জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভিডিয়ো কনফারেন্সে বিবেকানন্দের মূর্তি উন্মোচিত হল। এই সরকারি উদ্যোগকে বাম ছাত্র সংগঠন সুনজরে দেখেনি। বিবেকানন্দকে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁদের লোক বলে দখল করতে তৎপর। বামপন্থীদের কাছে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের আদিগুরু। বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বামপন্থী, তবে দাদা বিবেকানন্দের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধা ছিল না। বরং তিনি ভালই জানতেন, দাদা ধর্মের নামে বজ্জাতি করতে চাননি। নরেন্দ্রনাথ বা ভাই ভূপেন্দ্রনাথ কেউ কুয়োর ব্যাঙ ছিলেন না— ভারতীয় রাজনীতি এখন বদ্ধ কুয়ো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও তাই চিন্তাবদ্ধ অচলায়তন করে তোলার চেষ্টা চলছে।
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩। সে দিন স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্ম মহাসভায় দুই ব্যাঙের গল্প বলেছিলেন। কুয়োর ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের এক সত্যি উপকথা। সমুদ্রের ব্যাঙ কুয়োয় এসে পড়েছে। কুয়োর ব্যাঙ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথা থেকে আসছ হে?’ ‘সমুদ্র থেকে।’ এ কথা শুনে কূপমণ্ডূক বললে, ‘কত বড়ো তোমার সমুদ্র? আমার কুয়োর মতো বুঝি?’ সমুদ্র থেকে আসা ব্যাঙ তো অবাক। বললে, ‘ভাই রে, সমুদ্রের সঙ্গে কি কুয়োর তুলনা চলে?’ কুয়োর ব্যাঙ অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করল না, রেগে গেল। শেষে বলল, ‘যাও যাও। আমার কুয়োর থেকে কোনও কিছুই বড় হতে পারে না। মিথ্যেবাদী তুমি। যাও বেরিয়ে যাও।’ গল্পটা শুনিয়ে বিবেকানন্দ বললেন, ‘এই হল সব সমস্যার মূল। আমি হিন্দু। আমার নিজের ছোট্ট কুয়োয় বসে ভাবি গোটা পৃথিবীই বুঝি আমার কুয়োর মতো ছোট।’
বিশ্বজয়ী: চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ।
না, গোটা পৃথিবী কুয়োর মতো ছোট হতে পারে না। কিন্তু সঙ্কীর্ণমনা ধর্মধ্বজীরা তা-ই ভাবেন। শুধু ধর্মধ্বজীরাই বা কেন, উগ্র জাতীয়তাবাদীরাও তাই ভাবেন— তার পর নিজেদের নিরাপদ ক্ষুদ্র স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে উদার মানুষদের ঘাড় ধরে মিথ্যেবাদী বলে কোতল করতে চান। আর একটা কাজও তাঁরা করেন। কোনও চিন্তাবিদের সেই সব ভাবনা কেটেকুটে তাঁদের কাজে লাগাতে চান, যে ভাবনাগুলো তাঁদের কুয়োর দেওয়াল পোক্ত করে। বিবেকানন্দের কথাই ধরুন না কেন। মাত্র ঊনচল্লিশ বছর তাঁর আয়ুসীমা। দেশে-বিদেশে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। সঙ্কীর্ণ মানসিকতার বিরোধিতা করেছেন, আবার এ দেশের অতীতকালের যা কিছু ভাল, তা সশ্রদ্ধ চিত্তে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। বিদেশের ভাল যা কিছু তারও সমাদর করেছেন। গাজিপুর থেকে গুরুভাই অখণ্ডানন্দকে ১৮৯০ সালের মার্চ মাসে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার motto এই যে, যেখানে যাহা কিছু উত্তম পাই, তাহাই শিক্ষা করিব। ইহাতে বরাহনগরের অনেকে মনে করে যে, গুরুভক্তির লাঘব হইবে। আমি ঐ কথা পাগল এবং গোঁড়ার কথা মনে করি।’ অথচ বিবেকানন্দের লেখাপত্র মন দিয়ে না পড়েই অথবা তাঁর রচনা কেটেছেঁটে ব্যবহার করে এক দল তাঁকে সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী বানিয়ে তুলতে চান, অন্য দল তাঁকে গৈরিক-বস্ত্রধারী বলে সন্দেহের চোখে দেখে বাতিল করেন। তাঁর কথার সারবস্তু গ্রহণই করতে চান না। তাঁকে গোঁড়া বলে দখল করা কিংবা নিতান্ত ধর্মভাবুক বলে বাতিল করা— দু’টিই হল ওই কুয়োর ব্যাঙের দৃষ্টি। তাঁর জীবন আর কাজকর্মের দিকে খোলা চোখে তাকানোর সময় এসেছে। মনে রাখতে হবে, তিনি নিজেকে প্রয়োজন মতো শুধরে নিতেও দ্বিধা করতেন না। ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০২, বারাণসী থেকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বৌদ্ধধর্ম ও আধুনিক হিন্দুধর্মের সম্বন্ধ-বিষয়ে আমার মতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আমি এ বিষয়ে যে একটু-আধটু আলোক পেয়েছি, তা বিশেষভাবে বুঝাবার আগেই আমার শরীর যেতে পারে...।’ জীবনের শেষ অবধি যিনি ধর্মকে নতুন ভাবে বুঝতে চান, নিজেকে বদলাতে চান, তিনি কী করে কুয়োর ব্যাঙ হবেন! তিনি মনে করতেন জীবন ছোট সত্য থেকে বড় সত্যে যাওয়ার পথ। আর চিন্তাশীলদের মধ্যে ভাবনার ওঠা-পড়া তো স্বাভাবিক। নিবেদিতাকে লিখেছিলেন তিনি ‘আমরা সকলেই সাময়িক আবেগে চলি’ (৭ সেপ্টেম্বর ১৯০১), আবেগের ওঠা-পড়াহীন যান্ত্রিক মানুষ বিবেকানন্দ ছিলেন না। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে তাঁর সুপরিচয়, আবার দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর রামকৃষ্ণের মধ্যে দেখেছিলেন প্রাগাধুনিক ভারতীয় সন্তপন্থার ‘বহুসাধকের বহু সাধনার ধারা’— এ দুয়ের, অর্থাৎ প্রাগাধুনিকের সঙ্গে আধুনিকের মিলমিশ সহজ নয় বলেই হয়তো নিবেদিতাকে জীবনের প্রান্তবেলায় এসে লেখেন, ‘জীবনের স্রোতে উঠছি, পড়ছি।’ (৮ অক্টোবর, ১৯০১) এই চির সতেজ বিবেকানন্দকে তাঁর রচনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে বোঝার চেষ্টা করলে বাঙালি ও ভারতবাসীর উপকারই হবে, অন্তত পক্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে ইচ্ছে করবে না।
বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত দাদাকে কাছ থেকে দেখেছিলেন, বোঝার চেষ্টাও করেছিলেন। তাঁর সেই বোঝাপড়া বিবেকানন্দকে জানার অন্যতম সূত্র। ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যজীবনী’ পুস্তিকায় প্রায় কোনও অলৌকিক গল্পগাছার অবতারণা না করেই মহেন্দ্রনাথ দাদার গড়ে ওঠার ছবি এঁকেছেন। তাঁদের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত ইংরেজি, উর্দু, আরবি, ফার্সি— এই চারটি ভাষাই ভাল করে জানতেন। উর্দু আর ফার্সির প্রতি বিশ্বনাথের বিশেষ পক্ষপাত ছিল। বাইবেল, কোরান, শ্রীমদ্ভাগবত বই তিনটি মন দিয়ে পড়তেন। ওস্তাদ রেখে গান শিখেছিলেন তিনি। ভাল রান্না করতে পারতেন, লোক খাওয়াতে ভালবাসতেন।
পোলাও-মাংস রান্নায় বিশ্বনাথের বিশেষ দখল ছিল। দানধ্যানও করতেন প্রচুর। বলতেন, ‘আমার ছেলেদের জন্য ভাবতে হবে না; তারা নিজেরা করে নেবে। কিন্তু এদের সেরূপ শক্তি নেই এইজন্য এই গরীব লোকদের দেওয়া আবশ্যক।’ মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বিশ্বনাথ দত্তের ধর্মবিষয়ে উদার ভাব থাকায় স্বামীজী ও অপর দুই ভাইয়ের এরূপ উদার ভাব হইয়াছে।’ হক কথা।
বিবেকানন্দ সারাজীবন অনুদার ধর্মবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। খাওয়াদাওয়ার বাছবিচারের সঙ্গে ধর্মের অন্ধ, সঙ্কীর্ণ যোগ তিনি কখনও স্বীকার করেননি। শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর প্রশ্নের উত্তরে জানাতে ভোলেননি যে বিদেশে তিনি সে দেশের মতোই খাওয়া-দাওয়া করতেন। জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লিখেছেন, ওড়িশার মন্দিরগুলিতে, ‘আমি ম্লেচ্ছদের খাবার খেয়েছি বলে আমাকেই ঢুকতে দেবে কি না জানি না’ (৮ নভেম্বর ১৯০১)। এর ঢের আগে ১৮৯৪ সালে মঠের গুরুভাইদের লিখেছিলেন, ‘ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বসব কি আধঘণ্টা বসব— এ বিচারের নাম কর্ম নয়, ওর নাম পাগলা-গারদ।’ এই পাগলা-গারদ থেকে বাইরে আসার উপায় কী? বাবা বিশ্বনাথ দত্তের মতোই বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কী করে তা সম্ভব?
বিবেকানন্দ স্বীকার করেন হিন্দুধর্মের স্ববিরোধিতার কথা। ‘হিন্দুধর্মের ন্যায় আর কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম এরূপ করে না।’ (আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লেখা চিঠি, ২০ অগস্ট, ১৮৯৩) একদিকে মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, অন্য দিকে গরিব আর পতিতদের অত্যাচার করা হবে, এ দ্বিচারিতা চলতে পারে না। বিবেকানন্দ অস্পৃশ্যতার বিরোধী, চতুর পুরোহিতদের বিরোধী। এক বার নয়, একাধিক বার তাঁর চিঠিপত্রে এসেছে পুরোহিততন্ত্রের বিরোধিতা প্রসঙ্গ— ‘চতুর পুরুতরা যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামোগুলোকে বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে...’ (দেওয়ানজিকে লেখা চিঠি, ২২ অগস্ট, ১৮৯২)। ‘প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও।’ (মাদ্রাজের বন্ধুদের লেখা চিঠি, ১০ জুলাই, ১৮৯৩)। এই পুরুততন্ত্র দরিদ্র মানুষদের শেষ করেছে। হরিপদ মিত্রকে ২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৩ তারিখের চিঠিতে আবেগদীপ্ত ভাষায় বিবেকানন্দ লিখলেন, ‘যদি কারুর আমাদের দেশে নীচকুলে জন্ম হয়, তার আর আশাভরসা নাই, সে গেল। ... ঐ যে পশুবৎ হাড়ি-ডোম তোমার বাড়ীর চারিদিকে, তাদের উন্নতির জন্য তোমরা কি করেছ, তাদের মুখে এক গ্রাস অন্ন দেবার জন্য কি করেছ, বলতে পারো?... ঐ যে তোমাদের হাজার হাজার সাধু-ব্রাহ্মণ ফিরছেন, তাঁরা এই অধঃপতিত দরিদ্র পদদলিত গরীবদের জন্য কি করছেন?’ গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দকে লিখলেন, ‘যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশবিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ঐ গরীবদের রক্ত চুষে খায়, আর তাদের উন্নতির কোনও চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক!’ (১৯ মার্চ, ১৮৯৪) কথাগুলি বলেই কিন্তু বিবেকানন্দ থেমে যাননি। তিনি সন্ন্যাসধর্মকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন— ‘এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে যে, সন্ন্যাসিগণ কিসের জন্য এ-জাতীয় ত্যাগব্রত গ্রহণ করিবে এবং কেনই বা এ-প্রকারের কাজ করিতে অগ্রসর হইবে? উত্তরে আমি বলিব— ধর্মের প্রেরণায়। প্রত্যেক নূতন ধর্ম-তরঙ্গেরই একটি নূতন কেন্দ্র প্রয়োজন।’ (২০ জুন, ১৮৯৪) হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লেখা এই চিঠিতে জনগণকে শিক্ষিত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা বলে নির্দেশ করেছিলেন তিনি, আর সে কাজে সন্ন্যাসীদের এগিয়ে আসতে হবে, তাঁর অভিমত এই কার্যসূচিই তাঁর ধর্ম-তরঙ্গের নূতন কেন্দ্র। যদি মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে স্বীকার করতে হয়, তা হলে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সন্ন্যাসীদের কাজ করতে হবে। কাজের মূলত দু’টি ধারা। এক দিকে প্রয়োজন মতো দুর্ভিক্ষে-মহামারিতে সন্ন্যাসীরা দরিদ্র মানুষের সেবা করবেন, অন্য দিকে এই দরিদ্র মানুষদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা চাই। সন্ন্যাসীর তো জাতধর্ম নেই তাই, তাঁদের কাছে কেউ অস্পৃশ্য নন। দরিদ্র মানুষের সেবার জন্য অর্থ প্রয়োজন। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ এ জন্য পাবলিক ফান্ডের ওপর নির্ভরশীল। দেশের মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা পাওয়ার উপায় নেই। ‘তাই আমেরিকায় এসেছি, নিজে রোজগার করব, করে দেশে যাব and devote the rest of my life to the realization of this one aim of my life।’ (রামকৃষ্ণানন্দকে লেখা চিঠি, পূর্বোদ্ধৃত) দুর্ভিক্ষ বা প্লেগের সময় বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইরা জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে গরিব মানুষদের শিক্ষা দিয়ে আত্মনির্ভর না করলে চলবে কেন? অভিন্নহৃদয় রামকৃষ্ণানন্দকে লিখলেন, ‘শশী, তোকে একটা নূতন মতলব দিচ্ছি। যদি কার্যে পরিণত করিতে পারিস তবে জানব তোরা মরদ, আর কাজে আসবি। হরমোহন, ভবনাথ, কালীকৃষ্ণবাবু, তারকদা সকলে মিলে একটা যুক্তি কর। গোটাকতক ক্যামেরা, কতকগুলো ম্যাপ, গ্লোব, কিছু chemicals ইত্যাদি চাই। তার পর একটা মস্ত কুঁড়ে চাই। তারপর কতকগুলো গরীবগুরবো জুটিয়ে আনা চাই। তারপর তাদের Astronomy, Geography প্রভৃতির ছবি দেখাও... কোন্ দেশে কি হয়, কি হচ্ছে, এ দুনিয়াটা কি, তাদের যাতে চোখ খুলে, তাই চেষ্টা কর...’ (১৮৯৪)
বিবেকানন্দের এই মানুষের কাছে পৌঁছতে চাওয়া তো ধর্মের সম্প্রসারণ ভাবনারই ফল। তাঁর জীবদ্দশায় ‘বেদব্যাস’-এর মতো রক্ষণশীল পত্রিকাও প্রকাশিত হত। তাতে বাল্যবিবাহ, গর্ভাধান ইত্যাদি অপসংস্কার সমর্থন করা হত। গোরক্ষাকারী সমিতির রক্ষণশীল হিন্দুরা ভাবতেন, বিবেকানন্দ বুঝি তাঁদের মতোই সব ভুলে গো-মাতার সেবা করবেন। বিবেকানন্দ এর কোনওটাই করেননি। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ‘ভাববার কথা’ নামে তিনি ছোট ছোট কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন। পরশুরাম ছদ্মনামে রাজশেখর বসু যে ভাবে বিরিঞ্চিবাবাদের তুলোধোনা করেন, সে ভাবেই বিবেকানন্দ গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্যকে নিয়ে নকশা করেন। কৃষ্ণব্যালের দেড়কুড়ি ছেলে। বিবেকানন্দ লেখেন, ‘বিশেষ টিকি হ’তে আরম্ভ করে নবদ্বার পর্য্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ ও চৌম্বুকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্বজ্ঞ। আর এ রহস্যজ্ঞান থাকার দরুণ দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা হ’তে কাদা, পুনর্ব্বিবাহ, দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্য্যন্ত সমস্ত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে অদ্বিতীয়।’ ধর্মীয় কুসংস্কারকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যার চালটি সে কাল থেকেই চালু, এ কালে তার রমরমা। বিবেকানন্দ সে কালে যে ভাবে অপবিজ্ঞানীদের একহাত নিয়েছিলেন, এ কালে থাকলেও ছেড়ে কথা কইতেন না। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা ‘স্বামী শিষ্য সম্বাদ’ থেকে জানা যাচ্ছে গোমাতার সেবকেরা বিবেকানন্দের বাণে বিদ্ধ। বিবেকানন্দ তাঁদের প্রশ্ন করেছিলেন গোমাতার সেবকেরা মানুষের জন্য কী করছেন। নিরুত্তর গোসেবকদের প্রতি তাঁর টিপ্পনী, ‘এমন মাতা না হলে এমন সন্তান হয়?’
এই যে ধর্মের ছাঁচ ভাঙা সজীব বিবেকানন্দ, তিনি কিন্তু গভীর ভাবে স্বদেশব্রতী। তাই বিদেশে গিয়ে ইংরেজি ভাষার বক্তৃতায় দেশের খারাপ দিকগুলির কথা বলেন না। তিনি চান না হিন্দুরা ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করুন। বস্তুতপক্ষে তিনি যে কোনও মানুষেরই ধর্মনাশের বিপক্ষে। মুসলমান বা খ্রিস্টানদের হিন্দুভাবাপন্ন হতে হবে এমন কথাও তিনি বলেন না। বলবেনই বা কেন? রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য তিনি। রামকৃষ্ণদেব তো ইসলাম ও খ্রিস্টান এই দুই পন্থাতেও সাধনা করেছিলেন। তা ছাড়া পারিবারিক ভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহজ অনুরাগ ছিল তাঁর। সহোদর মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে বাবা বিশ্বনাথ দত্তের অর্শ হয়েছিল। ‘বাড়ীতে একজন হাকিম নিত্য দেখিয়া যাইতেন। এই হাকিমসাহেব বেশ বিচক্ষণ ছিলেন।’ মুসলমানরা অনেকেই বিশ্বনাথের মক্কেল। লালাবাগান আর কারবালার পুকুর মুসলমান মক্কেলের কাছ থেকে বিশ্বনাথ দত্ত উকিলের খরচ হিসেবে পেয়েছিলেন। পরে ওই মুসলমান বংশ গরিব হয়ে গেলে তাঁদের কথামতো ভুবনেশ্বরী সে জমি ফিরিয়ে দিলেন। বিবেকানন্দ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ রচনায় আকবরের বিচক্ষণতার বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। গুরুভাইদের প্রায়ই বলতেন, আরবি-ফার্সি জানা মুসলমানদের সহায়তায় ভারত-ইতিহাসের অজানা দিকগুলি বাংলায় অনুবাদ করতে।
তা হলে, এই বিবেকানন্দকে কেন হিন্দুত্বপন্থীরা দলে টানার চেষ্টা করছেন? কারণ, দলে টানলে লাভ হবে যে! বিবেকানন্দকে এ দেশে অসংখ্য মানুষ এখনও অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেন। বিবেকানন্দের নাম ব্যবহার করলে তাঁদের সহজে দলে পাওয়া যেতে পারে। তাই বিবেকানন্দের দু’টি প্রবণতাকে কাজে লাগাতে চান হিন্দুত্বপন্থীরা। ওই যে বিবেকানন্দ বিদেশে গিয়ে তাঁর স্বদেশি হিন্দুধর্মের খারাপ দিকগুলির কথা বলেন না বরং হিন্দু ধর্মের নির্বিশেষ দার্শনিক আদর্শের কথা বলে বিশেষ ত্রুটিগুলি ঢাকার চেষ্টা করেন, এই দিকটি হিন্দুত্ববাদীদের খুব পছন্দ। বিবেকানন্দ তখন আমেরিকায়। ব্রুকলিনে হিন্দু নারীদের অবস্থা নিয়ে বক্তৃতা দেবেন। তিনি তৎসাম্প্রতিক হীন অবস্থার কথা না বলে ভারতীয় সাহিত্যে ও প্রথায় কোথায় নারীকে বড় করে দেখানো হয়েছে, সে-কথা বললেন। তর্ক উঠল নানা রকম। বিবেকানন্দ বিদেশে দেশের খারাপ দিকের কথা কিছুতেই বলবেন না। হিন্দুত্ববাদীরা ভাবছেন, এ কায়দায় যদি হিন্দুধর্মের খারাপ দিক ঢাকা যায়। আর একটা দিকও একেলে হিন্দুপন্থীদের কাজে লাগছে। বিবেকানন্দ দেশজদের কাছে হিন্দুধর্মের নানা সমালোচনা করেন, কিন্তু সে ধর্মটাকে কিছুতেই খারিজ করতে চান না। হিন্দুত্ববাদীরাও ভাবছেন, তাঁরাও ধর্ম খারিজ করবেন না। কিন্তু কোথায় তাঁরা আর কোথায় বিবেকানন্দ! বিদেশের মাটিতে খারাপ কথা না বললেও, সোজাসাপটা ভাষায় বিবেকানন্দের মতো হিন্দুধর্মের ব্যভিচারকে ক’জন আক্রমণ করেছেন? আর ধর্ম খারিজ না করলেও তিনি ‘অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের’ মানুষ হতে চান। দেশের নানাত্বকে তিনি মুছে দিতে চাননি। মাত্র ঊনচল্লিশ বছরে ১৯০২ সালে চলে গেলেন বলে বিশ শতকের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্মের ব্যভিচার দেখার অবকাশ পেলেন না, দেখলে হয়তো নিজের উনিশ শতকীয় পিছুটানের বদল ঘটাতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের মতো দীর্ঘজীবী হলে হয়তো অভিজ্ঞতার সূত্রে নিজের চিন্তা ঝালাই করে নিতেন। এই মানুষটিকে তাই সম্পূর্ণ না-পড়ে বাদ দিলে কিংবা আংশিক পড়ে গোঁড়া বলে নিজেদের দলে ঢোকাতে চাইলে অন্যায় হবে। অন্যায় সহ্য করাও তো অন্যায়ই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy