Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Narendra Dabholkar

Narendra Dabholkar: বিজ্ঞানে স্বীকৃত সত্যই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য

মনে করতেন নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকর। কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সফল পেশার নিশ্চিত নিরাপত্তা ছেড়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তিনি। পরিণতি যা-ই হোক, তিনি হারেননি।

যুক্তিযোদ্ধা: নরেন্দ্র দাভোলকর।

যুক্তিযোদ্ধা: নরেন্দ্র দাভোলকর। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

সফিয়ার রহমান
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৫৫
Share: Save:

তিনি ছেলের নাম রেখেছিলেন হামিদ। সে ছেলে এখন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডক্টর হামিদ দাভোলকর। জন্মসূত্রে মরাঠি হিন্দু। তবু ছেলের নাম ‘হামিদ’ কেন? কারণ, তাঁর আদর্শস্থানীয় মানুষ, বিশিষ্ট সমাজ-সংস্কারক চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন হামিদ উমর দালওয়াই। ছেলের এই নাম রাখায় তাঁর স্ত্রীরও সম্মতি ছিল। স্বয়ং হামিদ দাভোলকর নিজে জানাচ্ছেন, “আমার নামের প্রথম ভাগে ‘হামিদ’ শব্দটি যুক্ত হওয়া সামগ্রিক জনবিজ্ঞান আন্দোলনেরই প্রতীক।”

কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বিরোধী আন্দোলনের আধুনিক পথিকৃৎ ডক্টর নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর, মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে। তিনি তাঁর মা তারাবাই ও বাবা অচ্যুত দাভোলকরের দশ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলোয় তুখড়। শিবাজি ইউনিভার্সিটি কবাডি টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে টিম নিয়ে বাংলাদেশেও খেলতে গিয়েছিলেন। কবাডিতে মহারাষ্ট্র সরকারের শিব-ছত্রপতি যুব পুরস্কারও জিতেছিলেন তিনি।

১৯৭০ সালে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি পান, তার পর থেকে ১৯৮২ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত একটি হাসপাতাল ও দু’টি ক্লিনিক চালাতেন। তার পর ওই বছরই হঠাৎ হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়ে ‘অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন’ আন্দোলনে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে যোগ দেন। একটি সফল পেশা, সুখ-সমৃদ্ধি, বিত্ত-বৈভব— সব ছেড়ে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন— এর কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? স্বয়ং নরেন্দ্র দাভোলকর মনে করতেন, হাসপাতাল ও ক্লিনিক মানুষের শরীরের রোগ সারাতে পারে মাত্র, অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞতার অসুখ সারাতে পারে না। ভারতের মতো কুসংস্কার ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত দেশে হাসপাতালের চেয়ে ঢের বেশি প্রয়োজন চেতনার বিকাশ।

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু কেউ বিজ্ঞান জানলে কিংবা বিজ্ঞানী হলে সমাজ বিকশিত হবে না, যদি না তিনি বিজ্ঞানমনস্ক হন। কারণ মানুষের সঙ্গে অন্য মনুষ্যেতর প্রাণীদের প্রধান তফাত হল, মানুষের কৌতূহল আছে, সে প্রশ্ন করে, অন্য প্রাণীরা করে না। প্রকৃতি সম্বন্ধে কৌতূহল থেকেই
মানুষ জন্ম দিয়েছে বিজ্ঞানের। নিরীক্ষা, তর্ক, অনুমান, অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে বিজ্ঞান। তাঁর মতে ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ হল, বিজ্ঞানস্বীকৃত সত্যকেই বিশ্বাস করার মানসিকতা।

নতুন পথে হাঁটার ভাবনা দাভোলকরের মধ্যে যুবা বয়স থেকেই সক্রিয়। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘ওয়ান ভিলেজ ওয়ান ড্রিঙ্কিং ওয়াটার’ আন্দোলনে। পানীয় জলের অপব্যবহার নিয়ে তিনি তৎকালীন ধর্মগুরু আসারাম বাপুর সরাসরি বিরোধিতা করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। আসারাম বাপুর যৌন কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস তখনও হয়নি। তখনও তাঁর অগণিত শিষ্য-শিষ্যা আর সীমাহীন প্রভাব। সেই প্রভাব খাটিয়ে আসারাম সরকারি পরিশোধিত জলের ট্যাঙ্ক আশ্রমে আনিয়ে শিষ্য-শিষ্যাদের সঙ্গে হোলি খেলায় মেতেছিলেন। সে বছর মহারাষ্ট্রে জলের খুব টানাটানি। এক দিকে জলের জন্য হাহাকার আর অন্য দিকে উৎসবের নামে হাজার হাজার লিটার পানীয় জলের অপচয় অন্যায়ও অগণতান্ত্রিক। নির্ভীক দাভোলকর সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁদের আন্দোলনে শেষে সরকারও নড়ে-চড়ে বসে।

দাভোলকর ১৯৮৩ সালে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’ বা ‘এমএএনএস’। শুধু মহারাষ্ট্রেই এর ২৩০টি শাখা। আজ সমগ্র ভারতে এই সমিতির শাখা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেমন সরব হলেন, তেমনি মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন নরেন্দ্র দাভোলকর। তথাকথিত অলৌকিক বাবাজি-মাতাজি অর্থাৎ স্বঘোষিত গডম্যানদের তিনি ধর্মের নামে বুজরুকি বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু তাতে কাজ হল না। মানুষ ঠকিয়ে বুজরুকি চলতেই থাকে। এ বার তিনি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ২০০২ সালে একটি চ্যালেঞ্জে বলেন, কোনও অলৌকিক বাবা যদি ‘এমএএনএস’-এর ঠিক করে দেওয়া ১২টি কাজের মধ্যে কোনও একটি করে দেখাতে পারেন তবে ১১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এই কাজগুলির মধ্যে ছিল শূন্যে ভেসে থাকা, গভীর জলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা, শূন্য থেকে একটা সোনার হার তৈরি করা ইত্যাদি। গডম্যানরা এগুলো করতে পারেন বলে দাবি করতেন। অথচ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এক জন বাবাজি-মাতাজিও এগিয়ে আসেননি।

২০০৯ সালে জ্যোতিষীদের উদ্দেশ্যে ‘এমএএনএস’ আবারও চ্যালেঞ্জ ছুড়ল। সে বার মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন। চ্যালেঞ্জে জানানো হয়, নির্বাচনের ফলাফল আশি শতাংশ সঠিক বলতে পারলে ২১ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। সে বারও কোনও জ্যোতিষী এগিয়ে আসেননি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে। কাউকে ব্যক্তিগত আঘাত করার উদ্দেশ্যে এই চ্যালেঞ্জ নয়, উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত গডম্যানদের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা, একটা সুস্থ সমাজ গঠন করা। ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’র লক্ষ্য ছিল— কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের চর্চা বন্ধ করা, যুক্তিবাদ, নৈতিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব চর্চা, বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসা ও অনুশীলন, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও রীতিনীতির সদর্থক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথ দেখানো।

কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাভোলকরের তীব্র আন্দোলন ভাল চোখে দেখেননি ঐশ্বরিক বাবাজি-মাতাজিরা। তার উপর এ বার দাভোলকর কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের প্রস্তুতি শুরু করলেন। ‘জাদু টোনা বিরোধী বিল’-এর খসড়া রচনার মধ্য দিয়ে শুরু আইনের প্রাথমিক প্রস্তুতি। ফলে শত্রু আরও বাড়তে থাকে। ‘গডম্যান’দের পালে হাওয়া দিতে শুরু করলেন রাজনীতির কারবারিরাও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলল, এই বিল পাশ হলে সনাতন হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিপন্ন হবে। মানুষের বিভ্রান্তি কাটাতে নরেন্দ্র দাভোলকর স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “বিলে কোথাও ধর্ম বা ভগবান বিরোধী একটিও কথা নেই। ধর্মীয় আচার পালন, পুজো বা সাধনার অধিকার ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত। কিন্তু ধর্মের নামে কাউকে প্রতারিত করা বা কারও জীবন বিপন্ন করে তোলার অধিকার কারও নেই।” অথচ কিছু রাজনৈতিক দল নরেন্দ্র দাভোলকরকে ধর্মবিদ্বেষী বলে প্রচার করতে থাকে। বিধানসভার অধিবেশনে বিলটি প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আলোচনার জন্য বিলটির কথা তোলাই হয়নি।

দাভোলকর কিন্তু থামেননি। অধিবেশনে বিলটি আবার এল। এক বার নয়, দু’বার নয়, সাত-সাত বার। এক বারও আলোচনার জন্য তোলা হল না। ১৯৮৩ সাল থেকেই বার বার জীবন নাশের হুমকি পেয়েছেন নরেন্দ্র, পাত্তা দেননি। পুলিশি-সুরক্ষা নেওয়ার কথাও বলেছেন শুভার্থীরা, কান দেননি। কিন্তু অন্ধকার কায়েম রাখা যাদের ব্রত, তারা জানে কী করে প্রতিবাদীর কণ্ঠ রোধ করতে হয়। ২০১৩ সালের ২০ অগস্ট ভোরবেলা পুনেতে তাঁর বাড়ির সামনেই প্রাতর্ভ্রমণের সময় দু’জন বন্দুকধারী আততায়ী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে চার রাউন্ড গুলি চালায় নরেন্দ্র দাভোলকরের উপর। দু’টি গুলি মাথায় লাগে। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

যুক্তিবাদী বীর সৈনিক, যিনি বহু বাধা-বিপত্তি-আক্রমণের মুখে পড়েও মাথা নত করেননি, সেই দাভোলকরের মৃত্যুতে জনতার মধ্যে তৈরি হল তীব্র বিক্ষোভ। মৃত্যুশোক ছাপিয়ে হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে তাঁর বাড়ির সামনে, রাস্তায় রাস্তায় জনস্রোত নেমে এসেছিল। এই স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত দেখে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকেও ছুটে আসতে হয়। দাভোলকরের সবচেয়ে বড় জয় হল, তাঁর হত্যার তিন দিনের মধ্যে (২৩ অগস্ট ২০১৩) বিলটি পাশ করানোর জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করেন মহারাষ্ট্র সরকার এবং শেষ পর্যন্ত ওই বছরই ১৮ ডিসেম্বর মহারাষ্ট্র বিধানসভায় ‘মহারাষ্ট্র প্রিভেনশন অ্যান্ড ইর‌্যাডিকেশন অব হিউম্যান স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড আদার ইনহিউম্যান ইভিল অ্যান্ড অঘোরী প্র্যাকটিসেস অ্যান্ড ব্ল্যাক ম্যাজিক বিল-২০১৩’ পাশ হয়।

নরেন্দ্র দাভোলকর নিজে ছিলেন একান্ত নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু কোনও মানুষের ধর্মাচরণে কখনও বাধা দেননি। ধর্মাসক্ত অসহায় মানুষকে তিনি বরং ভরসা দিতেন, বলতেন সাফল্যের জন্য সতত পরিশ্রম করার কথা। তাঁর মৃত্যুর পর ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান র‌্যাশনালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি নরেন্দ্র নায়ক তাই বলেছেন, “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যদি মনে করে থাকে আমাদের এক জনকে গুলি চালিয়ে খুন করে আন্দোলনকে স্তব্ধ করবে, তবে তারা ভুল করছে।” অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই কখনওই থামে না, ব্যাটনটা হাতবদল হয় শুধু।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Dabholkar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE