বিদগ্ধ: সত্যব্রত সামশ্রমী। পুত্র শিবব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আঁকা ছবি
রামায়ণ পড়লে আমরা জানতে পারি, এক শূদ্র বেদ পড়ছে এই সংবাদ পেয়ে, রামচন্দ্র সেই শূদ্রের মাথা কেটে ফেলেন। সামবেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সত্যব্রত সামশ্রমীর সামনে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এসে দাঁড়াতে কি তাঁর মনে পড়েছিল মহাকাব্যের সেই ঘটনা? আমৃত্যু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদ বিভাগের প্রধান, এ ছাড়াও ভারতের ন’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদের পরীক্ষক ছিলেন সত্যব্রত সামশ্রমী। ফারসি, ইংরেজিতেও দক্ষ ছিলেন।
মুহম্মদ শহীদু্ল্লাহ (পরে ভাষাচার্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ-তে ভর্তি হলেন সংস্কৃত নিয়ে পড়বার জন্য। তখন এম এ পাঠ্যক্রমে অন্যতম বিষয় ছিল বেদ। দু’মাস ঠিক ভাবে কাটলেও, গোলমাল বাধালেন বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। তিনি কোনও অহিন্দুকে বেদ পড়াবেন না বলে জেদ ধরে বসলেন। মুসলমান বেদ পড়বে, মানতে পারেননি তিনি।
শহীদুল্লাহকে স্নেহ করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি অনেক অনুরোধ করেন সত্যব্রতবাবুকে। কিন্তু সব অনুরোধ বিফলে গেল। অনাবশ্যক অটল জেদ ধরে বসে রইলেন সত্যব্রত সামশ্রমী। এই ঘটনায় সেই সময় শিক্ষাজগতে একটা সাংঘাতিক আলোড়ন পড়ে যায়। অগ্রগণ্য মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলি তাঁর ইংরেজি পত্রিকা ‘কমরেড’-এ ‘দ্য শহীদুল্লাহ অ্যাফেয়ার’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, কড়া ভাষায়। ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ সত্যব্রত সামশ্রমীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহকে সংস্কৃত পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য একটি বিষয় চালু করে যেন তাঁকে পড়ানোর ব্যবস্থা করে। আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী স্যর আশুতোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভাষাতত্ত্ব’ (ফিলোলজি) নামে নতুন একটি বিভাগ চালু করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে এই বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
কে ছিলেন এই সত্যব্রত সামশ্রমী? ১৮৪৬ সালের ২৮ মে তাঁর জন্ম। তাঁর আসল নাম কালিদাস চট্টোপাধ্যায়। বাবা রামদাস চট্টোপাধ্যায়, পটনার জজ ছিলেন। রামদাসবাবুর গোলাপ বাগানের শখ ছিল। কালিদাসের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স, এক দিন গাছ থেকে একটি গোলাপ ছিঁড়েছিলেন। রামদাসবাবু কোর্ট থেকে ফিরে, গাছে গোলাপ নেই দেখে মালিকে প্রচণ্ড বকুনি দেন। সেই দেখে শিশু কালিদাস রাশভারী বাবার কাছে গিয়ে আসল সত্যটা স্বীকার করেন। সেই থেকেই নাকি তাঁর নাম হয় ‘সত্যব্রত’।
সত্যব্রতর পাঁচ বছর বয়সেই রামদাসবাবু ছেলেকে কাশীর সরস্বতী মঠে পাঠিয়ে দেন সংস্কৃত শিক্ষার জন্য। কুড়ি বছর সেখানে থেকে সত্যব্রত সংস্কৃত সাহিত্য, চতুর্বেদ, স্মৃতি, বেদান্ত, উপনিষদ, সংহিতার সমস্ত পাঠ শেষ করেন। তার পর, তখনকার দিনের নিয়ম অনুযায়ী পায়ে হেঁটে সমস্ত ভারত ঘুরে বেড়ান— মা বাবার অনুমতি নিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি আসেন রাজস্থানের বুন্দি রাজ্যে। প্রচলিত জনশ্রুতি, তাঁর পা ধোয়ানোর জন্য জল এনে দেখা যায়, পায়ের তলায় পতাকা (ধ্বজ), বজ্র এবং অঙ্কুশ চিহ্ন! পরে নানা বেদ নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিত এবং রাজার সঙ্গে আলোচনা করলে, তাঁর প্রজ্ঞায় সবাই অভিভূত হন। সত্যব্রতর বেদ পারঙ্গমতায় চমৎকৃত হয়ে বুন্দিরাজ তাঁকে ‘সামশ্রমী’ উপাধি দেন। সেই থেকেই তিনি ‘সামশ্রমী’ উপাধি ব্যবহার করতে থাকেন।
এর পর সত্যব্রত আসেন নবদ্বীপে। এখানে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেন ব্রজনাথ তর্কালঙ্কারকে। বিখ্যাত গান ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’-র রচয়িতা এই ব্রজনাথ তর্কালঙ্কার। মুগ্ধ ব্রজনাথ তাঁর নাতনি সর্বমঙ্গলার সঙ্গে সত্যব্রত সামশ্রমীর বিয়ের প্রস্তাব দেন। সত্যব্রত প্রস্তাব মেনে বিয়ে করেন সর্বমঙ্গলাকে। কলকাতায় এসে শিমুলিয়াতে বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। তখন কোনও বাড়ির ঠিকানা ছিল না। পরে এই বাড়ির ঠিকানা হয় ১৬/১ ঘোষ লেন (তারও পরে বাড়ি ভাগ হয়ে ১৬/১এ ঘোষ লেন, কলকাতা-৬)। এ ছাড়াও তিনি ২৭ নং ঘোষ লেনে একটি বাড়ি কিনে সেখানে টোল চালু করেন। ছাত্ররা এখানে বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত আর সংস্কৃত পড়ত।
এই বাড়িতেই তিনি প্রেস তৈরি করেন। নাম, সত্যমঙ্গলা মুদ্রণ যন্ত্র। এখান থেকে তিনি প্রকাশ ও সম্পাদনা করতেন দু’টো পত্রিকা। সম্পূর্ণ সংস্কৃত ভাষায় লেখা পত্রিকা ‘প্রত্নকম্রনন্দিনী’ আর বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা পত্রিকা ‘ঊষা’। এই দুই পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর পরিচয় হয় জার্মান পণ্ডিত ফ্রিডরিখ ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে। নিয়মিত যোগাযোগ ছিল দু’জনের। ম্যাক্সমুলার সত্যব্রত সামশ্রমীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁদের দুজনের চিঠিপত্র রাখা আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে।
আশুতোষের দুই পুত্র, রমাপ্রসাদ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপনয়নের আচার্য ছিলেন সত্যব্রত সামশ্রমী। সেই যুগে ‘ঊষা’ পত্রিকায় তিনি বেদ উদ্ধৃত করে প্রমাণ করেছিলেন, সমুদ্রযাত্রায় হিন্দুদের জাত যায় না, বা কন্যা রজস্বলা বা ষোলো বছর না হওয়া পর্যন্ত তার বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু নিজের ছোট ছেলে শিবব্রতর বিয়ে দিয়েছিলেন তার তেরো বছর বয়সে, রাজেশ্বরীর সঙ্গে। বাগবাজারের সেই মেয়েটির বয়স তখন মাত্র নয়! এখানেই সত্যব্রত সামশ্রমীর স্ববিরোধ। নিজে কোনও দিন বিদেশ যাননি, আদৌ যেতেন কি না সেটাও অনুমানের ব্যাপার। কট্টর নিরামিষাশী ছিলেন সত্যব্রত সামশ্রমী ও তাঁর পরিবারের সবাই। বালিকা পুত্রবধূ রাজেশ্বরী মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারত না। অনেক চেষ্টার পরে সে মাছ খাবার অনুমতি পায়, তাও গোয়াল ঘরের কাছে।
কলকাতা ফিলোলজিকাল সোসাইটির আজীবন সভ্য ছিলেন সত্যব্রত সামশ্রমী। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে নিয়মিত সংস্কৃত ভাষায় চিঠিপত্র চালাচালি হত তাঁর। বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে থাকলেও, সত্যব্রত সামশ্রমী বহুবিবাহেরও সমর্থক ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সত্যব্রত সামশ্রমীর সৎ বোন লক্ষ্মীর। স্বগোত্র হলেও কেন যে এই বিয়েটা হয়েছিল, সেই কারণটা অজানা। এও এক স্ববিরোধিতার লক্ষণ। দোষে গুণে মানুষ, সত্যব্রত সামশ্রমীও তা-ই ছিলেন। ১৯১১ সালের ১ জুন মৃত্যু হয় তাঁর। তাঁর একটি মর্মর মূর্তি রাখা আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কৃতজ্ঞতা: সৌম্যব্রত চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy