‘বড়ে মিয়াঁ ছোটে মিয়াঁ’ ছবিতে কয়েদিদের আড্ডা।
জেলখানায় মৌচাকের মতো জুলজুল করে অফুরন্ত সময়, আড্ডা তো জমবেই। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের চ্যালেঞ্জ গেট পেরিয়ে দেখি কালীঘাটের ব্রিজ থেকে ট্রামলাইনের একটি শাখা জেলের ভিতর গিয়ে শেষ হয়েছে প্রেস বিল্ডিং ছুঁয়ে। জেলের ভেতরে ট্রামলাইন! তার উলটো দিকে আবার শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি নেহরুর আবক্ষ মূর্তি। তাকে ঘিরে ফোয়ারা, পদ্মডোবা, অপূর্ব গোলাপবাগান। চিকচিক করছে সোনালি রোদ। বাগানের মাঝখানে সিমেন্টের বেঞ্চ, আড্ডা দিচ্ছে কয়েক জন কয়েদি। প্রায় সকলেরই মার্ডার কেসে যাবজ্জীবন। সাধু বলছে: এ আর কী এমন ফুল! আমার সাত নম্বর সেলের গোলাপবাগান দেখলে চোখ ফেরাতে পারবি না! পাশ থেকে ভোলা সাধুখাঁর উত্তর: পাঁচ নম্বরে ক্যালেন্ডুলা, সুইট-মজারু যা ফুটেছে, এক বার দেখে আয়! মাথা চুলকোতে চুলকোতে সনৎ বলল: তোরা ফুল নিয়ে থাক ভাই, আমি ন’নম্বর সেলে যা পালং, ধনেপাতা, লালশাক, কপি, টমেটো ফলিয়েছি না, বাড়িতেও পারিনি।
নেহরু গার্ডেন ছাড়িয়ে কিছু উত্তরে গাঁধীজির ডান্ডি অভিযানের মূর্তি। মাথায় গাছগাছালির শামিয়ানা। এখানকার আড্ডায় কেউ কেউ ফাইল-হাতে বসে বা দাঁড়িয়ে। চাপদাড়ির এক তরুণ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, আইন সংক্রান্ত কোনও সাহায্য লাগলে বলবেন। পাশ থেকে এক জন ফিসফিস করে জানায়, ‘এ হচ্ছে চন্দন বণিক। নিজের স্ত্রী দেবযানীকে মেরে বস্তাবন্দি করে এখন জেলে আইনের ফেরিওয়ালা হয়েছে।’
এক ধবধবে ফর্সা জামাকাপড় পরা সুদর্শন চেহারার লোক, ফাইল হাতে হন্তদন্ত চলেছে। কেড়ে নিয়ে ধমক দিই: ‘কী আছে দেখি আপনার ফাইলে!’ ওরেব্বাস, থাকে থাকে স্বরচিত ছড়া! ‘যদি এমন হত’ ছড়াটা একটু পড়ে দেখি: ‘গ্রীষ্মকালে বইত যদি হিমের হাওয়া ঠান্ডা/ বেড়াল কুকুর সদর দোরে পাড়ত বড় আন্ডা/ অবাক কিছু হতাম না সে সৃষ্টিছাড়া কাণ্ডে/ সোম মঙ্গল বুধ বিষ্যুদ হত যদি সানডে/ বাছুর যদি মুরগি হত/ কুকুর হত পাঁঠা/ বাজার থেকে মাংস আনার চুকে যেত ল্যাঠা।’ লোকটির নাম সমর দত্ত। এক পড়ন্ত বিকেলে শ্যামপুকুর স্ট্রিটে বেঞ্চিতে বসে ছিল নির্লিপ্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে। আর একটু পরেই রেশন দোকানের ঝাঁপ খুলবে। আচমকা পুলিশ এসে তাড়া দিল: ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। বাড়িতে বউদি আত্মহত্যা করেছে।
আড্ডায় এক পেটানো চেহারার যুবক গিটার হাতে বসে। আদালত অনুমতি দিয়েছে, জেলে গিটার রাখতে পারবে। ছেলেটির করুণ থমথমে মুখখানি দেখে মনে হয় না, বধূনির্যাতন করতে পারে। বললাম, একটু হয়ে যাক। ভেবেছিলাম, ব্যান্ডের গান-টান গাইবে। ও বাবা, সে ধরল, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।’
সেল ব্লকের বাইরে বেরোতে পারে না নকশাল বন্দিরা। সকাল-বিকেল দাওয়ায় বসেই আড্ডা দেয়। কোনও অফিসার কাছে গেলেই চুপ, নয়তো প্রসঙ্গ পালটে দেয়। এক দিন তুলি নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে ভর্তি আজিজুল হকের কথা। তারা বলে, খুব শ্রদ্ধা করে আজিজুলকে। কিন্তু যেই তুলি জেল-হাসপাতালে ভর্তি সুজিত দত্তর প্রসঙ্গ, যিনি লেখেন: মানুষের গান গাইতে হবে/ নয় সে প্রেমের গান/ সচেতনতা দিয়ে আনতে হবে রেজারেকশান/ চাঁদ ফুল তারা অনেক হয়েছে/ হয়েছে প্রেমের অভিমান/ জীবনের গান আনতে হবে/ চাষির ঘামে রোয়া ধান— সমস্বরে তারা চেঁচিয়ে ওঠে: সুজিত দত্ত কোনও নকশালপন্থীই নন!
সবাই মিলে সিনেমা-মগ্ন। ‘বদলাপুর’ ছবির দৃশ্য।
নীলরতন সরকারে আজিজুলকে প্রায়ই দেখতে যেতাম, জেনে নিতাম কী কী বইপত্র ও অন্যান্য জিনিস লাগবে। আড্ডায় জানাতেন, কী ভাবে পুলিশ দিনের পর দিন বিনা কারণে অত্যাচার চালাত। মেরে হাড়গোড় ভেঙে দিয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। শহিদ নকশালপন্থীদের প্রতি তাঁর ছিল যেমন শ্রদ্ধা, এই পথ ত্যাগ করে ক্ষমতার জন্য যারা অন্যপন্থী, তাদের প্রতি তেমনই তীব্র ঘৃণা। তখনও ১৭-১৮টা কেস নিয়ে তিনি জেল হেফাজতে। এক দিন বলি, আপনার দুই ছেলে তো সাউথ পয়েন্টে ভর্তি হয়ে গেল। তাঁর ঝটিতি উত্তর: নিজেদের যোগ্যতায় কিন্তু!
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের হাসপাতাল ছুঁয়ে খেলার মাঠ। মাঠের তিন দিকে নারকেল গাছের বাগান। উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল শূলঘর। পরাধীন ভারতে কাউকে কাউকে শূলেও চড়ানো হত। এখন এই ফাঁকা জায়গাটা রোদ পোহানোর পক্ষে বেশ। এখানকার আড্ডায় চর্চা হয়, কোন জমাদার কোন বন্দিকে গাছে উঠিয়ে নারকেল পেড়েছে। ধোবিখানায় কোন কর্মচারী সব থেকে বেশি জামাকাপড় কাচায়, ইস্তিরি করায়। পুজোয় যোগ্য ধুনুচি-নাচিয়েকে কেন সরিয়ে দেওয়া হল। এ বারের স্পোর্টসে কত দামি প্রাইজ দেওয়া হবে। গির্জা-মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বারের সংখ্যা আর কত বাড়ানো উচিত। রাজা-উজির মারতে মারতে যখন রোদ চড়েছে, সরষের তেল হাতের তালুতে নাচাতে নাচাতে রওনা যে যার ওয়ার্ডে, কারণ দুপুর বারোটার গুনতি খুব জরুরি।
ফাঁসির সেল পশ্চিমমুখী। সকালে রোদ পোহানোর কোনও বালাই নেই। ফাঁসির আসামিদের আড্ডা সেই বিকেলে। ডি সি মেহতা হত্যার কেসে মূল পান্ডারা ছাড়া পেলেও, নসু, খোদাবক্স, নূর মহম্মদ পিয়াদারা ফাঁসির আসামি। নসুরা থেকে-থেকেই বলে: বিনোদ মেহতাকে চিনলাম না। এ দিকে জেলে পচছি। আর ডি সি’কে কচুকাটা করেছে যে ঔরঙ্গজেব, দিব্যি পার পেয়ে গেল। জানেন স্যর, সংসারটা আমার শ্মশান হয়ে গেল।
প্রতিটি সেন্ট্রাল জেলের অফিস সামলায় বন্দি রাইটাররা। ঝাঁটা-গোঁফের ঠ্যাঙাড়ে চেহারার রাইটার দুলাল নন্দী আড্ডা জমায় হস্তরেখা এবং হস্তলেখা নিয়ে। এসটাবলিশমেন্ট ব্রাঞ্চের কাজ সামলে নিয়েই, সে হাত নিয়ে পড়ে। কোন রেখা কত দূর গেলে কত আয়ু, রেখার উপর স্টার ঠিক থাকলে কী হয়, কাটাকাটি থাকলে কী বিপদ। পর ক্ষণেই হয়তো অন্যের হাতের লেখা নিয়ে টিপ্স দিচ্ছে: লেখা বাঁকা হলে ক্যারেক্টার সম্পর্কে কী বলা যাবে, অক্ষরগুলো গোটা-গোটা হলে লোকটার মনের গড়ন কেমন।
রাজশেখর বিশ্বাসের চলাফেরা আবার আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে। তার খেদ, সব আলো কেন সলমন রুশদি, তলসিমা নাসরিনের দিকে যাবে? মায়ানমারের নেত্রী আঙ সান সু কি এবং শ্রীলঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগের প্রধান মিস সিলভা-কে নিয়ে কেন হইচই হবে না? মিস সিলভা জাফনা দ্বীপের কারাগারে বছরের পর বছর বন্দি হয়ে আছেন প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে! আড্ডার ফাঁকে জেলেই শিক্ষাপ্রাপ্ত আর্টিস্ট জয়ন্ত হাতে ধরিয়ে দিল তার সদ্য আঁকা দুটো অয়েল পেন্টিং— একটিতে চোখ পাকিয়ে বাঘ জল খাচ্ছে লোকালয়ের ডোবায়, অন্যটিতে সবার চোখ আটকে আছে মাকড়সার জালে।
হাসপাতাল-লাগোয়া মাঠের আড্ডাধারীদের মধ্যে বাসুদেব শর্মাকে বলতে শুনি: পাপপুণ্য নিয়ে কেউ জন্মায় না, ঈশ্বর যেমন চালায় তেমনি আমরা চলি। চমৎকার অজুহাত, তার মানে বোধহয় তার জেল হওয়ার জন্যে ঈশ্বরই দায়ী। গুণধরের ভাবনাচিন্তা অন্য। তার সারা ক্ষণ ভয়, যদি পরমাণু যুদ্ধ হয়, কেউ তো রেহাই পাবে না!
শিক্ষকতা করে যে-সব বন্দি, তারা আড্ডা দেয় ‘বিদ্যার্থী ভবন’-এ। কারাধ্যক্ষ দীপক চৌধুরীর বদলি হয়েছে, তাঁর বিদায়ী সভায় কে কী বলবে, তার মহড়া চলছে এখানে। সে সবে কান না দিয়ে, সাধন মজুমদার একের পর এক সিরিজ এঁকে চলেছে মানুষ ও কীটপতঙ্গের মন নিয়ে। তবে সে আড্ডা আরও জমে উঠল, যেই দেবাংশু সেনগুপ্ত যোগ দিল। অনেক টিভি সিরিয়ালের সফল পরিচালক দেবাংশু সময় নষ্ট না করে গল্প-নাটক লিখে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে লাগল আর সকলের মতামত নিতে লাগল। কিছু দিনের মধ্যেই সে অনেককে শিখিয়ে-পড়িয়ে একখানা নাটক নামিয়ে দিল, তা দেখে ধন্য ধন্য পড়ে গেল!
দমদম সেন্ট্রাল জেলের ক্লাবঘরে দুর্গাপুজো ও অন্য উৎসব তো হয়ই, ইনডোর গেমস-এর সঙ্গে চলে তুখড় আড্ডাও। ফুর্তিতে তাস খেলতে খেলতে আড্ডা দিচ্ছিল গাট্টাগোট্টা চেহারার সুমিত ঘোষাল। আমাকে দেখে উঠে পড়ল: শুনুন স্যর, যাবজ্জীবন শাস্তির ব্যাপারটা নিয়ে আমি কী ভেবেছি। শাস্তির মূল উদ্দেশ্য যদি হয় অপরাধীকে শোধরানো, তা হলে সেটা ঠিক চোদ্দো বছরেই হবে, তা কী করে বোঝা গেল? বন্দিকে যত বেশি দিন জেলে রাখা হবে, ততই তার চরিত্র শুধরে যাবে, এ ভাবনার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি?
তার তারিফ করছি, আমাকে দেখে বারাসতের বাপি ঘোষ দৌড়ে এল— ‘কেমন আছেন স্যর?’ আসলে এটা আমার দ্বিতীয় বার দমদম সেন্ট্রাল জেলে পোস্টিং। পরীক্ষা হল-এ যাওয়ার পথে প্রেমিকাকে আঠারো বার ছুরির আঘাতে ঘায়েল করেছিল বাপি (তার ধারণা হয়েছিল, প্রেমিকা তাকে ‘ডিচ’ করেছে)। বাপির ফাঁসির হুকুম হয়। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তুমি তো ফাঁসির সেলে ছিলে? হেসে তার উত্তর: ছিলাম, কিন্তু এখন আমি যাবজ্জীবন। এ বারের ভোটে পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে খবর নিতে বেরিয়েছি কারও কোনও অসুবিধা আছে কি না।
গত বার ঠিক এই অঞ্চলে আড্ডা মারত কেশবলাল। বিহারের লোক। এক বিকেলে সে তার কীর্তিকাহিনি ফলাও করে জানিয়েছিল। শেয়ালদা স্টেশন থেকে শেষ বনগাঁ লোকাল ছাড়ত রাত ১১টা ৫৫-য়। সে এবং তার শাগরেদ তুফান সরপুরিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ত শেষ লোকাল ছাড়ার আগের মুহূর্তে। ভিখিরি ভবঘুরেদের ডেকে ডেকে বোঝাত— বনগাঁ গেলে অনেক খাবারদাবার, কাজকর্ম। অন্তত এক জনকে বোঝাতে পারলেই কেল্লা ফতে। প্রয়োজনে তার হাতে গুঁজে দিত পঞ্চাশ টাকার নোট।
বনগাঁ স্টেশনে ট্রেন পৌঁছত মাঝরাতের পর। চারদিক শুনশান। ভবঘুরে বা ভিখিরিকে জোর করে হাঁটিয়ে নিয়ে যেত পুব দিকের ফাঁকা মাঠে। মোটা আশশ্যাওড়া গাছের তলায়। হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে, এক বিশেষ কায়দায় তুফান তার ঘাড়টা মটকে, চুবিয়ে দিত বিশাল এক গামলা নুনজলে। দিনের বেলা এই গামলা লুকিয়ে রাখত পাটখেতে বা ঝোপঝাড়ে। নুনের বস্তা পুঁতে রাখত মাটির তলায়। গামলায় লোকটাকে চুবিয়ে, দুজনেই একসঙ্গে বিড়ি ধরাত। বিড়ি শেষ হলে, গাছের ডাল থেকে লাশটা ঝুলিয়ে, চামড়া ছাড়িয়ে, মাংস কেটে বাদ দিয়ে, আস্ত কঙ্কালটা বের করত। পায়ের জয়েন্ট খোলার বিশেষ কৌশল রপ্ত করেছিল তুফান। পরে স্প্রিং দিয়ে ফিট করত। দৈর্ঘ্যে যতটা সম্ভব ছোট করে, বস্তায় ভরে ভোরের ট্রেনেই শিয়ালদা। সেখান থেকে লালবাজারের পিছনে আন্তর্জাতিক কঙ্কাল রফতানি কেন্দ্রে।
সে দিন কী হল, দূরের গ্রাম থেকে স্টেশনের দিকে আসছিল একদল ওয়াগন-ব্রেকার। জোড়া আগুন দেখে সন্দেহ করল, বোধ হয় অ্যান্টি-পার্টি বসে আছে। ভোজালি-পাইপগান নিয়ে তাড়া করল। শ্রাবণ মাস। তুফান পালাতে পারলেও জলকাদায় আটকে গেল কেশবলাল। হাওয়া বুঝে ফেরার হয়ে গেল কঙ্কাল রফতানি কেন্দ্রের মালিক। আলিপুর সেশন কোর্ট কেশবকে দিল যাবাজ্জীবন। সাজা খেটে সেই কেশবলালও বেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
বেশ কিছু দিন বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের ওয়েলফেয়ারের অফিসঘর খালি। পাশেই ক্লাবঘর, তাঁতঘর, সেলাইঘর, শিল্পঘর। অরুণ মজুমদার, আবু সিদ্দিকিরা কাঠ দিয়ে হরিণ-বাঘ-সিংহের মাথা যেমন বানায়, তেমনি বানায় চমৎকার বেতের মোড়া, চেয়ার, টেবিল, সোফা। টিফিনের সময় হলে সবাই জড়ো হয় ওয়েলফেয়ার রুমে, যেখানে সাজানো তাদের নানা শিল্পকর্ম। শিল্পী চন্দন দেখাল তার সাম্প্রতিক আঁকা ছবি: পতপত করে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়ছে, খাঁচা থেকে বেরিয়ে পাখিও উড়ছে। কেবল উড়তে পারছে না বন্দিশালায় আটকা-পড়া তার দেহখানি।
অফিসপাড়ার উঠোনে বড় বড় আমগাছ। একটা মোটা গাছের গোড়া শান-বাঁধানো। এখানে আড্ডা দেয় অফিসের রাইটার, আর্দালি, পঞ্চায়েত সদস্য। নাট্যদলের কর্মী এবং বিভিন্ন মেটরা। চুপ করে বেদিতে বসে আছে পুষ্পেন্দু চৌধুরী। বললাম, এই যে তাসের দেশের হরতন, মুখে কথা নেই কেন? খানিক নড়েচড়ে বলল: না, মানে হরতনী সমিরা বিশ্বাস প্রেসিডেন্সি জেলে চলে যাচ্ছে তো, তাই। বললাম, তা হলে স্বীকার করছ প্রেমপর্ব খুব জমেছিল নাটকের রিহার্সালে?
হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে এল— বারোটার গুনতিতে আর্দালি বলবীরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আরে, কিছু ক্ষণ আগেই তো এখানে বসে ছিল। সাড়ে বারোটার পর পাগলাঘন্টি চলল আরও আধ ঘণ্টা। বেলা একটা নাগাদ তাকে দেখা গেল, বড় চৌকার কাছে অশ্বত্থগাছে চড়ে চুপটি করে বসে আছে। মুহূর্তে সবাই জড়ো হয়ে গেল সেখানে। সবাই বলছে, নেমে আয়। বলবীরের ভ্রুক্ষেপই নেই। শেষে ঠিক হল, দমকল ডাকা হবে। তা শুনে সে আরও উঠতে লাগল আগ-ডালের দিকে। সবাই যখন জিজ্ঞেস করতে করতে হাল্লাক, কী হয়েছে তোর, বলবীর হাউমাউ কেঁদেকেটে বলল: জেলারবাবু কেন তাকে আগের মতো ভালবাসে না? সমরকে দিয়ে চা বানায়, জল আনায়, ঝাড়পোঁছ করায়... সবাই হো হো করে হেসে উঠল। কিন্তু সে ধরল আরও সরু ডাল। ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে। চার জন মিলে নীচে একটা কম্বল টানটান করে ধরল। সত্যি সে ভাঙা ডাল-সহ পড়ল কম্বলের মাঝখানে।
চোদ্দো নম্বর ওয়ার্ডের বন্দিরা পশ্চিম পাশের উঠোনে আড্ডা দেয়। গিয়ে দেখি রাশি-রাশি রুটি শুকোতে দিয়েছে রোদে। ব্যক্তিগত চা খেতে গেলে রুটি ওদের জ্বালানি। সত্যি কথা বলতে, প্রতি দিন রাতে আড়াইশো গ্রাম আটার রুটি আমরা যেমন খেতে পারি না, ওদের মধ্যেও অনেকে পারে না। আমায় দেখেই দড়ি-পাকানো চেহারার কমলকুমার কর উঠে দাঁড়াল। বীরাপ্পনের মতো বাঁকানো গোঁফ মোচড়াতে মোচড়াতে জিজ্ঞেস করছে: স্যর, সত্যি কি আমি ছাড়া পাব না? ‘কী করে পাবেন? প্রথম যৌবনে নিজের বাবাকে মেরে যাবজ্জীবন সাজা খেটে গেলেন। দ্বিতীয় বার নিজের স্ত্রীকে মেরে আবার যাবজ্জীবন খাটছেন। আপনার মেয়ে-জামাই তো সরকারের কাছে, কমিশনের কাছে আবেদন নিয়ে ঘুরছে, যাতে আপনাকে কোনও দিন না ছাড়া হয়।’ কমলকুমার ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে এখন উপায়?
তেরো নম্বর ওয়ার্ডের সাজাপ্রাপ্তরা আবার সারা বছর ধরে ছৌ-নাচ, টুসু, বাউল, কীর্তন নিয়ে মাতোয়ারা। যখনই ঢুকি ওয়ার্ডে, খাতা নিয়ে দৌড়ে আসছে, নতুন লেখা গান কতটা ভাল হল। কিংবা পরামর্শ চাইছে, বীরসিং মাহাতো ছৌ-নাচের যে-সব মুখোশ দিয়ে গেছেন, কোথায় রাখলে বেশি দিন টিকবে? এগারো নম্বর ওয়ার্ডের সনাতন মাঝি তার বাউল গানের খাতা এবং দোতারা ধার দেবে, আপনি এক বার বলে দিলে?
কুড়ি নম্বর সেল ব্লকে চার জন ফাঁসির আসামি যেমন আছে, জেলের আইন ভাঙার জন্য বা খারাপ ব্যবহারের জন্য শাস্তি পাওয়া আসামিও আছে বেশ কিছু। আছে সেলের নির্জনতা পছন্দকারী কিছু পরীক্ষার্থীও। ফাঁসির আসামিদের বিশেষ ভাবে দেখভালের জন্য আছে কুড়ি বছরেরও বেশি জেলখাটা আন্দুলের বাসিন্দা শেখ কাটা।
সেলে ঢুকে আড়াল থেকে কান পেতে শুনি, শেখ কাটা অন্য বন্দিদের উসকে দিচ্ছে: নিতাই সাঁপুই, যার শাশুড়ির সঙ্গে ইয়ে আছে বলে শ্বশুরকে মেরে জেল খাটছে, সে যে গাছ থেকে কাজুবাদাম, পাখির বাচ্চা পেড়ে নিচ্ছে, তা কি ঠিক হচ্ছে? সাত নম্বর ওয়ার্ডের আসামিরা মহুয়া ফুল কলসির জলে পচাচ্ছে বলে কি শুধু ওরাই খাবে? পুকুরে বঁড়শি ফেলে অনেক কয়েদি খলসে, পুঁটি, চারাপোনা ধরে নিচ্ছে, তা কি চলতে থাকবে? পুজোয় দেড় বস্তা বোঁদে নষ্ট হল, তার জবাব কে দেবে? জেলের জমিতে এত যে শাকসবজি, লাউ, কুমড়ো, এঁচোড় ফলছে, গোডাউনবাবু সব কিচেনে দেবে কি? আড়াল থেকে বেরিয়ে কাটা-কে বলি: তুমি এবং তোমার শাগরেদরা মেল ট্রেন ডাকাতির যে-সব গয়নাগাটি, টাকা-পয়সা মাটির নীচে পুঁতলে, তা এখনও আছে? খোঁচা দাড়ির মোটা মানুষ শেখ কাটা মাথা চুলকোতে চুলকোতে শ্বাস টানছে: কী যে বলেন, দু-দু’বার প্যারোল নিয়ে দুটো মেয়ের শাদি দেওয়ার পর সে সব আর থাকে?
কেন কে জানে, এ সব দেখেশুনে আমার বার বার মনে পড়ে যায় প্রেসিডেন্সি জেলের কয়েদি সুশীল মালিকের কথা। অসামান্য বাউলশিল্পী। পুকুরপাড়ে শান-বাঁধানো বটগাছের তলায় নেচে নেচে সে শুনিয়েছিল তার নিজের কথায়-সুরে গান: গিন্নি আমার ভাবনা ভেবো না, সুখের জেলখানা/ যেই ঘরেতে খাওয়াদাওয়া, সেই ঘরেতে পায়খানা, সুখের জেলখানা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy