ঝড় অনেকটা রঘু ডাকাতের মতো। ভূমিকম্প কোনও চেতাবনি দেয় না, সে কখন কোথায় কত মাত্রার রিখটার স্কেলে সবাইকে টালমাটাল কাঁপিয়ে ছেড়ে দেবে, দেবা ন জানন্তি। কিন্তু ঝড় এ বিষয়ে ভদ্রলোক। পাঁচ-সাত দিন আগে থেকে জানিয়ে দেয়, বঙ্গোপসাগর থেকে সে বুধবার বিকেলে ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, কলকাতা পৌঁছবে। ঘণ্টায় দেড়শো থেকে দুশো কিলোমিটার বেগে। ঘণ্টা কয়েক প্রলয়নাচন চালাবে, তার পর প্রতিবেশীর চত্বরে ঢুকে যাবে। আমপান কথার খেলাপ করেনি। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত পথে সব কিছু তছনছ করে রঘু ডাকাত বিদায় নিয়েছে।
আমপান বা তার পূর্বসূরি ফনি, আয়লা সবই এক রকমের সামুদ্রিক ঝড় বা ‘সাইক্লোন’। এই ইংরেজি নামটার সঙ্গেও কলকাতার স্মৃতি জড়িয়ে। হেনরি পিডিংটন নামে এক ব্রিটিশ নাবিক বহু জাহাজঘাটার জল খেয়ে শেষে ১৮৩১ সালে এই কলকাতাতেই থিতু হয়েছিলেন। এখানকার চিনির কলে চাকরি করতেন, কিন্তু বর্ধমান অঞ্চলের আকরিক লোহা থেকে হুগলি নদীর বন্যায় জমি কতটা উর্বর হয়, এ সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন। এই নাবিক-কাম-বিজ্ঞানী তখনকার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে সামুদ্রিক ঝড় নিয়ে নানা সন্দর্ভ লেখেন, ‘সাইক্লোন’ নামটি তাঁরই অবদান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের ঢের আগেই কলকাতা ঝড়ের কাছে রেখে গিয়েছে নিজের ঠিকানা।
সাইক্লোন নামটা কেন? পিডিংটন দেখলেন, বৃষ্টির ফলে বায়ুপ্রবাহে অনেক সময় এতোলবেতোল একটি শূন্যস্থান তৈরি হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে তো শূন্য থাকতে পারে না, আশপাশের বাতাস তখন সে দিকে ছুটে যায়। একেই বলে নিম্নচাপ।
পিডিংটন আরও ঘেঁটে দেখালেন, এই শূন্যস্থানের কেন্দ্রটি অনেকটা চোখের মতো। একটাই চোখ। গ্রিক উপকথায় একচক্ষু দৈত্য বা ‘সাইক্লপস’ আছে না? অনেকটা সেই রকম। নিম্নচাপে আশপাশের বায়ুস্রোত হুটোপাটি করে, কিন্তু ওই চোখ বা কেন্দ্র অনেকটাই স্থির। কলকাতায় ঘণ্টা তিনেক দাপাদাপির শেষে আমপান যখন শেষের পথে, একটা ঠান্ডা হাওয়া ঝিলিক দিয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা বলবেন, ওটাই ছিল চোখ। শুধু আমপান নয়, হারিকেন থেকে টর্নেডো টাইফুন সব ঝড়েই এ রকম চোখ থাকে। জাহাজি পিডিংটন শুধু বঙ্গোপসাগর দেখেননি, টাইফুন-মুখর চিন সমুদ্রেও যাতায়াত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন আফিমের ব্যবসা করত, কলকাতা থেকে অনেক জাহাজ আফিম-বোঝাই বাক্স নিয়ে চিনের ক্যান্টন বন্দরে যাতায়াত করত। এই ‘টাইফুন’ শব্দটা অবশ্য এসেছে আরবি ‘তুফান’ থেকে। শব্দগুলি এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় এ ভাবেই ছুটে যায়। আর এই সব ছুটন্ত ঘূর্ণিঝড়ে কলকাতার পিডিংটন সাহেব আক্ষরিক অর্থেই চক্ষুদান করেছেন।
পিডিংটন দৈত্যের চোখ দেখেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে বিস্ফারিত চোখ মেলে কলকাতা তার ধ্বংসলীলা মর্মে মর্মে বুঝেছে। বুধবার, ঝড় আসার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল দিঘা, মন্দারমণির হোটেলের ছবি। সেখানে বাগানের পাশে গাড়ি রাখার ছাউনি তুমুল ভাবে উড়ে যাচ্ছে। অতঃপর ঝড়ের বেগে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হতে লাগল— কাশীপুর থেকে কসবা সব জায়গায় রাস্তায় ডালপালা নিয়ে থেঁতলে পড়ে আছে বিশালকায় সব মহীরুহ, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলি কে যেন ভিজে ন্যাকড়া নিংড়োনোর মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। দৈত্যের দাপটে বৃহস্পতিবার বিকেল অবধি লেক টাউন, বাঁশদ্রোণী, আরও কত এলাকা নিষ্প্রদীপ। আধুনিক মোবাইল এবং নেট সংযোগের পৃথিবীও দৈত্যের দাপটে বুধবার থেকেই বিধ্বস্ত। বাইপাসে আমাদের কমপ্লেক্সের পাশেই দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে এত দিন আগুন জ্বালিয়ে দিত। বুধবার দুপুর থেকে মেঘলা অন্ধকারে সেই সব গাছের পাতা কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল, সন্ধ্যার ঝড়বৃষ্টিতে তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনও এক অজ্ঞাত অনিষ্টকারীর হাতে এ দিক-ও দিক দুলতে শুরু করল। ঝড় থামার পর দেখা গেল, অন্ধকারে তারা নিহত হয়ে ফুটপাথে পড়ে আছে। কে জানত, এক দিন একচোখো দৈত্যের হাতে নিহত ওই দুই গাছের শোকগাথা লিখতে হবে!
মঙ্গলগ্রহে থাকে না, এই দৈত্য পৃথিবীরই সন্তান। মানুষেরও ঢের আগে তার জন্ম। গ্রিক পুরাণের মতে, সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী তিন একচোখো ‘সাইক্লপ’ দৈত্যের জন্ম দেন। তিন জনেই প্রাচীর তৈরি ও লোহার জিনিসপত্র তৈরিতে দক্ষ। তারাই উপকথার বিচিত্র পথে জড়িয়ে গেল সাইক্লোনের সঙ্গে।
এরাই শেষ নয়। গ্রিক ভূদেবী এর পর জন্ম দেন টাইফনের। এই টাইফনই তাঁর গর্ভজাত শেষ দৈত্য। উরুর নীচ থেকে পা নেই, সাপের মতো কুণ্ডলী। দু’দিকে হাত ছড়ালে সেগুলি একশো যোজন ছাপিয়ে যায়। হাত তো নয়, সবই সাপের মাথা। ডানা ছড়িয়ে সে সূর্যকে ঢেকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, দিন-রাত একাকার হয়ে যায়। চোখ দিয়ে আগুন বেরোয়, মুখ দিয়ে আগ্নেয় শিলা। সে দেবতাদের আবাস অলিম্পাস পাহাড়ে পৌঁছলে দেবতারা ভয়ে, বিভিন্ন প্রাণীর ছদ্মবেশ ধরে মিশরে পালিয়ে যান। দেবরাজ জ়িউস ধারণ করেন ভেড়ার রূপ, সূর্যদেব অ্যাপোলো কাক হয়ে উড়ে যান। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতে হয়ে যান মাছ। জ়িউস অতঃপর তাঁর বজ্র ছোড়েন, কিন্তু টাইফন তাতেও পরাস্ত হয় না। সাইক্লোন থেকে টাইফুন, আয়লা থেকে আমপান, সবই এক আদিম পৃথিবীর ধ্বংসলীলা।
এই ধ্বংসের ছবি আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও। ‘‘নিবিড় কালো মেঘ, মাঝরাত্রে শুরু হইল ঝড়। কী সে বেগ বাতাসের আর কী গর্জন! বড়ো বড়ো গাছ মড়মড় শব্দে মটকাইয়া গেল, জেলেপাড়ার অর্ধেক কুটিরের চালা খুলিয়া আসিল, সমুদ্রের মতো বিপুল ঢেউ তুলিয়া পদ্মা আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল তীরে’’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে এ ভাবেই ঝড়ে ধসে পড়ে কুবেরের ঘর।
আদিম, আধুনিক, সব পৃথিবীকে নিয়েই গেন্ডুয়া খেলেছে ঝোড়ো বাতাস। টাইফুনকে দমন করতে জ়িউস আমাদের দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই বজ্র ছোড়েন ঠিকই, কিন্তু দুই পৃথিবীর মিল ওই বজ্রসঙ্কর্ষেই। আমাদের ঋগ্বেদে ইন্দ্ ধাতুর অর্থ বর্ষণ, ইন্দ্র অর্থে বর্ষণকারী আকাশ। কিন্তু শুধু আকাশ এবং বৃষ্টির কথা বলেই থেমে গেলেন না ঋগ্বেদের ঋষিরা। ইন্দ্রের সহায়তাকারী কারা? ঝড় বা মরুৎগণ। ‘‘হে মরুৎগণ, তোমাদের উগ্র ও ভীষণ গতির ভয়ে মনুষ্য গৃহে দৃঢ় স্তম্ভ স্থাপন করেছে, কারণ তোমাদের গতিতে বহু পর্বযুক্ত গিরিও সঞ্চালিত হচ্ছে’’, জানাচ্ছে ঋগ্বেদ। এবং শুধু ঝড়ের কথা বলেই থেমে যাচ্ছেন না সেই বৈদিক ঋষিরা। ‘‘মরুৎগণের পত্নী রোদসী আলুলায়িত কেশে ও অনুরক্ত মনে মরুৎগণকে সেবা করছেন। দীপ্তশরীরা রোদসী চঞ্চল মরুৎগণের রথে উঠে শীঘ্র আগমন করছেন’’, সে কথাও বলেছেন তাঁরা। রোদসী মানে বিদ্যুৎ। তিনিই মরুৎগণের স্ত্রী। ঝড়, জল, বজ্রবিদ্যুৎ... কোনও দুর্বিপাকই বাদ যায়নি তাঁদের কল্পনা থেকে।
ঝড়বৃষ্টি, বজ্রপাত আর জলোচ্ছ্বাসকে কি শুধু ইজিয়ান সাগর আর বঙ্গোপসাগরের লোকেরাই ভয় পেয়েছে? তিব্বতে কোনও সমুদ্র নেই, সেখানে মধ্যযুগে তারানাথ নামে এক লামা ‘তারাতন্ত্র’ নামে এক পুঁথি লিখেছিলেন। করুণাময়ী তারা দেবী পথিককে অরণ্যে হিংস্র জন্তু ও দস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচান। আর কী করেন? লামা তারানাথ জানান, তিনটি অর্ণবপোত নিয়ে একদা ভারতীয় বণিকেরা দক্ষিণ সমুদ্রের দেশে গিয়ে প্রচুর ধনরত্নের সন্ধান পান। সে সব নিয়ে দেশে ফেরার সময় সমুদ্রদেবতার রোষানলে পড়েন তাঁরা। ঝড় তাঁদের জাহাজগুলি আছড়ে ফেলে দিতে চায়, বণিকেরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং কুবেরের নাম জপতে থাকেন। কোনও লাভ হয় না। প্রলয়ঝড়ে জাহাজ প্রায় ডুবুডুবু, যাবতীয় চন্দনকাঠ ও হিরে জহরত খোলামকুচির মতো স্রোতে ভাসতে থাকে। তখন এক জনের হঠাৎ করুণাময়ী তারা দেবীর কথা মনে পড়ে। তিনি মা তারার নাম জপতে থাকেন। ঝড় থেমে যায়, বণিকেরা ধনরত্ন নিয়ে নিরাপদে দেশে ফিরে আসেন। সমুদ্রে উত্থিত ঝড়কে দেশে বিদেশে সবাই বরাবর ভয়াবহ ভেবেছে।
সাইক্লোনের দুর্যোগ কি শুধু পদ্মা নদীর গ্রামে আসে? স্বামী হরিহর দেশের বাইরে, মেয়ে দুর্গার কয়েক দিন ধরে টানা জ্বর। তারপর এক রাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি, ‘‘হিংস্র অন্ধকার ও ক্রূর ঝটিকাময়ী রজনীর আত্মা যেন প্রলয়দেবের দূতরূপে ভীম ভৈরব বেগে সৃষ্টি গ্রাস করিতে ছুটিয়া আসিতেছে— অন্ধকারে, রাত্রে, গাছপালায়, আকাশে, মাটিতে তাহার গতিবেগ বাধিয়া শব্দ উঠিতেছে— সু-ই-শ... সু-উ-উ-ইশ্... বায়ুস্তরে বিশাল তুফান তুলিয়া আসুরিকতার বলে সর্বজয়াদের জীর্ণ কোঠাটার পিছনে ধাক্কা দিতেছে।’’ এই ভয়ঙ্কর ঝড়ের রাতের ট্র্যাজেডি বাঙালি জানে। দুর্গার মৃত্যু এবং তারসানাইয়ের কান্না।
ওই যে ‘ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ এবং পরানসখা বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার গান, এ সব অনেক পরে। উপন্যাসের উচ্চাবচ, বন্ধুর পথে আধুনিক বাঙালির প্রথম অভিযানও ঝড়ের হাত ধরেই। ‘‘পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন। অল্পকাল মধ্যে মহারবে নৈগাধ ঝটিকা প্রধাবিত হউল এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিধারা পড়িতে লাগিল।’’ ঝড়বৃষ্টির রাতেই তো বঙ্কিমচন্দ্র ‘দুর্গেশনন্দিনী’র জগৎসিংহকে আমাদের কাছে এনে দিলেন। এর পর নতুন শোণিতপ্রবাহ একের পর এক ঝড়ে। কখনও সমুদ্রে কুয়াশার ফলে নবকুমারদের নৌকো হারিয়ে যায়, কখনও বা গঙ্গায় এক বিশাল তরঙ্গ এসে কপালকুণ্ডলাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নবকুমারও সেই অনন্তপ্রবাহমধ্যে বসন্তবায়ুবিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হতে থাকেন। তারও পরে বালিকা রাধারাণী মাহেশের রথ দেখতে যায় এবং ঝড়বৃষ্টিতে হারিয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বাংলার সাহিত্যসম্রাট বারংবার তুলে আনেন তাঁর লেখনীতে।
এখানেই সারসত্য। এই ঝড়বৃষ্টি দুর্যোগ নয় নিছক মসীজীবীর উপকরণ, তা বাঙালি জীবনের সারসত্য। বঙ্গোপসাগরে ফুঁসে ওঠা সাইক্লোন বারংবার বাংলাকে তছনছ করে দিয়েছে। ১৫৮৪ সালের কথাই ধরা যাক। সিংহাসনে তখন মুঘল সম্রাট আকবর। ‘‘বেলা তিনটে নাগাদ প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। রাজা তাঁর পুত্র পরমানন্দ রায়কে নিয়ে প্রমোদবিহারে গিয়েছিলেন, পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী ঝড়বৃষ্টির দুর্যোগ শুরু হতেই তাঁরা উঁচু জায়গায় এসে একটি হিন্দু মন্দিরের শিখরে আশ্রয় নেন। মন্দিরটি ছাড়া কিছুই বাঁচে না, নীচু এলাকার বাড়িঘর
এবং নদীতীরে থাকা নৌকোগুলি তলিয়ে যায়’’, চন্দ্রদ্বীপ বা বরিশালের রাজাদের সম্বন্ধে জানাচ্ছেন আবুল ফজল।
আকবরের তিনশো বছর পর উনিশ শতকের সন্ধ্যা। কলকাতায় তখন সংস্কার আন্দোলন, বিদ্যাসাগর, নারীশিক্ষা, ব্রাহ্মসমাজের যুগ। ১৮৬৪ সালের আশ্বিন মাসে রাজপুরের বাড়িতে ফিরছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রবল ঝড়বৃষ্টি ও দুর্যোগ। কালীঘাট থেকে শালতি বা ছোট নৌকো ভাড়া করেছেন শিবনাথ। জালসি গ্রামে থামল শালতি, বায়ুর বেগ প্রবল। চোখের সামনে চালা উড়ে যাচ্ছে, ঘর পড়ে যাচ্ছে। সামনে রানি রাসমণির কাছারি বাড়ি, ‘‘নিকটস্থ হইতে না হইতে সমগ্র বাড়ি ভূমিসাৎ হইল। চারিদিকের প্রাচীর পর্যন্ত ধরাশায়ী হইয়া সমভুম হইযা গেল’’, আত্মজীবনীতে লিখছেন শিবনাথ। সাহিত্য থেকে ইতিহাস থেকে আত্মজীবনী, সর্বত্র বাঙালিকে যুগে যুগে ঝড়ের কবলে পড়তে হয়েছে, আমপান কোনও ব্যতিক্রম নয়।
অথচ আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির আধুনিকতা কিন্তু সচরাচর প্রকৃতিকে এড়িয়ে গিয়েছে। টাইফুন বা একচোখো সাইক্লপসকে আমরা যেন আর কল্পনা করতে পারি না। শুধু ঝড় কোন পথে আসবে— নিজেকে সেফ মার্কিং করতেই মশগুল নেকুপুষু গুগল-পৃথিবী। ইংরেজিতে লিখেও অমিতাভ ঘোষ একটি জরুরি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন আজকের বাঙালির সামনে। ‘‘বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতিভূষণে আমরা ঝড়বৃষ্টি এবং প্রকৃতির কথা যত পাই, আজকালকার লেখালেখিতে তত নয়। তা হলে কি আধুনিকতা যত এগিয়েছে, সাহিত্যে আমরা প্রকৃতিকে ততই ‘নিষ্প্রাণ’ ভেবে বাতিল করেছি?’’
সেই নিষ্প্রাণই গত বুধবার বিকেলে জানিয়ে দিল তার রুদ্র তেজ। তখনই অমিতাভর কয়েক বছর আগের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’ মনে পড়ছিল। সেই বইয়ে অমিতাভ জানিয়েছিলেন, হংকং, ম্যানিলার মতো উপকূলবর্তী এশীয় শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে কলকাতা। একটা বড় রকমের ঝড়বৃষ্টি, সাইক্লোন এলে কলকাতার অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়বে। মানিকতলা থেকে শেক্সপিয়র সরণি, সায়েন্স সিটি, রুবি হাসপাতাল বা সাউথ সিটি কারও নিস্তার নেই। কিন্তু সংস্কৃতির শহর নাহি শোনে লেখকের বাণী!
তা, ঝড়বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এ সব তো দিল্লির মৌসম ভবনের বিষয়। সাহিত্যের সঙ্গে কি আদৌ আছে তার কোনও সম্পর্ক? আছে অবশ্যই। বঙ্গোপসাগরে ক্রমাগত বেড়ে চলা ঝড়ের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। আর সেই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্প, পণ্যমনস্কতা, বিশ্বায়ন প্রভৃতিকে খাড়া করে লাভ নেই। হিমবাহের কত বরফ গলল, বাতাসের ওজ়োন স্তর কতটা ফুটো হল, গ্রিনহাউস গ্যাস কত বাড়ল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞের আলোচনাতেও সমস্যা মিটবে না। সাহিত্য, সংস্কৃতিকেও সচেতন হতে হবে।
অমিতাভের পাশাপাশি, আর এক বাঙালি ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীও মানুষের প্রগতিকে বহু দিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাঁর মতে, মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে, কয়লা তুলতে শিখল, সে-ও হয়ে গেল প্রাকৃতিক পরিবর্তনের অন্যতম এজেন্ট। ডাইনোসর, ম্যামথরা এত দ্রুত প্রকৃতি ধ্বংস করেনি, মানুষ করেছে। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি এবং সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য এত নির্বিচারে ধ্বংস না হলে বুধবার বিকেলে কলকাতা আমপানে এতটা বিপর্যস্ত হত কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়।
অথচ রঘু ডাকাত কত বার যে নোটিস দিয়ে এসেছে! যেমন ১৮৭৬ সালে। সে বার বরিশাল, বাখরগঞ্জকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল এক ঝড়। ত্রাণকাজ শুরুর পরেই নোয়াখালির কালেক্টর রেজিনাল্ড পোর্চ খবর পাঠালেন, ‘‘মহামারি শুরু হয়েছে। খুব খারাপ পর্যায়।’’ মহামারি ঠেকাতে তখন ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম, বাখরগঞ্জে পাঠাচ্ছে কলেরার বড়ি। গাছগাছড়া, মশলাপাতি ও আফিম দিয়ে তৈরি ট্যাবলেট। তখনকার বিজ্ঞান ভাবত, ওটাই কলেরার ওষুধ। বিজ্ঞানও ধাপে ধাপে এগোয়, প্রথমেই সে সর্বরোগহর কোনও মিরাকিউরল তৈরি করতে পারে না।
মানুষের অত সোপান নেই। তার লোভ বরাবরই লাগামছাড়া। হাল আমলে ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, ওই সময় বাখরগঞ্জে ঝড় এবং মহামারির জোড়া ফলার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল শাসকের লোভ। বরিশালে নদী গতিপথ
বদলে চর তৈরি করছিল, সেই উর্বর জমিতে মানুষকে চাষের দাদন দিয়ে পাঠানো হত। ম্যানগ্রোভ কেটে চরভূমিতে চাষের জমি— এ কি আর আজকের গল্প?
এবং এতেই শেষ নয়। নদীর বাঁধগুলি ভেঙে গেলে সেখানে ব্রিটিশ সরকার লবণের গোলা তৈরি করে, চাষিদের সেখানে উদয়াস্ত পরিশ্রমে বাধ্য করা হয়। ঝড় এবং মহামারির জোড়া বিপদ, আর তার সঙ্গে ক্ষমতাবানের লোভের ত্র্যহস্পর্শের বিরুদ্ধে বাঙালি অনেক আগে থেকেই যুঝছে, গত বুধবারটাই প্রথম নয়।
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy