুরু হল সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা। স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্য পেলেন বেলুড় মঠে। তার পরে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতন। তারিখটি ছিল ওই বছরেরই ১৩ জুন। দুপুর দু’টো ৩৫-এ হাওড়া থেকে বোলপুরগামী ট্রেনে চড়ে।

শান্তিনিকেতনে আসার পর এই ছাত্রটিকে ব্রাহ্ম-মন্ত্র শোনান রবীন্দ্রনাথ। জাপানের হিসেবে চার ইয়েন দামি একটি ধুতিও দিলেন। রবীন্দ্র-সঙ্গে আশ্রমজীবনে নিজেকে মিশিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি হোরির। তবে প্রতিকূল অবস্থা যে আসেনি, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় চলে গেলেই টান পড়ে খাবারে। ছাত্রটির মনে হয়, যেন আশ্রম বিদ্যালয়ের পাচকেরা ঠিক মতো খেতে দিচ্ছেন না! শরীরও বেগতিক হচ্ছিল। ওকাকুরা পরামর্শ দিলেন, দেশে ফেরার। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম পুনরুত্থানের যে দায়িত্বভার হোরি নিজেই এক দিন গ্রহণ করেছিলেন, তা মাঝপথে ফেলে চলে যেতে মন সায় দেয়নি।

কিন্তু শুধুই কি ধর্ম আগ্রহ বা ছবি তোলা? হোরির শান্তিনিকেতন-পর্ব নানা রঙে সাজানো। রবীন্দ্রনাথকে জাপানিদের সৌন্দর্যবোধ বরাবরই মুগ্ধ করত। ‘জাপান যাত্রীর পত্র’-তে লিখেছেন, ‘সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্ভ্রম অন্য কোথাও দেখি নি। এমন সাবধানে, যত্নে, এমন শুচিতা রক্ষা ক’রে সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে অন্য কোনো জাতি শেখে নি।’

জাপানের মানুষ সম্পর্কে এই ধারণার অন্যতম আধার বোধহয় হোরি। তাঁতশিল্প ও শিল্পীদের অসম্পূর্ণতা দেখে রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য অনুরোধ করে বসলেন। তাঁতযন্ত্রের নকশা উদ্ভাবন। কিন্তু হোরি কাঠের কাজ জানেন না। তবে ওই জাপানের ‘সুন্দরের প্রতি...সম্ভ্রম’-এর কারণেই বোধহয় খেটেখুটে তৈরি করে ফেললেন তাঁতযন্ত্রের এক চমৎকার নকশা। সেটি শান্তিনিকেতনে সকলের প্রশংসাও পেল। কিন্তু স্রষ্টার কাছে প্রশংসার চেয়েও বড় আত্মোপলব্ধি। তাই বোধহয় মনে মনে বললেন, ‘আমার আকাঙ্ক্ষা বড়ো ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নয়। নির্মাণ-কর্তা, আমি আর তার পাত্র তাঁতযন্ত্র, উভয়ের মধ্যে মন ও প্রকৃতির মিলন ঘটেছে।’ রবি ঠাকুরের শিক্ষাদর্শের এটাই তো সার-কথা, যন্ত্র থাকবে মন ও প্রকৃতির অঙ্গ হয়ে। ১৯২২-এর পরে ব্রতীবালকেরা যখন শান্তিনিকেতনের আশপাশের গ্রামে যেতেন, তাঁরা তাঁতযন্ত্র ব্যবহারে উৎসাহ দিতেন।

কিন্তু তাঁতযন্ত্রের ‘ব্লু প্রিন্ট’ করে হোরি তাক লাগালেও, তাঁর স্বপ্নভঙ্গের ঘটনাও ঘটেছে শান্তিনিকেতনেই। সেখানকার রুখা মাটিতে একটি কুটির তৈরির কাজে যোগ দিলেন হোরি। পাথরের মতো শক্ত মাটিতে স্তম্ভ দাঁড় করানো ও কাঠের খুঁটি পোঁতাটা হয়ে দাঁড়াল কষ্টের। তিনি শুকনো কাঠের দিকে কেমন নির্বিকার চেয়ে থাকেন, কিন্তু কোনও উপায় বার করতে পারেন না। নিজের কাঁধে তুলে নিলেন গৃহ নির্মাণের সব দায়িত্ব। কাঠের মিস্ত্রির যন্ত্র শান দিতে দিতে শান্তিনিকেতনে তাঁর দিন পেরোচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ঘর তৈরির সামগ্রী ঠিকমতো জোগাড় করতে পারছিলেন না। এক সময় উপায়ান্তর না দেখে তাই পরিত্যাগ করতে হল কাজ। ঘর তৈরির স্বপ্নটা অধরাই থেকে গেল।

ইংরেজি শিখতে শুরু করলেও তাতে খুব দড় হওয়া হল না হোরির। পাশাপাশি চলছিল সংস্কৃত শিক্ষাও। সংস্কৃত অভিধান ‘অমরকোষ’-এর মূল পুঁথি ও টীকা ‘কপি’ করতেও আরম্ভ করলেন। এই বিদ্যাচর্চার প্রতি টানের কারণেই বোধহয় রবীন্দ্র-হোরির মধ্যে সুসম্পর্কের পরিসর তৈরি হয়। উনিশ শতকের শেষ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনের প্রতি রবি ঠাকুরের আগ্রহ মহীরুহের মতো প্রসারিত হল। পরে, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ অনুবাদ করার কথাও বলেন। আদতে, বৌদ্ধ ধর্ম যে মৈত্রী-ভালবাসার কথা বলে, তাতে আস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাই তো তাঁর বড় প্রিয়জন করুণাময় গৌতম। বুদ্ধ ও তাঁর দর্শনের একান্ত অনুগত হোরিও। এও রবীন্দ্রনাথ-হোরির সম্পর্কের সেতুটি মজবুত হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

ভারতবর্ষ আর তার মানুষের সঙ্গে এই সেতুর স্তম্ভগুলি নির্মাণে অনেকাংশেই সহযোগিতা করে চিঠিপত্র। হোরির দিনপঞ্জি থেকে জানা যায়, শান্তিনিকেতনে বসে নিয়মিত প্রিয়জনদের চিঠি লেখাটা ছিল তাঁর অভ্যেস। সেই চিঠি কলকাতায় সুরেন্দ্রনাথ, মীরাদেবীদের কাছে পৌঁছে যায়। পাড়ি দেয় জাপানে ছেড়ে আসা মা ও ছোট ভাইয়ের কাছেও। আবার এই চিঠিই কখনও কখনও নিয়ে আসে বিচ্ছেদের

ব্যথা। চিঠিতেই স্বামী বিবেকানন্দ ও কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুসংবাদ পেলেন হোরি।

ভারতবর্ষের মানুষের সঙ্গে ছাত্রটির এই সখ্য দেখে খুশিই হলেন রবীন্দ্রনাথ। কন্যা মীরার সঙ্গেও ভারী বন্ধুত্ব ঘটল হোরির। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, ‘...মীরা প্রত্যহ তাহাকে (‌‌হোরি) এক পেয়ালা ফুল দিয়া বশ করিয়া লইয়াছে।’

ভারতবর্ষের মানুষজন, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি, পরিবেশকে আপন করে নিলেও প্রায়শই হোরির মনের মধ্যে এক অনিশ্চয়তা কাজ করত। নিজের কাছে তাঁর নিজেরই প্রশ্ন, ‘সময় মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না। আগামী বৎসরের এই দিন আমি কোথায় থাকব?’ পরের বছর সত্যিই থাকেননি শান্তিনিকেতনে। ১৯০৩-এর ২৪ জানুয়ারি শান্তিনিকেতন থেকে পাড়ি দিলেন ভারত-ভ্রমণে। কিন্তু পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ওই বছরেই ২৩ নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান হোরি। তাঁর বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থানের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে গেল।

তবে ভারত ও জাপান মৈত্রী-ভাবনা থেমে থাকেনি রবীন্দ্র-মননে। তাই কি পরে দেখা যাবে, শান্তিনিকেতনে ‘যুযুৎসু’ শিক্ষার জন্য নবুজা টাকাগাকি-কে নিয়ে আসছেন রবীন্দ্রনাথ! নিজে জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন, বুঝতে চেষ্টা করছেন সেখানকার শিল্প-সংস্কৃতি, ‘নেশনকামী’ জাপানের বদলে খুঁজছেন সেখানকার প্রাচীন সভ্যতার আলো। জাপান ও ভারতের যে মৈত্রী-ভাবনা শিতোকু হোরির মনের মধ্যে ছিল, সেই ভাবনাই যেন পরিণতি পেল রবীন্দ্রনাথের মনে।

জাপানের মেইজি সম্রাটকে কী উপহার দেওয়া যায়, তা নিয়ে হোরির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জানতে চেয়েছিলেন চিন ও জাপানে সংরক্ষিত বিভিন্ন সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি প্রতিলিপি করে কী ভাবে দেশে আনা সম্ভব, তার উপায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়ায় ‘সভ্যতার সংকট’-এর মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু এই মহাপ্রলয়ের পরে, পূর্বের কোনও সভ্যতাই যে নতুন আলো দেখাবে, এ কথা ভাবছিলেন তিনি। যখন ভাবছিলেন, তখন কি মনে পড়েছিল তাঁর আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম বিদেশি ছাত্রটির কথা? তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন:

‘...খুব সরল ও খাঁটি মানুষ এবং খুব কোমল ও দয়ালু। ভাষা বুঝতে না পারা সত্ত্বেও হোরি বিদেশ থেকে এসে একটি আদর্শকে ধরে অচঞ্চল ও শান্ত মনে রয়েছে।’

নিঃসন্দেহে এই আদর্শ মানবতার।

অন্য বিষয়গুলি:

Shantiniketan student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy