তোমরা কী সব ছড়িয়ে দিলে বলো তো! পৃথিবী তো তছনছ করে দেবে দেখছি!” পেঁয়াজির দাম বাবদ পাঁচ টাকা নিতে নিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেন তেলেভাজার দোকানের মালিক।
শুরুতে লীনা ভেবেছিলেন, রোজকার তেলেভাজা-কাকু হয়তো স্নেহবশত তার বাড়ি গোয়ালপাড়ার খবর নিচ্ছেন। কলকাতায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে আসা মেয়েটা বলেছিল, “কেন, সবাই তো ভালই আছেন।’’ অতঃপর অবিশ্বাসী দোকানির শ্লেষসহ প্রশ্ন, “ঠিক বলছ? বাড়ির সবাই ঠিক আছে? তোমরা চিনারাই তো এই সব ছড়িয়েছ।”
বৃদ্ধা রোগিণীকে বেডে দেওয়ার পর কেস হিস্ট্রির চার্ট বোর্ডে লাগাচ্ছিলেন ডেলিনা লোইতংবাম। কয়েক বছর ধরে সল্টলেকের একটি নার্সিংহোমে কর্মরতা। মার্চের পর থেকে দম ফেলার ফুরসত নেই। কানে এল রোগীর আত্মীয়ের গলা। তাঁর সামনেই মেট্রনকে বলে গেলেন, “দেখবেন, এ সব চিনা নার্সকে ভরসা নেই। কখন কী ছড়িয়ে দেয়!”
অথচ রোগ ছড়িয়েছে কলকাতাই। মণিপুরের ২২ বছরের নার্স সমিচন কলকাতার নার্সিং হোমে ডিউটি করতে করতেই জ্বর, সর্দিতে অসুস্থ বোধ করছিলেন। সন্দেহ, কোভিড নয় তো! কর্তৃপক্ষকে জানানোয়, নার্সিং হোমেরই এক ডাক্তারকে দিয়ে তাঁর পরীক্ষা করিয়ে বলা হয়, ও কিছু নয়, সামান্য জ্বর। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে কাজ চালাতে বলা হয়। হয়তো তিনি কলকাতায় থেকেই যেতেন। কিন্তু কামজঙ জেলার মেয়ে সমিচন জানান, “রাস্তাঘাটে আমায় ও আমার বান্ধবীদের দেখলেই মানুষ মুখে কাপড় চাপা দিচ্ছিলেন। আশপাশের মানুষ আমাদের ডাকনামই দিয়ে দেন ‘করোনা’। এ দিকে হাসপাতালে কোনও সুরক্ষা ছিল না। এমনকি হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ারও নয়। তাই যখন খবর পেলাম আমাদের অনেকে ফিরে যাচ্ছে, আমিও ফেরার সিদ্ধান্ত নিই।” ১৪ মে ইম্ফলে ফেরেন সমিচন। নমুনা সংগ্রহের পরে জানা যায় তিনি কোভিড পজ়িটিভ। সেই অবস্থাতেই কলকাতার নার্সিং হোম তাঁকে অন্য রোগীর সেবা করতে বাধ্য করেছে।
চেহারার জন্য ‘চিঙ্কি’ খোঁটা তো ছিলই। গত কয়েক মাসে যুক্ত হয়েছিল ‘করোনা ছড়ানো চিনা’ বলে গঞ্জনা। কোভিডের ধাক্কাই উত্তর-পূর্বের শতাধিক নার্সকে কলকাতা-ছাড়া করল। প্রাণের তাগিদে আর সম্মান বাঁচাতে কলকাতার হাসপাতাল-নার্সিং হোমের কষ্টার্জিত চাকরি ছেড়ে প্রায় সাড়ে তিনশো নার্স ফিরলেন ইম্ফল, আইজলে। যাঁদের এ ভাবে ফেরার উপায় নেই, তাঁরা মাটি কামড়ে এখনও কলকাতায়। কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি বলে গালাগালি খাচ্ছেন, কাউকে বলা হচ্ছে, অন্যত্র ঘর দেখে নিতে।
প্রস্মিতা গগৈ দক্ষিণ কলকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। ঘর ভাড়া নিয়েছেন টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে। যে দিন ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি ঢুকলেন, তার খানিক পরেই ক্লাবের ছেলেরা বাড়িওয়ালার কাছে এসে জবাব চায়, “বাড়িটা কি মধুচক্র বানিয়ে ফেললেন কাকু? চিঙ্কি মেয়ে, ঘরে ছেলে নিয়ে উঠল দেখলাম!’’ প্রস্মিতা কলেজে গেলে, পাড়ার এক মহিলা তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে মিষ্টি কথায় প্রমাণপত্র, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, সব যাচাই করে নিশ্চিন্ত হলেন।
নাগাল্যান্ডের লিজা চাংকেজা, মণিপুরের মেম্মা দেবী, মীরাবাই চানম— কারও অভিজ্ঞতা সুখের নয়। তাঁদের কপাল পুড়িয়ে পুলিশ কাছেই একটি বাড়িতে হানা দিয়ে কয়েক জন মণিপুরি তরুণ-তরুণীকে আটক করে। গোটা পাড়ার সন্দেহ, ‘চিঙ্কি’গুলো নিশ্চিত দেহব্যবসা, মাদকব্যবসায় জড়িত। মেম্মা দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে নার্স। তিনি জানান, এমনিতেই ভাষা ও চেহারাগত কারণে আমরা কোণঠাসা। তার সঙ্গে অশালীন ইঙ্গিত, অবজ্ঞা, সন্দেহ। কোনও অভিযোগ থাকলে, পেশেন্ট পার্টি জাত তুলে কথা বলে। হিন্দিতে কথা বললেও বাংলা তো বুঝি। রাগে হলেও চুপ করে থাকি। কারণ কথায় কথা বাড়বে। আমরা চিনের লোক নই, ভারতেরই— কিন্তু প্রমাণ করতে বিস্তর হ্যাপা।
অবশ্য উল্টো ঘটনাও আছে। জুবিলি পার্কে লিপিকা মুখোপাধ্যায়কে ক’দিনের মধ্যেই আপন করে নিয়েছেন লীনারা। কারণ, পাড়ায় যখন প্রথম আসেন, লোকের বাঁকা কথা সইতে হচ্ছিল। লিপিকা দেবীর স্বামী পুলিশে আছেন। তিনি নিজেও মেজাজি। এক দিন কোমর বেঁধে পাড়ার লোককে কথা শুনিয়ে দিয়েছেন লীনাদের হয়ে। তার পর থেকে সব ঠান্ডা।
মেরি কম থেকে হিমা দাস, জুবিন থেকে অঙ্গরাগ মহন্ত, রিমা দাস বা ময়দানে খেলা ফুটবলাররা উত্তর-পূর্বকে অনেকটাই পরিচিত করেছেন বটে, কিন্তু বাদ সাধে মঙ্গোলীয় চেহারাগুলো। সে অসমের জনজাতি হোক বা মেঘালয়ের খাসিয়া বা নাগা বা মণিপুরের মেইতেই বা মিজো। গুয়াহাটির মানুষের পক্ষেও চেহারা দেখে ছয় রাজ্যের কোথাকার বাসিন্দা বোঝা সম্ভব হয় না। তাই কলকাতায় যে এঁরা সকলেই চৈনিক হিসেবে পরিচিত হবেন, আশ্চর্য কী! তাই শিলিগুড়ির ও-পারে সবাই হয় নেপালি, নইলে চিনা।
এক খাসি ছাত্রনেতা জানালেন, শিলংয়ে কার্ফু, ভাঙচুরের ঘটনায় বহিরাগতদের উপরে আক্রমণের ঘটনা ছিল সংবাদ শিরোনামে। কিন্তু লেখা হয়নি, কত খাসি ট্যাক্সিচালক বিপদের মুখে পর্যটকদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন। শিলংয়ের হরিজন কলোনিতে হাঙ্গামার সময়ও কোনও বাঙালি পর্যটকের গায়ে আঁচ পড়েনি। অথচ তাঁরা ফেসবুকে শিলংয়ের এমন ছবি আঁকলেন, যা সিরিয়া, ইরাক, কাশ্মীরকে লজ্জা দেবে। জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করা হল স্থানীয়দের।
ফিরে আসি লীনার কথায়। তাঁর এখন উভয়সঙ্কট। বাবা ইএফআর-এ ছিলেন। লীনা ও তাঁর দিদির জন্ম ও বড় হওয়া খড়্গপুরের প্রেমবাজারে। আশেপাশে নেপালি, বাঙালি। মা কমতাপুরিয়া। মিশ্র ভাষামণ্ডলে বেড়ে ওঠা দুই বোন এখন হিন্দি, নেপালিতে সড়গড়, কিন্তু অসমিয়া বলেন ভাঙা ভাঙা। অসমে কোচ-রাজবংশীরা এখনও তফশিলভুক্ত জনজাতির মর্যাদা পাননি, তাই অনেকেই রাভা বা হাজোং পদবি নিয়েছেন। লীনার বাবাও তাই। তখন তো এনআরসির কথা ভাবেননি। এখন দুই মেয়ে ও স্ত্রীর নাম এনআরসিতে এলেও ঠাকুরদার সঙ্গে বাবার পদবির গরমিলে বাবার নাম এনআরসি-ছুট। তা নিয়েও চিন্তায় গোটা পরিবার। এ দিকে কোচ-কমতাপুরিয়া মিশ্রণে দুই মেয়ের মুখের আদল মঙ্গোলীয়। তাই তাঁরা এক অদ্ভুত পরিচয়হীনতা, শিকড়হীনতায় ভুগছেন। লীনা দুঃখ করে বলছিলেন, “নিজের রাজ্যে বাবা বিদেশি হয়ে রয়েছে। কলকাতায় আমার পরিচয় চিনা। এর পরেও দেশপ্রেম কোথায়, কাকে দেখাব!” গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তাঁদের বাড়িতে আগে মুরগিও ঢুকত না। কলকাতাবাসী দিদি ও বোন এখন নিরামিষাশী। কখনও-সখনও ডিম খান। কিন্তু পাড়ায় কুকুর ডাকলেও টিটকিরি ভেসে আসে, “ডাকিস না, চিঙ্কিরা কিন্তু কেটে খেয়ে ফেলবে। ওরা সব খায়!”
কলকাতার বহু বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমের মেরুদণ্ড এই ‘চিঙ্কি’রাই। সদাহাস্যময়, ছোটখাটো ছটফটে এই নার্সদের দৌলতে রমরমিয়ে চলতে থাকা নার্সিং হোমগুলি কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়নি। প্রতিবাদ এক দিন হতই। করোনা যত ছড়িয়েছে, ততই বেড়েছে ডিউটির সময়। সঙ্গে রোগাক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক। কলকাতার চাকরি ছুড়ে ফেলে সদ্য ইম্ফলে ফেরা এক নার্সের ক্ষোভ, করোনার চিকিৎসা করা নার্সদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা নেই। তাই হাসপাতাল থেকে ভাড়াঘর বা হস্টেলে ফিরতে হত। এ দিকে সেখানকার আবাসিকরা আতঙ্কিত হয়ে তাঁদের চলে যেতে বলতেন!
কলকাতার এক হাসপাতালে সহকারী নার্সিং সুপারিন্টেন্ড্যান্ট থাকা ওয়াই সমিতা জানান, পিপিই কিট এক বার খুললে, ফের পরা মানা। তাই ১২ ঘণ্টা ডিউটিতে কিছু না খেয়ে, শৌচালয়ে না গিয়ে কাজ করতে হচ্ছিল নার্সদের। সাত দিন কাজ করার পরে কোয়রান্টিনে না রেখে, তাঁদের অন্যদের সঙ্গেই হস্টেলে রাখা হচ্ছিল। তাঁর হাসপাতালে চার জন নার্সের করোনা হলে তাঁদের সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। যে সব নার্স ভাড়াবাড়ি বা বহুতলে থাকতেন, তাঁদের লিফট ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছিল না। অনেকে নিজের ভাড়াবাড়িতে বা পাড়ায় ঢুকতেও বাধা পান। বিভিন্ন নার্সিং হোমে কর্মরত উত্তর-পূর্বের নার্সরা ফেসবুক-টুইটারে উগরে দিয়েছেন দুঃখ, হতাশা, আশঙ্কার কথা। ডাক এসেছে ঘর থেকে। ফিরে আসার। ভদ্রস্থ মাইনে বনাম পরিচয়হীনতা, বড় শহরের চাকরি বনাম নিত্যদিন নিজেকে আরও ছোট মনে হওয়া— এই কুমিরডাঙা খেলায় ক্লান্ত হয়ে অবেশেষে এ বার ঘরে ফেরার পালা। মেম্মা, লোইতংবাম, সঞ্জিতারা জানেন, মণিপুরে হাসপাতাল হাতে গোনা। বেতন খুব কম। কিন্তু তা-ই সই। আবেম দেবী বলেন, “শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতের বড় শহরগুলোয় উত্তর-পূর্বের নার্সরা সেবা করছেন। কিন্তু নাগাড়ে বৈষম্য, আমাদের নিয়ে হাসাহাসি, থাকার সমস্যা, মানসিক দূরত্ব, অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেওয়া, এক জন নার্সের উপরে পাঁচ জন রোগীর দায়িত্ব, আর সর্বোপরি পর্যাপ্ত পিপিই কিট, গ্লাভস, মুখোশের অভাব— এত কিছু সহ্য করে আর থাকা যাচ্ছিল না।”
কিন্তু যাঁরা ফিরতে পারছেন না? টালিগঞ্জ থেকে যাদবপুর, সল্টলেক থেকে রাজারহাট, হস্টেল হোক বা হাসপাতাল— উত্তর-পূর্বের মঙ্গোলীয় চেহারার মেয়েদের এখানে তাড়া করে বেড়ায় চিনা জুজু। এ ভাইরাস করোনার চেয়েও মারাত্মক! ওঁরা এখন আর দয়া, সহানুভূতি, সম্মান চান না। শুধু নিজেদের মতো থাকতে চান। প্রস্মিতা কসমোপলিটান তিলোত্তমাকে পাল্টা ঘেন্না ছুড়ে দিয়ে বলেন, “কলকাতা শুনেছিলাম সবাইকে বুকে টেনে নেয়। কাছে না টানতে পারুক, অন্তত বজায় রাখুক সম্মানজনক দূরত্ব। আর যা-ই করুক, জাত তুলে গালাগালি যেন না দেয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy