Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
Devi Kannaki

অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ দেবী কন্নকি

তামিল মহাকাব্য ‘শিলাপ্‌পদিকারম’-এর পতিব্রতা নায়িকা। সেখান থেকে বর্ষার দেবী মারি আম্মান। কিংবা তামিল শৈবদের কাছে ভগবতী। তাঁর মূর্তির অপসারণে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তামিলনাড়ু। অপশাসনের চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে প্রশ্ন করার শিক্ষা যে তাঁরই দেওয়া। তামিল মহাকাব্য ‘শিলাপ্‌পদিকারম’-এর পতিব্রতা নায়িকা। সেখান থেকে বর্ষার দেবী মারি আম্মান। কিংবা তামিল শৈবদের কাছে ভগবতী। তাঁর মূর্তির অপসারণে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তামিলনাড়ু। অপশাসনের চোখে চোখ রেখে নির্ভয়ে প্রশ্ন করার শিক্ষা যে তাঁরই দেওয়া।

দেবী কন্নকির বিখ্যাত সেই মূর্তি।

দেবী কন্নকির বিখ্যাত সেই মূর্তি।

শৌভিক মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

অন্ধ্রপ্রদেশের দিক থেকে আসা একটি ট্রাক হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ল ট্রাফিক সিগনাল লাগোয়া মূর্তির পাদদেশে। এমন দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। পর দিন শহরের পুলিশ কমিশনার উপরমহলে চিঠি লিখে জানালেন, ব্যস্ত রাস্তায় এমন মূর্তি বিপজ্জনক। মূর্তিটি এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও বসাবার ব্যবস্থা করা হোক। মুহূর্তের মধ্যেই মূর্তিটা যেন উধাও। পিচ-অ্যাসফল্টের রিফু-কাজে মুছে গেল বাকি চিহ্নটুকুও।

ব্যস্ত শহর চেন্নাই। মেরিনা বিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মূর্তির সংখ্যা কম নয়। প্রাথমিক ভাবে এই অনুপস্থিতি কারও নজরে না এলেও পরবর্তী গণ-অসন্তোষের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী পনিরসেলভাম। বিরোধী দলের নিরন্তর প্রশ্ন, মাদ্রাজ হাইকোর্টে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলা, ক্রমবর্ধমান জনবিক্ষোভের চাপে সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানানো হল, মূর্তিটি প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মিউজ়িয়ামে রাখা আছে। অবিলম্বেই আবার স্থাপিত হবে। সম্ভাব্য স্থান নির্বাচনের জন্যে পাঁচ সদস্যের কমিটিও তৈরি হল। কিন্তু মূর্তি ফিরে এল না।

পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের দখলে এল তামিলনাড়ুর মসনদ। মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নেওয়ার দিনকয়েকের মধ্যে চেন্নাইয়ের এগমোরে সরকারি মিউজ়িয়ামের দিকে পা বাড়ালেন এম করুণানিধি। দরজা দিয়ে সোজা ঢুকে পৌঁছলেন সেই ঘরে, ধুলোয় ঢাকা মূর্তিটি অবহেলায় এত দিন যেখানে পড়ে আছে। নির্বাচনে জেতার পর জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখলেন ডিএমকে প্রধান। মূর্তিটি আবার স্থাপিত হল। আগের জায়গাতেই। ৩ জুন, ২০০৬। পাঁচ বছর বাদে চেন্নাইবাসী আবার দেখতে পেল তাদের প্রিয় কন্নকি-কে।

স্মৃতিসরণি: পুম্পুহারের কন্নকি মিউজ়িয়াম।

কে এই কন্নকি? প্রাচীন পুহার নগরীর এক কুলবধূ, যাঁর ক্রোধে ধ্বংস হয়েছিল সমৃদ্ধ মদুরাই (বর্তমানে মাদুরাই) নগরী? না কি ইন্দ্রের রথে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা এক সাধ্বী নারী? দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্যে, শ্রীলঙ্কায় তামিল শৈবদের পূজিতা দেবী কন্নকি? না বোধিসত্ত্বের হাত ধরে সিংহলের মাটিতে পা রাখা দেবী পট্টিনি, কোন পরিচয়ে চিনব তাঁকে? তামিল সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ‘শিলাপ্‌পদিকারম’-এর নায়িকা, পতিব্রতা ঘরনি? না রাজার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করার সাহস রাখা অগ্নিকন্যা, যার কাহিনি পড়ে সাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে পৌঁছন তরুণ গবেষক? যিনি মহাকাব্যের কন্নকির খোঁজে বাকি জীবনটা এ দেশের মাটিতেই কাটাবার সিদ্ধান্ত নেন।

বলা হয়, তামিল সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনটি নিদর্শন হল, তিরুবল্লুবর-এর লেখা ‘তিরুক্কুরুল’, সন্ত ইলঙ্গো অডিগলের রচনা ‘শিলাপ্‌পদিকারম’ আর কম্বনের রামায়ণ। প্রাথমিক ভাবে শিলাপ্‌পদিকারম-এর কাহিনিকাল ধরা হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক, কিন্তু পরবর্তী তামিল সাহিত্য-গবেষকদের মতে গ্রন্থটির রচনাকাল চতুর্থ শতক। কাহিনির প্রথম পর্বে নায়ক-নায়িকার বেড়ে ওঠা যে পুহার নগরীর বুকে, কাহিনি রচনাকালে সে নগরী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুহার কাণ্ডে ‘আশীর্বাদ দান’ পর্বে লেখক স্বয়ং তা জানিয়েছিলেন। তা থেকেই গবেষকদের অনুমান, হয়তো মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনিই লিপিবদ্ধ করেছিলেন সন্ত ইলঙ্গো অডিগল।

পুহার নগরীর বণিক মাসাত্তুবানের পুত্র, ষোড়শ বর্ষীয় কোবলনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দানশীল মানাকয়নের কন্যা দ্বাদশ বর্ষীয়া কন্নকির। সুখে-দুঃখে দুজনের সংসারজীবন ভালই কেটে যাচ্ছিল। এমন সময় এক দিন কোবলনের নজরে পড়ল, পণ্যবীথিকার সামনে এক কুব্জা দাসী একটি মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নগরের শ্রেষ্ঠ নর্তকী মাধবীর নৃত্যে খুশি হয়ে রাজাধিরাজ চোলন নিজের গলার মালা তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। সেই মালা দাসীর হাতে পণ্যবীথিকায় পাঠিয়েছিল মাধবী। এক হাজার আটটি স্বর্ণমুদ্রায় যে ব্যক্তি এর মূল্য দিতে পারবে, সে-ই হবে তার হৃদয়ের অধীশ্বর। নিজের সব সম্বল দিয়ে বণিকপুত্র কোবলন মালাটি ক্রয় করল। ভুলে গেল কন্নকির কথা। আনন্দ-রভসে স্বপ্নের মতো দিনের পরে দিন পেরোল মাধবী আর কোবলন। অন্য দিকে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের আশায় বিরহযন্ত্রণায় নিঃসঙ্গ কন্নকির দিন কাটতে থাকল। কপর্দকশূন্য, অপরাধবোধে ন্যুব্জ, অসহায় কোবলন মাধবীর মায়া কাটিয়ে এক দিন ঘরে ফিরে এল। পুহার নগরীতে তার আর পাওয়ার কিছু নেই। হারানো আত্মসম্মান ফিরে পেতে সে রওনা দিল মাদুরাইয়ের উদ্দেশ্যে। সমস্ত ক্ষোভ, অভিমান দূরে সরিয়ে স্বামীর সঙ্গে যাত্রা করল কন্নকিও। ব্যবসার মূলধন সংগ্রহের জন্যে স্বামীর হাতে তুলে দিল বহুমূল্য রত্ন-পরিপূর্ণ শিলম্বূ বা নূপুর। মাদুরাইয়ের বাজারে স্ত্রীর নূপুরজোড়ার একটি বিক্রয় করতে গিয়ে ধূর্ত স্বর্ণকারের চক্রান্তে প্রাণ হারাল কোবলন। বেদনায় মুহ্যমান কন্নকি রাজদরবারে পৌঁছে, রাজার কাছে কোবলনের অপরাধ জানতে চাইলে, বিস্তর বাদানুবাদের পর প্রমাণ হল তাঁর স্বামী নির্দোষ। নিরপরাধের প্রতি অবিচার করায় তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন পাণ্ড্যরাজ। স্বামিহারা ক্ষিপ্ত নারীর ক্রোধ ধ্বংস করে দিল মাদুরাই নগরী। অবশেষে মাদুরাইয়ের রক্ষাকর্ত্রী দেবী, মতান্তরে দেবী মীনাক্ষী কোবলনের পূর্বজন্মকৃত পাপের কথা বলে তাকে শান্ত করলেন। শ্রান্ত কন্নকি মাদুরাই ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল বঞ্জির পথে। এক নাগাড়ে চোদ্দো দিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সুব্রহ্মণ্য দেবের বাসস্থান ‘নেডুবেল্ কুন্ড্রম্‌’ নামক পর্বতের উপর পৌঁছলে দিব্যরথে এসে কোবলন তাঁকে নিয়ে গেল স্বর্গের উদ্দেশে। পর্বতের বাসিন্দা আদিবাসী সর্দারদের থেকে দেবী কন্নকির কথা জানতে পেরে চেররাজ শেঙ্গুট্টুবন সুদূর হিমালয় থেকে দেবীমূর্তি নির্মাণের জন্যে পাথর নিয়ে এসে মূর্তি গড়ে পর্বতের উপর তাঁর মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।

কেরালার থেনি জেলার ভান্নাথিপারাইয়ে ‘মঙ্গলাদেবী কন্নগী কোট্টাম’ মন্দিরে চিত্তিরাই (এপ্রিল-মে) মাসের পূর্ণিমায় বাৎসরিক পুজো উপলক্ষে বহু পুণ্যার্থী সমাগম ঘটে। ১৮১৭ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভে রিপোর্ট এবং ১৮৮৩ সালের সেন্ট জর্জ গেজেটে এই অঞ্চল তামিলনাড়ুর অন্তর্গত হলেও বর্তমানে তা কেরল রাজ্যের সীমানাধীন। এই মন্দিরটিই চেররাজ নির্মিত আদি মন্দির বলে মনে করা হয়।

তামিলনাড়ুতে বৃষ্টির দেবী ‘মারি আম্মান’ হিসেবে কন্নকিকে কল্পনা করা হয়, কারণ আষাঢ় মাসের এক শুক্রবারে তাঁর কোপে মাদুরাই নগরী ধ্বংস হয়। শিলাপ্‌পদিকারমের প্রস্তাবনা অংশেও তাঁকে বৃষ্টির দেবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেরলে কন্নকি, দেবী ভগবতীর সঙ্গে আত্মীকৃত। শ্রীলঙ্কার তামিল শৈবদের কাছে দেবী, শক্তির অবতার রূপে কল্পিত। সিংহলের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে কন্নকি দেবী, পট্টিনি নামে পরিচিত। দেবী পট্টিনিই একমাত্র সংমিশ্রণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। অবশ্য শিলাপ্‌পদিকারমের কাহিনির সঙ্গে দেবী পট্টিনির কাহিনি মেলে না। সিংহলি বৌদ্ধদের মতে, দেবী পট্টিনির জন্ম হয়েছিল পাণ্ড্যরাজের রাজবাগিচার আমগাছে একটি আমরূপে। দুষ্ট পাণ্ড্যরাজ তাঁকে নৌকো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলে তিনি চোল রাজ্যে এসে পৌঁছন এবং পরে পাণ্ড্যরাজ্যের বিনাশ করে প্রতিশোধ চরিতার্থ করেন। পরে পরম করুণাময় বুদ্ধদেব তাঁকে শ্রীলঙ্কার অন্যতম রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

সাধারণ মানুষ থেকে দেবী হয়ে ওঠার এই পারম্পর্যই কি তামিল ভাবাবেগের সঙ্গে কন্নকিকে একাত্ম করে তুলেছিল? ‘ভারতসাহিত্যকথা’-র মতো কিছু জায়গায় ‘কান্নাগী’ বা মহাকাব্যে ‘কন্নগী’ থাকলেও, দেবী হিসেবে তিনি ‘কন্নকি আম্মান’। কন্নকির মূর্তি অপসারণের পর তামিলনাড়ু জুড়ে গণবিক্ষোভের পিছনে কি দৈবী মাহাত্ম্যই কার্যকর হয়ে উঠেছিল? সম্ভবত নয়। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই দ্রাবিড় আন্দোলনের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে তামিল সাহিত্যের যে দুটি নিদর্শন ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল, তার একটি যদি হয় তিরুক্কুরল, অন্যটি অবশ্যই শিলাপ্‌পদিকারম। প্রতিবাদের মুখ হিসেবে উঠে এসেছিলেন কন্নকি। যিনি অপশাসনের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখেন।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ ভারতে কায়েম হতে চলা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছিলেন অব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষজন। শুরু হল দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। ক্রমশ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল তামিলনাড়ু। দ্রাবিড় সভ্যতার গৌরবময় অতীত এবং অখণ্ড তামিল ঐক্যের নিদর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল শিলাপ্‌পদিকারম। চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী পুহার নগরী, পাণ্ড্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদুরাই নগরী আর চের সাম্রাজ্যের রাজধানী বঞ্জি নগরীকে কেন্দ্র করে কন্নকির জীবন আবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন দাক্ষিণাত্যের সুসমৃদ্ধ অতীত মহাকাব্যের বর্ণনা-অনুষঙ্গে ধরা দিয়েছে। ‘কন্যাকুমারিকা থেকে হিমাচল পর্যন্ত ব্যাপ্ত বিশাল দেশের রাজা চেরলাদন ও উজ্জ্বল ভাস্করের বংশজা চোলরাজপুত্রীর সন্তান, রাজা শেঙ্গুট্টুবন’-এর মধ্যে অগণিত অব্রাহ্মণ দক্ষিণী ভূমিপুত্র খুঁজে পেল তাদের জাতীয় বীরের প্রতিচ্ছবি। দ্রাবিড় মানসে শিলাপ্‌পদিকারমের প্রভাব সম্পর্কে বার্কলে-র ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তামিল ভাষার অধ্যাপক জর্জ এল হার্ট বলেছিলেন, গ্রিসে যেমন ইলিয়াড-ওডিসি, তামিলদের কাছে শিলাপ্‌পদিকারম তার চেয়ে কিছু কম নয়।

যদিও শ্রদ্ধেয় ভি আর রামচন্দ্র দীক্ষিতের মতো অনেকেরই অভিমত, রাজনৈতিক প্রয়োজনে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই মহাকাব্য থেকে কিছু বাছাই অংশ সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। তবুও ক্রমান্বয়ী জনপ্রিয়তায় ১৯৬২-তে প্রথম শিলাপ্‌পদিকারমকে অবলম্বন করে লেখা হল, ‘কন্নকিপ পুরাচিক্কাপ্পিয়াম’। ১৯৬৪ সালে সুপারহিট ‘পুম্পুহার’ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখলেন এক তরুণ লেখক, একই বিষয় অবলম্বনে কিছু পরে ১৯৬৭-তে তিনি লিখেছিলেন ‘শিলাপ্‌পদিকারমঃ নাটকক্‌ কাপ্পিয়াম’। সি এন আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যুর পর আজীবন ডিএমকে-র পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল যাঁর কাঁধে, তিনি এম করুণানিধি। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করার পর আন্নাদুরাই সরকারের তত্ত্বাবধানে, ১৯৬৮-র বিশ্ব তামিল সম্মেলন উপলক্ষে, মেরিনা বিচে উদ্বোধন হওয়া ন’টি মূর্তির মধ্যে দ্বিতীয় মূর্তিটি ছিল কন্নকির। ১৯৭১ সালে সন্ত ইলঙ্গো অডিগলের মূর্তিও স্থাপিত হয়।

১৮৯২ সালে বিখ্যাত তামিল পণ্ডিত ইউ ভি স্বামীনাথ আইয়ার কর্তৃক শিলাপ্‌পদিকারমের পুঁথি থেকে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশের পর দেশে-দেশান্তরে বহু ভাষায় অজস্র বার অনূদিত হয়েছে কন্নকি-গাথা। তামিল সাহিত্যের অভিজ্ঞ লেখক জগমোহন, কন্নকির কাব্য-গাথাকে গদ্যে রূপ দিয়েছেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস ‘কোট্রাভাই’। কবি ও নাট্যকার এইচ এস শিবপ্রকাশ মাদুরাই খণ্ড অবলম্বনে লিখেছেন ‘মাদুরেইকান্ড’। হিন্দিতে অমৃতলাল নাগর লিখেছিলেন ‘সুহাগ কে নূপুর’। শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় দূরদর্শনে সম্প্রচারিত ‘ভারত এক খোঁজ’-এ দুই পর্ব জুড়ে সম্প্রচারিত হয়েছিল অডিগলের মহাকাব্য। শিলাপ্‌পদিকারম অবলম্বনে পরে আরও সিনেমা, টিভি সিরিয়াল তৈরি হয়েছে।

মহাকাব্যের ধ্রুপদী আবহাওয়ায় এক ঝলক দমকা বাতাসের মতো বয়ে চলা সাধারণ মেয়ের গল্পই সবার মন কেড়েছে। ‘অমর চিত্র কথা’-র ১৯৭৫-এ প্রকাশিত ৯৩তম সংখ্যার নাম তাই ‘কন্নকি’। দু’বছর আগে প্রকাশিত উৎকর্ষ পটেলের উপন্যাসের নামও ‘কন্নকি’স অ্যাঙ্কলেট’।

সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ভারতে আসা গবেষক এরিক মিলার এক সময় কন্নকির অতীত যাত্রাপথ বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবার জন্যে পুম্পুহার থেকে মাদুরাই পর্যন্ত ৪০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পেরিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ‘ওয়র্ল্ড স্টোরিটেলিং ইনস্টিটিউট’ তৈরি করে এই প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের গল্প শুনিয়ে বেড়ান। কন্নকি-কাহিনি গভীর প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মনে।

এড়িয়ে যেতে পারেননি থালাইভিও। একের পর এক মামলা-মকদ্দমায় জেরবার এডিএমকে-প্রধান ভাগ্য ফেরাতে জ্যোতিষীর দ্বারস্থ হলে, আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভের জন্যে তিনি যে-সব দাওয়াই বাতলেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল কন্নকি মূর্তি অপসারণ। এক হাতে নূপুর, অন্য হাত চেন্নাই শহরের দিকে নির্দেশ করা— কন্নকির মূর্তিটি জয়ললিতাও পছন্দ করতেন না। তাই যখন ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও আদালতে চলতে থাকা অমীমাংসিত মামলার কারণে পনিরসেলভামের হাতে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্বভার ছেড়ে দিতে হল, সেই সময়েই হঠাৎ উধাও হয়ে যায় কন্নকির মূর্তি।

ট্রাক দুর্ঘটনা কি সত্যিই ঘটেছিল? ২০০১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারি অবধি এই সন্দেহে সারা তামিলনাড়ু উত্তাল হয়ে ওঠে। পরে উত্তেজনা থিতিয়ে গেলেও, মানুষ যে সে

কথা ভোলেনি, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে। মাত্র ৬১টি আসনে জয়লাভ করেছিল এডিএমকে। বিনা অপরাধে পাওয়া নির্বাসনের প্রতিশোধ কি এ ভাবেই নিয়েছিলেন কন্নকি?

সে কথা জানার কোনও উপায় নেই। কিন্তু দাক্ষিণাত্যের মানুষ এই প্রতিস্পর্ধী নায়িকাকে আজও মনে রেখেছে।

হয়তো তিনিও ভোলেননি কিছুই।

(ছবি সৌজন্য : উইকিমিডিয়া কমন্‌স)

অন্য বিষয়গুলি:

History Devi Kannaki
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy