Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ভুয়ো ডাক্তার থেকে রেহাই পায়নি ইংল্যান্ড-ফ্রান্সও

এঁরা কি আর শুধু আজকের বাংলায়? এক সময় ইউরোপ, আমেরিকাতেও ছিল এই উৎপাত। বিখ্যাত ভুয়ো ডাক্তারেরা তখন কেউ বাকিংহাম প্রাসাদে রানির চোখ দেখেন, কেউ বা প্যারিসে খুলে বসেন চৌম্বক চিকিৎসার মন্দির। কারও চিকিৎসালয়ে আবার সুরের মূর্ছনায় নেমে আসেন মোহময়ী এক দেবী। অশোককুমার মুখোপাধ্যায় এঁরা কি আর শুধু আজকের বাংলায়? এক সময় ইউরোপ, আমেরিকাতেও ছিল এই উৎপাত। বিখ্যাত ভুয়ো ডাক্তারেরা তখন কেউ বাকিংহাম প্রাসাদে রানির চোখ দেখেন, কেউ বা প্যারিসে খুলে বসেন চৌম্বক চিকিৎসার মন্দির। কারও চিকিৎসালয়ে আবার সুরের মূর্ছনায় নেমে আসেন মোহময়ী এক দেবী। অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

মেসমার-এর চিকিৎসাকক্ষের ছবি।ছবি: সুব্রত চৌধুরী

মেসমার-এর চিকিৎসাকক্ষের ছবি।ছবি: সুব্রত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৭ ০০:৪৮
Share: Save:

এই চিকিৎসালয়কে প্যারিসের স্বাস্থ্য-আকাঙ্ক্ষীরা মন্দির বলে জানে। ডাক্তারের কথায় ‘স্বাস্থ্য-দেবতার মন্দির’। ভদ্রলোক বেশ অদ্ভুত। নিজেকে মহাপুরুষ ভাবেন। সগর্বে বলে বেড়ান, পৃথিবীর যে কোনও বস্তুতে, এমনকী গাছের মধ্যেও চুম্বক-শক্তি চারিয়ে দিতে পারেন। গাছের পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে যাবে চুম্বকের টান। তা রোগ নিরাময়ের শক্তি অর্জন করবে। তখন গাছের কাছে যে রোগী যাবে, সুস্থ হয়ে উঠবে। মানুষের দেহে চুম্বক-শক্তি জাগিয়ে দেন ডাক্তার। এই শক্তির উদ্বোধনের পরেই তার সঙ্গে মিলিয়ে দেন সম্মোহন। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক নাকি রোগীর প্রতিটি অসুখ নিমেষে বুঝে যান। তা শরীরের কোন অংশে হয়েছে, তাও নাকি বোঝা যায়। তার মত, একমাত্র এই প্রক্রিয়াতেই চিকিৎসাবিদ্যার চরম উন্নতি।

ডাক্তারের স্বাস্থ্য-মন্দিরে প্রবেশ থেকে চিকিৎসা, সবই বেশ নাটকীয়। মন্দিরে ঢুকে রোগীরা, যাদের অধিকাংশই রমণী, নিঃশব্দে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় প্রশস্ত হলঘরের দিকে। ধূপের তীব্র গন্ধ মাদকতা আনছে তাদের শরীরে, মনে। দূর থেকে ভেসে আসছে যন্ত্রসংগীতের মূর্ছনা। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে ফুলের মৃদু সুবাস। জানালার পরদার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে আয়না-ঢাকা দেওয়ালে। রচনা করেছে মায়াবী চিত্রজাল।

হলঘরে ঢুকতেই রোগীদের বসিয়ে দেওয়া হল চুম্বকীকৃত গামলার চারপাশে। গামলা ধরে বসে থাকতে হবে তাদের, কিছু ক্ষণ।

প্রতিটি রমণীর জন্য নির্দিষ্ট এক-একটি অনিন্দ্যকান্তি যুবক। এরা সব ডাক্তারের সহকারী। এক সময় তারা এগিয়ে আসে। প্রতিটি যুবা বেছে নেয়ে তার নির্দিষ্ট নারী। রমণীর পাশে বসে, তার চোখে চোখ রাখে সে। অপলক। ইতিমধ্যে যুবকের নিম্নাঙ্গ জড়িয়ে ধরেছে রোগিণীর হাঁটু, উরু, তলপেট। শুরু হল রমণীর অঙ্গ-মর্দন। কখনও পেট, কখনও পিঠ।

হঠাৎ সংগীতমূর্ছনার সঙ্গে ভেসে এল নারীকণ্ঠের অপূর্ব সুর। আবেশে চক্ষু মুদে আসে রমণীর। যেন চুম্বক-শক্তি জেগে উঠেছে শরীরে!

এহেন রমণীয় আদিখ্যেতার পর ডাক্তারের প্রবেশ। হারমোনিয়ামের বাজনার তাল-ছন্দ মিলিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন তিনি। পরনে লাল জমকালো জোব্বা। রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ালেন বিহ্বল রমণীদের সামনে। একে-একে প্রতিটি রোগীর চোখে চোখ রাখলেন। তার দৃষ্টি একই সঙ্গে তীব্র এবং মায়াময়। কিছু ক্ষণ এমন চলবার পর হঠাৎ হাতে তুলে নিলেন পাতলা কাঠির মতো জাদুদণ্ড। তা দিয়ে স্পর্শ করলেন রোগীদের। স্পর্শ করতেই, রমণী পূর্ণ বিহ্বল। বিবশ অবস্থা। ডাক্তারের পরিভাষায় ‘ক্রাইসিস’। পূর্ণ মোহাবিষ্ট এক রমণীকে ডাক্তার নিজে কোলে তুলে নিয়ে গেলেন ‘ক্রাইসিস চেম্বার’-এ।

এই সব অনুষ্ঠানে পুরুষরাও ভিড় জমায়। বিহ্বল, বিস্রস্ত মেয়েদের দেখতে। পূর্ণ বিহ্বল মেয়েরা কেমন আচরণ করে, তা দর্শনে শরীর মন্থিত হয় তাদের। তাদেরও কিছু ঘটে নিশ্চয়ই।

পূর্ণ মোহাবেশ নিশ্চয় খুব মধুর অনুভূতি। দেখা যায়, যে রমণীর এক বার ‘ক্রাইসিস’ হয়েছে, তিনি আবার ওই ক্রিয়ায় মজে যেতে চাইছেন।

এই চুম্বক-চিকিৎসার ধাক্কায় অন্য সব প্রথাগত পদ্ধতি ম্রিয়মাণ। সবাই ছুটছে ওই মহাপুরুষের স্বাস্থ্যমন্দিরে।

কী নাম চিকিৎসকের?

নামের আগে ডাক্তার সম্পর্কে আরও দু-একটি কথা জানা দরকার। ফ্রান্সে আসার আগে ডাক্তার থাকতেন ভিয়েনায়। সেখানেও এমনই আরোগ্য-নিকেতন খুলেছিলেন। হইচই পড়ে গিয়েছিল ভিয়েনাতেও। কাতারে-কাতারে রোগী চিকিৎসালয়ে। কিন্তু ওই যে একলাটি ঘরের মধ্যে রোগিণীদের নিয়ে যান ডাক্তার, তাতে সন্দেহ জাগল কিছু লোকের। অভিযোগ পেয়ে রানি মারিয়া টেরেজা অনুসন্ধানী কমিশন বসালেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ভিয়েনা ছাড়তে বলা হল ডাক্তারকে। এর পরেই ডাক্তার এলেন ফ্রান্সে। ১৭৭৮ সালে। একটি শহরে এমন সম্মোহনের কারবার খুলে তেমন জমল না। এলেন প্যারিসে। এখানে চুম্বক-সম্মোহন চিকিৎসা ভিয়েনার মতোই সাড়া জাগাল।

ফরাসি সরকার ডাক্তারের কাছে তাঁর এই বিদ্যার গুপ্ত রহস্যটি প্রকাশ করতে অনুরোধ করলেন। একাধিক বার। মোটা টাকার পেনশন দিতে গভর্নমেন্ট প্রস্তুত। সর্বোচ্চ সম্মান ‘ক্রস অব দি অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল’-ও দেওয়া হবে তাঁকে। কিন্তু ডাক্তার এই লেনদেনে নারাজ। এমনিতেই তাঁর রোজগার আকাশছোঁয়া, যা ওই পেনশন-পুরস্কারের থেকে অনেক বেশি।

তার পর এক দিন পুলিশের বড়কর্তা এলেন। সহকারী চিকিৎসককে তাঁর প্রশ্ন, এই পদ্ধতিতে সম্মোহিত হবার পর কি মহিলার শ্লীলতাহানি করা সম্ভব? সহকারী খানিক মাথা চুলকে জানাল, হ্যাঁ স্যর, তবে এই সম্মোহনের কাজ করেন একমাত্র ডাক্তার স্যর, অথবা তার কোনও যোগ্য এবং অভিজ্ঞ সহকারী।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফিরে গিয়ে রিপোর্ট পেশ করলেন। ভিয়েনার মতো প্যারিসেও নামী বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত হল অনুসন্ধানী কমিশন। স্বল্প কালের মধ্যেই কমিশন তাদের মতামত জানিয়ে বিবৃতি দাখিল করল। যার সারমর্ম, এই চিকিৎসার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সবই কল্পনাপ্রসূত। সোজা কথায়, ধাপ্পাবাজি। বিবৃতির প্রথম স্বাক্ষরকারী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। ব্যস, ফ্রান্সেও এই মছলিবাবার কারবার খতম।

এই ভুয়ো ডাক্তারের নাম ফ্রান্‌জ অ্যান্টন মেসমার (১৭৩৪-১৮১৫)। আর তাঁর মতবাদের নাম ‘মেসমেরিজম’। মেসমেরিজম নিয়ে এই মছলিবাবা একটি বইও লিখেছিলেন, যা প্রকাশিত হয় ১৭৭৯ সালে।

যদি ক্ল্যারিসিমাস গ্যালেন-কে (১৩০-২০০) আমরা অ্যানাটমির আদি গুরু মানি, কিংবা আধুনিক অ্যানাটমি চর্চার জন্মদাতা মানি অ্যান্ড্রিয়াস ভেসালিয়াস-কে (১৫১৪-১৫৬৪), জন হান্টারকে যদি মান্য করি আঠারো শতকের শল্যচিকিৎসায় নতুন যুগের প্রবর্তক হিসাবে, তবে মেসমারকে দিতেই হবে সেরা ভুয়ো ডাক্তারের শিরোপা।

মেসমারের মতো কারবার ফেঁদেছিলেন এডিনবরার জেমস গ্রেহাম। গ্রেহামের বাবা ঘোড়ার জিন তৈরি করতেন। ইচ্ছে হল ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু ডাক্তারি পাশ করবার অনেক আগে গ্রেহাম কলেজ ছেড়ে পাড়ি দিলেন সোজা আমেরিকায়। ওখানে গিয়ে নিজেকে ডাক্তার ঘোষণা করে শুরু করে দিলেন প্র্যাকটিস। এক জায়গায় বসে থাকা তাঁর স্বভাবে নেই। ঘুরে ঘুরে প্র্যাকটিস করে বেড়ান তিনি।

ডাক্তারবাবু: ফ্রান্‌জ অ্যান্টন মেসমার।

ফিলাডেলফিয়ায় এসে শুনলেন, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন বৈদ্যুতিক শক্তির নতুন এক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছেন। বুদ্ধি খেলে গেল। গ্রেহাম ঠিক করলেন, বৈদ্যুতিক শক্তি চিকিৎসার কাজে লাগাবেন। এই কারবারের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডে এসে অভিজাত এলাকায় বাড়ি নিলেন, ১৭৮০ সালে।

তাঁর বাড়িটিও অদ্ভুত করে সাজানো। ঢুকতেই সাজানো-গোছানো প্রশস্ত হলঘর। মেসমারের স্বাস্থ্যমন্দিরের মতোই উগ্র সুবাস, পাথরের নগ্ন মূর্তির সারি, এমনই আরও নানা মনোহরণ বস্তু। একটি বড় স্তম্ভের গায়ে খানকতক লাঠি, কাঠের পা, চশমা, বধিরের প্রয়োজনীয় কানের ড্রাম ইত্যাদি। এগুলো দেখিয়ে গ্রেহাম জানাতেন, তাঁর চিকিৎসার আগে রোগীদের লাগত এই সব, এখন আর লাগে না। এই স্বাস্থ্যমন্দিরে প্রবেশমূল্য ছয় গিনি।

ডাচেস অব ডেভনশায়ার-কে বশ করে ফেললেন গ্রেহাম। অভিজাত মহলে নাম ছড়িয়ে পড়ল। রোজই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। তাঁর চিকিৎসা নেওয়া যেন একটা ফ্যাশন! ডাক্তার ঘোষণা করলেন, তাঁর ‘গ্রেট অ্যাপোলো অ্যাপার্টমেন্ট’ যারা দেখেনি, তাদের জীবন বৃথা। এই কন্দর্পমন্দিরে আছে বিদ্যুৎ, বায়ু আর চুম্বক, এই ত্রিশক্তির মেলবন্ধনে দেহের পুষ্টির এক অনুপম ব্যবস্থা। অ্যাপোলো অ্যাপার্টমেন্টের আসল বস্তু চল্লিশটি কাচের থামের ওপর বসানো নরম গদির এক অতীব আরামদায়ক শয্যা। চুম্বক এবং বৈদ্যুতিক কলকবজার আড়ম্বর চতুর্দিকে। ঘরে মৃদু আলো, ধূপধুনোর মাদক সুবাস, দেওয়ালে কামোদ্দীপক চিত্রমালা। আবহসংগীত বেজে চলে সর্ব ক্ষণ। রমণীয় শয্যার পাশেই আবির্ভূত হন স্বর্গের স্বাস্থ্যদেবীর প্রতিভূ এক নারী। তিনি স্বয়ং এসে ঘটান রোগীর নিরাময়!

গ্রেহামের ঘোষণা— এই শয্যায় শয়ন করলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ফিরে পাবেন নবযৌবন, নবদম্পতির সন্তান হবে স্বাস্থ্যবান, যুবক-যুবতীরা চিরজীবন রক্ষা করতে পারবে দেহকান্তি আর নিঃসন্তান পাবে সবল সন্ততি। লোকে হইহই করে আসতে লাগল। মওকা পেয়ে ডাক্তার এই ‘মেডিকো-ম্যাগনেটিকো-মিউজিকো-ইলেকট্রিক্যাল’ শয্যার এক রাতের ভাড়া ধার্য করলেন একশো পাউন্ড।

এক দিন সব ধরা পড়ল। দেখা গেল, স্বাস্থ্যদেবী আর কেউ নন, মোহিনী নর্তকী এমা লিয়ন। ফাঁস হল সব কীর্তিকলাপ। স্বাস্থ্যমন্দির বন্ধ হল ১৭৮২ সালে।

এ কাহিনির এক উপসংহার আছে। গ্রেহামের সবচেয়ে দামি ওষুধ ‘ইলিকসার অব লাইফ’। দাম এক হাজার পাউন্ড। ডাক্তারের দাবি, এ জিনিস সেবন করলে মানুষের আয়ু দেড়শো বছর হবেই। মাঝে মাঝে কয়েক বার রিপিট করলে আয়ু গিয়ে ঠেকবে অনন্তকালে। যদিও এই ওষুধের আবিষ্কর্তা জেমস গ্রেহাম মারা যান পঞ্চাশ পূর্ণ হবার আগেই।

স্বীকৃত ডাক্তারদের পাশাপাশি ভুয়ো ডাক্তারি সেই আদ্যিকাল থেকেই। সতেরো শতকের ইউরোপে যেমন ছিল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, পাশাপাশি হাতুড়ে ডাক্তারদের পরামর্শে ডাকিনী সন্দেহে স্ত্রী-পুরুষ-শিশুদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডও চলেছে অবাধে।

আঠারো শতকে অন্য ছবি। জার্মানি হঠাৎ এক-একটি তত্ত্ব বাজারে ছাড়ে, ফরাসি দেশ তাতে পুষ্টি জোগায়!

কোষ্ঠকাঠিন্য হলে দেহে অস্বস্তি, অমনি হামবুর্গের ডাক্তার জোয়ান ক্যাম্‌ফ-এর ধারণা হল, যত নষ্টের গোড়া এই বস্তুটি। অতএব, রোগ থেকে বাঁচতে চাও? পেট সাফ করো। ঘরে-ঘরে এনিমা নেওয়া চালু হয়ে গেল। এ সেই ডাক্তারের গল্প, যে সব রোগেই ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ায়। জ্বর হয়েছে? ক্যাস্টর অয়েল। পায়ে ব্যথা? ক্যাস্টর অয়েল। কী করে যেন সেরেও ওঠে রোগী। এক জনের গরু হারিয়েছে, সেও ডাক্তারের কাছে হাজির। বেশ রাত্তির তখন। কিছু বলতে আরম্ভ করতেই, ডাক্তার তাকে ক্যাস্টর অয়েল খাইয়ে দিলেন। তার পর ভোররাত থেকে পেটে মোচড়। মাইল খানেক দূরে যে মাঠে প্রাতঃকৃত্য সারতে যায় সে প্রতি দিন, কোনও রকমে সেখানে পৌঁছে পেট খোলসা করতে বসে গেল। মাঠেই বসে আছে, হঠাৎ সেই আলো-আঁধারির মধ্যেই দেখে, প্রায় কুড়ি-তিরিশ পা দূরে একটি গরু ঘাস চিবোচ্ছে। ভালো করে চোখ কচলে দেখে বুঝল, আরে, এ তো তার গরু! এর পর আর ডাক্তারের ওপর বিশ্বাস না বেড়ে পারে!

জন ব্রাউনের তত্ত্ব একটু ভিন্ন— রোগ আসে উত্তেজনা থেকে। অতএব মাথা চড়ে গেলে আফিম, আর দুর্বল লাগলে মদ খাওয়ানোর নিদান। সহজ ব্যবস্থা। শুধু বলা নয়, ডাক্তার নিজে এর প্রমাণ দিতে পাঁচ পাবলিকের সামনে ঢকঢক করে পাঁচ গেলাস মদ খেয়ে দেখাতেন। এই পরিমাণ মদ আর আফিম খেলে যা হয়, অল্প বয়সেই তিনি সোজা সাধনোচিত ধামে! কিন্তু ডাক্তার না বাঁচলে কী হবে, তার পরেও প্রায় পঁচিশ বছর এই থিয়োরি বেঁচে রইল। আরোগ্যের আশায় লোকে খেতে থাকল মদ আর আফিম, আফিম আর মদ। ঐতিহাসিকের মতে, ফরাসি বিপ্লব আর নেপোলিয়নের যুদ্ধে একত্রে যত না লোকক্ষয়, তার অনেক বেশি হয়েছে এই বিচিত্র চিকিৎসায়।

অভিজাত মহলে বক্তৃতারত জেমস গ্রেহাম

এই সময়েই হোমিয়োপ্যাথির আবির্ভাব, যা আজও লোকপ্রিয়।

আঠারো শতকের ইংল্যান্ড চিকিৎসায় ধাপ্পাবাজির সুবর্ণসময়। যার যেমন ইচ্ছে ওষুধ ছাড়ে বাজারে, আর লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার করে।

সে-সময় পাড়ার দর্জিও ইচ্ছে করলে চিকিৎসক বনে যায়। এমনই এক দর্জি উইলিয়াম রিড। হঠাৎ ডাক্তার হবার শখ। অতএব দর্জিখানা বন্ধ। নিজেকে ডাক্তার ঘোষণা করে প্র্যাকটিস চালু করে দিলেন। চক্ষু-বিশেষজ্ঞ ডা. রিডের প্রশংসা করে লন্ডনের প্রধান কাগজে রোজ বিজ্ঞাপন ছাপা হতে থাকল। এক পণ্ডিত মানুষকে মোটা ঘুষ দিয়ে লেখানো হল চক্ষুরোগের ওপর বই। সেই পাণ্ডুলিপি নিজের নামে বাজারে ছেড়ে দিলেন ডা. রিড। সেই বইয়েরও বিজ্ঞাপন ছাপা হতে থাকল নিয়মিত। তার প্রশংসা করে লেখাও বেরিয়ে গেল। এর পরে ধরলেন এক কবিকে। তিনি উইলিয়াম রিডের ক্ষমতার প্রশংসা করে ছড়া লিখে দিলেন। কাগজে ছাপা হয়ে সেই ছড়া লোকের মুখে-মুখে ঘুরতে থাকল। সেই সময়ের বিদ্বজ্জনদের অনেকেই বুঝেছিলেন রিডের অজ্ঞতা। তাঁরা হাসাহাসি করতেন। কিন্তু ডাক্তার অদম্য। নানান কায়দায় তিনি হয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের রানির চক্ষু-চিকিৎসক। রানির এতটাই বিশ্বাস জন্মেছিল উইলিয়াম রিডের ওপর, তাকে নাইটহুড দিয়ে বসলেন!

রিডের সমসময়ে লন্ডনে হঠাৎ এক বিধবা ভদ্রমহিলা জোয়ানা স্টিফেন্স-এর খুব নামডাক হয়ে গেল। তাঁর কাছে নাকি আছে মূত্রাশয়ে পাথর গলাবার অব্যর্থ ওষুধ। লন্ডনের অভিজাত সমাজ মুগ্ধ। লোকে বোতল-বোতল এই ওষুধ খেতে
শুরু করল।

এক দিন ‘জেন্টলম্যান’ ম্যাগাজিনে বিজ্ঞপ্তি বেরল, ডাক্তার এই ওষুধের ফর্মুলা জাতির কল্যাণে সরকারকে দান করতে প্রস্তুত। বিনিময়ে তাকে দিতে হবে পাঁচ হাজার পাউন্ড। অভিজাতেরা ট্যাঁক খুলে দান করলেন, তবু এই টাকা উঠল না। মিসেস স্টিফেন্সও ওষুধের রহস্য ফাঁস করলেন না। এ দিকে জনমত প্রবল। গভর্নমেন্টের উচিত এমন অব্যর্থ ওষুধ জনসাধারণের কল্যাণে কিনে নেওয়া। চাপে পড়ে বসানো হল অনুসন্ধানী কমিশন। তিন বাঘা সার্জেন রইলেন সেই কমিটিতে। ওষুধ পরীক্ষার পর তিন চিকিৎসকই একযোগে রায় দিলেন, আমরা এই ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেছি। কী করে বানানো হয় তাও লক্ষ করেছি। এই ওষুধের পাথর গলাবার ক্ষমতা আছে। সরকারকে কথা রাখতে হল। মিসেস স্টিফেন্সকে দেওয়া হল পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরস্কার। জাতীয় সম্পত্তি হয়ে গেল মিসেস স্টিফেন্সের ওষুধ।

১৭৩৯ সালের ১৯ জুন লন্ডন গেজেটে প্রকাশিত হল ওষুধের ফর্মুলা। সবার বিষম খাওয়ার উপক্রম। স্টিফেন্সের টনিক তৈরি কতকগুলো বাজে গাছপাতা সাবানজলে সেদ্ধ করে। বুনো গাজর আর গাছগাছড়ার পোড়ানো ছাইয়ের সঙ্গে সাবান আর মধু মিশিয়ে তৈরি হয়েছে বড়ি। গ্রীষ্মকালে শুকনো ডিমের খোলা বালিতে ভেজে, বাগানের শামুকের সঙ্গে বেঁটে মিশিয়ে তৈরি স্টিফেন্সের পাউডার। এই আবর্জনা থেকে তৈরি হয়েছে মূত্রাশয়ে পাথর গলাবার ওষুধ! এর জন্য এত কাণ্ড! সব থেকে যা মজার, তিন নামী সার্জেনকে কেমন বোকা বানিয়ে পাঁচ হাজার পাউন্ড জোগাড় করে নিলেন এক বিধবা মহিলা!

সে যুগের এমন অনেক ভুয়ো ডাক্তারের খোঁজ মেলে। লন্ডনে টেলর নামে আর এক ‘চক্ষু চিকিৎসক’-এর খবর পাওয়া যায়। তিনিও প্রথাগত পড়াশোনায় ফেল মেরে চিকিৎসার লাইন নিয়েছিলেন। তাঁর বৈশিষ্ট্য, ঘুরে-ঘুরে চিকিৎসা করে বেড়ান। রবার্ট জেমস বের করেছিলেন ‘জেমস পাউডার’। তাতে যে কী আছে কেউ জানে না, অথচ সবাই ভালো বলত। জর্জ বাকলি-র বিশ্বাস, যেহেতু দেবদারু গাছ সোজা আকাশে উঠে সূর্যের আলো আর মুক্ত বাতাস থেকে বিশ্বের সারটুকু টেনে নিজের গুঁড়িতে জমায়, অতএব এই গুঁড়ির কষ নিশ্চয়ই নিরাময় করবে বসন্ত, যক্ষ্মা, সিফিলিস ইত্যাদি গুরুতর রোগ!

ওই সময়ের কলকাতা তথা বাংলাতেও একই চিত্র। এমন অনেক হাতুড়ে ছিল নিশ্চয়ই। যার কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ১৮৪০-১৮৭০ সময়কালে প্রকাশিত নাটিকায়, নিবন্ধে। ‘হাসিও আসে কান্নাও পায়’ নাটিকায় দেখা যায়, এক হাতুড়ে ডাক্তার ম্যালেরিয়া রোগীকে টিংচার আয়োডিন খেতে দিয়েছেন। রোগীর শ্বাস ওঠার উপক্রম!

তবে এই সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর। জানা গেল, আগামী সেপ্টেম্বর থেকে মধ্যপ্রদেশ সরকার প্রথাগত পদ্ধতির পাশাপাশি গ্রহনক্ষত্র বিচার করে চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করতে চলেছেন। হাসপাতালের আউটপেশেন্ট বিভাগে ডাক্তারের পাশাপাশি থাকবে জ্যোতিষীদের বসার ব্যবস্থা। ডাক্তারকে দেখানোর পরেই রোগী জ্যোতিষীর কাছে জেনে নিতে পারবেন, আয়ু আর কত দিন, কিংবা সার্জারির আগে বিচার করে নেবেন ভাগ্য।

সব দেখেশুনে মনে হয়, মেসমার মারা যাবার দু’শো বছর পেরিয়ে গেলেও ভুয়ো ডাক্তারি, হাতুড়েগিরি কিছুই মরেনি। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy