বাদল হালদারকে যে সামান্য একটা কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়াতে পারেননি, হাড়িভাঙার শঙ্কর দেবনাথের এ দুঃখ জীবনেও ঘুচবে না। হাড়িডাঙার পঞ্চায়েত সদস্য শঙ্করবাবু কয়েক কিলোমিটার দূরের খলিসা গোসানামারি গ্রামের বাদল হালদারকে চিনতেন না, চেনার কথাও নয়। এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তাঁর নজরে পড়ে, দূর থেকে হেঁটে আসছেন পরিশ্রান্ত এক মানুষ। কাঁধে ভারী ব্যাগ, পরনের জামাকাপড় এলোমেলো, মুখটাও শুকনো।
এই লকডাউনের সময় বিষণ্ণ, সান্ধ্য চরাচরে কে হেঁটে যায়? গ্রাম এখন দুপুর থেকেই স্তব্ধ হয়ে যায়, সন্ধ্যাবেলায় বুড়োরা চণ্ডীমণ্ডপে আড্ডা মারতে আসেন না, টিমটিমে বিদ্যুতের আলোয় ছেলেপুলেরাও আর চেঁচায় না। সকলেই জানে, করোনা বলে নতুন এক মহামারি দেশকে উজাড় করে দিচ্ছে।
শঙ্কর কথা বলতে গিয়ে জানলেন, ক্লান্ত বাদলবাবুর পেটে গতকাল থেকে দানাপানি নেই। ‘‘অতটা পথ, দু’গাল খাইয়া যান।’’ বাদলবাবু আপত্তি করেননি। কোচবিহারের এই সব প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও মানুষ অভুক্তকে চাট্টি ভাত খেয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, অস্বাভাবিক নয়।
অস্বাভাবিকতা অন্যত্র। সামান্য ভাত আর সাদা আলুর তরকারি পেয়েই প্রায় হাবড়ে খেতে শুরু করলেন বাদলবাবু, ‘‘একটু পেঁয়াজ হবে?’’ ১৪ দিন ধরে দেড় হাজার কিমি পথ পেরিয়ে কোচবিহারের গ্রামের বাদল হালদারের তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল ওইটুকুই। ভাতের সঙ্গে দু’টুকরো কাঁচা পেঁয়াজ। বাংলা থেকে বহু দূরে, গুরুগ্রামে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতে করতে রোজ সন্ধ্যায় আধপেটা ভাতের সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়া তাঁর অভ্যাস।
অভ্যাস বদলে গেল গত ২৭ মার্চ। তার তিন দিন আগে প্রধানমন্ত্রী আচমকা দেশ জুড়ে লকডাউন জারি করেছেন। বাদল হালদার ও তাঁর সঙ্গীরা তবু কোনও ক্রমে এক চিলতে ভাড়ার ঘরে ঠাসাঠাসি করে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু সে দিন সকালে পুলিশ আচমকা ঢুকে এসে হুকুম দিল, এই ঘর তাঁদের আজই খালি করে দিতে হবে।
তার পর? কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা লরি-চালককে দ্বিগুণ টাকা দিয়ে লরির মাথায়, কখনও রাস্তার ধারে স্বেচ্ছাসবীদের দেওয়া রুটি চিবোতে চিবোতে… ভারতের সব মানুষ এখন বাদল হালদারদের ঘটনা জানেন। ভাগ্য ভাল থাকলে তাঁরা গ্রামের রাস্তায় পৌঁছন। নয়তো রেল লাইনে বা এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির ধাক্কায় শুকনো রুটির সঙ্গে লাশ হয়ে থাকাটাই নিয়তি।
কেন এত ঝুঁকি নিয়ে ভিন রাজ্যে যেতে হয় এঁদের? কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ সর্বত্র ঘরে-ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের বয়ান একটিই। মজুরি বেশি। জঙ্গিপুরের খালেক শেখ জানালেন, ‘‘কলকাতায় এখনও রাজমিস্ত্রির কাজে দৈনিক ৫৭০ টাকা করে দেওয়া হয়। অথচ অন্য রাজ্যে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কেরলে দৈনিক ৯০০ টাকা।’’ বেশি মজুরির আশ্বাস, স্ত্রী-পরিবারের ভাল থাকার স্বপ্নই এ রাজ্যের গরিব মানুষকে ভিন রাজ্যে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য করে।
কোথাও কোথাও স্বপ্ন আবার অনেক দূরের স্টেশন। কোনও দিনই তার নাগাল পাওয়া যায় না। যেমন পুরুলিয়ার বোরো থানার ওলগাড়া গ্রামের এক দল শবর যুবক কয়েক বছর আগে রাজস্থানের কোটা শহরে কাপড়ে জরি বসানোর কাজে গিয়েছিলেন। উঁচু পাঁচিল ঘেরা চত্বরের মধ্যে তাঁদের কার্যত উদয়াস্ত খাটানো হত। খাবার ঠিকমতো জুটত না বলে অভিযোগ। কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘পশ্চিমবঙ্গ শবর খেড়িয়া কল্যাণ সমিতি’-র তরফে ভীম মাহাতো বলেন, ‘‘অত্যাচারে অভিযুক্ত ওই জরি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা হয়নি। তাই কয়েক বছর ওলগাড়া গ্রামের যুবকদের বাইরে কাজে যাওয়ায় ভাটা পড়েছিল।’’
ভাটার সিজ়ন শেষ। গত ২০১৮ সাল থেকে ওলগাড়ার শবর যুবকেরা ফের কোটায় যাচ্ছেন। গ্রামের বৃদ্ধ অঙ্গদ শবরের বক্তব্য, ‘‘এখানে ১০০ দিনের কাজ শেষ কবে হয়েছে, মনে পড়ে না। বাইরে গিয়ে কিছু রোজগার করছে ছেলেগুলো।’’ কুমারী পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের সুধীর মুর্মু দাবি করেছেন, ‘‘এলাকায় একশো দিনের কাজ ঠিকই চলছে। কিন্তু শবরদের মধ্যে দু-এক জন ছাড়া, কেউ কাজে আসতে চান না। ওঁরা কাজ করে সঙ্গে সঙ্গেই মজুরি চান।’’ পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজে বেরিয়ে জানা গেল, শবরদের আজও ‘অন্য রকম এবং লোভী’ বলে দাগিয়ে দেয় মহাশ্বেতা দেবীর রাজ্য।
পুরুলিয়া ছেড়ে ডুয়ার্সের বন্ধ চা বাগানের দূরত্বই বা কত? রাজগঞ্জ এলাকার বিষ্ণু রায় এই বাজারেও বলেন, “একে কম মজুরি, তার পরে আবার এর-ওর হাতে টাকা দিতে হয়। আমাদের কেরলই ভাল।”
চোদ্দো বছর আগে প্রথম কেরলে যান বিষ্ণু। সেখানে তখন দৈনিক মজুরি সাড়ে তিনশো টাকা। বিষ্ণুর কথায়, “আমাদের এখানে তখন হাজিরা ৫০ টাকা।” এখন কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে প্রতি সপ্তাহে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠান বিষ্ণু। ছোট ভাইকেও নিয়ে গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। এখন দুই ভাইয়ের স্বাস্থ্যবিমার কার্ড রয়েছে। যে সংস্থায় কাজ করেন, তারাই করিয়ে দিয়েছে। বিষ্ণু জানালেন, তাঁদের থাকার জন্য আলাদা বাড়ি রয়েছে। এক ঘরে অনেকে থাকেন, তবে সকলের আলাদা খাট। সেখানেই রোজ রান্না হয়। মাছ, ডিম বা মুরগি। এক দিন নিরামিষ। সবটাই ‘কোম্পানি’র খরচে।
ভিন রাজ্যে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের গোটা জীবনটাই কি কেরলে পরিযানের মতো নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব? এক এক জায়গায় এক এক সমস্যা। যেমন, লালগোলার নসিপুর এলাকার প্রায় ৩০০ শ্রমিক দীর্ঘ দিন ওড়িশার বিভিন্ন জেলায় নানা কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁদের দাবি, সম্প্রতি চুরির মিথ্যা অভিযোগে তাঁদের বিপাকে ফেলে ওড়িশা পুলিশ। কয়েক জন গ্রেফতারও হন। তার পরে তাঁরা মুর্শিদাবাদে ফেরত এসেছেন। এখনও পর্যন্ত কাজ পাননি।
আবার অসমে হকারি করতে যান মুর্শিদাবাদের সুতি ও জঙ্গিপুর এলাকার বহু মানুষ। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি থেকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে পুলিশি মামলায় জেরবার হতে হয় তাঁদের। অভিযোগ, আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখিয়েও ছাড় মেলেনি। ১৫ দিন অন্তর গুয়াহাটির ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। এ ভাবে ‘হেনস্থা’র ঘটনায় তাঁরা দ্বারস্থ হন জঙ্গিপুরের তৎকালীন সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের। অভিজিৎবাবু সমস্ত ঘটনা জানিয়ে চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। শেষ পর্যন্ত রেহাই মেলে। কিন্তু এত হয়রানির পর, আজও মুর্শিদাবাদ থেকে অসম যাওয়া বন্ধ হয়নি।
তার চেয়েও বড় ঘটনা অন্যত্র। লকডাউনেরও আগে, মালদহের কালিয়াচকের আফরাজুল খানের ক্ষেত্রে ভিন রাজ্যই হয়ে উঠেছিল ‘বধ্যভূমি’। অভিযোগ, রাজস্থানে নৃশংস ভাবে খুন করা হয় আফরাজুলকে। উত্তরপ্রদেশে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল মালদহেরই মানিকচকের ৯ বাসিন্দার।
কাশ্মীরের কুলগামে আবার জঙ্গি হানায় মুর্শিদাবাদের বহালনগর এলাকার পাঁচ শ্রমিক মারা যান। যে বাড়িতে থাকতেন তাঁরা, সেখানেই হানা দিয়েছিল জঙ্গিরা। তুলে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল। এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন ছুটি সেরে কাশ্মীরের প্লাইউড কারখানায় কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন বনগাঁর মধ্য ছয়ঘরিয়ার কমল সরকার, হরিদাসপুরের দীপঙ্কর বিশ্বাসেরা। ২০০৪ সাল থেকে কাশ্মীরের প্লাইউড কারখানায়
কাজ করতেন কমল। দীপঙ্কর তাঁর সহকর্মী। বছরের এগারো মাস কাজ আর এক মাসের ছুটিতে বাড়ি, এই ছিল রুটিন। রোজগার ছিল মাসে ২০-২২ হাজার টাকা। ট্রেন থেকে নেমে তাঁরা জানতে পারেন, জঙ্গি হানার প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেখানে কর্মরত এ রাজ্যের শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করেছে। এ রাজ্যের মোট ১৩৫ জন শ্রমিকের সঙ্গে দু’জনে বাড়ি ফেরেন। তার পর থেকেই কর্মহীন।
মুর্শিদাবাদের যে পাঁচ জন মারা গেলেন, তাঁদের সঙ্গীরা কী বলছেন? বহালনগরের সাদের সরকার বলছেন, ‘‘ভয় ভয় করছে। তবে ডাক পেলে ফিরতেই হবে। দিনে পাঁচশো টাকা মজুরি, খাওয়া ফ্রি। বাড়ি আসার সময় হাজার দেড়েক টাকা বখশিস এবং কয়েক পেটি কাশ্মীরি আপেল। এখানে এত কিছু মিলবে কোথায়?’’
ভিন রাজ্যের এখানে-ওখানে চুপিসারে এই বিপদগুলি এত দিন ওত পেতেই থাকত। কিন্তু এখনকার বিপদ অন্য। জঙ্গি হানা নয়, অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে দিনের পর দিন না খেতে পাওয়া। ঠিকাদার, মালিক এবং রাষ্ট্র সকলেরই দায়িত্ব এড়িয়ে স্যানিটাইজ়ারে হাত ধুয়ে বসে থাকা।
এই পরিস্থিতিতে বাঙালির মনে পড়তে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গল্প ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন’। আসলে, দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে মানুষগুলি এমনই দুবলা হয়ে যায় যে ছিনিয়ে খাওয়ার শক্তিটুকুও থাকে না। দেশের এখানে-ওখানে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক এখন প্রায় সেই অবস্থাতেই। হাঁটতে হাঁটতে কিংবা তিন গুণেরও বেশি টাকা খরচ করে ট্রেনে, লরিতে শুধু ঘরে পৌঁছনোর অপেক্ষা।
সেখানে সুখ নেই, স্বস্তি আছে। পাশের গ্রামের আতিথেয়তা আছে। অভ্যাসের কাঁচা পেঁয়াজ না পেলেও, ঘরে ফেরার পথে অনাহারক্লিষ্ট শরীরে গরম ভাতের সুবাস আছে।
তথ্য সহায়তা: নমিতেশ ঘোষ, অনির্বাণ রায়, অভিজিৎ সাহা,
বিমান হাজরা, মফিদুল ইসলাম, সমীর দত্ত, প্রশান্ত পাল,
সীমান্ত মৈত্র, অভিজিৎ চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy