সদ্য কোভিড-১৯’এ ভুগে উঠেছেন হ্যারি পটার রচয়িতা জে কে রোওলিং। এমনই দুর্বল সময়ে এক ইটালিয়ান ভক্ত টুইটারে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রিয় অভিনেতা অ্যালান রিকম্যান-এর কথা। রোওলিং জানিয়েছেন, এখনও হ্যারি পটার নাটকে সেভেরাস স্নেপ চরিত্রে অ্যালানকেই খোঁজেন তিনি।
‘ডাই হার্ড’ সিনেমার ক্ষুরধার বুদ্ধির হান্স গ্রুবার, ‘লাভ অ্যাকচুয়ালি’-র প্রতারক স্বামী— সিনেমার তুখড়তম ভিলেনদের অনেকগুলো চরিত্রই রিকম্যান-এর ঝুলিতে। কিন্তু শতাব্দীর শুরুতে তিনি যখন সেভেরাস স্নেপ-এর কালো পোশাকটা গায়ে চড়ালেন, কী ভাবে যেন মিশে গেল রিল আর রিয়েল! হ্যারি পটারের মতো আমরাও তখন সেভেরাস স্নেপকে ঘোর অবিশ্বাস করতাম। মধ্যিখানে সিঁথি করা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে, মিশকালো পোশাক, ভীষণ মেজাজি। অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকান। সমস্ত অকুস্থলে স্নেপকে দেখা যায়। নির্ঘাৎ ডার্ক লর্ড ভোল্ডেমর্টের দোসর। শেষ কালে জানা যায়, অনেক জ্বালায় স্নেপ ভোল্ডেমর্টের দলে ভিড়েছিলেন। কিন্তু হ্যারির মা লিলিকে বাঁচাতে, লিলির শেষ চিহ্ন হ্যারিকে রক্ষা করতে দল বদলে ডাম্বলডোরকে সাহায্য করতে শুরু করেন। ভোল্ডেমর্টের অনুগামীদের মধ্যে মিশে থেকেই তিনি হ্যারিকে আড়াল করতেন।
ভোল্ডেমর্টের নাগিনীর ছোবলে প্রাণ যায় স্নেপের। ঘটনাচক্রে হ্যারি জানতে পারে তার অপছন্দের প্রফেসরের ব্যথাতুর অতীতের
কথা। কর্কশ ভিলেন থেকে সিরিজ়ের অন্যতম প্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠেন উপেক্ষিত স্নেপ। তার পর, ২০১৬ সালে ক্যান্সার কেড়ে নেয় অ্যালানকে।
সারা পৃথিবী মর্মাহত, শোকবিহ্বল। চার বছর পরেও, আবেগের সেই প্লাবন থামেনি।
আমাদের দেশেও এমন সোনার টুকরো ভিলেনের অন্ত নেই। এই তালিকায় প্রথমেই নাম আসবে এক বঙ্গসন্তানের। বিকাশ রায়। ক্রূর দৃষ্টি, উদ্ধত হাঁটা আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা। হেমেন গুপ্তের ‘৪২’ ছবির মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় তাঁকে দেখে পর্দায় জুতো ছুড়তেন দর্শক। ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদাদিদি’ ছবিতে সাপের ছোবল খেয়ে মৃত্যুর দৃশ্যে যে আক্রোশে সাপটাকে চিরে দিয়েছিলেন, বুকের রক্ত চলকে উঠেছিল। জান্তব সব অভিব্যক্তি অনায়াসে ফুটিয়ে তোলা মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন পুজো-আচ্চা করা নিপাট গৃহস্থ। তাঁর আদর্শ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র। বিকাশ রায়ের প্রসঙ্গ উঠলে এখনও স্মৃতিতে সজল হয়ে ওঠেন অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়। মাধবী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এক বার। নিজের মেয়ের মতো করে যত্ন করে তাঁকে সারিয়ে তুলেছিলেন বিকাশ রায় ও তাঁর স্ত্রী। এক বার নবীনা মাধবীকে যখন ইউনিটের লোকজন মদের আসরে নিমন্ত্রণ করতে এল, অভিভাবকের মতো আগলে দাঁড়ালেন বিকাশ রায়। মাধবী জানাচ্ছেন, ‘‘বিকাশদা মদ ছুঁতেন না। কিন্তু সিনেমায় তো জলপানের মতো মদ্যপান করেন, লোকে ভাবত বাস্তবেও বুঝি তিনি ও রকম। এক বার সিনেমার সেটে একটু সফ্ট ড্রিঙ্ক পান করছিলেন, পরিচালক নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় ভাবলেন মদিরা! তার পর সত্যিটা জেনে তিনি হতবাক! বাস্তবের দুষ্টু লোকেরা আরও এক কাঠি বাড়া! সোজা স্ত্রীকে উড়ো ফোন করত— ‘বিকাশ রায় অনুভা গুপ্তকে নিয়ে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছেন’। বৌদি শান্ত ভাবে বলতেন, ‘না উনি গাড়ি চালাতে জানেন, না উনি মদ খান!’ তাঁর নেশা ছিল পরোপকার। গুরু বাগচীর ‘তিন ভূমি’ ছবির জন্য আমাকে পারিশ্রমিক নিতে বারণ করেছিলেন। আর ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’-র সভ্যরা যখন প্রেসিডেন্ট উত্তমকুমারকে ‘চোর’ বলল, বিকাশ রায় নায়ককে নিয়ে আলাদা সংগঠন তৈরি করলেন। ‘শিল্পী সংসদ’। আইনজ্ঞ বিকাশদা নতুন আইন পাশ করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিলেন।’’
বিকাশ রায় যে সময়ে বাংলা কাঁপাচ্ছেন, তখন বম্বে ফিল্ম দুনিয়ারও ছবি চলত এক রোম্যান্টিক ভিলেনের নামে। ছবির টাইটেল কার্ডে তাঁর নামটি আসামাত্রই দর্শক শিহরিত। ‘অ্যান্ড প্রাণ’। পর্দায় তিনি মূর্তিমান আপদ। শাণিত ব্যক্তিত্ব, মুখে সিগারেটের ধোঁয়ার নকশা, হাতে চাবুক। খালি হিরোইনকে হাতিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করত আমজনতা। ঠিক যেমন ‘গুড্ডি’ সিনেমায় শুটিং দেখতে এসে প্রাণকে দেখে আঁতকে উঠছেন জয়া ভাদুড়ি। ধর্মেন্দ্র তাঁকে বোঝাচ্ছেন, আরে ও খুব ভাল মানুষ, ‘‘ইঁহা শরিফ আদমিকো ভিলেনকা রোল করনা পড়তা হ্যায়।’’ সত্যিই সুদর্শন এই অভিনেতাকে সমসাময়িকরা বলতেন, পারফেক্ট জেন্টলম্যান। একই ধাঁচের খল চরিত্রের অফার পাচ্ছিলেন তিনি, কিন্ত নিজ অধ্যবসায়ে প্রতিটি চরিত্রকে একেবারে আলাদা করে তুলতেন। ‘খানদান’ সিনেমায় অ্যাডলফ হিটলারের কায়দায় সাজলেন, ‘পুরব অউর পশ্চিম’-এ মোটা ফ্রেমের চশমা পরলেন, ‘কাশ্মীর কি কলি’-তে ডায়লগে ‘সতালে, সতালে’ বলে হাততালির ঝড় বইয়ে দিলেন। সত্তরের দশকে নায়কদের থেকেও বেশি পারিশ্রমিক ছিল প্রাণের। সে সময়ই তিনি এক বিখ্যাত পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন, কারণ তাঁর মতে ওই পুরস্কার কর্তৃপক্ষ সে বার ‘পাকিজ়া’-র সঙ্গীত পরিচালককে পুরস্কার না দিয়ে অন্যায় করেছেন। রাজ কপূরের আর্থিক সমস্যা চলছে শুনে এক টাকার বিনিময়ে ‘ববি’ ছবিতে সই করেছিলেন। ‘জ়ঞ্জির’ ছবিতে তিনিই অমিতাভ বচ্চনের নাম সুপারিশ করেন। প্রকাশ মেহরাকে ‘জ়ঞ্জির’-এর ডেট দেওয়ার পর, একই ডেট তাঁর কাছে চেয়েছিলেন মনোজকুমার। সে সময় পরিচালক হিসাবে প্রকাশ মেহরার থেকে শত যোজন এগিয়ে মিস্টার ভারত। অন্য যে কেউ মনোজকুমারের ছবিটাই করতেন। কিন্তু ইমানই প্রাণের জ়িন্দেগি। তিনি ‘জ়ঞ্জির’-কে আগে কথা দিয়েছিলেন, তাই প্রকাশ মেহরার ছবিটিই করলেন। এর কয়েক বছর পর, তিনি হরিয়ানার এক তরুণ ক্রিকেটারের স্পনসর হতে চেয়ে বিসিসিআই-কে চিঠি দিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ছেলেটি ভারতের সম্পদ হয়ে উঠবে। এই তরুণের নাম— কপিল দেব।
প্রাণের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের খলনায়ক রঞ্জিত। বলিউডে তখন মনমোহন দেশাইয়ের ‘মসালা ফিল্ম’ ফর্মুলার রমরমা। এমন সময় হিন্দি সিনেমায় গুন্ডা-ছাপ বদমায়েশি নিয়ে রঞ্জিতের আগমন। তিনি বলেছেন, ‘‘তখন অন্তত ৩০০টা সিনেমায় মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি। আমার বাড়ির লোক গ্রামে থাকতেন, তাঁরা সিনেমা দেখতেন না। তাঁদের সঙ্গে মেয়ে দেখতে গিয়েছি, পাত্রীপক্ষ রেগে আগুন। আমার আসল নাম গোপাল বেদী। নাম শুনে কোনও সভ্যভব্য ছেলে ভেবেছিলেন, আর এখন দেখছেন রঞ্জিতই হল পাত্র। বললেন, খুব খারাপ ছেলে, আমরা সিনেমায় দেখেছি। আমিই সেই রঞ্জিত শুনে বাবাও অগ্নিশর্মা। তখন কোনও পার্টিতে গেলে আমাকে দেখামাত্র মেয়েরা পালিয়ে যেত। বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছি, রান্নাঘরে চিকেন আনতে ঢুকেছি, পরিচারিকা আমাকে দেখে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে উঠল।’’
আত্মীয়-বন্ধু-সহকর্মীরা সাক্ষী, গোপাল বেদী নামটা শুনলে গোবেচারা সুবোধ গোপাল মার্কা যে মানুষটির কথা মনে হয়, বাস্তবের রঞ্জিত একেবারে তাই। লাজুক, নির্বিবাদী মানুষ।
সেই জমানায় এক বিশেষ অভিনেতার নাম শুনলে ভীষণ নিশ্চিন্ত বোধ করতেন অভিনেত্রীরা। যে কোনও নৈশ জমায়েতে এই মানুষটি থাকলে আর চিন্তা নেই। সব বিপদ কাটিয়ে ঠিক বাড়ি পৌঁছে দেবেন। এই সজ্জন ব্যক্তিটি কে জানেন? প্রেম চোপড়া!
সব থেকে সংবেদনশীল খলনায়ক ছিলেন খোদ গব্বর। আমজাদ খানের বিশাল দেহের অন্দরে শিশুর মন লুকিয়ে ছিল। কেউ তাঁকে উঁচু গলায় একটা কথা বলতে শোনেনি। অ্যাক্টর্স গিল্ড-এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বহু নতুন শিল্পীকে ব্রেক দিয়েছেন, কত জনের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বড় অল্প আয়ু নিয়ে এসেছিলেন। বম্বে-গোয়া হাইওয়েতে তাঁর গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী ছিলেন, প্রাণের বন্ধু অমিতাভ বচ্চন নার্সিংহোমে বসে থাকতেন। শক্তি সামন্ত দেখা করতে এলেন, গব্বর কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বললেন, ‘‘আপনার ছবিটা করতে পারলাম না। আপনার কত ক্ষতি হল! আমাকে পরে আবার ফিল্মে নেবেন তো দাদা?’’ সে যাত্রা আমজাদ বাঁচলেন ঠিকই, কিন্তু ওষুধে মুটিয়ে গেলেন খুব। পঞ্চাশ পেরোতেই হৃদ্রোগে সব শেষ। প্রিয় বন্ধু অমিতাভ বলেছিলেন, ‘‘প্রচুর শারীরিক সমস্যা ছিল বেচারার। আমার যখন অ্যাক্সিডেন্ট হল, রোজ নার্সিংহোমে পড়ে থাকত, ডাক্তারের বারণ শুনত না। বলত, দোস্ত, এ বার আমার কর্তব্য করতে দে।’’
সিনেমা নাকি বদলে গিয়েছে। এখন তো যে নায়ক সে-ই খলনায়ক, রিল আর রিয়েল লাইফও ভয়াবহ রকমের এক রকম, কৃত্রিম। এতে দমবন্ধ লাগে তাঁর, বলেছেন ড্যানি ডেনজ়োংপা। পর্দার এই শয়তানই সিকিমের মানুষের কাছে প্রায় ভগবান। প্রকৃতির সেবক রূপে সারা বিশ্ব তাঁকে ‘মংক অ্যাক্টর’ বলে চেনে। পরভিন ববি-র শেষকৃত্যে গুটিকয়েক চেনা মুখের মধ্যে তিনিও ছিলেন। পরভিনের সঙ্গে কিছু দিনের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর অতিনায়কদের মতো তাঁকে নস্যাৎ করে দেননি এই খলনায়ক। দুর্দিনে তাঁর খোঁজও রাখতেন। স্ত্রীকে বলতেন, অভিনেতা হয়েছি বলে অমানুষ হতে পারব না।
শেষ গল্প মেজাজ ফের রঙিন করে দেবে। এ সেই দীর্ঘদেহী অভিনেতার কাহিনি, যাঁর প্রয়াণের পর বলিউডের ভিলেন-যুগটাই কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছে। বর্ষীয়ান মানুষটি তীব্র পরিশ্রম আর অনুশাসনের মাধ্যমে তাঁর আকাশ-বাতাস কাঁপানো ব্যারিটোন সামলে রাখতেন। আউটডোরে গেলে তাঁর কাছে ডিসিপ্লিন আর ফিটনেসের ক্লাস করতেন সহশিল্পীরা। হোলির দিন বলিউডের শাহেনশার বিশাল লনের কোণে বসে থাকতেন তিনি। সোশ্যাল ড্রিঙ্কার। কিন্তু বাচ্চারাও থাকবে বলে এ দিন হাতে কেবল লাইম জুস। খুদেরা কাছে এলে রং দিতেন সাবধানে, পাল্টা আবির ছোঁয়ালে চোখ পাকিয়ে হেসে বলতেন, ‘‘মোগ্যাম্বো... খুশ হুয়া-আআ।’’
চিনতে পারলেন হিন্দি সিনেমার সাংঘাতিকতম ভদ্রলোকটিকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy