Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Dwijendralal Ray

রবীন্দ্রবিদ্বেষ থেকেই নিজস্ব আসন হারিয়েছিলেন তিনি

অথচ প্রথম দিকে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল কবির সঙ্গে। একে অপরের গান গাইতেন। অনুষ্ঠানে সমাবেশে এক সঙ্গে অংশ নিতেন। হঠাৎই জমা হয় তিক্ততার কালো মেঘ। মধুর সম্পর্ক হয়ে ওঠে অম্ল। রবীন্দ্রনাথ উদারতা দেখালেও আর কখনও সহজ হতে পারেননি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। নূপুরছন্দা ঘোষ

সৃজনশিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দু’জনেই ছিলেন সুপুরুষ, সুকণ্ঠের অধিকারী।

সৃজনশিল্পী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দু’জনেই ছিলেন সুপুরুষ, সুকণ্ঠের অধিকারী।

নূপুরছন্দা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৪ ০৮:২৮
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র দু’বছরের ছোট ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। আশ্চর্য মিল দুই ব্যক্তিত্বে। তাঁরা দু’জনেই উচ্চবংশে, সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দু’জনেই পড়াশোনা করতে বিলেত যান। দু’জনেই ছিলেন সুপুরুষ, সুকণ্ঠের অধিকারী। দু’জনেরই স্ত্রী-বিয়োগ হয় অকালে। দ্বিজেন্দ্র-পুত্র দিলীপকুমার রায় লিখেছেন— “পিতৃদেব বলতেন, না, বাঙালি আমাকে কি রবিবাবুকে ভুলে যাবে না, আর কেন যাবে না জানিস? এই জন্যে যে আমরা রেখে যাব বাঙালির প্রাণের জিনিস— সুরে বাঁধা গান।”

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রতি বারই এসে মনে হয়, সত্যিই কি এই মানুষটির যথার্থ মূল্যায়ন বাঙালি করতে পারল?

সেই মানুষটি স্বদেশপ্রেমকে শুধু আত্মোপলব্ধির বিষয় করে রাখেননি, মন্ত্রের মতো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশের মানুষের মধ্যে, ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’র মন্ত্র গুঞ্জরিত হয়েছিল দেশময়। তখনও জাতীয় সঙ্গীত বলে আমাদের কিছু ছিল না, কিন্তু বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে সেই মন্ত্রশক্তি আমাদের আত্মজাগরণের দরজা একেবারে হাট করে খুলে দিয়েছিল। এক দিকে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অন্য দিকে দ্বিজেন্দ্রলাল। এই দু’জনের কলম থেকে উৎসারিত হয়েছিল স্বদেশের ঘুম ভাঙানোর চারণগীতি। এই দেশ তাঁর কাছে ছিল প্রেরণা। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি তিনি গয়ায় লিখেছিলেন। তাঁর বন্ধু দেবকুমার রায়চৌধুরী লিখেছিলেন, গানটি লেখার পর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। গানটি লেখায় তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।

পাঁচশোরও বেশি গান রচনা করে গিয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। সুরে ও বাণীতে সেগুলির বৈচিত্র যেন বর্ণালীর মতো। হাসির গান ও কবিতায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেই হাসি কখনও নির্মল, আবার কখনও তাঁর মধ্যে থাকে ব্যঙ্গের কশাঘাত। এ গানগুলি যুগ এবং কালকে অতিক্রম করে গিয়েছে। তার রচিত ‘নন্দলাল’ আমাদের প্রত্যেকের পরিচিত। ‘খামখেয়াল’-এর আসরকে আনন্দে মশগুল করে রাখতেন দ্বিজেন্দ্রলাল, তাঁর অফুরন্ত হাসির গান দিয়ে! তিনি গাইতেন আর অন্য সভ্যরা কোরাস ধরতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোরাসের নেতা। দ্বিজেন্দ্রলাল গাইতেন, ‘নন্দলাল একদা একটা করিল ভীষণ পণ...’, রবীন্দ্রনাথ গাইতেন ‘বাহারে নন্দ বাহারে নন্দলাল’। নন্দলাল বলেছিলেন ‘আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ’, নন্দলালের সাঙ্গোপাঙ্গরা তাল ঠুকে বলেছিলেন ‘ঠিক ঠিক বাহবা বাহবা বেশ’— দেশ উদ্ধারের ছদ্ম-লড়াইয়ে আজ যে রাজনীতিকরা ডুবে আছেন, সেই মিথ্যাসর্বস্বদের ভণ্ডামির মুখোশ
বহু দিন আগেই খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কৌতুকবোধ ছিল প্রখর। এক বার তিনি সুরধামে থাকাকালীন, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে একটি ছোট্ট আমন্ত্রণপত্র লেখেন—

প্রিয়বরেষু,

আগামী রবিবাসরে মদীয় ভবনে ভবদীয় অপরাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ রইল। উদ্দেশ্য ভালো। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে রাজা-মহারাজারা কেহই নাই। অথচ প্রায় সকলেই আপনার পরিচিত ব্যক্তি।

তামাক এবং পান

গল্প এবং গান

প্রচুর পরিমাণ।

—ভবদীয়

শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়

১৮৯৭ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বিরহ’ শীর্ষক প্রহসনটি প্রকাশিত হয়। এটি তিনি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল—

“কবিবর শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করকমলে,

বন্ধুবর! আপনি আমার রহস্যগীতির পক্ষপাতী, তাই রহস্যগীতপূর্ণ এই নাটিকাখানি আপনার করে অর্পিত হইল।”

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রহসনটি মহাসমারোহে অভিনীত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই।

‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকা মাঘ-চৈত্র, ১৩৬৯ সংখ্যায় পাওয়া যায় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি আমন্ত্রণমূলক কবিতা, যা তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন। ‘সনেট’ নামে এটি পাওয়া যায়।

কাল রবিবার রাত্রে, সাড়ে সাতটায়,

১ ব্যাংকশাল স্ট্রিটে, ভারতীয় ‘ক্লাবে’,

‘ডিনার’-ব্যাপার সবই পূর্ববৎ প্রায়;

ইচ্ছা গোলযোগ করা মাত্র মিলে সবে।

কদিনেরই বা জীবন? তাও অনিশ্চিত

ঠিক নেই চলে যায় কোথায় কে কবে।

আমোদটা যে এ ঘোর অর্থশূন্য ভবে

যত করে নিতে পারে তত তার জিত।

কেহ পায় সে আমোদ দোল দুর্গোৎসবে;

কেহ নৃত্যগীতবাদ্যে; কেহ বন্ধুসহ

নম্র ডিনারের মৃদু-তর কলরবে।

আমাদের এই অতি সাধু মতলবে

রবিবাবু— আপনার যোগ দিতে হবে।

ভবদীয়

শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়

দ্বিজেন্দ্রপুত্র দিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন— “আজও মনে পড়ে আমার একটি অবিস্মরণীয় দিনের কথা; রবীন্দ্রনাথ যেদিন আমাদের শুকিয়া স্ট্রিটের বাসায় এসে, ‘সে যে আমার জননী রে’ গানটি গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন! গানের শেষে পিতৃদেব তাঁকে আবিরে রাঙিয়ে দেন, তখন কবিগুরু হেসে বলেছিলেন, ‘আজ দ্বিজেন্দ্রবাবু শুধু আমাদের মনোরঞ্জন করেছেন তাই নয়— আমাদের সর্বাঙ্গ রঞ্জন করলেন!’ আজও মনে পড়ে অনিন্দ্যকান্তি কবির লালে লাল হয়ে ওঠা প্রতিভাদীপ্ত মুখের সে অপরূপ শোভা। কবির উক্তিটিও পিতৃদেব কত বার যে সগর্বে উদ্ধৃত করেছেন আমাদের কাছে।”

এ হেন মধুর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে এক কালো ছায়া তাঁর উপর এসে পড়েছিল, তাতেই দুই কবির সম্পর্ক দিনে দিনে তিক্ততায় পরিণত হল। ভুল বোঝাবুঝির পিছনে কে বা কারা ছিলেন, তা আর স্পষ্ট করে জানা যায় না। দ্বিজেন্দ্রলাল কবিকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন ‘আনন্দবিদায়’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে কোনও বিরূপ ভাব প্রকাশ করেননি, বলেছিলেন, “আমি অন্তরের সঙ্গে তাহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি।” এখানেই বোধ হয় বৃহৎ আর বৃহত্তমের তফাত।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পরে ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। ধরাধাম ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হয় অসময়ে, তাই হয়তো
তিনি লিখেছিলেন, “জীবনটা তো দেখা গেল, কেবল শুধু কোলাহল, এখন যদি সাহস থাকে, মরণটাকে দেখবি চল।”

হয়তো এই বিচ্যুতির জন্যই আজ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও প্রাপ্য সম্মান তিনি পেলেন না। এতগুলো বছর পেরিয়েও তাঁর নাটক, গান, কবিতা সমান প্রাসঙ্গিক। দেশ, সমাজ, মানুষের কথা সেখানে খুঁজে পাই আমরা। তিনি এখনও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অমর। তবু অবহেলিতই রয়ে গেলেন ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা-’র কবি। সময়বিশেষে তাঁর রবীন্দ্র-বিদ্বেষ সময়ই হয়তো ক্ষমা করেনি। না হলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্ট্রিটে তাঁর বাসভবনটি কি একটু যত্নে সংরক্ষিত হয়ে একটি সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে উঠতে পারত না? যাঁরা দ্বিজেন্দ্রলালকে আজও শ্রদ্ধা করেন, তাঁর রবীন্দ্র-বিরোধিতায় সঙ্কোচ বোধ করেন, এ প্রশ্ন তাঁদের সকলের।

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy