শিল্পসাক্ষ্য: রামকিঙ্কর বেজ। ডান দিকে, রামকিঙ্করের আঁকা বিনোদিনীর প্রতিকৃতি।
ঝলমলে বসন্তদিন। ফাল্গুনের পড়ন্ত বেলায় লাল খোয়াইয়ের পথে পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন দু’জন। রামকিঙ্কর বেজ ও তাঁর ছাত্রী বিনোদিনী। হাঁটতে হাঁটতে দিগন্তের আলোছায়ায় কখন যেন একটি বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেলেন দু’জনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদগন্ধ তখনও বাতাসে। জাপানি সৈন্যরা বর্মা পেরিয়ে মণিপুরের সীমান্তে এসে পড়েছে। জাপানি আগ্রাসনের ভয়ে মণিপুরের রাজপরিবার একুশ বছরের বিনোদিনীকে নিয়ে রাজ্যপাট ছেড়ে চলে এলেন নবদ্বীপে। ধর্মপ্রাণ এই বৈষ্ণব রাজপরিবারটি ছিল নবদ্বীপের গৌড়ীয় মঠের গোস্বামীদের কাছে দীক্ষিত। কিছু কাল গুরুগৃহে নিরাপদ বাসের জন্যই তাঁদের সপরিবার নবদ্বীপে আসা।
মণিপুরের মহারাজা চূড়াচাঁদ সিং ও মহারানি ধনমঞ্জরীর পাঁচ মেয়ে। বিনোদিনী বা ইমসাই তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠা। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালে, ইম্ফলের সানা কুনুং রাজপ্রাসাদে। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়েছিল এক জন ইংরেজ দিদিমণির কাছে। একটু বড় হতেই অসমের তখনকার রাজধানী শিলংয়ের পাইন মাউন্ট স্কুলে পড়তে গেলেন তিনি। উচ্চশিক্ষাও ওখানেই, সেন্ট মেরি’জ় কলেজে।
গুরুগৃহে এসে বাড়িতেই লেখাপড়া শুরু হল তাঁর। তাঁকে পড়াতেন নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের তরুণ অধ্যাপক পীযূষ দাশগুপ্ত। রবীন্দ্রানুরাগী পীযূষবাবুই বিনোদিনীর মনে রবীন্দ্রপ্রেম জাগিয়ে তোলেন। শিল্পী চণ্ডী লাহিড়ী সেই সময় পড়তেন নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজে। মণিপুর রাজপরিবারের ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে তিনিও বিনোদিনীর সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ‘ধর্মের বাইরে যে বৃহৎ বঙ্গ সংস্কৃতি তার সঙ্গে বিনোদিনী ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হন। তিনি সেক্যুলার মনের অধিকারী এবং সে দিক থেকে তিনি পরিবারের মধ্যে ব্যতিক্রম।’
১৯৪৫ সালে বিনোদিনী মূলত তাঁদের দু’জনের পরামর্শেই শান্তিনিকেতনে আসেন। ভর্তি হন বিশ্বভারতীর কলাভবনে। ভাস্কর্য ছিল তাঁর পছন্দের বিষয়। এক বছর শান্তিনিকেতনে থাকার পরে ফিরেও যান। ১৯৪৭-এর অগস্টে আবার আসেন বিশ্বভারতীতে। এ বারে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর যোগ নিবিড় হল। ১৯৪৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত কলাভবনে শিক্ষার্থী হয়ে থাকলেন তিনি। বিশ্বভারতীর ভাস্কর্য বিভাগে মাস্টারমশাই হিসেবে পেয়েছিলেন রামকিঙ্করকে। পঁচিশ বছরের যুবক রামকিঙ্কর বিশ্বভারতীতে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর বিভাগে কলাভবনের ছাত্রী হয়ে আসেন একুশের বিনোদিনী।
কাজের মধ্যে দিয়েই বিনোদিনী রামকিঙ্করের প্রিয় ছাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর শিল্পকর্মে নিছক মুনশিয়ানার চেয়েও বেশি কিছু ছিল, যা মুগ্ধ করত তাঁর শিক্ষকদের। এই ছাত্রীটির প্রতি রামকিঙ্করের ছিল তীব্র মানসিক আকর্ষণ। শিল্পীর প্রেরণাদাত্রী ছিলেন বিনোদিনী। রামকিঙ্কর তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিনোদিনী আমার ছাত্রী। মণিপুরী মেয়ে।... ইনস্পিরিশন পেতাম তার কাছ থেকে।’
শান্তিনিকেতনে আসার সময় অনেক দামি শাড়ি-গয়না সঙ্গে নিয়ে আসেন রাজকন্যা। কিন্তু এ সব পরে গরিব সাঁওতালপাড়ায় যেতে তাঁর বাধো-বাধো লাগে। তাই সব সময় পরার মতো কিছু সাধারণ জামাকাপড় আনিয়ে নিয়েছিলেন। এতে সঙ্কোচ কাটল। সহজ ভাবে মিশতে পারলেন জনজাতি জীবনের সঙ্গে। তাঁর এই সহজিয়া মনই কাছে টেনেছিল রামকিঙ্করকে। খোয়াইয়ের পথে-প্রান্তরে রামকিঙ্করের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। দু’জনকে দেখা যায় শালবনে, কোপাই পাড়ে, সাঁওতাল পাড়ায়। রূপবতী রাজকন্যার মনের মাধুরী মিশে যায় প্রকৃতিতে। দিনগুলো যেন রঙিন পালকের মতো ভেসে বেড়ায় খোয়াইয়ের আকাশে বাতাসে।
বিনোদিনীর উদার মন ধর্ম, বর্ণ বা অন্য কোনও রকম বিভাজনের কথা মনেই রাখেনি কখনও। তাই খুব সহজেই রামকিঙ্করের সঙ্গে নিজের মন মেলাতে পারলেন তিনি। ভুলে গেলেন তাঁর সঙ্গে রামকিঙ্করের যোজন দূরত্বের সামাজিক ব্যবধানের কথা। মনে রাখেননি নিজেদের বয়সের ব্যবধানও। ভালবাসার রাখিটি সহজেই বেঁধে দিলেন শিল্পীর প্রাণে।
রামকিঙ্করের মনের খুব কাছাকাছি গিয়ে হয়তো তিনি চেয়েছিলেন দু’জনের জীবনকেও এক করে নিতে। তাঁর এই হৃদয়াভাস রামকিঙ্করের মনকেও আলোড়িত করেছিল। আজন্ম নানা অপ্রাপ্তি নিয়ে বেডে় ওঠা রামকিঙ্করের জীবন আঁকড়ে ধরেছিল এই প্রেমকে। নিজের হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন বিনোদিনীকে।
কাজে-অকাজে মাঝেমধ্যেই রামকিঙ্করের কোয়ার্টারে যান বিনোদিনী। নিজের ঘরের মোড়ায় ছাত্রীকে বসিয়ে একটার পর একটা স্কেচ করেন রামকিঙ্কর। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা ও মণিপুরী ভাষায় তুখোড়, সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় কুশলী রাজকন্যা সুন্দরী, লাবণ্যময়ী। হালকা-পাতলা গড়ন। স্বপ্নমাখা দু’টি মায়াবী চোখ। তাঁর মুখটি রামকিঙ্করের মনে এমন ভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল যে, যখন খুশি মন থেকেই তিনি এঁকে ফেলতে পারতেন বিনোদিনীর পোর্ট্রেট।
বিনোদিনী ছিলেন রামকিঙ্করের অন্যতম মডেল। তাঁকে নিয়ে বহু কাজ করেছেন তিনি। ১৯৪৫ সালে সিমেন্টে করেন তাঁর পোর্ট্রেট। ১৯৪৮ সালে তেল আর জলরঙে করেন বেশ কিছু প্রতিকৃতি। এ ছাড়া রয়েছে নানা সময়ে করা অজস্র স্কেচ। তাঁর এই সব ছবি ও ভাস্কর্যের ‘বিনোদিনী সংগ্রহ’ দিল্লির ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’-এ সংরক্ষিত রয়েছে। কিছু কাজ রয়ে গিয়েছে বিশ্বভারতীর কলাভবনেও। বিনোদিনী সংগ্রহের ‘আর্টিস্ট অ্যান্ড মডেল’ বা ‘কমরেড’ এচিং-এ শিল্পী ধরে রেখেছেন নিজেদের। রামকিঙ্কর এবং বিনোদিনী নির্জন বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। বলিষ্ঠ চেহারার বেঁটেখাটো রামকিঙ্করের মাথায় তালপাতার টোকা, হাতে ছবি আঁকার বোর্ড, বিনোদিনীর দিকে চেয়ে আছেন। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত বিনোদিনী চলেছেন পাশে পাশে। আনন্দে-আগ্রহে তাঁরা নিজেদের মধ্যে ডুবে আছেন। গাছপালারা তাঁদের ঘিরে আলোছায়ার মায়া জগৎ তৈরি করেছে। নারী-পুরুষের এমন অনাবিল মধুর ছবি বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু এই আলোছায়ার পথে জীবনের কতটুকু পরিক্রমা করলেন তাঁরা?
শেষ হয়ে আসছে রাজকন্যার কলাভবনে পাঠের সময়। ফিরে যেতে হবে নিজের রাজ্যে। কিন্তু সেখানে কি তিনি একা ফিরবেন? কিঙ্করদাকে রাজকুমারী বলেন, ‘চলুন আমার সঙ্গে, মণিপুরে থাকবেন।’ কিন্তু তাঁর শিল্পীমন যে কোনও বাঁধনে বাঁধা পড়তে চায়নি। বলেছিলেন, “আসল কথাটি হচ্ছে আমি কোন বন্ধনে বাঁধা পড়তে রাজি নই। ওতে কাজের ক্ষতি হয়। আমি নানা তালে ঘুরতে রাজি নই। আমার লক্ষ্য একটাই— সেটা আর্টওয়ার্ক।”
মণিপুরের রাজপরিবারও রাজি নয় রাজকন্যাকে এক বাউন্ডুলে প্রতিভার হাতে তুলে দিতে। বিনোদিনীকে তাই ছেড়ে যেতে হয় তাঁর প্রিয় কৃষ্ণরূপ শিক্ষককে। যে শিল্পী প্রেমের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “জীবনে প্রেম এসেছিল। সে কথা কাউকে বলার নয়, সে কথা কাউকে বলা যাবে না।”
শিক্ষা শেষে মণিপুরে ফিরে গেলেন বিনোদিনী। যাওয়ার সময় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দিয়ে যেতে চেয়েছিলে নিজের ক্যামেরাটি। কিন্তু মায়া বাড়াননি শিল্পী: ‘সে যাবার সময় তার ক্যামেরাটা দিতে চাইল। আমি নিলাম না। কি হবে নিয়ে কোথায় হারিয়ে যাবে।’ বিনোদিনী চলে যাওয়ার পরে অনেকেই দেখেছেন গুরুদেবের কিছু কিছু গান গাইতে গাইতে রামকিঙ্করের দু’চোখ জলে ভেসে যেত। লুকনোর চেষ্টা করতেন না।
শান্তিনিকেতন থেকে মণিপুরে ফিরে গিয়ে বিনোদিনী মানিয়ে নিতে পারছিলেন না নিজেকে। ভুলতে পারছিলেন না শান্তিনিকেতনের জীবন, রামকিঙ্করের সান্নিধ্য। এখানে তাঁর বিয়ে হয় ডাক্তার লাইফুঙবাম নন্দবাবুর সঙ্গে। তাঁদের দুই ছেলে, দেবব্রত ও শমী। তবে বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি তাঁর। তিনি ক্রমশ মনোনিবেশ করেন সাহিত্য ও চিত্রকলা চর্চায়। ১৯৬৫ সালে তাঁর লেখা নাটক ‘আসংবা নোংগিয়াবি’ রেডিয়োয় সম্প্রচারিত হয়। এই নাটকের নায়ক গৌতম আর নায়িকা ইন্দুকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন রামকিঙ্কর আর তাঁর নিজের আদলে।
রামকিঙ্কর দিল্লিতে ‘যক্ষ যক্ষী’-র কাজ শেষ করে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলে এক বার নাকি বিনোদিনী রামকিঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁকে বলেন তাঁর লেখা নাটকের কথা। আকাশবাণীতে নিয়মিত নাটকটি সম্প্রচারিত হয়েছিল। তাঁর নাটকের সঙ্কলনগ্রন্থও প্রকাশিত হয়, ‘নুংগাইরক্ত চন্দ্রমুখী’।
১৯৭৬-এ মহারাজা সুরচন্দ্রের কন্যার জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘বড়সাহেব ওংবি সানাতোঙবি’-র জন্য তিনি ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পান। সে বছরেই পান ‘পদ্মশ্রী’।
নিজেকে সব সময় ডুবিয়ে রেখেছিলেন কাজের মধ্যে। টানা ষোলো বছর ‘জওহরলাল নেহরু ডান্স অ্যাকাডেমি’র সচিব ছিলেন। মণিপুরের নর্তকীদের নিয়ে রাজকুমারী মেক্সিকো, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, সোভিয়েট রাশিয়া সফর করেন। তাঁর নৃত্যনাট্য ‘সাংগাই’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায়। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অবসান হয় ৮৯ বছর বয়সে, ২০১১-র ২৭ জানুয়ারি।
জীবনসায়াহ্নে বেশ ক’টি সাক্ষাৎকারে তিনি রামকিঙ্করের কথা অকপটে বলেছেন। কখনও তাতে স্পষ্ট হয়েছে অভিমান, কখনও তীব্র ভালবাসার আবেগ। সেই সব কথায় প্রকাশ পেয়েছে রামকিঙ্করের প্রতি তাঁর অন্তরের অগাধ ভালবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধা।
রাজপরিবারের নির্দেশে পাঠ শেষে বিনোদিনী দেশে ফিরে গেলে রামকিঙ্কর একা হয়ে পড়েন। কাজের মধ্যে তো তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েইছিলেন, এর পর আরও বেশি করে শিল্পকর্মে ডুবে যান। নাম-যশ অর্থের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এই মানুষটির হৃদয়াবেগটুকু অনুভব করার মতো আর কেউ থাকল না। রামকিঙ্কর গৃহী হলেন না, বিনোদিনীকে নিয়ে চিরস্থায়ী কোনও সম্পর্কের কথা কখনও হয়তো মনে এসেছিল, কিন্তু তা যখন হল না তখন আর বাঁধা পড়লেন না তিনি।
তাঁর জীবনে ‘প্রেম এসেছিল। সে কথা কাউকে বলার নয়।’ বলতে গেলে হয়তো তাঁর মনে আসত কবিগুরুর ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটকের সেই গান, ‘মণিপুর রাজকন্যা/ কান্তহৃদয়বিজয়ে হবে ধন্যা।’ হয়তো অশ্রুসজল চোখে তিনি দেখতে পেতেন অপস্রিয়মাণ বিনোদিনী দূরদেশের সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy