Advertisement
১৭ জানুয়ারি ২০২৫
সরল আফগানদের আন্তরিক হাসির মোড়কে লুকিয়ে আছেন এক জন রক্তাক্ত দুঃখী মানুষ। তবু আতিথেয়তায় খামতি নেই। ছোট্ট মেয়ে রোজ তিন ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছয় ভোরের স্কুলে।
Afghanistan

Afghanistan crisis: পাথরে ফুল ফোটার আফগানি কিস্সা

বারো বছরের কিশোরের চোখে ধরা পড়ে ৫০ বছরের ধ্বস্ত জীবনের ক্লান্তি। কাবুল বামিয়ান জলালাবাদে ঘুরে গল্প বললেন বাঙালি যুবা আজহারুল হক।

জলালাবাদের ইটভাটায় কর্মরত শিশুশ্রমিক।

জলালাবাদের ইটভাটায় কর্মরত শিশুশ্রমিক। ছবি সৌজন্য: আজহারুল হক।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৪৯
Share: Save:

মুশকিল নিস্ত!’— কুতকুতে চোখ, ছোট্টখাট্টো চেহারার লোকটাকে ভাল করে দেখার আগেই তাঁর মুখ থেকে ছিটকে আসা শব্দটা কানে গেঁথে গেল। আমার ফার্সির দৌড় খুবই করুণ। ফলে মানে বুঝিনি। তবে মুশকিল শব্দটা না বোঝার কারণ নেই। আফগান মুলুকে আসব ঠিক হওয়া ইস্তক, এই শব্দটা তো কম বার শুনিনি। দেশে বন্ধুদের খোঁচা, ‘আর যাওয়ার জায়গা পেলি না! মরার শখ হয়েছে বুঝি!’ কাবুলে নামার পরের অভিজ্ঞতাটাও ঠিক মসৃণ বলা যাবে না।

কাবুল থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিমান পরিষেবা উদ্যোগ ইউএনহ্যাসের চিলতে ৩২ সিটের উড়োজাহাজ নামিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত বা কুখ্যাত বামিয়ানে। ওইটুকু রাস্তা নাকি কাবুল থেকে মোটে ঘণ্টা তিনেকের পথ। কিন্তু সড়কপথে যেতে হয় বিস্তর ঝুঁকি নিয়ে। তাও আবার ঘুরিয়ে নাক ধরার মতো, ঘুরপথে বেঁকেচুরে! এমনিতে স্বাভাবিক রুট হল, কাবুল থেকে ভায়া ময়দান ওয়ারদাক। সেখানে তখনও (দু’বছর আগে) ভয়ানক যুদ্ধ, অশান্তি! তাই সিধে রাস্তায় যাওয়ার জো নেই। শুনলাম কাবুল থেকে বামিয়ান আকাশপথেই যেতে হবে! আফগানিস্তানে তখন আমি এসেছি সবে দিন তিনেক। এবং তখনই বুঝতে শুরু করলাম, এখানে কোথাওই ঠিক সোজা আঙুলে ঘি ওঠার নয়! সেই দেশেই মহম্মদ তাহিরের মতো সহজ, সরল ভালমানুষ এক বন্ধুর দেখা পেলাম। বামিয়ানে নামার পরে আমায় নিতে এসেছিল যে টয়োটা করোলা গাড়িটা, তাহির তার সারথি। তাঁর মুখে শোনা কয়েকটা শব্দই আমার আফগান মুলুকে ফার্সি শিক্ষার প্রথম পাঠ হয়ে থাকল।

‘মুশকিল নিস্ত’! মানে ‘নো প্রবলেম’। তাহিরভাই যা শোনে, সবেতেই এক রা! হালকা ঘাড় নেড়ে ঝটপট বলে ‘মুশকিল নিস্ত’! সবার আগে ওই শব্দটাই আমার মুখস্থ হয়ে গেল। এর ঠিক ২৫ মাস পর, গত ২২ অগস্ট রাষ্ট্রপুঞ্জের বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বসে যখন তালিবানদের পাহারায় দুরুদুরু বুকে কাবুল বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছি, তখনও শুনি স্থানীয় দু’-এক জন হিতৈষী অভয় দিচ্ছেন, মুশকিল নিস্ত! টেনশনেও হাসি পাচ্ছিল আমার। তত দিনে ওই ফার্সি শব্দবন্ধটিই আমার আফগানিস্তান-যাপনের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে।

কাবুলে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘরছাড়া শিবিরের ক্লাসে কচিকাঁচাদের সঙ্গে আজহারুল হক।

কাবুলে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘরছাড়া শিবিরের ক্লাসে কচিকাঁচাদের সঙ্গে আজহারুল হক। ছবি সৌজন্য: আজহারুল হক।

হাজ়ারা মুলুকে

দু’বছর আগে বামিয়ানে যখন প্রথম নেমেছি, তখনও খালেদ হোসেইনির ‘দ্য কাইটরানার’ পড়া হয়নি আমার। ছোট্টখাট্টো তাহির আমার মতো সাড়ে পাঁচফুটি বঙ্গসন্তানের থেকেও ক্ষীণ বপু। তখনও আফগানিস্তানের হাজ়ারাদের কথা ভাল জানি না। আফগানিস্তানে হাজ়ারা জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাকিদের সম্পর্ক, শোষণের ইতিহাসও সে ভাবে শুনিনি। দীর্ঘদেহী আফগানদের প্রায় আধাসাইজ় চিনে পুতুলের মতো লোকগুলো! সেই সরল, সাদাসিধে গ্রাম্য জনতার সঙ্গেই আমার প্রথম ভাব জমল আফগান মুলুকে। বামিয়ানে তো হাজ়ারাদেরই ছড়াছড়ি। আমি ইন্ডিয়ান না পাকিস্তানি, প্রথমটা ওরা একটু বাজিয়ে নিতে চাইল! ভারতীয় শুনলেই স্থানীয় রুটির দোকান পয়সা নেবে না! সেলুনে তো ভর্তি শাহরুখ খানের ছবি। চুল কাটার পরেও টাকার কথায় খালি ‘খৈরাস্ত খৈরাস্ত’ (ইটস ওকে) করে। ভারতীয়দের প্রতি এই সহৃদয়তা আমি আফগানিস্তানে সর্বত্রই পেয়েছি।

শিশু ও নারীশিক্ষার কাজে নিবেদিত রোমের জেসুইট রিফিউজি সার্ভিস সংস্থার চাকরি নিয়ে আমি এসেছি আফগানিস্তান। পা রেখেই হুঁশিয়ারি, কাবুলে অফিস ক্যাম্পাসের বাইরে পারতপক্ষে বেরোবেন না! আমার প্রথম কাজের জায়গা বামিয়ানে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে কাবুল থেকে কেটে পড়ার নির্দেশ। তবে সড়কপথে ভ্রমণের সুযোগ নেই। তিন দিনের মধ্যে তাই রাষ্ট্রপুঞ্জের বিমানে চেপে বসতে হল।

তাহিররা ঠিক কাবুলি ফার্সি বলেন না। ফার্সির আফগান রকমফের দারিরই একটি উপভাষা হাজ়ারাগিতে কথা বলতেন। আমি অবশ্য অতশত বুঝি না। ফার্সি রপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টায় তাহিরই আমার অনুশীলনের সঙ্গী। মাটির মানুষ ছেলেটা! শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ওর বাড়ি থেকে প্রায়ই এটাসেটা রান্না করে আনে। বামিয়ানে আমার সহকর্মীরা বেশির ভাগই জেসুইট সন্ন্যাসী। সাধারণত বমিয়া (ঢেঁড়শ), রাজমা বা গুলপি (ফুলকপি)-র একটা নিরামিষ রান্নাতেই তাঁদের চলে যায়। তাহির ক’পয়সাই বা রোজগার করে। কিন্তু বাড়ি থেকে সপ্তাহান্তে প্রায়ই আমার জন্য মাংস নিয়ে আসবে। ঝাল, মশলাদার রান্না, যেমনটা আমাদের ভারতীয়দের মুখে রোচে।

ক্রমশ বুঝেছি, এই তাহির কী অদম্য প্রাণশক্তির প্রতীক! কিংবা চিরন্তন আফগান সহনশীলতার স্বাক্ষর। আমাদের স্কুলের পাশেই ইউনেস্কোর ঐতিহ্য অঙ্গনে বামিয়ানের প্রকাণ্ড বুদ্ধমূর্তির ধ্বংসাবশেষ। ‘সালসাল’ এবং ‘শামামা’, দু’টি বুদ্ধমূর্তির কত নাম শুনেছি। মোল্লা ওমরদের তালিবানি তাণ্ডবের স্মারকটুকু চলতে ফিরতে চোখে পড়ে। এক দিন তাহির আমায় বলল, “সাহেব জানেন, এই মূর্তিগুলোর নীচে কারা ডিনামাইট জড়ো করেছিল?” একটু থেমে নিজেই জবাব দেয়, “তালিবানরা আমাদের বন্দুক দেখিয়েই ওই বুদ্ধমূর্তিগুলোর নীচে যাবতীয় বিস্ফোরক মজুত করিয়েছিল। তখন আমায় গুহায় বন্দি করে রেখেছে! চার ধারে উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের নল। আরডিএক্স নিয়ে মূর্তির কাছে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, এই বুঝি আমাকেও উড়িয়ে দেবে।” তাহির রেহাই পেয়েছিল, বলাই বাহুল্য! তবে বিস্ফোরক ডাঁই করার পরে তালিবরা তাতে গুলি ছুড়তেই মূর্তিগুলো ওর চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যায়!

বামিয়ানে তালিবানি অত্যাচারের যে গল্প আমি শুনেছি, তার সঙ্গে নকশাল আমলের পুলিশি ‘এনকাউন্টার’-এর কিছু মিল আছে। বন্দিদের এক-একটা ঝাঁককে গুহা থেকে বার করে এনে ওরা আকছার ‘যা তোদের ছেড়ে দিচ্ছি’ বলে মুক্তি ঘোষণা করে দিত। তার পরই পাহাড়ি উপত্যকায় লোকগুলো ছুটতে শুরু করলেই গর্জে উঠত বন্দুক! তাহিরভাই বেঁটেখাটো হলেও সাহস কম ছিল না! শুনেছি, ও নাকি এক বার তালিবানদের খপ্পরে পড়ে এক জনকে টেনে চড় কষিয়ে দেয়। লোকটা ওর বাবাকে ধাক্কা দিয়েছিল। তাতে রেগে গিয়েছিল তাহির। পরে তালিবরা দলবল নিয়ে ওর বাড়িতে চড়াও হলে সে মেয়েদের পোশাকে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। তবে শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত হাজ়ারাদের প্রতি তালিবদের বিদ্বেষের পিছনে অজ্ঞতাই আসল কারণ বলে আমার মনে হয়েছে। তারিকের থেকেই শোনা, তালিবানরা প্রথম বামিয়ানে ঢুকে হাজ়ারাদের ঘরবাড়ি দেখে অবাকই হয়েছিল। এর আগে কোনও দিন ওঁদের সংস্পর্শে আসেনি। হাজ়ারারা যে মনুষ্য পদবাচ্য, সেটাই ওরা প্রথমে মানতে পারছিল না!

কাবুলের চরাহি কাম্বার শিবিরের বাচ্চারা।

কাবুলের চরাহি কাম্বার শিবিরের বাচ্চারা। ছবি সৌজন্য: আজহারুল হক।

তালিবান বনাম নারী

কলকাতার খবরের কাগজের প্রথম পাতায় তালিবানদের বন্দুকের সামনে অকুতোভয় কাবুলি নারীটিকে দেখে আমার সহকর্মী সামিয়ার কথা মনে পড়ছিল। জেসুইট সংস্থাটি ছেড়ে আমি তখন কাবুলে ‘আশিয়ানা’ বলে একটি এনজিও-তে যোগ দিয়েছি। কাজ মোটামুটি এক। শিশু বা নারীশিক্ষার প্রকল্পে কান্ট্রি প্রোগ্রাম ম্যানেজার। কাবুল, জলালাবাদে ঘুরে শিশুশ্রমিক বা পথশিশুদের হালহকিকত জরিপও করতে হত। সামিয়া আমাদের অফিসে ছোটদের স্পোর্টস ট্রেনিং দিত।

আফগানিস্তানে অনাত্মীয় মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা খুব সহজ নয়। আমার মতো বিদেশির জন্য তো আরও দুর্লভ। কে কী মনে করে ভেবে আমি এ বিষয়টায় একটু সাবধানই থাকতাম। তবে সামিয়ার সঙ্গে সহজেই ভাব হয়ে গিয়েছিল! বয়সে আমার থেকে কয়েক বছরের ছোট ও। বছর পঁচিশ ওর বয়স। থাকত কাবুলের কিছুটা বাইরে। নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েটা নিজেও একদা আশিয়ানার ছাত্রী ছিল। বড় হয়েও সম্পর্কটা অটুট। আমি তো জেনে অবাক! সামিয়া আফগান মহিলা ফুটবল দলের সদস্য।

ভারত, তাজিকিস্তানের মতো নানা দেশে ঘুরেছে মেয়েটা। আমি আর ও মিলে কাবুলে মেয়েদের একটা রাগবি টিম গড়ার তোড়জোড় করছি। তাতেও সামিয়াই কোচ। আফগান ফুটবল ফেডারেশনের মাঠে ওদের প্র্যাকটিসেরও আমি সাক্ষী। বিশ্বস্ত লোক ছাড়া স্টেডিয়ামে তখন যাকে তাকে ঢোকানোর ছাড়পত্র নেই। মাথায় একটা স্কার্ফ, পা-ঢাকা লেগিংসে কিন্তু বল পেটানোর সময়ে দিব্যি স্মার্ট লাগত মেয়েগুলোকে।

সামিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় বছর দেড়েক আগে। অফিসে প্রায়ই বলত, “আফগানিস্তানে কিছু সমস্যা আছে! কিন্তু দুনিয়ার কোথায় নেই বল তো! সমস্যা থাকলে তা জয় করার রাস্তাও থাকে, সেটার জলজ্যান্ত প্রমাণ আমাদের মতো মেয়েরাই।” কাবুল পতনের পরে যে ক’টা দিন দাঁতে দাঁত চেপে আমরা দেশে ফেরার বিমানের অপেক্ষা করছি, তখন ফোন করে কাঁদত সামিয়া! আসলে আমাদের সবারই তো কত স্বপ্ন ছিল। ভাবিনি এমন ঝড়ের গতিতে সব ওলটপালট হবে। তালিবানরা জলালাবাদে ঢোকার দিন চারেক আগেও আমি সেখানে গিয়ে সাড়ে তিন বছরের একটা নতুন শিশুশিক্ষা প্রজেক্ট চূড়ান্ত করে এলাম! কে জানত, আমি এখন কলকাতায় বসে কাবুলের স্মৃতিচারণ করব! তালিবরা নিজেদের সরকার ঘোষণা করার দিনেই খবর পেয়েছি, সামিয়া ইটালি চলে যেতে পেরেছে। ভাল আছে। কিন্তু আমি তো জানি দেশ ওর হৃদয়ের কতটা গভীরে, আফগানিস্তান থেকে ছিটকে গিয়ে এ মেয়ের কতখানিই বা ভাল থাকা সম্ভব!

আফগান তরুণীদের ফুটবল খেলা।

আফগান তরুণীদের ফুটবল খেলা। ছবি সৌজন্য: আজহারুল হক।

কাবুলকথা

এক-একটা শহরের সঙ্গে কোনও একটা ছবি দীর্ঘদিন, হয়তো বা চিরকালের মতোই আমাদের চেতনায় মিশে যায়। তেমনই কাবুল বলতেই এখন আমার মাথার উপরে সেই অতিকায় নজরদার বেলুনের কথা মনে পড়ে। ভাবতে বেশ মজা লাগে, হিন্দুকুশ বা পাগমানের পাহাড় নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী বর্ণিত খাইবার পাস-টাসও নয়! আফগানিস্তান বা কাবুলের প্রতীক হিসেবে মাথার উপরে সেই হিলিয়াম স্পাই বেলুনের কথাই আমার সবার আগে মনে পড়ছে। গোটা শহরে এমন বেশ কয়েকটা বেলুন সারা ক্ষণ নজরদারি চালাচ্ছে। দু’বছর আগে কাবুলে প্রথম পা রাখার মুহূর্তে সেই বেলুনটাই যেন আমায় বলল, ‘ওয়েলকাম টু কাবুল!’ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে পুরোটাই এক ধরনের ঠাট্টা বলেও মনে হচ্ছে। কী হল বলুন, এত নজরদারির পরিণাম! কিছু লাভ হল!

কাবুলে প্রথম তিনটে দিন কাটিয়ে বামিয়ানে এক ধরনের মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। কাবুলের মতো অত কড়াকড়ি নেই। বিকেল, সন্ধেয় ইচ্ছেমতো একটু ঘুরে বেড়ানো, লোকজনের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ ছিল। দু’আড়াই মাস বাদে হেলিকপ্টারে করে গিয়ে নিলি-তে ঘাঁটি গাড়লাম। সেটা দাইকুন্ডি প্রদেশ। নিলি থেকে দুর্গমতম রাস্তা পেরিয়ে বরফ ঠেঙিয়ে ৭০ কিলোমিটার দূরে আস্ত্রালয়ে পৌঁছতে সাত ঘণ্টা লাগত। ‘চাপরাসাক’ বলে একটা গ্রামে লম্বা সময় কাটিয়েছি। ‘এল’ এর মতো দেখতে গ্রাম্য আফগান বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। বরফ। নামমাত্র ইন্টারনেট। সন্ধে হলেই বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। তবু কাবুলের মতো বন্দি নিজেকে আমার আর কোথাও মনে হয়নি।

আমাদের কাজের নিয়ম মেনে কিছু সাবধানতা বজায় রাখতে বামিয়ানে থাকতেই অকারণে জনপরিসরে ঘোরাঘুরি, ভিড়ে মাখামাখিটা আমি বন্ধই করে দিয়েছিলাম। মসজিদে জুম্মার নমাজ পড়তেও যেতাম না। কোনও নতুন দেশে এলে সাধারণত প্রাণপণে তার আকাশ-বাতাসের স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে উঠি, কিন্তু আফগানিস্তান আমায় শেখাল, যে কাজটা করতে এসেছি, তা ঠিক মতো করতে হলে যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে সারাটাই মঙ্গল।

২০২০-র মে মাসে প্রত্যন্ত এলাকা ছেড়ে কাবুলে ফিরে নতুন চাকরি নিলাম। পদে পদে বাধা মেনে চলাটাই তখন আমার জীবনদর্শন। কাবুলকে আমি মজা করে বলতাম বন্দিখানা (ফার্সিতে জেলখানা)। তবে বলাটায় এক ফোঁটা বাড়াবাড়ি ছিল না। ভাবতে পারেন, কাবুলে এত দিন থেকেও বাগ-এ-বাবর (বাবরের কবর), পরিন্দা বাজার বা কারগা লেক কিছুই দেখতে যাইনি। হয়তো পরে কখনও যেতাম, কিন্তু হুট করে আফগানিস্তানের মেয়াদ ফুরোবে, তা-ও তো আঁচ করা সম্ভব ছিল না! সত্যি বলতে কোভিডের ভয়ে চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ কাবুলে আমার গায়েই লাগেনি। তত দিনে পুরোদস্তুর তালিম হয়ে গেছে, কী ভাবে অদৃশ্য হয়ে বাঁচতে হবে, কাজ করতে হবে। অফিস আমাদের দেহরক্ষীও দিয়েছিল। করোনা ছড়ানোর ঢের আগেই পাখিপড়া করানো হয়েছিল, কাবুলে কোনও সঙ্গী ছাড়া একা, একা যত্রতত্র যাওয়া যাবে না। এমন নয় যে, আমাকেই কেউ টার্গেট করবে! কিন্তু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা যে কোনও জায়গাতেই হতে পারে! আর যুযুধান দুই বন্দুকবাজ দলের গোলাগুলির মাঝে পড়ে উলুখাগড়ার প্রাণ যাওয়াও কিছু বিচিত্র নয়।

একটা মজার ঘটনা বলি! কাবুলে এক বার জার্মান দূতাবাসের সামনে দেখি দারুণ একটা গাড়ি। জি-ক্লাস মার্সিডিজ! দেখে তো আমি দারুণ উত্তেজিত। মনে হল লন্ডনে, কলকাতায় আমার কয়েক জন বন্ধুকে তক্ষুনি ছবিটা পাঠাই! ফোনটা বের করে ঝটপট ক্লিক করেছি। তখনই যেন মাটি ফুঁড়ে কোথা থেকে ক’জন আফগান সেনার উদয় ঘটল! আমি কে, কেন ছবি তুলছি হাজারো প্রশ্ন! শেষতক আমার ফোনটা নেড়েচেড়ে গ্যালারির পুরনো ছবিটবি ঘেঁটে পরখ করে ওই ছবিটা মুছে তবে নিষ্কৃতি।

কাবুলে থাকতাম সাবেক সোভিয়েট মহল্লা ওল্ড ম্যাকরোয়ান-এ। ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করা বাগানঘেরা বাড়ির পাড়াটা। এমনিতে কাবুলকে কলকাতার তুলনায় ছোটখাটো সেকেলে শহর বলেই মনে হতো। তবে আমাদের পাড়াটা শহরের সব থেকে কাঙ্ক্ষিত ঠিকানাগুলোর একটি। আমাদের অফিসের ক্যাম্পাসেই দরকারি যা কিছু সব হাতের কাছে। রান্না করা খাবারদাবার জুটে যায়! বাঙালির মতো রসিয়ে-কষিয়ে মশলা দিয়ে রাঁধতে পারে না, তবে কলকাতায় মহার্ঘ নধর দুম্বার মাংস সহজেই পাই। কাবুলে বিদ্যুতের খরচ খুব বেশি বলে আমাদের ওখানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের চল ছিল। কিন্তু বছরে সাত মাসই তো কনকনে শীত, সূর্যের মুখ দেখতে পাওয়াই ভার! তাই রাতে ঘর গরম রাখতে আমাদের সাধারণত কয়লার সাবেক রুম হিটার তুর্কি বুখারি ব্যবহার করতে হত। গ্রামে আমি বাড়ির নীচে ঘর গরম রাখার গ্যাসের লাইন দেখেছি। কিন্তু কাবুলে তুরস্কের বুখারিরই রমরমা। কী করে তাতে কয়লা দিতে হবে, আবার পুরনো কয়লা পরিষ্কার করতে হবে— সবই আমার শেখা হয়ে গিয়েছিল।

জীবন মানেই ফুরফুরে থাকা, নিজের খেয়ালখুশিতে চলা— সব সময়ে এমন না-ও হতে পারে! প্রতি মুহূর্তে কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে কথা বলছি, এই অনবরত চাপের মধ্যে বাঁচাটাও যে জীবনের অঙ্গ হতে পারে, সেটাও কাবুল শিখিয়েছিল। তবে আমি সৌভাগ্যবান, আমার কাজটা ঘেরাটোপের মধ্যেও আমায় অজস্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিত। গৃহযুদ্ধে জেরবার দেশে দেশের মধ্যেই ঘরহারা অসহায় মানুষের আশ্রয়ও তো কাবুল। আফগানিস্তানের নানা প্রান্তের বাসিন্দাদের নিয়েই আইডিপি (ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট) ক্যাম্প। সেখানে মানুষের নরকযন্ত্রণা দেখেছি। গত বছরের মে মাসে চরাহি কাম্বারে বিস্ফোরণের পরে মানুষের অসহায়তা দেখেছি। এবং রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচ! আমি অফিসের নির্দেশে দুর্গতদের খোঁজ নিতে গিয়েছি, ইরানি টুপি-পরা কয়েকটা লোক তো আমাকেই জেরা করা শুরু করল! আমার অফিস তল্লাটে আশিয়ানার স্কুলেও কত দুঃখী বাচ্চা পড়তে আসে! নানা বিধিনিষেধেও জীবন তাই বড় কম দেখিনি! তাঁর মধ্যে একটি কিশোরের চোখজোড়া আমি কখনও ভুলতে পারব না। তার নাম শাহ মির খান।

মানবজমিন

বামিয়ানে, চাপরাসাকে, জলালাবাদ, কাবুলে এমন কত জনের কথা মনে পড়ছে, যে মানুষগুলো এখন বেমালুম উবে গিয়েছে। কত জনের ফোনে শেষ বার হোয়াটসঅ্যাপ খোলার তারিখটা ১৫ অগস্ট বা তারও আগে! কাবুলের পতনের পরে তারা কোথায় গেল, কোনও হদিস নেই। আমার প্রিয় বন্ধু তাহির ভাইয়ের খোঁজ এখনও পাইনি! এক বার শুনেছিলাম, ও নাকি ইটালি পালাতে পেরেছে! কিন্তু খবরটা ঠিক নয়! তালিবানদের সঙ্গে তাহিরের পুরনো সম্পর্কের কথা মাথায় রাখলে আমারই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

কিংবা বামিয়ানে আমাদের স্কুলের ছোট্ট মেয়ে শুকরিয়া! অনেক দূরের গাঁ থেকে পাহাড় ভেঙে হেঁটে আসতে ওর পাক্কা তিন ঘণ্টা লাগত। তবু এক দিনও ক্লাস কামাই নয়! আমাদের স্কুলের টাইমিং বদলে সকাল সাড়ে সাতটায় ক্লাস চালু হয়েছিল। তখনও দেখি শুকরিয়া সবার আগে এসে হাজির। ও নাকি সূর্য ওঠারও আগে উঠে দৌড়ে দৌড়ে পাহাড় ভেঙে চলে এসেছে! নতুন তালিবান শাসকদের জমানায় যা-ই ঘটুক, আমি বিশ্বাস করি ক্লাস সিক্সের সেই অপরাজিতা কিশোরীর জেদই আগামীর আফগানিস্তানের স্বপ্ন। ফুটফুটে মেয়েটার মধ্যে কত সম্ভাবনা ছিল। মেয়েটার মুখ মনে পড়লে আমাকেও গভীর বিষাদ পেড়ে ফেলছে।

কাবুলে একাকিত্বের দিনগুলোয় আমার প্রিয়তম বন্ধু ছিল আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের ভাইপো দশ বছরের মসি। কখনও আমি একটু থম মেরে থাকলেও ওর বকবকানির চোটে নিমেষে গুমোট কেটে যেত! অফিসটাইমে আমায় সুইমিং পুলে নামতে টানাটানি করবে। আমি কাজ আছে বললে ‘জুত, জুত’ (আড়ি, আড়ি) বলে ঠোঁট ফুলিয়ে একশা। মসির বাবা বড়সড় মাইনিংয়ের কারবারে যুক্ত ছিলেন। আমি কাবুল থেকে বেরোতে পারার আগেই ওঁরা সপরিবার লন্ডনে যেতে পেরেছিলেন। সেখান থেকেও আমায় ফোন করে মসির কত কথা!

কিন্তু আশিয়ানার স্কুলের শাহ মির খানের কী হয়েছে, তা জানি না! কখনও জানতেও হয়তো পারব না! ছেলেটার বয়স বড়জোর ১২-১৩ বছর। কিন্তু ওর চোখ দু’টোয় আমি যেন ৫০ বছরের একটা ধ্বস্ত জীবনের ক্লান্তি দেখেছি। তালিবানদের অত্যাচারেই ওদের গোটা পরিবার জলালাবাদ না কোথা থেকে পাকিস্তান চলে গিয়েছিল। সেখানেই শাহ মিরের জন্ম। ওর বাবা পাকিস্তানেই রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। ওরা ভাইবোনেরা মিলে থাকত উদ্বাস্তু শিবিরে। আমাদের এনজিও-র মাধ্যমেই কাবুলে এনে ছেলেটার পড়াশোনা চলছিল। সে খালি ওর পাকিস্তানি বন্ধুদের কথা বলত! আমাদের কাছে জানতে চাইত, কী ভাবে এক বারটি পাকিস্তানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারে!

চাপরাসাকের বন্ধু আব্দুল্লা হায়দারি বলত, আমার সঙ্গে নাকি গজনির লোকেদের চেহারার মিল। ঢলঢলে আফগানি কুর্তা-পাজামা পেরাহান, তুনবানে আমায় সাজতে দেখলেই সে এক গাল হেসে বলত, “এটাই তোমার ঘর!” টের পেয়েছি, সহজ-সরল, বিনয়ী, অত্যন্ত আন্তরিক ব্যবহারের এই মানুষগুলোর স্নিগ্ধ উপস্থিতির মোড়কে এক জন দুঃখী রক্তাক্ত মানুষও বাস করেন। এঁদের অনেকেই আগের তালিবান আমলে চরম নৃশংসতার শিকার বলে শুনেছি।

আমাদের অফিসের ছুতোর মিস্ত্রি জাভেদ আর এক আশ্চর্য চরিত্র। সে আবার আফগান ক্রিকেট-তারকা রশিদ খানের তুতো ভাই! বলত, “রশিদ আবার বোলার কবে হল! ছোটবেলায় তো ব্যাট হাতছাড়া করতে চাইত না!” ওঁকে নাকি জাভেদ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বল করেছিল। জাভেদরা পাক-সীমান্তে ননগরহারের লোক, শিনওয়ারি গোষ্ঠীর। রশিদ খানের কথায় একই সঙ্গে একটা গর্ব আর হতাশা কাজ করত ওর মধ্যে। যেন ‘দ্য কাইটরানার’ গল্পের দুই চিরন্তন আফগান সত্তা। ওই দেশে স্বস্তিতে বাঁচতে পারার মধ্যেও মিশে থাকে গ্লানি! আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আঁধারে তাকিয়ে দুনিয়ার প্রতি একটা চাপা আক্রোশ বা অভিমান থেকে থেকে ফুঁসে ওঠে। কাবুলে বাণিজ্যিক বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ার পরে আমি তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের অফিস ক্যাম্পাসে আশ্রিত। নিয়মিত জাভেদের ফোন আসত! কেমন আছি, কী ভাবে আছি? রাষ্ট্রপুঞ্জের অফিসের নিয়ম, কোথায় আছি কাউকে বলা যাবে না! আমি স্পষ্ট জবাব এড়িয়ে চলতাম, সে কারণে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে আছি!

আমাদের অফিসে ঘরের কাজ করতেন যে ‘খালা’ বা আমাদের প্রবীণ রাঁধুনি, দুরন্ত নান, রুটি বিশারদ ‘জান আগা’ (একটু বয়স্কদের সম্মানসূচক সম্ভাষণ হল আগা) খুব টেনশনে ছিলেন কাবুলের পতনের সময়টায়! অফিস, চাকরি জীবনে কী হতে চলেছে! এই ক্রান্তিকালে তাঁদের তো কোথাও যাওয়ার নেই! ক্রান্তিকাল শব্দটা আফগানিস্তান বিষয়ে খাটে কি না অবশ্য জানি না। অন্তহীন অশান্তির অধ্যায় চলতে থাকলে ব্যাপারটার আর মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা থাকে না বোধহয়!

 তুষারে আবৃত কাবুলের রাস্তা।

তুষারে আবৃত কাবুলের রাস্তা। ছবি সৌজন্য: আজহারুল হক।

তাশাকোর আফগানিস্তান

অনেকেই প্রশ্ন করেন, এত দিন আফগান মুলুকে থেকে তালিবদের সঙ্গে আমার মোলাকাতের অভিজ্ঞতা কী রকম! মজা করে বলি, ওদের সঙ্গে খুব বেশি দেখা হলে কি আর আপনার সঙ্গে দেখা হত! তবে কাবুলে দুর্যোগের দিনগুলোতেও ফোনে কলকাতায় আমার প্রিয়জনদের আশ্বাস দিতাম, নিশ্চিন্ত থাকো, শিগগির দেখা হবেই।

কে তালিবান আর তালিবান নয়, তা তো কারও গায়ে লেখা থাকে না! তবে প্রত্যন্ত গ্রামে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সহশিক্ষার কাজ করার সময়ে আমাদের নিয়মিত স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে কথা বলতে হত। তখনই কারও কারও বিষয়ে কানাঘুষো শুনতাম। চাপরাসাকে থাকার সময়ে এমনই এক জনের বাড়িতে রাতে থেকে যেতে হয়। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে আমাদের কথা কিন্তু তিনি মন দিয়ে শুনেছিলেন! ওঁর বাড়িতেই আমার সহকর্মীদের সঙ্গে বিখ্যাত ফার্সি কবিতার বয়েতবাজি করা ওঁর ফুটফুটে কিশোরী কন্যাটিকেও দেখেছিলাম। অথচ ওই মেয়ের বাবাকে নিযে কত কথা! রাজনীতি আমি বুঝি না! আফগানিস্তানের সহৃদয়, সাদাসিধে লোকগুলোকে নানা রাজনৈতিক কারণে এক রকম ভুল বোঝানো হচ্ছে বলেও আমার মনে হয়েছে!

মুজতবা আলীসাহেবের কাবুলবাসের মতোই আমার আফগান অধ্যায়েও আচমকা যবনিকাপাত হল, সে-দেশে হঠাৎ পালাবদলের ধাক্কায়। দিল্লির বিমানের টিকিট কেটেও আমি বিমানবন্দরে ঢুকতে পারিনি! কাবুল থেকে কলকাতায় ফিরতে রাষ্ট্রপুঞ্জের সহায়তায় কাজাখস্তানে গিয়ে পড়তে হবে, এত নাটকীয়তার কিছুই কল্পনা করিনি। কিন্তু আমার আফগানিস্তানকে আমি বুকের মধ্যে লালন করব অন্য কারণে। উজান ঠেলা স্পর্ধার শান্ত এই মানবজমিনে সুযোগ পেলে আবারও যেতে চাই! আফগানিস্তানে বরফের মতো শুভ্রহৃদয় ‘পানশিরের আব্দুর রহমান’-এর কথা লিখেছিলেন আলীসাহেব। কলকাতায় ফিরেছি মাসখানেক। কিন্তু আফগানিস্তানের সেই মানুষগুলো আমায় ছাড়েনি। কাবুলে আমার শেষ সকালে রাষ্টপুঞ্জের বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বিমানবন্দরে ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে বলছিলাম, থ্যাঙ্ক ইউ! তাশাকোর (ধন্যবাদ) আফগানিস্তান! এখনও সেটাই বলে চলেছি।

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan taliban
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy