নীতিভ্রষ্ট: লর্ড ক্লাইভ ও (ডান দিকে) ওয়ারেন হেস্টিংস। দেশের আইনব্যবস্থাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন এই প্রশাসকরা। ছবি: গেটি ইমেজেস
ভবঘুরে ইউরোপীয়রা বাঁচার তাগিদেই বেছে নিত অন্ধকার পথ। ব্যাঙ্ক ডাকাতি, জালিয়াতি, রাহাজানি, খুন, সবেতেই হাত পাকিয়েছিল তারা। বিচারের নামে চলত প্রহসন। যে অপরাধে সাদা চামড়ার কোনও অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়েছে, সেই একই অপরাধে নন্দকুমারের ফাঁসি হয়।
জোব চার্নক ডাইনিং রুমে মধ্যাহ্নভোজ সারছিলেন। আর এক জন নেটিভকে কোনও এক অপরাধে চাবুক মারা হচ্ছিল সামান্য দূরে। চার্নক খেতে খেতে আবহসঙ্গীতের মতো শুনেছিলেন সেই হতভাগ্যের আর্তস্বর। ক্যাপ্টেন আলেকজ়ান্ডার হ্যামিল্টনের দেওয়া এই বর্ণনা বিশ্বাস করেননি স্যর হেনরি ইউল। হতে পারে হ্যামিল্টনের বর্ণনা অতিরঞ্জিত। কিন্তু এটা সত্যি যে, সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কলকাতার সায়েবরা অপরাধীদের সাজা দিতে গিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়তেন নিষ্ঠুর অপরাধে। সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হওয়ার পরও ঘটেছিল এমন অনেক ঘটনা, এমিলি এডেন-এর ‘লেটার্স ফ্রম ইন্ডিয়া’ বইয়ে তার উল্লেখ আছে। জনৈক পদস্থ সায়েব তাঁর বাড়িতে ডাকাতির অপরাধে ১৬ জন নেটিভকে নিছক সন্দেহবশে নিষ্ঠুর শাস্তি দিয়েছিলেন আদালতে বিচারের অপেক্ষা না করে। বাঁশে হাত বেঁধে শূন্যে ঝুলিয়ে প্রথমে তাদের চাবুক মারা হয়। তার পর নীচে আগুন জ্বালিয়ে গরম লোহার ছ্যাঁকা দেন তাদের পায়ে। ওই অবস্থায় তাদের প্রায় ১৮ ঘণ্টা ঝুলিয়ে রেখে তিনি ডিনার উপভোগ করেছিলেন সামান্য দূরে বসে।
রেভারেন্ড লঙও এমন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। বারটন নামে এক জন সায়েব কাউন্সিল হাউসের দরজার একেবারে উল্টো দিকে জনৈক বাঁটুরাম চট্টোপাধ্যায়ের হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যে ভাবে শুয়োর মেরে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর নিষ্ঠুর ভাবে চাবুক মেরে তার ধর্ম নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল গোমাংস খাইয়ে।
কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এবং ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠার সুবাদে যতই এগিয়ে চলেছিল নগরায়ণের পথে, বৃদ্ধি পাচ্ছিল অপরাধ। অপরাধজগতে ঢুকে পড়েছিল সায়েবরা। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে দারিদ্র চরমসীমায় পৌঁছেছিল। ফলে অনেকে ইউরোপীয় রুজির খোঁজে এসে হাজির হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু অনেকের কপালে কিছু জুটত না। তারা ভবঘুরে হয়ে বাঁচার তাগিদে ঢুকে পড়ত অপরাধজগতে। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসকরা স্বজাতির অপরাধপ্রবণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলত, এ দেশের অপরাধীরা পেশাগত ভাবে অপরাধ করে, আর সায়েবরা এ দেশে এসে ডাকাত হয় নেটিভ অপরাধীদের মন্দ প্রভাবে!
আঠারো শতকের শুরু থেকে কলকাতা শহরে চুরি-ডাকাতিতে হাত পাকিয়েছিল সায়েবরা। ১৭০৩ থেকে ১৭১৮-র মধ্যে বেশ কয়েকটা ভয়াবহ ডাকাতি হয় যাতে জড়িত ছিল বেশ কয়েক জন সায়েব। তারা ডাকাতি করতে গিয়ে খুনও করে। তবে ধরা পড়ে অপরাধীরা। তাদের গালে গরম লোহার শিকের ছ্যাঁকা দিয়ে দাগ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর অপর পারে। ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ প্রবাদবাক্যটি প্রমাণ করেছিল তখনকার কলকাতার অপরাধীরা, কালা আর গোরা অপরাধীদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল গোপন আঁতাঁ ত। সায়েব ডাকাতদের নজর ছিল কলকাতার ধনী বাঙালি এবং ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও পদস্থ কর্মচারীদের বাড়ির ওপর। তারা ১৭৬৯ সালেই ভবানীপুরে সামরিক অফিসার মারসার-এর বাড়িতে ডাকাতি করে, একই বছরে হানা দেয় উনিশ শতকে কলকাতার বিখ্যাত পুরুষ মতিলাল শীলের বাবা চৈতন্য শীলের বাড়িতে। তাদের নেতৃত্ব দেয় এক জন বাঙালি অপরাধী, নাম মোহন পাল। মোহন ওস্তাদ পর্তুগিজ ভাষায় চোস্ত ছিল, যে ভাষা ছিল কলকাতার ইউরোপীয়দের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। ডাকাত দলে ছিল ৭০ জন ইংরেজ, পর্তুগিজ, জার্মান ও ইটালীয়। সকলেই ধরা পড়ে। দু’জনকে ফাঁসি দেওয়া হয় চৈতন্য শীলের বাড়ির কাছে বাজারের মধ্যে। সে কালে অপরাধীদের ফাঁসি কিংবা বেত্রাঘাতের শাস্তি দেওয়া হত সর্বসমক্ষে বাজারে অথবা চৌমাথায়।
১৭৯৫-এ শহরে পর পর অনেক ডাকাতি হয়। ডাকাত দলের এক জন রাজসাক্ষী হয়ে জানায়, তারা দলে ছিল দু’শো জন, পর্তুগিজ এবং অন্যান্য ইউরোপীয়। তাদের মতলব ছিল হিন্দুস্থান ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা।
সায়েব চোররা ছিল যেমন ধূর্ত, তেমনই বেপরোয়া। তাদের চেনা এবং ধরা ছিল দুষ্কর। দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় এমন দু’জন সায়েব চোরের কথা শুনিয়েছেন— ওয়ার্নার ও হিলি। ওয়ার্নার ছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে বিখ্যাত সেলাই মেশিন সিঙ্গার কোম্পানির দোকানের ম্যানেজার। কলকাতার সায়েবদের উঁচু মহলের সঙ্গে ছিল তার ওঠা-বসা, যাওয়া-আসা ছিল অভিজাত ক্লাবে। এই সামাজিক অবস্থানই ছিল তার হাতিয়ার। এক সোমবার সকালে সে উত্তেজিত হয়ে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করে, তার দোকানে ভয়ঙ্কর চুরি হয়ে গিয়েছে। পুলিশকে দেওয়া তার বয়ানে সে বলে, সকালে সে দোকানে এসে দেখে, দোকানের প্রধান দরজায় লাগানো তালাটি খোলা এবং দোকানে ঢুকে দেখে দেরাজে রাখা টাকা-কড়ি, সোনা-রুপোর অলঙ্কার উধাও। তদন্তে এসে পুলিশ কিন্তু লক্ষ করে তালা কিংবা দেরাজ ভাঙার কোনও চিহ্ন নেই। নকল চাবি তৈরির সম্ভাবনাও ছিল না, কারণ আসল চাবি থাকত ওয়ার্নারের হেফাজতে।
তদন্ত শুরু হতেই সন্দেহের তির ঘুরে গেল ওয়ার্নারের দিকে। পুলিশ তার চালচলন সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানতে পারল, ওয়ার্নারের নিত্য যাওয়া-আসা কলিঙ্গবাজারের পতিতাদের ডেরায়। সেখানে এক পতিতার হাতে পুলিশ দেখতে পেল এক জোড়া সোনার বালা। ওয়ার্নারের দেওয়া চুরি যাওয়া সামগ্রীর তালিকায় ছিল এক জোড়া সোনার বালা। সেই বালার সঙ্গে যথেষ্ট মিল পতিতার হাতের বালার। আরও জানা গেল, ওয়ার্নার বোম্বাইয়ে তার মাকে একটা পার্সেলে পাঠিয়েছিল সোনার গয়না। সব প্রমাণ মজুত। কিন্তু পুলিশ চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ওয়ার্নার গা-ঢাকা দেয়, পালায় রেঙ্গুনে। সেখানেই ধরা পড়ে শেষে।
দ্বিতীয় চোর হিলি ব্রিটিশ বাহিনীর এক জন দক্ষ সেনা। মিরাটের সেনা শিবির থেকে সে হঠাৎ পালায় ইংল্যান্ড, তার পর ভারতে ফেরে। কলকাতায় রানিমুদি লেন বা ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে একটা হোটেলে ওঠে। তার পর থেকেই ওই এলাকায় ঘন ঘন চুরি হতে থাকে। অনেক কসরত করে পুলিশ তাকে পাকড়াও করে জেলে পোরে।
কলকাতায় ইউরোপীয় নাবিক এবং সেনারা ছিল কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথার বড় কারণ। বিদেশি জাহাজগুলো কলকাতা বন্দরে এসে বিশ্রাম নিত। তখন নাবিকরা ঢুকে পড়ত শহরে, ছুটির দিনে দলে দলে দাপিয়ে বেড়াত শহরের রাস্তায়। যথেচ্ছ মদ্যপান করে মাতলামি, খুন, রাহাজানি প্রভৃতি অপরাধে জড়িয়ে পড়ত হামেশাই। এমনই একটা ঘটনা ঘটিয়েছিল মার্কিন জাহাজ ‘এলিজা’-র নাবিক ফ্রাঙ্ক ফোলস। সে বিবিজান নামে এক পতিতার মাকে খুন করে কপালে গুলি করে। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬১ পাঁচ বছরে ১৫২২ জন নাবিককে জেলে পোরা হয় বিভিন্ন অপরাধে।
১৮২৭-এর নভেম্বরের তিন তারিখে ‘সমাচার দর্পণ’ লিখেছিল, শহর কলকাতার কাছেই কেল্লা অবস্থিত হওয়ায়, সদ্য আগত সেনারা প্রায়ই কেল্লা থেকে শহরে ঢোকে। নাবিক এবং বরখাস্ত হওয়া ভাড়াটে সেনারা আস্তানা গাড়ত লালবাজার, ফ্ল্যাগ স্ট্রিটে। এখানেই তারা পরিচিত হত শহরের অন্ধকার জগতের সঙ্গে। ১৭৯৫-এ এসপ্লানেড অঞ্চলে ডাকাতির অপরাধে তিন জন ভাড়াটে সেনার হাত পুড়িয়ে দিয়ে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সায়েবদের মধ্যে সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ ছিল পর্তুগিজরা। অপরাধ ছিল বেঁচে থাকার পথ, জীবনযাপনও ছিল নোংরা।
দুর্বৃত্ত ও ছিনতাইকারীদের উপদ্রবে কলকাতার পথঘাট ছিল বিপজ্জনক। উনিশ শতকের প্রথম দিকেও পালকি বেহারারা রাতে ডালহৌসি থেকে এসপ্লানেডে যেতে চাইত না ডাকাতদের ভয়ে। রাজি হলেও ভাড়া চাইত দ্বিগুণ। পথ-ডাকাতিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা থাকত পুলিশের। গোরা অপরাধীদের সঙ্গে তাদের আঁতাঁত থাকত অনেক ক্ষেত্রে। ১৮৩৬-এর ২৮ মে ‘দ্য ইংলিশম্যান’ পত্রিকা লেখে, চিৎপুর থেকে কলুটোলার পথে কয়েক জন মহিলা পালকি চড়ে যাওয়ার সময় ডাকাতের হাতে পড়েন। পালকির বেহারারা ডাকাতদের মোকাবিলা করলেও অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ উল্টে বেহারাদের হেনস্থা করে ডাকাতদের বাধা না দিয়ে।
সে কালে মানুষ খুন অপেক্ষা চুরি এবং জালিয়াতিকে বিবেচনা করা হত গুরুতর অপরাধ বলে। ১৮০২-এ সুপ্রিম কোর্ট জনৈক মার্কিন ধর্মযাজককে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় জালিয়াতির অপরাধে। অথচ ১৮০৪-এ জন ম্যাকলাউচলিনকে এক টাকা জরিমানা ও এক মাসের হাজতবাসের নির্দেশ দেয় একটা খুনের অভিযোগে। ‘বিচারকের আসনে যাঁরা বসতেন, তাঁদের বিচার ছিল হাস্যকর’— লিখেছেন ডবলিউ এইচ কেরি। জালিয়াতি গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হলেও ১৮০২-এ সুপ্রিম কোর্ট জনৈক মরগ্যানকে জালিয়াতির অপরাধে বেকসুর খালাস দেয় এই যুক্তিতে যে, তার অপরাধ বিলেতের আইনে শাস্তিযোগ্য হলেও সেই আইন তখনও ভারতে কোম্পানির এলাকায় চালু হয়নি। অথচ এই ঘটনার অনেক আগে ১৭৭৫-এ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল একই অপরাধে। যে যুক্তিতে মরগ্যানকে মুক্তি দেওয়া হয়, জালিয়াতির অপরাধে সে যুক্তি খাটেনি নন্দকুমারের ক্ষেত্রে।
উঁচু মহলের প্রভাবশালী সায়েবরা কোনও অপরাধ করলে অধিকাংশ সময় বেমালুম রেহাই পেয়ে যেত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সখ্য থাকার ফলে। ১৮২২ সালে ‘হান্টার’ জাহাজের পদস্থ অফিসার ম্যাকডোনাল্ড, এক জন নাবিককে প্রচণ্ড শীতের রাতে হাত-পা বেঁধে প্রহার করে সারা রাত খোলা আকাশের নীচে ফেলে রাখায় তার মৃত্যু হয়৷ অকাট্য প্রমাণ মজুত ছিল সায়েবের অপরাধের, তথাপি জুরি ঘোষণা করে তাকে নিরাপরাধ বলে। বিচারপতির কিছু করার ছিল না।
চুরি, ডাকাতি, খুন-জখম, রাহাজানি প্রভৃতি ফৌজদারি অপরাধ করত নিচু তলার সায়েবরা। উঁচু তলার সায়েবরাও কিন্তু ফৌজদারি অপরাধ থেকে মুক্ত ছিল না, যদিও সেগুলো হিংসাত্মক অপরাধের মধ্যে পড়ে না। কোম্পানির উঁচু মহলের সায়েবদের মধ্যে ক্লাইভ ছিলেন সেই সব অপরাধের গুরুমশাই। পলাশির আগে সিরাজ-বিরোধীদের সঙ্গে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কথা উমিচাঁদ নবাবের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন যুদ্ধের পর তাঁকে দু’কোটি টাকা দেওয়ার জবান না দিলে। এ ব্যাপারে লিখিত চুক্তিপত্র তৈরি হল। অতি ধূর্ত এবং কূটকৌশলী ক্লাইভ দু’টি চুক্তিপত্র তৈরি করলেন, একটা আসল আর একটা নকল। আসল চুক্তিপত্র রচিত হল সাদা কাগজে, যেখানে অর্থ দেওয়ার কথা রইল অলিখিত। লাল কাগজের নকল চুক্তিপত্রে উল্লেখ রইল উমিচাঁদের দাবির কথা। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন আসল চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিলেও অরাজি হলেন নকল চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দিতে। তাঁকে জপাতে না পেরে অগত্যা ক্লাইভ নিজেই ওয়াটসনের স্বাক্ষর নিজের হাতেই করে দিলেন নকল চুক্তিপত্রে! পরিষ্কার জালিয়াতি, ফৌজদারি অপরাধ।
এই জালিয়াতি ছাড়াও ক্লাইভের অপরাধের তালিকায় স্থান পেয়েছিল বহু অপরাধ। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি, যার জন্য বিলেতের পার্লামেন্টে তাঁকে ইমপিচ করা হয় তিনি দেশে ফিরলে। সিলেক্ট কমিটি হিসেব করে দেখেছিল, ক্লাইভ বেআইনি ভাবে এ দেশ থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ লুটেছিলেন ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫-র মধ্যে। পার্লামেন্টে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে সাধারণ ভেড়া-চোরের মতো ব্যবহার করার জন্য তীব্র প্রতিবাদ করছি।’ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ঝাড়া দু’ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে শেষে প্রায় হাহাকার করে বলে ওঠেন, ‘আমার সৌভাগ্য কেড়ে নিয়ে ফিরিয়ে দিন আমার সম্মান।’ পার্লামেন্ট তাঁকে অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। কিন্তু তাঁর অপরাধ স্বদেশবাসীর মনে এমনই ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল যে, তারা তাঁর নামকরণ করেছিল ‘লর্ড ভালচার’। পার্লামেন্ট তাঁকে রেহাই দিলেও রেয়াত করেনি তাঁর নিজের বিবেক। পার্লামেন্টে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ ছেড়ে এক বছর ধরে চষে বেড়িয়েছিলেন গোটা ইউরোপ। তাতেও মুক্তি পাননি আত্মগ্লানি ও অনুশোচনা থেকে। শেষে আত্মহত্যা করেন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে।
ক্লাইভের শিক্ষাদীক্ষার পাট ছিল না তেমন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস? আপাতদৃষ্টিতে সুভদ্র, শিক্ষিত, নম্র, প্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আলোকপ্রাপ্ত এই মানুষটার মনের কোণে যে ভয়ঙ্কর অপরাধের অন্ধকার থাকতে পারে, তা ভাবাই যায় না। তাঁর অনেক দুর্নীতি ও অপরাধের প্রমাণ ছিল মহারাজা নন্দকুমারের হাতে। নন্দকুমার সেগুলো হেস্টিংসের আজন্ম শত্রু কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিসের হাতে তুলে দিলে ফ্রান্সিস সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ পেশ করেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতি-আক্রমণ আত্মরক্ষার কার্যকর উপায়, এই নীতিতে ভর করে হেস্টিংস উল্টে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র রচনা করে তাঁকে ফাঁসিয়ে দিলেন ছ’বছরের পুরনো এক জালিয়াতি মামলায়। নন্দকুমারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে নালিশ জানায় এ দেশের এক জন মানুষ, নাটের গুরু হেস্টিংস রইলেন আড়ালে। প্রধান বিচারপতি এলাইজ়া ইম্পে হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং পথের কাঁটা নন্দকুমারকে সরিয়ে দিতে বেগ পেতে হল না হেস্টিংসকে, নন্দকুমারের ফাঁসি হল। কার্যকাল শেষ হলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হেস্টিংস অভিযুক্ত হলেন নানা অপরাধে। পার্লামেন্টের বিশিষ্ট সদস্য এডমন্ড বার্ক হেস্টিংসকে তীব্র আক্রমণ করে সোজাসাপ্টা বলেন, হেস্টিংস এক জন ক্রিমিনাল। ‘হি ইজ় রোলার, হি স্টিল্স, হি ফ্লিচেস, হি প্লান্ডার্স, হি অপ্রেসেস, হি এক্সর্টস।’ ক্লাইভের মতো হেস্টিংসেরও সব অপরাধ খারিজ হয়ে গিয়েছিল পার্লামেন্টের বিচারে। তবে ক্লাইভের মতো অপরাধবোধে তাড়িত হয়ে অনন্ত অনুশোচনার তিরে বিদ্ধ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেননি ওয়ারেন হেস্টিংস। বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন অনেক দিন। ৮৬ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় তাঁর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy